প্রসব সহিংসতা ও প্রসবের হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরূদ্ধে তুর্কি নারীদের কৌশলগত অবস্থান (দ্বিতীয় কিস্তি)

[সেলেন গোবেলেজের ‘Tactics of women up against obstetrical violence and the medicalization of childbirth in Turkey’ নামক একাডেমিক নিবন্ধটি নেওয়া হয়েছে ‘The Politics of Female Body in Contemporary Turkey’ নামে একটি সংকলন থেকে। সেলেন গোবেলেজের কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে কিভাবে সন্তান জন্মদান সম্পর্কিত প্রক্রিয়াগুলোকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আওতায় নিয়ে আসার নামে একধরনের সহিংসতার জন্ম হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে নারীরা কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে। নিবন্ধটি এনথ্রোসার্কেলের জন্য অনুবাদ করেছেন সাদিয়া শান্তা। নিবন্ধটি তিনটি কিস্তিতে প্রকাশিত হবে। আজকে প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কিস্তি। ]

প্রসব সহিংসতার মুখে নারীর প্রতিরোধী কণ্ঠস্বর নিয়ে গবেষণা

নিম্ন জ্ঞান করা

তুরস্কে মাতৃত্বকালীন সেবার হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসাকরণ প্রক্রিয়াতে enema administration, amniotomy [যাকে সাধারণত প্রসবের পূর্বে গর্ভবতী নারীর “পানি ভাঙা” বলে], fundal pressure এর নিয়মিত চর্চা উল্লেখযোগ্য। তবে তুরস্কের নারীদের মতে episiotomy [প্রসবকে সহজ ও দ্রুততর করার জন্য যোনিদ্বার ও মলদ্বারের মধ্যবর্তী অংশের কর্তন] বাকি সবগুলো প্রক্রিয়ার চেয়ে সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর। কিন্তু এই এপিসিওটোমি মা কিংবা শিশু কারোর পক্ষেই উল্লেখযোগ্যভাবে উপকারী বলে এখনো জানা যায়নি। ফলে সম্প্রতি একটি Cochrane রিভিউ [‘ককরেন’ – চিকিৎসা সেবার গবেষণা বিষয়ক একটি ব্রিটিশ সংস্থা] এই উপসংহারে এসে পৌঁছেছে যে, প্রসব প্রক্রিয়ায় যোনিদ্বারের কষ্ট লাঘব করতে এপিসিওটোমির চর্চা আজও যুক্তিসঙ্গত নয় (Jiang et al. 2017)।

তুরস্কে দেশব্যাপী পরিচালিত এপিসিওটোমির তথ্য নিয়ে সরকারিভাবে তেমন কোন গবেষণা করা হয়নি। একটি সমীক্ষা অনুসারে, তুরস্কে ২০১৭ সালে হাসপাতালকেন্দ্রিক প্রসব ব্যবস্থায় ৬৫% এরও বেশি ক্ষেত্রে এবং প্রথম সন্তান জন্মদানে ৯০% এর ক্ষেত্রে এপিসিওটোমি করা হয় (Hotun Sahin, Yildirim, and Aslan 2007)। ওই একই বছরের অন্য একটি গবেষণার সমীক্ষা অনুসারে এপিসিওটোমির গড় জাতীয় হার পাওয়া যায় ৭০.৩৩%, যেখানে নারীর প্রথমবার সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ৯৬.৭২% এবং একাধিকবার সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ৫১.৮৫% সময়ে এপিসিওটোমি করা হয় (Sayıner and Demirci 2007)। প্রসব সহিংসতার মতো হস্তক্ষেপমূলক চিকিৎসার ক্ষেত্রে সম্মতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। আমার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারীদের কারো কাছেই এপিসিওটোমির ব্যাপারে সম্মতি চাওয়া হয়নি। আজকের দিনে যে নারীরা সন্তান প্রসব করছে তাদের কাছে এপিসিওটোমির অভিজ্ঞতা যতোটা যন্ত্রণাদায়ক ও ভয়ংকর ঠেকে, বিশ বছর আগে সন্তান প্রসবকারী নারীদের কাছেও এপিসিওটোমির স্মৃতি ততোটাই ভয়ংকর ঠেকে।

আয়ফার [গবেষণায় অংশ্রগ্রহণকারী একজন নারী] সন্তান প্রসব করেছে আজ থেকে ২৩ বছর আগে। তিনি জানান, প্রসবের পূর্বে এপিসিওটোমি সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ওরা আমার মলদ্বারে সাতটা, আটটা, নয়টা সেলাই দিয়েছিল; এটা খুব ভয়ঙ্কর। আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে, অজ্ঞান না করেই ওরা সেলাই করা শুরু করে। শুরুতে আমি খুবই ব্যথা পেয়েছিলাম।” – (আয়ফার, বয়স-৪৬, সন্তান-১জন)
মিউনেভারও [গবেষোনায় অংশগ্রহণকারী একজন নারী] স্পষ্টভাবে এপিসিওটোমির অভিজ্ঞতা মনে করতে পারেন। তিনি তুরস্কের সুনামধন্য সরকারি হাসপাতালে সন্তান প্রসবের সময় এপিসিওটোমির অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি বলেন, “এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। বিশ বছর পার হলেও আমার এখনো স্পষ্টভাবে মনে আছে কিভাবে তারা কেটেছিল। যখন বাচ্চা পেট থেকে বের হয়ে আসে, আপনি সব যন্ত্রণার কথা ভুলে যান, আপনি বিশ্রাম অনুভব করেন। কিন্তু ওই কাটাছেঁড়া আর সেলাইয়ের কথা আমি এখনো ভুলতে পারিনা। জানিনা এটা করাতে ডাক্তারদের কাজ সহজ হয় কিনা।” – (মিউনেভার, বয়স-৪১, সন্তান-১জন)

আসলে নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি কিভাবে প্রয়োগ করা হবে তা চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের উপর নির্ভর করে। চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা নারীর প্রয়োজনীয়তা কিংবা নারীদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের স্বার্থে সেবা দেয় না। বরং চিকিৎসা প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়ই সেবা প্রদানের এই প্রশ্নাতীত অভ্যাসগুলো তারা রপ্ত করে।

উদাহরণস্বরূপ, বুর্জো [গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারী] ২০১৫ সালে যখন তার প্রথম সন্তান প্রসব করেন তখন তার প্রসবের সময় যেন এপিসিওটোমি করা না হয় সে ব্যাপারে হাসপাতাল কর্মীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু এর জবাবে তাকে বলা হয়, “আমাদের চিকিৎসা প্রশিক্ষণকালেই শেখানো হয়েছে প্রসবের সময় যেন এপিসিওটোমি করা হয়। এই নিয়মের বাইরে আমরা যেতে পারবো না।” (বুর্জো, বয়স-২৪, সন্তান-১জন)

‘অঙ্গুলিসঞ্চালন’ – বারবার যোনি পরীক্ষা:

প্রসবকালে নারীদের পক্ষে আরেকটি বিরক্তিকর বিষয় হলো জরায়ুর মুখ খোলার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঘন ঘন তাদের যোনি পরীক্ষা করা (বিশেষকরে তা যদি পুরুষ ডাক্তার দ্বারা পরিচালিত হয়)। অধিকাংশ মায়েদের বর্ণনা মতে যোনি পরীক্ষা শুধু কষ্টকরই নয়, বরং অস্বস্তিকরও বটে, আবার কোন কোন সময় বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। একজন  তধ্যদাতা ২০০৫ সালে তুরস্কের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তিনি তার প্রসব অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলেন, “অনেক শিক্ষানবিশ চিকিৎসক আসতো, আমাকে পরীক্ষা করতো, যেন তারা আমাদের উপর কোন একটা অনুসন্ধানমূলক পরীক্ষা চালাচ্ছে। নারী ও পুরুষ উভয়ই আসতো। যখন একজন পুরুষ ডাক্তার এসে আঙ্গুল সঞ্চালন করে আমার যোনি পরীক্ষা করে দেখছিলেন তখন আমি তা সঙ্কুচিত করে ফেলি। আমি আমার পা জড়িয়ে ফেলেছিলাম আর তাতে করে তারা আমার উপর রেগে গেল।” (ফাদিম, বয়স-৩৮, সন্তান-৩জন)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (২০১৮) সুপারিশ সত্ত্বেও শিক্ষা ও গবেষণা হাসপাতালগুলোতে একই সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে একাধিক চিকিৎসাকর্মী দ্বারা একই নারীর যোনি পরীক্ষা করা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়ফার যখন ২০১৫ সালে প্রথম গর্ভধারণ করেন, তখন তার যোনিদেশ পরীক্ষা করার বিষয়টিকে তিনি অসম্মানজনক বলে মনে করেন। তিনি জানান, “আমার কাছে এই ব্যাপারটা খুবই অপমানজনক লেগেছিল। হাসপাতালের সেবিকা প্রথমে সব গর্ভবতী নারীদের এক লাইনে দাঁড়াতে বললো। এরপর সবাইকে ঘাঘড়া আর অন্তর্বাস খুলে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিল। আমরা ওই অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় দুই পা ছড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমার এই সবকিছু ভয়ঙ্কর লাগছিল। ব্যাপারটা খুব বাজে লাগছিল, আমি ভীষণ বিব্রত বোধ করেছি। চিকিৎসকরা এমনকি কারো মুখের দিকেও তাকিয়ে দেখে না। তিনি ওই যন্ত্রটা (স্পেকুলাম) ভেতরে ঢুকিয়ে দেন আর সব শিক্ষানবিশরা ভেতরে তাকিয়ে ছিল। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি।” (আয়ফার, বয়স-৪৬, সন্তান-১জন)

যোনি পরীক্ষার মাধ্যমে নারীর গোপনাঙ্গ প্রকাশ্যে আনার বিষয়টিকে কাপসালিস বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, ধাত্রীবিদ্যা কেবলমাত্র নারীর দেহ বিষয়ক বিদ্যা নয়, বরং এর মাধ্যমে নারীদেহের নির্মাণও হয়। এই যুক্তি অনুসারে, যোনি পরীক্ষা যদি সঠিক নিয়মকানুন মেনে পরিচালিত না হয়, অর্থাৎ, রোগীকে যদি কেবলমাত্র একটি জড়বস্তু হিসেবে ভাবা না হয়, সম্মতির অভাবে এই পরীক্ষা উক্ত জড়বস্তুটির হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয় (Kapsalil 1997:14)। জেনগিনের বিশ্লেষণ মতে, নারীকে ঘিরে স্পর্শকাতর রাজনীতির ব্যাখ্যা গড়ে উঠে সহিংসতা, ঘনিষ্ঠতা ও সেক্স/জেন্ডার এর মতো বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে। জেনগিন তার বিশ্লেষণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কর্তাব্যক্তিদের সহিংস স্পর্শের বিভিন্ন রূপ হিসেবে সংবেদনশীল কিছু ক্ষেত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। জেনগিন মূলত দুটি ক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালান। একটি হলো সরকারি হাসপাতালগুলোতে ট্রান্স-ওমেন অর্থাৎ রূপান্তরিত নারী, অন্যটি হলো মিলিটারি হাসপাতালে সমকামী পুরুষ। তার অনুসন্ধানে নারীর যোনিতে অনুপ্রবেশ (penetration) এর ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতা প্রকাশ পায়। যার ফলে যৌন-বিন্যাস ও লিঙ্গীয় পরিচয় নির্মাণে এই ধরনের অনুপ্রবেশ চিকিৎসা আইনের বিমূর্ত রূপ হয়ে উঠে (Zengin 2016)। এর সমান্তরালে আমার বক্তব্য হলো, নারীর প্রতি সম্মান ও নারীর সম্মতি ব্যতীত কৌশলগত অনুপ্রবেশের এই নিয়মানুগ অনুশীলন (যেমন- প্যালপেশন, বাইমেন্যুয়াল, স্পেকুলাম, ইত্যাদি) অনুগত দেহ (docile body) নির্মাণের ভয়ঙ্কর পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে।

শ্রেণী অবস্থান ও সহিংসতা: 

একচেটিয়াভাবে না হলেও প্রসবকালীন দুর্ব্যবহারের কাহিনী সাধারণত এমন সব নারীদের থেকে উঠে এসেছে যারা শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে আছে, স্বল্প আয়ে জীবনযাপন করছে, অল্প বয়সে বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে ও প্রসবের জন্য সরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হচ্ছে। একইভাবে সম্প্রতি চারটি দেশে (ঘান, গিনি, মায়ানমার, নাইজেরিয়া) হওয়া একটি গবেষণার ফলাফল হতে জানা যায়, অল্প বয়স্কা ও কম শিক্ষিতা নারীরাই প্রসবকালীন দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি (Bohren et al. 2019)।

তুরস্কের হাসপাতালকেন্দ্রিক প্রসব সংস্কৃতির বহুমাত্রিক ব্যবস্থায় নিম্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর নারীরা প্রতীকীভাবে দ্বৈত-শোষণের শিকার হয়। যেসব নারীরা সরকারি হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেছেন এবং সেখানকার চিকিৎসকদের সেবা ও আচরণে সন্তুষ্ট নয়, তাদের অনেকেই দাবী করেছেন যে সামর্থ্য থাকলে তারা বেসরকারি হাসপাতালেই সন্তান প্রসব করতেন। কারণ সেখানে পৃথক শয্যার ব্যবস্থা করে রোগীর নিজস্বতা রক্ষা করা হয় এবং অধিক সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাতৃত্বের পথে নারীরা চিকিৎসক, ধাত্রী, সেবিকা দ্বারা একাধিক ধাপে মৌখিক অপমানের শিকার হয়। কয়েকজন নারীর ভাষায় তাদের যেসব মৌখিক অপমানের শিকার হতে হয় সেগুলোর নমুনা হলো – “এমনকি একটা হাতি ও কতো বড় বড় বাচ্চা জন্ম দেয়, আর তুমি পারছো না?”; “বাচ্চা কিন্তু এতক্ষণে জন্ম হয়েই যেতো, আপনিই কেবল সুবিধা কর‍তে পারছেন না”; “এইযে দেখুন, আপনার জন্য আমি বাড়তি একটা সেলাই দিয়ে দিলাম” (স্বামীকে উদ্দেশ্য করে)।

প্রসব সহিংসতার যতগুলো বর্ণনা শুনেছি তারমধ্যে মার্ভ [গবেষণার একজন সাক্ষাৎকারী] এর বর্ণনা সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। মার্ভ তার প্রথম সন্তান জন্ম দেন ইস্তাম্বুলের নামকরা এক সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেই প্রথম প্রসবের অভিজ্ঞতা মনে করেই তিনি আর দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের সাহস করেন নি। তিনি বলেন, “আমাকে কেউ সাহায্য করে নি। সেবিকারা আমাকে ধমকাচ্ছিল। তারা খারাপ খারাপ শব্দ উচ্চারণ করে আমাকে কথা শুনাচ্ছিল। তারা আমাকে এভাবে বলেছে – “করার সময় তো ঠিকই জানো তা কিভাবে করতে হয়, তবে এখন এতো কান্নাকাটি কিসের?” (মার্ভ, বয়স-৪৩, সন্তান-১জন)

আমাদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় মার্ভ প্রথম কারো কাছে তার প্রসব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে। সেই বিবরণ দেওয়ার সময় মার্ভের চোখে পানি এসেছিল, মার্ভ কাঁদছিল। মার্ভ আরো বলেন, “ওই হাসপাতালের নাম শুনলেই আমি আঁতকে উঠি। আমি ওই স্মৃতি ভুলতে চাই। প্রসবের পর ওরা সেলাই জুড়ে দিচ্ছিল। যখন আমি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বিছানায় উঠছিলাম তখন আমার সেবা দিয়ে যন্ত্রণা প্রশমন করার বদলে একজন ধাত্রী আমাকে বললো, “তোমার স্বামী যদি এভাবে তোমাকে গ্রহণ করে, তবে যাও। আবার পরের বছর আমি তোমার হালত দেখবো।” আমি তখন জবাব দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, তা দেখবেন।” এরপর আমি আর কখনোই দ্বিতীয় সন্তানের নেওয়ার ব্যাপারে ভাবিনি। একারণে আমি ধাত্রীদের ঘৃণা করি। সবার তো আর বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রসব চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই।” (মার্ভ, বয়স-৪৩, সন্তান-১জন)

নেজলিহান [গবেষণার একজন সাক্ষাৎকারী] ২০১৬ সালে প্রথম সন্তান জন্ম দেন একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ২২ বছর বয়সী নেজলিহানের প্রসবের সময় তার সাথে এমন কিছু অসম্মানজনক ঘটনা ঘটে যা আজও তার স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি জানান, “প্রসবের পর আমি যে বিছানায় শুয়ে ছিলাম সেখানে খুব ঠান্ডা লাগছিল। সেবিকাদের আমি অনুরোধ করলাম তারা যেন আমার মা আর স্বামীকে মোজা নিয়ে আসতে অনুমতি দেয়। প্রসব কক্ষটি পরিষ্কার ছিল, কিন্তু তাদের আচরণ ছিল খুব বাজে। তারা কথায় কথায় আমাকে ধমকাচ্ছিল। তখন তাদেরকে কিছুই বলা যায় না; কোন প্রশ্নই করা যায় না।” (নেজলিহান, বয়স-২২, সন্তান-১জন)

প্রসবের সময় নারীর যন্ত্রণাকাতর চিৎকার এভাবে ধমকিয়ে থামিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক সাক্ষাৎকারীই অভিযোগ করেছেন। এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্যাবট বলেছেন, “গর্ভবতী দেহকে সাধারণত নারীত্বের পৌরাণিক রূপের বিরূদ্ধাচার হিসেবে ধারণ করা হয়। মনে করা হয় গর্ভবতী নারীদেহ পিতৃতন্ত্রের অধীনে নির্মিত নারীদেহের আদর্শ রূপকে হেয় করে এবং এর মাধ্যমে পিতৃতন্ত্রের হেজিমনিক ক্ষমতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। ফলে নারীর দেহকে আদর্শ নারী রূপে ফিরিয়ে এনে তার উপর বশ্যতা জারি করতে তখন সহিংসতার প্রয়োজন পড়ে” (Shabot 2015)।

অনেক সমালোচকের মতে, প্রসবের হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে নিপীড়নমূলক সামাজিক কাঠামোর আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে এবং তা প্রোথিত আছে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির গোড়ায় (Cahill 2001:334)। সেই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণে নারীকে আবশ্যিকভাবে অস্বাভাবিক প্রজনন ব্যবস্থা ও অস্বাভাবিক হরমোনের শিকার হিসেবে দেখা হয় এবং এই অস্বাভাবিকতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী বলে বিবেচিত হয়। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ নারীর এই অসংযত ও অনিয়ন্ত্রিত দেহকে নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার অজুহাত দেখিয়ে যে প্রসব সহিংসতা ঘটানো হয় তা বুঝতে সাইবেল [গবেষণার তথ্যদাতা] এর প্রসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, “আমার চিকিৎসক দেরিতে এসেছিলেন। আর জরুরী বিভাগের স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ আমার সাথে খুব দুর্ব্যবহার করছিলেন। প্রসবের পর তিনি দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন আর ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন তখন আমার সাথে ওমন আচরণ করতে হয়েছিল। তার যুক্তি ছিলো যে এভাবে ধমকিয়েই তিনি মা ও প্রসবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন।” (সাইবেল, বয়স-৩০, সন্তান-১জন)

শ্রেণী মানদন্ড অনুসারে গর্ভবতী নারীর সাথে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণের তারতম্য বিষয়ে আমি যে যুক্তি পেশ করেছি, সেই আলাপের সাথে সিনদগলু ও সায়ান-চেঙ্গিজের কাজের বেশ সামঞ্জস্য আছে। তাদের কাজেও দেখা যায়, রোগীর প্রতি চিকিৎসকের আচরণ নির্ধারিত হয় রোগীর সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতার মতো নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড দ্বারা। “চিকিৎসক ও ধাত্রীরা যখন তাদের দুর্ব্যবহারের জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন করে, তখন তারা সাধারণত “আধুনিক” ও “ঐতিহ্যগত” (modern and traditional) ধারণার ব্যাপারে বারবার উল্লেখ করেন। গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষায় আক্রান্ত নারীদের মনে করা হয় যে, তারা “পিছিয়ে পড়া” এবং “ঐতিহ্যগত”; তারা জানে না আধুনিক হাসপাতাল ভবনে কেমন ব্যবহার করতে হয়, কিংবা চিকিৎসকের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়; তারা অসংযত ও বিশৃঙ্খল আচরণ করে যেমন- প্রসবকালে অযথা জোরে চিৎকার করে উঠে। হাসপাতালে রোগীর প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন করার সময় এই যুক্তিগুলো দেখানো হয় (Cindoglu and Sayan-Cengiz 2010: 240)।

অন্যদিকে, শহুরে ও শিক্ষিতা নারীরা যারা গ্রামের অশিক্ষিত নারীদের চেয়ে বাড়ন্ত বয়সে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে তারা তাদের প্রথম মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার নিজেদের “অনভিজ্ঞ” বলছিলেন। প্রসব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এমন অনেক নারীই নিজেদের “অপ্রাপ্তবয়স্ক”, “অনভিজ্ঞ”, ” অজ্ঞ”, “নতুন”, “লাজুক”, “লজ্জিত”, ” বিব্রত”, “অসম্মানিত”, “নিষ্ক্রিয়” ইত্যাদি বলে সংজ্ঞায়িত করছিলেন। তারা প্রায়ই আধুনিক চিকিৎসক ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মুখে অপ্রস্তুত ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছিলেন। তাদের প্রসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনলে মনে হয় চিকিৎসকদের এই দুর্ব্যবহার, অসম্মান প্রকাশ ও নারীর প্রতি প্রচলিত ধ্যানধারণার বহিঃপ্রকাশ গর্ভবতী নারীর যন্ত্রণা এতোটাই অসহনীয় করে তোলে যে এসব তার প্রসব বেদনাকেও ছাড়িয়ে যায়।


মাতৃত্বকালীন সময়ে নারীর শারীরিক সক্ষমতা হারানো ও নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারানোর যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা অনেক নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদন্ডের সাথে সামঞ্জস্য না। এই আলাপটি ইজরা [গবেষণার সাক্ষাৎকারী] এর অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে যুক্তিযুক্ত। ইজরা একজন মানব ও নারী অধিকার কর্মী। ইজরার শারীরিক ওজন নিয়ে তার বিশেষজ্ঞ প্রায়ই তাকে উত্ত্যক্ত করতো। ইজরার এখনো ভাবলে অবাক লাগে তিনি তখন কিভাবে সেসব কটূক্তি সহ্য করে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমার মায়ের ওজন ৪০কিলো। আমার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাকে আমার স্বামী ও মায়ের সামনে বললেন, “দোয়া করি তোমার সন্তানটি তোমার মতো না হয়ে বরং তোমার মায়ের মতো হোক।” সেই চিকিৎসকের সাথে প্রতিবারের সাক্ষাতেই আমি আমার ওজন নিয়ে চিন্তিত থাকতাম।” (ইজরা, বয়স-৩৩, সন্তান-১জন)

এছাড়াও ইজরার বিরক্ত হওয়ার আরো কারণ হচ্ছে সিজার অস্ত্রোপচারের সময় তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল। প্রসবকালে এভাবে হাত বেঁধে রাখা ও হাতে ভাস্কুলার ক্যাথেটার সংযুক্ত করে রাখার ফলে প্রসবের পর তা মা-কে সন্তান স্পর্শ করে দেখতে বাধা দেয়; এর ফলে মা ও সন্তানের মিলনে বিলম্ব ঘটে। ইজরা বলেন, “আমি তাদের বলেছিলাম আমার হাত যেন না বাঁধা হয়। তারা শুনে নি। যে চামড়ার বেল্ট দিয়ে আমার হাত বাঁধা হয়েছিল সেগুলো আমাকে আদালতের কিছু ঘটনাবন্দি কাগজপত্রের কথা মনে করিয়ে দেয় যেসব ঘটনার আমি উকিল ছিলাম।” (ইজরা, বয়স-৩৩, সন্তান-১জন)

(চলবে)

1.  এই পদ্ধতিতে মলদ্বারের সাথে একটি নল যুক্ত করে তরল কিংবা গ্যাসীয় পদার্থ প্রবেশ করিয়ে মলাশয় খালি করা হয় যাতে করে সন্তান প্রসবের প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজে সম্পন্ন হয়

2. হস্তচালিত চাপে গর্ভের সন্তানকে নারীর যোনিদ্বারের দিকে ঠেলে দেওয়া- এর নিয়মিত চর্চা উল্লেখযোগ্য’

প্রথম কিস্তির লিংক