ঝোপঝাড়ে শেক্সপিয়ার: লর্যা বোহ্যান্নান
[নৃবিজ্ঞানী লর্যা বোহ্যান্নানের বহুল পঠিত ‘Shakespeare in the Bush’ প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন তাহমিদ রহমান। নৃবিজ্ঞানী বোহ্যান্নান আফ্রিকার টিভ সমাজে গিয়ে শেক্সপিয়ারের মহাবিখ্যাত নাটক হ্যামলেটের গল্পটি বর্ণনা করলে, গল্পটি নিয়ে টিভদের যে প্রতিক্রিয়া হয়, সেটি নিয়েই এই প্রবন্ধ। বোহ্যান্নানের এই লেখাটি বিশ্বব্যাপী যেকোনো সাহিত্যকর্মের অর্থ বিশ্বজনীন কিনা সে প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। একইসাথে অনুবাদের ক্ষেত্রে টেক্সটের সাথে সাথে কিভাবে সংস্কৃতিও গুরত্বপূর্ণ, সে জায়গাটিও স্পর্শ করেছে।]
অক্সফোর্ড ছেড়ে টিভ সমাজের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার মাত্র ক’দিন আগেই আমাদের আলাপে স্ট্র্যাটফোর্ডের কথা উঠে এলো। “তোমরা আমেরিকানরা,” এক বন্ধু ফোঁড়ন কাটলেন, “শেক্সপিয়ারকে এখনো ঠিক মত বুঝতে পারলা না, আর যাই হোক ব্যাটা তো জাতে ইংরেজ ছিলো, আর ওর মধ্যে যেটা বিশেষভাবে স্থানীয় যেটাকে ভুলভাবে বুঝার কারণে যে কেউ শেক্সপিয়ারের মধ্যে যেটা বিশ্বজনীন সেটিরও ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে।”
প্রতিবাদ করে বললাম— মানুষের মনের ছাঁচ পৃথিবীর সর্বত্র কমবেশি একই আদলে তৈরি। নিদেনপক্ষে প্রধান ট্র্যাজেডিগুলোর সাধারণ প্লট আর মূল উদ্দীপনাগুলো সবার কাছেই ক্লিয়ার থাকার কথা, হয়তো এসবের মধ্যে থাকা কিছু প্রথা আর কিছু অনুষঙ্গ বুঝিয়ে দিতে হবে, আর অনুবাদের কারণে হয়তো সামান্য কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। ঘটনা এখানেই শেষ হতো যদি না ভদ্রলোক আফ্রিকান ঝোপে গিয়ে পড়ার জন্য আমার হাতে এককপি হ্যামলেট ধরিয়ে না দিতেন: তার আশা ছিলো এটা আমার চিন্তাকে এর আদিম পরিবেশের ঊর্ধ্বে তুলে নিয়ে যাবে আর কপালে থাকলে আমি হয়তো ধ্যানমগ্ন অবস্থায় হ্যামলেটের সঠিক ব্যাখ্যার মহিমাও লাভ করে ফেলতে পারি।
ওই আফ্রিকান গোত্রে এটা আমার সেকেন্ড ফিল্ড ট্রিপ, আর ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে (এ জায়গা পায়ে হেঁটে পার হওয়াও কঠিন) থাকার জন্য আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম। আমার ঠাই হলো টিলার ওপর বসতি গড়া এক জ্ঞানী বৃদ্ধের বাড়িতে, যেখানে বাস করা প্রায় একশ-চল্লিশটা প্রাণের সবাই হয় তার নিকট আত্মীয় অথবা তাদেরই স্ত্রী-সন্তান। তিনি বড়কর্তা। আশেপাশের অন্যান্য প্রবীণদের মতো তিনিও তার বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করে কাটান। এর মধ্যে অনেক আচারাদি এই গোত্রের অভিগম্য অংশগুলিতে আজকাল খুব কমই দেখা যায়। আমি আনন্দে ছিলাম। কারণ শীঘ্রই এ অঞ্চলে টানা তিন মাস ব্যাপী বিচ্ছিন্নতা ও অবসর নেমে আসবে; জলাভূমির উত্থানের ঠিক আগে যে ফসল কাটা হয় এবং পানি নেমে যাওয়ার সময় নতুন খামার পরিষ্কার করার মধ্যের সময়টুকুতে। আমি ভেবেছিলাম তাদের হাতে তখন হয়তো এসব অনুষ্ঠানাদি আরও ঘন ঘন পালন করার ফুসরত থাকবে এবং আমাকে বোঝানোর সময়টুকুও।
আমি ভুল ঠাউরেছিলাম। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই আশেপাশের বহু প্রবীণদের উপস্থিতি কাম্য ছিলো। কিন্তু জলাভূমি বৃদ্ধির সাথে সাথে, বৃদ্ধ লোকদের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে হেঁটে আসা খুব কঠিন হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে অনুষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে যায়। জলাভূমি আরও ওপরে উঠে এলে একটা ব্যতিক্রম বাদে আর সমস্ত কাজকর্মই স্থগিত হয়ে পড়ে। মহিলারা ভুট্টা এবং বাজরা থেকে যে বিয়ার তৈরি করে, তা নারী, পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে তাদের টিলার ওপর বসে পান করত।
ভোরবেলা থেকে পান আরম্ভ হয়। বেলা একটু গড়ালে পুরা বাড়ি নাচ, গান ও মাদলে মেতে ওঠে। এর মধ্যে বৃষ্টি হলে যে যার কুঁড়েঘরে আশ্রয় নেয়, তারপর সেখানেই পান করে-গান গায় কিংবা পান করে-গল্প শোনে। যেটাই হয় না কেন, দুপুর বা তার আগে, আমার হাতে করার মতো দুইটা কাজ থাকে: হয় এই আমোদআহ্লাদে যোগ দেয়া অথবা নিজের কুঁড়েঘরে আমার বইগুলির মধ্যে অবসর নেয়া। “বিয়ার হাতে থাকলে কেউ গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে কথা বলে না। আসেন, আমাদের সাথে যোগ দেন।” যেহেতু এদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশীয় ঘন বিয়ার উদরস্থ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না, আমি তাই তার পরিবর্তে হ্যামলেটের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছিলাম। দ্বিতীয় মাস শেষ হওয়ার আগে, আমার মনে ক্রমেই স্বস্তি নেমে আসে। কারণ আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছি যে হ্যামলেটের শুধু একটা মাত্র ইন্টারপ্রিটেশানই সম্ভব। আর তা সবার কাছে স্পষ্ট।
রোজ ভোরবেলা, বিয়ার পার্টির আগে কিছু ‘কাজের’ কথা বলার আশায়, আমি গৃহস্থকে আহ্বান করতাম তার বৈঠকখানায়। বৈঠকখানা বলতে বাতাস-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে একপাশে মাটির নিচু দেয়াল, যার চারপাশে বৃত্তাকারে পোঁতা খুঁটির ওপর বসানো খড়ের চাল। একদিন সে ঘরের নিচু দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি বসতির বেশিরভাগ পুরুষ তাদের ছিন্ন মেঠো-কাপড়ে পিঁড়ি, তক্তা-বিছানা এবং হেলান দেওয়া চেয়ারে জুত করে বসে, ধোঁয়াটে আগুনের চারপাশে বৃষ্টির কনকনে ঠান্ডায় নিজেদের উষ্ণ করছে। বিয়ারের তিনটা পট মধ্যে রাখা। পার্টি শুরু হয়ে গেছে।
বৃদ্ধ আমাকে দেখে প্রসন্ন হলেন। বললেন, “বসো, খাও।” আমি বিয়ারে ভরা একটা বড় লাউয়ের খোল গ্রহণ করলাম, তার থেকে একটা ছোট লাউয়ে কিছুটা ঢেলে এক ঢোকে গিলে ফেললাম। তারপর সেই ছোট লাউয়ের পাত্রটাকে কোনও যুবকের কাছে (যে আর সবার মধ্যে বিতরণ করবে) হস্তান্তর করার আগে আরও কিছুটা ঢেলে আমার আশ্রয়দাতার থেকে জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে দ্বিতীয় যে জন তার দিকে এগিয়ে দিলাম। গুরুজনদের নিজেদের বিয়ার নিজেরা পরিবেশন করা উচিৎ নয়।
“এখন সুন্দর লাগছে” আমার দিকে সম্মতিসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এবং আমার চুলে লেগে থাকা একটা খড় টেনে তুলতে তুলতে বৃদ্ধ বললো। “তোমার আরও ঘন ঘন আমাদের সঙ্গে বসে পান করা উচিত। তোমার চাকররা আমাকে বলে— তুমি যখন আমাদের সাথে থাকো না, তখন নাকি তোমার ঘরে বসে একটা কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকো।”
বৃদ্ধ চার ধরণের “কাগজে”র সঙ্গে পরিচিত ছিল: ট্যাক্স রসিদ, কন্যা পণের রসিদ, কোর্ট ফি রসিদ এবং চিঠি। যে বেয়ারা তাকে গ্রাম-প্রধানের কাছ থেকে চিঠি এনে দিতো সে সেগুলিকে মূলত সিলমোহর হিসাবে ব্যবহার করত, কারণ সে সবসময় জানতো তাতে কী লেখা আছে এবং বৃদ্ধকে সেটা পড়ে শোনাতো। আর গভর্নমেন্ট-এ বা মিশন স্টেশনে চাকরি করে এমন আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে যেসব ব্যক্তিগত চিঠিপত্র অল্পকিছু মানুষজনের কাছে আসতো সেগুলোকে রেখে দেওয়া হতো, পরে বড় বাজারে গিয়ে পত্রলেখকের মাধ্যমে পাঠোদ্ধারের জন্য। আমি আসার পর থেকে, সেসব চিঠি পড়ে দেয়ার জন্য আমার কাছে আনা হতো। কিছু লোক প্রাইভেটলি আমার জন্য কন্যা পণের রসিদও এনেছিল, যেন সেগুলোর দাম বাড়িয়ে দেই। দেখলাম যে নৈতিক যুক্তিটুক্তি দিয়ে কোনো কাজ হবে না, কারণ বেয়াই বাড়িও এসব ক্ষেত্রে কম যায় না, আর জালিয়াতির টেকনিক্যাল বিপত্তিগুলি কোনো অশিক্ষিত লোকের কাছে ব্যাখ্যা করা কঠিন। যাই হোক আমি চাই না এরা মনে করুক আমি দিনকে দিন এ জাতীয় কাগজপত্র নিয়ে পরে থাকার মতো গবেট, তাই তাড়াহুড়া করে তর্জমা করলাম আমার “কাগজ” আমার দেশের “অনেককাল আগের জিনিস”গুলির মধ্যে একটা।
“ওহ,” বৃদ্ধ বলল। “আমাদেরকে বলো তাহলে।” বাঁধা দিয়ে বললাম— মাফ চাই আমি গল্পবলিয়ে না। গল্পবলা এদের মধ্যে একটা দক্ষ শিল্পের পর্যায়ে পরে। তাদের মান উচ্চ, শ্রোতারা সমালোচনামূলক, আর এ ব্যাপারে তাদের কোনো রাখঢাক নাই। কিন্তু বৃথাই প্রতিবাদ করলাম। আজকে সকালে এরা পান করতে করতে গল্প শুনতে চায়। এরা আমাকে আর কোনো গল্প বলবে না বলে হুমকি দিলো যদি না আমি আমার কোনো গল্প শোনাই। অবশেষে বৃদ্ধ কথা দিলো যে কেউ আমার বলার ভঙ্গি নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করবে না, “কারণ আমরা জানি আমাদের ভাষা শিখতে আপনার কষ্ট হচ্ছে।” “কিন্তু,” একজন প্রবীণ বলে উঠলো, “আমরা কিছু না বুঝলে সেটা অবশ্যই বুঝিয়া দিতে হবে, যেমন আমরা গল্প বলার সময় আপনাকে বোঝাই।” হ্যামলেট সার্বজনীনভাবে বোধগম্য কি না তা প্রমাণ করার এটাই মোক্ষম সুযোগ বুঝে রাজী হয়ে গেলাম।
বৃদ্ধ আমাকে গলা পরিষ্কার করার জন্য আরও কিছুটা বিয়ার ঢেলে দিলো। পুরুষরা হাতের লম্বা কাঠের পাইপগুলো ভর্তি করে নিলো। আগুন থেকে তুলে পাইপের বাটিতে কয়লা ছেড়ে দিয়ে তৃপ্তি সহকারে টানতে টানতে, আসন করে বসলো। আমি ঠিকঠাক মতো শুরু করলাম, “গতকাল না, গতকাল না, তারও অনেক আগে, একটা ঘটনা ঘটেছিলো। এক রাতে তিনজন শাস্ত্রী গ্রাম-প্রধানের বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলো, এমন সময় তারা হঠাৎ দেখতে পেলো তাদের প্রাক্তন প্রধান তাদের দিকে হেঁটে আসছে”
“কেন সে আর তাদের প্রধান ছিল না?”
“তিনি মারা গেছেন,” আমি ব্যাখ্যা করলাম। “তাই তাকে দেখতে পেয়ে তারা ভয় পেয়ে যায়।”
“অসম্ভব,”একজন প্রবীণ বাঁধা দিলো, তার পাইপটা পাশের জনের হাতে দিয়ে বললো “এটা কোনো মৃত লোক হতে পারে না। ডাকিনী মন্ত্র— কোনো ডাইনির পাঠানো লক্ষণ। হ্যাঁ তারপর বলে যাও”।
সামান্য ইতস্তত করে আমি বলে গেলাম। “তিনজনের মধ্যে একজন ছিলো যে অনেক কিছু বুঝতো” পণ্ডিত বোঝানোর নিকটতম অনুবাদ, দুর্ভাগ্যবশত এর মানে আবার ডাইনিও হয়। সে দ্বিতীয় প্রবীণ প্রথমজনের দিকে বিজয়ের দৃষ্টিতে তাকালো। “তো সেই লোক তাদের মৃত প্রধানের সাথে বাৎচিত শুরু করলো এই বলে যে, ‘আমাদেরকে বলুন আপনার মৃত আত্নার শান্তির জন্য আমরা কী করতে পারি’ কিন্তু নেতা কোনো জবাব দিলো না। সে হাওয়ায় মিশে গেলো, এবং কেউ তাকে আর দেখতে পেলো না। তারপর যে লোকটা অনেক কিছু বুঝতো, তার নাম ছিলো হোরেশিও, বললো যে— এ ঘটনা মরহুম প্রধানের পুত্র হ্যামলেটের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ব্যাপার।”
এটা শোনার পর শ্রোতাদের মধ্যে একধরণের দোলাচল দেখা গেলো। “মরহুম প্রধানের কি কোনো জীবিত ভাই ছিলো না? নাকি এই পুত্রই বর্তমান প্রধান?”
“না” — আমি জবাব দিলাম। “মানে, তার একজন জীবিত ভাই ছিলো যে পরবর্তীতে নেতা হয় বড় ভাই মারা যাওয়ার পর।”
বৃদ্ধরা বিড়বিড় করে উঠলো: এসব অলক্ষুণে জিনিস প্রধানদের ব্যাপার, বড়দের ব্যাপার, পোলাপানের না। প্রধানকে ডিঙ্গিয়ে কিছু করতে গেলে সেটার কোনো ভালো ফল আসবে না। বোঝাই যাচ্ছে হোরেশিও সমঝদার লোক ছিলো না।
“হ্যাঁ, সে ছিলো” — আমি জোর দিলাম, আমার বিয়ারের দিকে মুখ দেয়া একটা মুরগিকে ধাও দিতে দিতে। “আমাদের দেশে বাবার পরে পুত্রেরই অধিকার। কিন্তু মরহুম প্রধানের ছোটভাই তা দখল করেছিলো। মৃত সৎকারের এক মাসের মাথায় সে আবার বড় ভাইয়ের বিধবাকেও বিবাহ করে।”
“সে ভালোই করেছে,” বৃদ্ধের চোখ জ্বলে উঠলো এবং আর সবাইকে এ কথা ঘোষণা করলো, “তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে, আমরা যদি ইউরোপিয়ানদের সম্বন্ধে আরও জানতাম, তাহলে দেখতাম ওরা আসলে প্রায় আমাদেরই মতো। আমাদের দেশেও ছোট ভাই তার বড় ভাইয়ের বিধবাকে বিবাহ করে আর তার সন্তানদের বাবা হয়। এখন তোমার কাকা, যে তোমার বিধবা মাকে বিবাহ করলো সে যদি তোমার বাবার আপন ভাই হয়, তাহলে সে তোমার আসল বাবার মতোই হবে। হ্যামলেটের বাবা আর কাকা কি একই মায়ের পুত্র?”
প্রশ্নটা আমার মাথাতেই ঢুকলো না। হ্যামলেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটাকে এভাবে ঠেলা মেরে বের করে ফেলায় আমি প্রথম ভেবাচেকা খেয়ে পরে বেসামাল হয়ে গেছিলাম। অনিশ্চিতভাবে বললাম যে আমার মনে হয় তাদের একই মা ছিলো, কিন্তু আমি নিশ্চিত না, গল্পের মধ্যে এ জিনিস নাই। বৃদ্ধ আমাকে কঠোরভাবে বললেন যে বংশগত পরিচয়ই সব হিসাব বদলে দেয়, আমি যেন নিজের বাড়ি যাওয়ার পর অনতিবিলম্বে এই ব্যাপারে মুরুব্বিদের জিজ্ঞেস করি। দরজার দিকে চেঁচিয়ে সে তার ছোট বউদের একজনকে তার ছাগলের চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে আসতে বললো।
মা-বিষয়ক প্রসঙ্গকে যতটুকু রক্ষা করা যেতে পারে ততটুকু করার সংকল্প নিয়ে, আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলাম তারপর আবার শুরু করলাম, “এত শীঘ্রই দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য হ্যামলেট তার মায়ের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলো। কাজটা করার তার কোনো প্রয়োজন ছিলো না, একজন বিধবা দ্বিতীয় বিবাহ করার আগে অন্তত দুই বছর শোক পালন করা আমাদের প্রথা।”
“দুই বছর অনেক দীর্ঘ” ছোট বউ আপত্তি করলেন, তার হাতে বৃদ্ধর ছাগলের চামড়ার ব্যাগ। “স্বামী না থাকলে তার খামারের নিড়ানি দিবে কে?”
“হ্যামলেট,” আমি কিছু না ভেবেই জবাব দিলাম, “মায়ের খামার দেখভাল করার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার। এ বিয়ের দরকার ছিল না।” কাউকে আশ্বস্ত মনে হলো না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম। “হ্যামলেটের মা ও প্রধান নেতা তাকে দুঃখ না করতে বললো, কারণ নেতা নিজেই এখন হ্যামলেটের পিতা হবেন। তার ওপর হ্যামলেটই হবে পরবর্তী প্রধান: সুতরাং সব কিছুর হালচাল শেখার জন্য তার ঘরেই থাকা উচিৎ। হ্যামলেট থাকতে রাজি হল আর বাকিরা বিয়ার খেতে চলে গেল।”
আমি যখন থামলাম, হ্যামলেটের বীতশ্রদ্ধ স্বগতোক্তি কিভাবে একদল শ্রোতার কাছে উপস্থাপন করা যায় যারা ধরে বসে আছে যে ক্লডিয়াস আর গেরট্রুড তাদের তরফ থেকে সবচেয়ে আন্তরিক কাজটাই করেছে, তখন এক যুবক জানতে চাইলো যে প্রধানের বাকি স্ত্রীদের কারা বিবাহ করেছে।
“তার আর কোনো স্ত্রী ছিলো না,” আমি বললাম।
“কিন্তু একজন প্রধানের তো অনেক স্ত্রী থাকতে হয়! নাইলে সে তার অতিথিদের জন্য বিয়ার আর খাবার প্রস্তুত করবে কিভাবে?”
আমি কঠিন ভাবে জবাব দিলাম, আমার দেশের প্রধানদেরও একটাই স্ত্রী থাকে, আর তাদের কাজ করার জন্য চাকর চাকরানি নিযুক্ত থাকে, ট্যাক্সের টাকা থেকে তাদের মজুরি দেয়া হয়।
একজন প্রধানের, তারা জানালো, অনেক স্ত্রী-পুত্র থাকা ভালো যারা তার জমি নিড়ানি দিতে আর তার লোকজনের আহারদানে সহায়তা করবে। সে প্রধানকে সকলেই শ্রদ্ধা করে যে দু’হাতে দান করে কিন্তু বিনিময়ে কিছু নেয় না। ট্যাক্স-ফ্যাক্স অসাধু পন্থা।
শেষ মন্তব্যটার সঙ্গে আমি একমত ছিলাম, কিন্তু বাকিরা আমার প্রশ্নগুলিকে আটকানোর জন্য তাদের পছন্দের উপায়ে ফিরে গিয়েছিলেন: “এভাবে এটা করা হয়, তাই আমরা এটা এভাবে করি।”
আমি হ্যামলেটের স্বভাষণ এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্লডিয়াস যদি তার বড় ভাইয়ের বিধবাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে সঠিক হয়েও থাকে তারপরও তো বিষ- বিষয়ক ব্যাপারটা থেকেই যাচ্ছে, আর আমি জানি ওরা ভাতৃহত্যাকে সমর্থন করবে না। তাই আশাহত না হয়ে আমি আবার শুরু করলাম, “সেই রাতে হ্যামলেটও আগের প্রহরী ত্রয়ীর সঙ্গে পাহারায় দাঁড়ালো। মৃত নেতা আগের বারের মতো আবার হাজির হলো, আর অন্যরা ভয় পেলেও, হ্যামলেট তার বাবাকে অনুসরণ করে একদিকে সরে গেলো। তারপর তারা দুইজন ছাড়া আশেপাশে যখন আর তৃতীয় কেউ ছিলো না, তখন তার মৃত বাবা কথা বলে উঠলো।”
“পূর্বলক্ষণ তো কথা বলতে পারে না!” বৃদ্ধ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
“হ্যামলেটের মৃত বাবা কোনো পূর্বলক্ষণ ছিলো না। তাকে দেখা হয়তো কোনো পূর্বলক্ষণ হতে পারে, কিন্তু সে নিজে না।” শ্রোতারা আমার প্যাঁচানো কথায় আরও প্যাঁচ খেয়ে গেলো। “এটা হ্যামলেটের বাবাই ছিলো। এরকম জিনিসকে আমরা ‘ভূত’ বলি।” আমাকে স্বভাষাতেই বলতে হয়েছিলো। কারণ এদের আশেপাশের বিভিন্ন প্রতিবেশী গোষ্ঠী বিশ্বাস করলেও, মৃত্যুর পর মানুষের সত্ত্বার কোনো অংশ বেঁচে থাকতে পারে এমন মতে এরা বিশ্বাসী না।
“‘ভূত’ আবার কী?”
“না, ‘ভূত’ হল এমন একজন যে মৃত কিন্তু যে চারপাশে ঘুরে বেড়ায় আর কথা বলতে পারে, এবং লোকেরা তাকে শুনতে পায়, দেখতেও পারে কিন্তু স্পর্শ করতে পারে না।”
ওরা আপত্তি করলো। “জম্বিদের স্পর্শ করা যায়।”
“না, না! বলি দেয়ার ও খাওয়ার জন্য ডাইনিরা যেরকম লাশ জিন্দা করে এটা সেরকম কোনো লাশ না। হ্যামলেটের মৃত বাবাকে হাঁটার জন্য কেউ পরিচালিত করছে না। সে নিজে থেকেই সব করছে।”
“মৃত মানুষ হাঁটতে পারে না,” আমার শ্রোতারা একযোগে প্রতিবাদ করলো।
আমি আপোষ করতে রাজী ছিলাম।
“‘ভূত’ হলো মৃত মানুষের ছায়া।”
তারা আবারো মাথা নাড়লো, “মৃত মানুষ কোনো ছায়া ফেলে না।”
“আমাদের দেশে ফেলে,” এবার আমি চেতে গেলাম।
আমার কথা থেকে সবার মধ্যে যে অবিশ্বাসের গুঞ্জন উঠেছিলো তা বৃদ্ধের কন্ঠস্বরে শান্ত হয়ে এলো। বৃদ্ধ আমাকে অসরল কিন্তু সৌজন্যমূলক ভঙ্গিতে, কেউ যেভাবে ছোটদের, মূর্খদের কিংবা কুসংস্কারাচ্ছন্নদের খামখেয়ালকে বাগড়া দেয়, বললেন, “কোনো সন্দেহ নাই তোমার দেশে মৃতরা জম্বি না হয়েও হাঁটতে পারে।” সে তার ব্যাগের গভীর থেকে কোলা বাদামের একটা শুকনা টুকরা বের করলো, সেটা যে বিষযুক্ত না তা দেখানোর জন্য কোনা থেকে সামান্য অংশ কামড় দিয়ে ভাঙলো, তারপর বাকিটা সমঝোতার স্মারক হিসাবে আমার হাতে দিলো।
“যাই হোক,” আমি আবার শুরু করলাম, “হ্যামলেটের বাবা তাকে বললো যে তার নিজের ভাই, যে বর্তমান প্রধান, তাকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে। সে চায় হ্যামলেট যেন তার প্রতিশোধ নেয়। হ্যামলেট মনে প্রাণে এ কথা বিশ্বাস করলো কারণ সে তো তার চাচাকে আগে থেকেই অপছন্দ করতো।” আমি আরেক চুমুক বিয়ার নিলাম। “তো সেই মহান প্রধানের দেশে, একই ঘরে (কারণ এটা বিশাল ঘর ছিলো) আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ প্রবীণ বাস করতো। সে প্রধানের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবে ও তাকে শলাপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতো। তার নাম ছিলো পোলোনিয়াস। হ্যামলেট তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতো, কিন্তু তার বাবা ও ভাই… [ওদের ভাষায় উপমা খোঁজার জন্য আমার মাথা তখন চারদিকে হাতড়াচ্ছে] তাকে সতর্ক করে, সে যেন হ্যামলেটকে তার সঙ্গে নিভৃতে দেখা করার সুযোগ না দেয়। কারণ হ্যামলেট পরবর্তীতে প্রধান হবে আর তাই সে পোলোনিয়াসের কন্যাকে বিবাহ করতে পারবে না।”
“কেন না?” বউটা জিজ্ঞেস করল, সে এর মধ্যে বৃদ্ধের চেয়ারের ধারে বসে পড়েছে। বোকার মতো প্রশ্ন করার জন্য বৃদ্ধ তার দিকে ভ্রুকুটি করে বললো, “ওরা যে একই বাড়িতে থাকত।”
“সেজন্য না,” আমি জানালাম। “পোলোনিয়াস বাইরের লোক ছিলো। সে এ বাড়িতে থাকতে পারতো কারণ সে প্রধানকে সাহায্য করতো, আত্মীয়তার খাতিরে না।”
“তাহলে হ্যামলেট তার মেয়েকে বিবাহ করতে পারবে না কেন?”
“সে করতে পারে,” আমি ব্যাখ্যা করলাম, “কিন্তু পোলোনিয়াস মনে করতো যে সে তা করবে না। আর যাই হোক হ্যামলেট তার দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লোক ছিলো, তার মতো লোক অন্য কোনো প্রধানের কন্যাকে বিবাহ করে, কারণ তারা মাত্র একটাই বিবাহ করতে পারে। পোলোনিয়াসের ভয় ছিলো যে হ্যামলেট যদি তার কন্যার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায় তাহলে অন্য কেউ তার জন্য উচ্চ মূল্য দিতে রাজি হবে না।”
“তা হয়তো হতে পারে,” প্রবীণদের মধ্যে চতুর একজন বললে উঠলেন, “কিন্তু একজন প্রধানের ছেলে তো তার প্রণয়িনীর বাবাকে যথেষ্ট উপহার এবং পৃষ্ঠপোষকতা দেবে যেন তার তাদের মধ্যে পার্থক্য কমে আসে। এই পোলোনিয়াসকে তো আমার বোকা মনে হচ্ছে।”
“অনেকেই তা মনে করে,” আমি যোগ করলাম, “এর মধ্যে পোলোনিয়াস তার পুত্র লেয়ার্টিসকে প্যারিস পাঠিয়ে দিলো যাতে সে সে দেশের নিয়ম কানুন শিখে আসতে পারে, কারণ আরেক মহান প্রধানের বসত ছিলো ওই দেশে। পোলোনিয়াসের ভয় ছিলো যে লেয়ার্টিস বিয়ার, নারী আর জুয়ার পেছনে প্রচুর অর্থ অপচয় করে ফেলবে অথবা বিশৃঙ্খলা করে সমস্যায় পড়ে যেতে পারে, তাই তিনি তার এক ভৃত্যকে গোপনে প্যারিসে পাঠান, লেয়ার্টিস কী করছে তার গুপ্তচরি করতে। তো একদিন হ্যামলেট পোলোনিয়াসের কন্যা ওফেলিয়ার সঙ্গে দেখা করলো। সে সময় সে এত অদ্ভুত আচরণ করছিলো যে ওফেলিয়া ভয় পেয়ে গেলো। এমনকি” — হ্যামলেটের উন্মাদনার দ্বৈততা বোঝানোর শব্দ খুঁজতে গিয়ে আমি আমতা আমতা করছিলাম — “প্রধান নেতা এবং আরও অনেকেই এটা ধরতে পেরেছিলো যে হ্যামলেট যখন কথা বলে তখন শব্দগুলি বোঝা গেলেও অর্থ বোঝা যায় না। অনেকেই ভেবেছিলো সে পাগল হয়ে গেছে।” আমার শ্রোতারা হঠাৎ করে অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে গেলো। “প্রধান নেতা এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলো, তাই সে হ্যামলেটের সমবয়সী দুজন সঙ্গীকে তলব করে [স্কুলের বন্ধু বোঝাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো] আর নির্দেশ দিলো যাতে তারা হ্যামলেটের সঙ্গে কথা বলে তার মনঃকষ্টের হেতু খুঁজে বের করে। হ্যামলেট যখন দেখলো নেতা তাদেরকে ঘুষ দিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য, সে তাদের কিছুই বললো না। আর পোলোনিয়াস এ কথা জোর দিয়ে বলতে লাগলো যে হ্যামলেটের পাগলামির কারণ হচ্ছে ওফেলিয়া, যাকে সে ভালোবাসত তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ হওয়া।”
“কেন?” একটা বিভ্রান্ত কন্ঠ জিজ্ঞেস করলো, “শুধু এই প্রেক্ষিতে কি হ্যামলেটকে কারো বশ করা উচিৎ?”
“বশ করা?”
“হ্যাঁ, শুধুমাত্র জাদুটোনাই কাউকে উন্মাদ করতে পারে, যদি না, অবশ্য, কেউ বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অবয়বকে দেখতে পায়।”
এটা শুনে আমি গল্পকার হওয়া বন্ধ করে আমার নোটবুক বের করলাম আর উন্মাদ হওয়ার এই দুটি কারণ সম্বন্ধে আরও বিশদ বর্ণনা জানতে চাওয়ার দাবি করলাম। এমনকি ওরা যখন বলছে আর আমি নোট নিচ্ছি তখনও আমি গল্পের মধ্যে এই নতুন প্রভাবকের হিসাব গোণার চেষ্টা করছিলাম। হ্যামলেট বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অবয়বদের সংস্পর্শে আসেনি। আর তার বাবার দিকের আত্মীয়রাই কেবল তাকে বশ করতে পারে। অনুল্লেখিত আত্মীয়দের বাদ দিয়ে, শুধু ক্লডিয়াসই তার ক্ষতি করতে পারে। আর, আসলে তো, সে-ই করছিলো।
এখনের মতো প্রশ্নগুলাকে এড়ানোর জন্য আমি বললাম যে শুধুমাত্র ওফেলিয়ার জন্য হ্যামলেট পাগল, আর কিছু নয়, এমন কথা বিশ্বাস করতে প্রধান নেতা নারাজ ছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হ্যামলেটকে অশান্ত করে তুলেছে।
“এখন হ্যামলেটের সমবয়সী সাথীরা” আমি আবার শুরু করলাম, “তাদের সঙ্গে একজন বিখ্যাত গল্পকার নিয়ে এলো। হ্যামলেট সিদ্ধান্ত নিলো যে সে এই লোকটার মাধ্যমে গ্রামপ্রধান এবং তার সমস্ত বসতবাড়িকে এমন এক লোকের গল্প বলবে যে তার ভাইকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছিল, কারণ সে তার ভাইয়ের স্ত্রীকে কামনা করতো এবং নিজে প্রধান হতে চেয়েছিলো। হ্যামলেট নিশ্চিত ছিলো যে প্রধান নেতা যদি সত্যিই দোষী হয় তাহলে কোনো প্রকার অস্বস্তি ছাড়া এ গল্প সে শুনতে পারবে না। এবং এর ফলে সে বুঝতে পারবে তার মৃত বাবা তাকে সত্য বলেছে কী না।”
বৃদ্ধ বাঁধা দিলেন, গভীর ধূর্ততার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা ছেলেকে মিথ্যা বলবে কেন?”
আমি ঘোলাটে করে জানালাম, “হ্যামলেট নিশ্চিত ছিলো না এটা সত্যিই তার মৃত বাবা কী না।” শয়তান প্রদত্ত দৃশ্যের মানে বোঝানো সে ভাষায় প্রায় অসম্ভব ছিলো।
“তার মানে” সে বললো, “তুমি বলতে চাইছো যে এটা আদতে একটা পূর্বলক্ষণ ছিলো, আর সে জানতো যে ডাইনীরা মাঝেমধ্যে মিথ্যা লক্ষণ পাঠায়। লক্ষণ পাঠে পারদর্শী এমন কোনো লোকের পরামর্শ না নিয়ে হ্যামলেট চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। যে-সত্য-দেখতে-পারে সে হ্যামলেট কে বলতে পারতো তার বাবা কিভাবে মারা গেছে, তাকে কি আসলেই বিষ দেয়া হয়েছে কী না, নাকি এর মধ্যে জাদুটোনা জড়িত, তারপর সে বড়দের ডাকতে পারত ব্যাপারটার সুরাহা করার জন্য।”
কিন্তু চতুর প্রবীণ বাঁধ সাধলেন। “যেহেতু তার বাবার ভাই বর্তমান প্রধান, তাই যে সত্য দেখতে পারে সে হয়তো সত্য বলার ঝুঁকি নাও নিতে পারে। আমার মনে হয় এ জন্য হ্যামলেটের বাবার কোনো বন্ধু— যে কী না এক ডাইনি ও প্রবীণ— এ লক্ষণ পাঠিয়েছে যাতে তার বন্ধুর পুত্র এ ব্যাপারে জানতে পারে। লক্ষণটা কি সত্য বলছিলো?”
“হ্যাঁ” — আমি বললাম, ভুত-শয়তান এসব বাদ দিলে, এটাকে ডাইনি-প্রদত্ত লক্ষণই এর একমাত্র ব্যাখ্যা। “লক্ষণ সত্যি বলছিলো, কারণ গল্পবলিয়ে যখন বাড়ির সবার সামনে এ গল্প বলছিলো, মহান প্রধান তখন ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার গোপন রহস্য ফাঁস গেছে ভেবে সে হ্যামলেটকে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।”
গল্পের পরবর্তী ধাপের মঞ্চ সংস্থাপন অনুবাদের জন্য কিছু মুশকিল তৈরি করলো। আমি সাবধানে শুরু করলাম। “প্রধান নেতা হ্যামলেটের মাকে তার ছেলের কাছে পাঠান সে কী জানে তা খুঁজে বের করতে। কিন্তু যেহেতু একজন নারীর হৃদয়ে সন্তানের মঙ্গল সর্বাগ্রে থাকে, তাই সে (প্রধান নেতা) গুরুত্বপূর্ণ প্রবীণ পোলোনিয়াসকে হ্যামলেটের মায়ের শোবার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো কাপড়ের পেছনে লুকিয়ে থাকতে বলে। সেখানে মায়ের কৃতকর্মের জন্য হ্যামলেট তাকে তিরস্কার করতে শুরু করলো।”
শ্রোতাদের মধ্য থেকে এক হতবাক গুঞ্জন ওঠে। কারো কখনই তার মাকে তিরস্কার করা উচিৎ নয়।
“হ্যামলেটের মা ভয়ে চিৎকার দিলো আর পোলোনিয়াস পর্দার পেছন থেকে নড়ে উঠলো। ‘একটা ইঁদুর!’ বলে গর্জন করে উঠলো হ্যামলেট, তারপর সঙ্গে সঙ্গে তার খঞ্জর খুলে পর্দার কাপড়ে বিঁধে ফেলে।” আমি নাটকীয়তার জন্য পজ্ দিলাম। “সে পোলোনিয়াসকে মেরে ফেলেছে।”
প্রবীণরা একজন আরেকজনের দিকে চরম বিরক্তিতে তাকালো। “এই পোলোনিয়াস আসলেই চরম বোকা ছিলো এবং কিছুই জানতো না। একটা বাচ্চাছেলেও তো এরকম জায়গায় থাকলে চিৎকার করে বলতো, ‘এটা আমি!’” যন্ত্রণার সঙ্গে আমার মনে পড়লো এখানে জমায়েত হওয়া মানুষগুলো সব তুখোড় শিকারি; তীর, ধনুক, খঞ্জর এ যাবতীয় অস্ত্র সর্বদা এদের সাথেই থাকে। ঘাসের ওপর সামান্য মরমর ধ্বনিতে এদের ধনুকের ছিলা টানটান হয়ে ওঠে আর শিকারি আওয়াজ তোলে, “মারররা!” কোনো মানুষের গলা যদি তার জবাবে না শোনা যায়, শাঁই শাঁই করে তীরগুলি ধনুক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একজন দক্ষ শিকারির মতো হ্যামলেটও আওয়াজ তুলেছে, “একটা ইঁদুর!”
আমি পোলোনিয়াসের মান বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। “পোলোনিয়াস কথা বলেছিলো। এবং হ্যামলেট তা শুনতেও পায়। কিন্তু সে ভেবেছিলো পর্দার আড়ালে যে লুকিয়ে আছে সে তার চাচা এবং তাই সে তাকে হত্যা করে তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলো। কারণ ইতোমধ্যেই সে মনঃস্থির করে ফেলেছে তাকে হত্যা করার…” আমার কথা ভেঙে গেলো, কারণ প্রিয়জনের দোয়াদরুদের করুণাবৃত শয্যায় মৃত্যু বরণ করা আর “আশ্রয়হীন, ভগ্নোত্সাহ, অপরিশুদ্ধ” মৃত্যুর ফারাক আমি এই প্যাগানদের কী করে বোঝাই যারা কোনো স্বতন্ত্র আখেরাতে বিশ্বাস করে না।
কিন্তু এবার আমি আমার শ্রোতাদের সিরিয়াসলি চমকে দিয়েছি। “একজন লোক তার বাবার ভাই এবং যে হাল আমলে তার বাবা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে হাত তুলেছে – এটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এমন লোককে জাদুবলে বশ করা হলে প্রবীণদের কীই বা বলার থাকতে পারে।”
ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুঁচকে আমি হাতের কোলা বাদামে কুট করে কামড় দিলাম। বললাম আর যাই হোক লোকটা তো হ্যামলেটের বাবাকে হত্যা করেছে।
“না,” বৃদ্ধ আমাকে প্রতিহত করলেন, এবং পেছনে বসে থাকা যুবাদের উদ্দেশ্যে আমাকে বললেন, “তোমার বাবার ভাই যদি তোমার বাবাকে হত্যা করে, তবে তোমাদের উচিৎ বাবার সমবয়সীদের আহবান করা: তারা এর শোধ নিবেন। কিন্তু কেউ যেন তার প্রবীণ স্বজনদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার সহিংসতা না করে।” এর মধ্যে আরেকটা চিন্তা তার মাথায় এলো, তিনি যোগ করলেন, “কিন্তু হ্যামলেটের চাচাই যদি তাকে জাদু দিয়ে বশ করার মতো হীন কাজ করে এবং তার কারণেই হ্যামলেট পাগল হয় তাহলে এটা নিঃসন্দেহে একটা খাসা গল্প হবে। কারণ তাহলে দোষটা তার নিজের এবং তার কারণেই হ্যামলেট হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এখন তার চাচাকে হত্যা করতে চায়।”
একটা করতালির গুঞ্জন উঠলো। হ্যামলেট আবার তাদের কাছে একটি ভাল গল্প হয়ে উঠেছে, কিন্তু এখন এটাকে আর আমার একই গল্প বলে মনে হচ্ছে না। প্লটের আসন্ন জটিলতা ও অভিপ্রায় বিবেচনা করে আমি সাহস হারিয়ে ফেললাম, আর ঘোলা পানিতে মুখ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
“মহান প্রধান এ ব্যাপারে,” আমি এগিয়ে গেলাম, “চিন্তিত ছিলো না যে হ্যামলেট পোলোনিয়াসকে মেরে ফেলেছে। কারণ এর ফলে তার কাছে হ্যামলেটকে দেশত্যাগী করার উপলক্ষ তৈরি হয়েছে। সে হ্যামলেটকে তার দুই প্রতারক বন্ধুসহ, দূরবর্তী এক দেশের প্রধানের কাছে হ্যামলেটকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য একটা চিঠি দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করে দিলো। কিন্তু হ্যামলেট চিঠির লেখা বদলে ফেলেছিলো, এবং ফলস্বরূপ তার বদলে তার দুই বন্ধু নিহত হয়।” পূর্বোল্লিখিত এক আবেদনকারী আমার দিকে ভৎসনার দৃষ্টিতে তাকালো। তাকে আমি বলেছিলাম যে অসনাক্তযোগ্য জালিয়াতি করা শুধু অনৈতিকই না , এটি মানুষের ক্ষমতারও ঊর্ধ্বে। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
“হ্যামলেট ফিরে আসতে পারার আগেই, লেয়ার্টিস তার বাবার শেষকৃত্যের জন্য ফিরে আসে। প্রধান নেতা তাকে বলে যে হ্যামলেট তার বাবাকে হত্যা করেছে। তাতে লেয়ার্টিস হ্যামলেটকে হত্যা করার পণ করে আর তার বোন ওফেলিয়া যখন শুনলো যে তার বাবা তার প্রিয়তমের হাতে খুন হয়েছে, সে পাগল হয়ে যায় আর নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করে।”
“আপনাকে যা বলেছিলাম তা কি এর মধ্যেই ভুলে গেছেন,” বৃদ্ধ তিরস্কার করলেন, “পাগলের ওপর কেউ প্রতিশোধ নিতে পারে না; হ্যামলেট তার পাগলামিতে পোলোনিয়াসকে হত্যা করেছিল। আর মেয়েটার ব্যাপারে, সে কেবল পাগলই হয়নি, ডুবে গেছে। শুধু ডাইনিরাই পারে মানুষকে ডুবিয়ে দিতে। পানি নিজে থেকে কোনো ক্ষতি করতে পারে না। পানি কেবল একজন পান করে বা এর মধ্যে গোসল করতে পারে।”
আমি এবার চেতে গেলাম, “গল্পটা আপনাদের পছন্দ না হলে, আমি আর বলবো না।”
বৃদ্ধ প্রশান্তিদায়ক শব্দ করলেন এবং নিজেই আমাকে আরও কিছুটা বিয়ার ঢেলে দিলেন। “তুমি ভালোই গল্প বলতে পারো এবং আমরাও শুনছি। কিন্তু এটা ক্লিয়ার যে তোমার দেশের প্রবীণরা তোমাকে কখনোই বলে নাই গল্পটার আসল মানে কী। না না, বাঁধা দিও না! আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি যখন তুমি বলো যে তোমাদের বিবাহের রীতি আমাদের চেয়ে ভিন্ন, কিংবা তোমাদের পোশাক-আশাক, অস্ত্র। কিন্তু মানুষ সব জায়গায় একই রকম হয়; সুতরাং, ডাইনিরাও সব জায়গায় থাকে এবং আমরা, বয়স্করাই শুধু জানি ডাইনিরা কীভাবে কী করে। আমরা তোমাকে বলেছিলাম যে মহান প্রধানই হ্যামলেটকে হত্যা করতে চায়, আর এখন তোমার কথাই আমাদের কথাকে সত্য প্রমাণ করছে। ওফেলিয়ার পুরুষ আত্মীয় কারা ছিলো?”
“শুধু মাত্র তার বাবা এবং ভাই,” হ্যামলেট ক্লিয়ারলি হিসাবের বাইরে চলে গেছিলো।
“আরও অনেকে নিশ্চয়ই ছিলো, এটাও তুমি দেশে ফিরে তোমার বড়দের জিজ্ঞেস করতে পারো। তুমি যা বলছো তার থেকে এটাই পরিষ্কার হয় যে, যেহেতু পোলোনিয়াস মৃত, লেয়ার্টিসই ওফেলিয়াকে হত্যা করেছে, যদিও আমি এর কোনো কারণ দেখি না।”
বিয়ারের খোল এতক্ষনে খালি হয়ে গেছে। বৃদ্ধ হালকা নেশার সঙ্গে তার যুক্তি খন্ডন করছিলেন। অবশেষে একজন জানতে চাইলো, “পোলোনিয়াসের প্যারিসগামী ভৃত্য ফিরে এসে কী বলেছিলো?”
মুশকিলের সঙ্গে আমি রেনাল্ডো আর তার অভিযানের কথা স্মরণ করলাম, “আমার মনে হয় না সে পোলোনিয়াসের মৃত্যুর আগে দেশে ফিরে এসেছিলো।”
“শোনো,” প্রবীণ বললেন, “আমি বলছি কীভাবে কী হলো আর পরে কী হবে, তারপর তুমি আমাকে বলো আমি ঠিক কী না। পোলোনিয়াস জানতো তার ছেলে ঝামেলায় জড়াবে, এবং তাই হলো। নানা ঝগড়ার জরিমানা দিতে দিতে আর জুয়াখেলার ঋণে সে জর্জরিত হয়ে গেল। কিন্তু দ্রুত টাকা কামানোর জন্য তার হাতে মাত্র দুইটা উপায় ছিলো। একটা হলো তার বোনের বিয়ে দিয়ে দেওয়া, কিন্তু প্রধান নেতার পুত্র যাকে কামনা করে তাকে বিয়ে করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। কারণ প্রধানের উত্তরাধিকারী যদি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করে তবে আপনি আর কীই বা করতে পারবেন? একমাত্র কোনো বোকাই পারে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে যে ভবিষ্যতে তার বিচারক হবে। সুতরাং লেয়ার্টিসকে দ্বিতীয় পন্থা বেঁছে নিতে হলো: সে তার বোনকে জাদুবলে হত্যা করে, তাকে পানিতে ডুবিয়ে মারে যাতে সে তার দেহ গোপনে ডাইনিদের কাছে বিক্রি করতে পারে।”
আমি আপত্তি করলাম। “তারা তার লাশ খুঁজে বের করে আর কবর দেয়। এমনকি লেয়ার্টিস তার বোনকে শেষবারের মতো দেখতে কবরে ঝাপ দেয়— অর্থাৎ, লাশ কবরের ভিতরই ছিলো। আর হ্যামলেট, ঘটনাস্থলে মাত্রই ফিরে এসে, লেয়ার্টিস এর পরে ঝাপ দেয়।”
“কী বললাম তোমাকে,” প্রবীণ সকলের সুবিবেচনার প্রতি পেশ করলেন, “বোনের লাশ নিয়ে লেয়ার্টিস এর কুমতলব ছিলো। হ্যামলেট তাকে রোধ করলো, কারণ প্রধানের উত্তরাধিকারী, প্রধানের মতোই অন্য কাউকে তারচেয়ে ধনবান ও ক্ষমতাশালী হতে দিতে পারে না। আর লেয়ার্টিস তখন ক্রোধে উপচে পড়বে, কারণ বোনকে মেরেও তার কোনো লাভ হলো না। আমাদের দেশে হলে সে এই কারণে হ্যামলেটকে হত্যার চেষ্টা করবে। এটাই কি হয় নাই?”
“হ্যাঁ কম-বেশি তাই,” আমি মেনে নিলাম, “মহান প্রধান যখন দেখতে পেলেন হ্যামলেট এখনো জীবিত তখন সে লেয়ার্টিসকে প্ররোচিত করে হ্যামলেটকে হত্যা করার জন্য। তিনি তাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধের আয়োজন করেন। যুদ্ধে এক যুবক আরেক যুবকের ওপর মরণাঘাত আনে। হ্যামলেট যদি যুদ্ধে জয়ী হয় সেই ভয়ে প্রধান নেতা তার জন্য বিষাক্ত বিয়ার তৈরি করে রেখেছিলেন। হ্যামলেটের মা সেই বিয়ার পান করে মৃত্যুবরণ করে। মাকে বিষ খেয়ে মরতে দেখে, খোদ মরণরত হ্যামলেট, তার বাবার ভাইকে খঞ্জর দিয়ে হত্যা করতে সক্ষম হয়।”
“দেখেছো, আমিই ঠিক ছিলাম!” প্রবীণ লাফিয়ে উঠলেন।
“এটা একটা ভালো গল্প বলেছো,” বৃদ্ধ বললেন, “আর তোমার বলার মধ্যে ভুলের পরিমাণও কম ছিলো।” শুধু একটা ছোট ত্রুটি রয়ে গেছে, একেবারে শেষে। হ্যামলেটের মা যে বিষ পান করেছিলো সেটা পরিষ্কারভাবে লড়াই থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির জন্য ছিল, সে যে-ই হোক না কেন। কারন লেয়ার্টিস যদি বিজেতা হতো, তাহলে তাকে বিষ দিলে বাইরের আর কেউ জানতে পারবে না যে মহান নেতা হ্যামলেটের মৃত্যুর আয়োজন করেছিলো। আর তাছাড়া লেয়ার্টিস এর জাদুটোনার আছর নিয়েও তার ভয় পেতে হতো না, কারণ নিজের একমাত্র বোনকে জাদুবলে মেরে ফেলতে শক্ত হৃদয় লাগে।
পরনের জীর্ণ টোগা-পোষাক গায়ে জুত মতো জড়িয়ে নিতে নিতে বৃদ্ধ আলাপের ইতি টানলেন,“আবার কখনো তোমার দেশের আরও কিছু গল্প আমাদের শুনিও। আমরা, যারা প্রবীণ, তারা তোমাকে গল্পের সঠিক মানে বুঝিয়ে বলবো। এরপর তুমি যখন নিজ দেশে ফিরে যাবে তখন যেন তোমার দেশের প্রবীণরা দেখে যে তুমি শুধু ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর বসে ছিলে না, বরং তাদের সাহচর্য পেয়েছো যারা জানে এবং তোমাকে জ্ঞানের পথ দেখিয়েছে।”