নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দশটি আলোচিত বই
[বিশ্বব্যাপী নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় লেখা হয়েছে অনেক বই। ইংরেজিতে প্রকাশিত হওয়া দশটি আলোচিত বই নিয়ে লিখেছেন আবদুল্লাহ হেল বুবুন]
১৯৬৫ সালে “জার্নাল অব দি হিস্ট্রি অব বিহেভিওরাল সাইন্স” –এ প্রকাশিত একটি বিখ্যাত প্রবন্ধে জি.ডব্লিউ. স্টকিং সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ডিসিপ্লিনারি হিস্ট্রিওগ্রাফিতে দুটি ধারার অস্তিত্ব চিহ্নিত করেন – ‘প্রেজেন্টিস্ট’ ও ‘হিস্ট্রিসিস্ট’। প্রেজেন্টিস্ট হিস্ট্রিওগ্রাফি নতুন বা প্রান্তিক কোন তত্ত্ব বা ধারণা প্রচার ও প্রসারের জন্য অতীতের কাজ পর্যালোচনা করে। মার্ভিন হ্যারিসের “দি রাইজ অব এন্থ্রোপলজিকাল থিওরি” কে (র্যাট নামেও পরিচিত) দেখা যেতে পারে প্রেজেন্টিস্ট হিস্ট্রিওগ্রাফির একটি চমৎকার উদাহরণ হিসেবে। এই বৃহৎ রচনার পিছনে হ্যারিসের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো নৃবিজ্ঞানের এক ধরণের আমূল পুনর্গঠন সাধন করা। যার মাধ্যমে তিনি প্রাক্তন প্রভাবশালী বিবর্তনবাদী ও বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী অ্যাপ্রোচকে অগ্রভাগে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, হিস্ট্রিসিস্ট হিস্টোরিওগ্রাফি বর্তমানের শাস্ত্রীয় বিতর্ক থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখে তত্ত্ব ও তাত্ত্বিকদের দেখে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময়ের অংশ হিসেবে, যারা প্রভাবিত হয়েছে ওই সময়ের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নানাবিধ প্রেক্ষাপট দ্বারা। জে.ডি. মুরের “ভিশন অব কালচার” হিস্ট্রিসিস্ট হিস্ট্রিওগ্রাফির চমৎকার একটি উদাহরণ। সাধারণত তত্ত্ব ও জ্ঞানশাস্ত্রের ইতিহাসবিদরা (হিস্ট্রিয়ান অব আইডিয়াস) হিস্ট্রিসিস্ট ইতিহাস রচনা করে, অন্যদিকে প্র্যাক্টিসিং সামাজিক বিজ্ঞানদের ঐতিহাসিক কাজের বেশীরভাগই প্রেজেন্টিস্ট ধারার। আবার, প্রেজেন্টিজম ও হিস্ট্রিসিজমের সংমিশ্রণেও শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক ইতিহাস রচিত হয়েছে। নব্য-মার্ক্সবাদী ধারার তাত্ত্বিক মার্ক মোবার্গের “এনগেজিং এন্থ্রোপলজিকাল থিওরি” এরকম কাজেরই একটি উদাহরণ।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস রচনার কাজ বেশ পুরোনো। ১৯১০ সালে প্রকাশিত এ.সি. হ্যাডনের “এ হিস্ট্রি অব এন্থ্রোপলজি” নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে লেখা প্রথম বই হিসেবে স্বীকৃত। এ বইটি ছিল প্রেজেন্টিস্ট ধারার, যেখানে হ্যাডনের লক্ষ্য ছিল ব্যাপ্তিবাদী তত্ত্বকে নৃবিজ্ঞানের মূল ধারা হিসেবে স্থাপন করা। হ্যাডনের পথ ধরে এখন পর্যন্ত নৃবিজ্ঞান ও এর তাত্ত্বিক ইতিহাস নিয়ে রচিত হয়েছে প্রচুর বই, যেখানে প্রেজেন্টিস্ট ও হিস্ট্রিসিস্ট দুটি ধারারই শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে।
এ তালিকায় স্থান পাওয়া বইগুলো বাছাই করার মানদণ্ড ছিল নৃবিজ্ঞানে এই বইগুলোর প্রভাব, এদের মৌলিকত্ব ও অভিনবত্ত্ব এবং সহজপাঠ্যতার উপর।
১) দি রাইজ অফ এন্থ্রোপলজিকাল থিওরি: এ হিস্ট্রি অফ থিওরিস অফ কালচার// মারভিন হ্যারিস
নৃবিজ্ঞানের বই নিয়ে তৈরি যেকোনো তালিকাতেই অটোমেটিক চয়েজ হিসেবে থাকবে এই বই। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এই বিশাল সাইজের বইয়ে আলোচিত হয়েছে আলোকায়ন ও উত্তর-আলোকায়নের সকল সামাজিক দর্শন যা নৃবৈজ্ঞানিক চিন্তার উৎসস্থল এবং প্রায় ১০০ বছরের নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। হ্যারিস মনে করতেন, নৃবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান এবং এই শাস্ত্র অনুশীলনকারীদের উচিত মানব আচরণের সাধারণ নিয়ম অনুসন্ধানে ব্রত হওয়া। এই বইয়ে হ্যারিস নৃবিজ্ঞানে একসময়ে প্রভাবশালী বিবর্তনবাদী-বস্তুবাদী অ্যাপ্রোচকে পুনর্জীবীত করার জন্য যুক্তি দিয়েছেন।
২) ‘ভিক্টোরিয়ান অ্যান্থ্রোপলজিস্ট’ এবং ‘আফটার টাইলর’// জি ডব্লিউ স্টকিং
ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই অপরিহার্য গাইড স্টকিং –এর বই দুটি। এই বই দুটিতে নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞানীদের ব্যক্তিজীবনের তথ্যই শুধু নয়, সামনে এসেছে তৎকালীন বৃটিশ সমাজ-সংস্কৃতিও। একটি সদা পরিবর্তনশীল শিল্পায়িত সমাজ উদীয়মান নৃবিজ্ঞান জ্ঞানশাস্ত্রকে কিভাবে দেখেছে এবং প্রভাবিত করেছে এটাও ফুটে উঠেছে স্টকিং-এর লেখনীতে। উনবিংশ শতকের ওয়ার্ল্ড এক্সিবিশন, ডারউইন, উপনিবেশবাদ, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক রাজনীতি প্রভৃতি পটভূমিকায় এই দুই বইয়ে স্টকিং নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞানীদের স্থাপন করেছেন।
৩) ভিশনস অব কালচার// জে ডি মুর
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত জে ডি মুরের এই বই নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটি বহুল পঠিত টেক্সটবুক। শিক্ষার্থীদের কাছে এক্সেসিবল এই বইয়ে আলোচিত হয়েছে নৃবিজ্ঞানের ২৫ জন কেন্দ্রীয় তাত্ত্বিক। নৃবিজ্ঞানীদের ব্যক্তিজীবন কিভাবে তাদের কাজকে প্রভাবিত করেছে, তার বিশদ ব্যাখ্যা এই বইয়ের একটি বিশেষত্ব। মুর দেখিয়েছেন, নৃবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব ও দর্শনের উপর তাদের পরিবার, বেড়ে ওঠা, ধর্মীয় শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাকাডেমিক পরিবেশ কিভাবে তাদের তত্ত্ব ও দর্শনকে প্রভাবিত করেছে।
৪) অ্যান্থ্রোপলজি অ্যান্ড অ্যান্থ্রোপলজিস্টস: দি ব্রিটিশ স্কুল// অ্যাডাম কুপার
নৃবিজ্ঞানের অতীতকে জানতে অ্যাডাম কুপারের থেকে ভালো পথপ্রদর্শক খুব কমই রয়েছে৷ ক্রিয়াবাদী স্কুল অব থটকে নিয়ে লেখা এই বইয়ে ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানের বিচিত্র ধারা, সকল কেন্দ্রীয় বিতর্ক ও ঔপনিবেশিক সংশ্লিষ্টতা খুব স্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে৷ একটি জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞান নিজের ইতিহাস (সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত এই জ্ঞানশাস্ত্রের সাথে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক) সম্পর্কে অত্যন্ত আত্মসচেতন। এই আত্মসচেতনতাই খেয়াল করি আমরা কুপারের মাধ্যমে, যে বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আফ্রিকার ঔপনিবেশিক পটভূমিকার কথা, যেখানে অধিকাংশ ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক তাদের মাঠকর্ম সম্পন্ন করেন।
৫) হিস্ট্রি অ্যান্ড থিওরি ইন অ্যান্থ্রোপলজি// অ্যালান বার্নার্ড
২০০০ সালে প্রকাশিত এই ক্ষুদ্র কিন্তু সহজপাঠ্য বইয়ে বার্নার্ড নৃবিজ্ঞানের সকল কেন্দ্রীয় ইস্যু ও তত্ত্বকে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। আলোচনা শুরু হয়েছে নৃবিজ্ঞানের বিচিত্র তাত্ত্বিক ধারা, নানাবিধ দৃষ্টিকোণ (সিনক্রোনিক-ডায়াক্রোনিক) ও প্রাক নৃবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা থেকে। ১৪টি অধ্যায়ে একে একে আলোচিত হয়েছে বিবর্তনবাদী ও ব্যাপ্তিবাদী ধারা, ক্রিয়াবাদ, সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ, কাঠামোবাদ, মার্ক্সবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ প্রভৃতি। নৃবিজ্ঞানের সম্পর্কে জানতে চাওয়া যেকোনো ব্যক্তির জন্য এই বই একটি একটি আবশ্যক পাঠ।
৬) অ্যা হিস্ট্রি অব অ্যান্থ্রোপলজি// থমাস হাইল্যান্ড এরিকসেন ও ফিন সিভার্ট নিয়েলসেন
নৃবিজ্ঞানের এই বহুল পঠিত পাঠ্যবই প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। নৃবিজ্ঞানের প্রাক-ইতিহাস, একটি আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা এবং এর বিভিন্ন প্যারাডাইমগত পরিবর্তন এই বইয়ে এক বিশেষ স্পষ্টতায় এরিকসেন ও নিয়েলসেন ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। একটি জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞান যেমন আধুনিকতা ও উপনিবেশবাদের মিলিত স্রোতে উঠে এসেছে, তেমনিভাবে পরবর্তী বিভিন্ন ঐতিহাসিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও পদ্ধতিকে প্রভাবিত করেছে; ক্রমপরিবর্তনশীল আধুনিক বিশ্ব ও নৃবিজ্ঞানের মিথস্ক্রিয়া এই বইয়ে লেখকদ্বয় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন৷
৭) এনগেজিং অ্যান্থ্রোপলজিকাল থিওরি: অ্যা সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিকাল হিস্ট্রি// মার্ক মোবার্গ
২০১৭ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের উপজীব্য শুধু নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বই নয়, এখানে উঠে এসেছে পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রথা এবং যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই প্রথা বিকাশিত হয়েছে তার কথাও। মোবার্গের বইয়ের প্রথম দুই অধ্যায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যার বিষয়বস্তু ছিল একটি জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞানের বিতর্কিত প্রকৃতি। “নৃবিজ্ঞান একটি বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র নাকি নৃবিজ্ঞান হিউম্যানিটিজের অংশ যার কাজ ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই না” –এই বিতর্কে মোবার্গ নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তার বইতে।
৮) অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল থিওরি: অ্যান ইন্ট্রোডাক্টোরি হিস্ট্রি// ম্যাকগি ও ওয়ার্মস
ম্যাকগি ও ওয়ার্মস সম্পাদিত এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসের কিছু প্রভাবশালী প্রবন্ধ, যা এই শাস্ত্রের বিভিন্ন স্কুল অব থট প্রতিষ্ঠা ও গবেষণা এজেন্ডা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিক স্পেনসারের সোশ্যাল অরগ্যানিজমের মতো কাজ থেকে শুরু করে হাল আমলের অর্জুন আপ্পাদুরাই এর ‘ডিসজাংচার অ্যান্ড ডিফারেন্স ইন গ্লোবাল কালচারাল ইকোনোমি’-র মতো প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থ স্বভাবতই নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের এই শাস্ত্র ও এর ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে।
৯) অ্যান্থ্রোপলজি: হোয়াই ইট ম্যাটারস// টিম ইনগোল্ড
টিম ইনগোল্ডের এই বই নৃবিজ্ঞানের কোন সিস্টেমিক ইতিহাস নয়। বরং এই বইয়ে ইনগোল্ড একটি জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞানের কিছু ঐতিহাসিক বিতর্কের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়েছেন। প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতি, ইউনিভার্সালিজম বনাম পার্টিকুলারিজম, স্ট্রাকচার বনাম এজেন্সি সহ নৃবিজ্ঞানের কিছু চিরন্তন ইস্যু টিম ইনগোল্ড এক বিশেষ স্পষ্টতার সাথে তুলে ধরেছেন। সোশিওবায়োলজি, বিশ্বায়ন অধ্যয়ন, উত্তরাধুনিকতা সহ বইটির প্রকাশকালে নৃবিজ্ঞানের আলোচিত কিছু বিতর্কও এই বইয়ের বিষয়বস্তু ছিল। নৃবিজ্ঞানে আগ্রহী যেকোনো ব্যক্তির জন্যই এই বই হতে পারে একটি ‘ট্রেজার ট্রোভ’।
১০) এভোল্যুশান অ্যান্ড সোসাইটি// জন বারো
কোনো পেশাদার ঐতিহাসিকের নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে লেখা প্রথম দিকের একটি বই। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে আলোচিত হয়েছে উদীয়মান জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রাথমিক ইতিহাস এবং এই শাস্ত্রের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্যারাডাইম বিবর্তনবাদ। উনবিংশ শতককে বলা হয় ডারউইনের শতক আর ডারউইনবাদ উভয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে একইরূপে প্রভাবশালী ছিল। জৈবিক ও সামাজিক বিবর্তনবাদী তত্ত্ব তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজে যেভাবে গৃহীত হয়েছে এবং যেভাবে ওই সমাজকে প্রভাবিত করেছে, এটাই জন বারোর লেখা এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু।