আকালের সন্ধানে: রূপালী পর্দায় ক্ষুধার উপাখ্যান

[Anthro Circle Presents 1st Anthropological Film Review Competition- এ প্রথম স্থান অধিকার করেছে নিশাত আজাদ ছোঁয়ার লেখা ‘আকালের সন্ধানে: রূপালী পর্দায় ক্ষুধার উপাখ্যান’ রিভিউটি। মৃণাল সেনের বিখ্যাত এই সিনেমাটিকে বেছে নিয়ে নৃবিজ্ঞানের কিছু মৌলিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে এই লেখাটি।]

মৃনাল সেনের সৃষ্টি এই চলচ্চিত্রের ইংরেজি ট্যাগলাইন “In Search of Famine”….

“হেই সামালো ধান হো

কাস্তেটা দাও শাণ হো

জান কবুল আর মান কবুল

আর দেবনা আর দেবনা

রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।।

চিনি তোমায় চিনি গো

জানি তোমায় জানি গো,

সাদা হাতির কালা মাহুত তুমি নও।।

পঞ্চাশে লাখ প্রাণ দিছি

মা-বোনেদের মান দিছি,

কালোবাজার আলো কর তুমি মা।।

মোরা তুলবনা ধান পরের গোলায়

মরবনা আর ক্ষুধার জ্বালায় মরবনা,

ধার জমিতে লাঙ্গল চালাই

ঢের সয়েছি আর তো মোরা সইবনা

এই লাঙ্গল ধরা কড়া হাতের শপথ ভুলবনা।।” 

আকালের সন্ধানের এই অনবদ্য গণসঙ্গীতটি ছাড়া এই মুভি রিভিউয়ের এর চেয়ে ভালো উপক্রমণিকা আর হতে পারতো বলে মনে হয়না। এই গানে আছে নিত্যকার আকালের কারণ, সেইসাথে যাদের রক্ত চুষে খাওয়া হয় তাদের আবারও রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয়। নৃবিজ্ঞানের পাঠক/শিক্ষানবিশ হয়ে থাকলে, দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে অজানা থাকার কথা নয়, তেমনি অজানা থাকার কথা নয় চলচ্চিত্র নিয়ে নৃবিজ্ঞানের আগ্রহটাও। নৃবিজ্ঞানী হর্টেন্স পাউডারমেকার বহু আগে বলেছিলেন যে, চলচ্চিত্রে সেইখানকার সমাজেরই প্রতিচিত্র উঠে আসে। আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে খানিক সুর টানার পর তাই আসুন জেনে নিই, মৃণাল সেনের চোখে দেখা ‘আকাল’র আদ্যোপান্ত আর অতীত-বর্তমান আকালের ফারাক-সাদৃশ্য।  

‘আকাল’, ‘ক্ষুধা’, ‘জীর্ণশীর্ণ’, ‘হাড্ডিসার’ মানুষের অবয়ব বর্তমান সভ্যতায়ও আমাদের খুব পরিচিত। আকালের মুখ দেখতে শুধু সেই আফ্রিকার কিছু দেশ, কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত কিছু দেশের মানুষের চেহারা কল্পলোকে আঁকতে হবে তা নয় বরং উপমহাদেশের ইতিহাস ঘুরে আসলেই ব্যাপারটা পরিস্কার হবে। দুর্ভিক্ষ বা আকালের সাথে এই ভূমির সন্তানদের দেখা হয়েছে বহুবার। তাই আকালের গল্প শিল্প-সাহিত্য, আর সিনেমায় উঠে এসেছে বারেবারে। তেমনি একটি আকাল দর্শনের সুযোগ হবে মৃণাল সেনের অন্যতম সেরা কীর্তি (অত্যুক্তি নয় মোটেও) ‘আকালের সন্ধানে‘। 

চিত্রঃ স্মিতা পাতিলের সঙ্গে ” আকালের সন্ধান” এর সেটে মৃণাল সেন। (ছবিসূত্রঃ Film history pics twitter page) 

প্রকাশকাল– ১৯৮২

দৈর্ঘ্য- ১১৫ মিনিট

কাহিনী– অমলেন্দু চক্রবর্তীর অভিন্ন নামের উপন্যাস অবলম্বনে, মৃনাল সেনের চিত্রনাট্যে

সম্পাদনায়- গঙ্গাধর নষ্কর 

প্রযোজনায়- ডি.কে. ফিল্মস

সংগীত সংযোজনায়- সলিল চৌধুরী 

চরিত্র চিত্রায়ণে- ধৃতিমান মুখার্জি (মুভি ডিরেক্টর), স্মিতা পাতিল (স্বনামে), দীপঙ্কর দে (স্বনামে), দেবিকা মুখার্জি (স্বনামে), গীতা সেন (পুরাতন বনেদী বাড়ির প্রৌঢ়া স্ত্রী), শ্রীলা মজুমদার (দূর্গা, গ্রামের দরিদ্র ঠিকে ঝিঁ), রাজেন তরফদার (হরেন), রাধামোহন ভট্টাচার্য (গ্রামের মাস্টার মশাই), এছাড়াও মনু মুখার্জি, বিপ্লব চ্যাটার্জি, সত্য ব্যানার্জি প্রমুখ। 

কাহিনী সংক্ষেপ-  

‘আকালের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রটিতে একটি মূল কাহিনীর কয়েকটি শাখা-প্রশাখা মিলে কাহিনীর পূর্ণাঙ্গ অবয়ব দাঁড়িয়েছে। এই চলচ্চিত্রে কোনো নির্দিষ্ট প্রটাগনিস্ট কিংবা এন্টাগনিস্টের উপস্থিতি নেই। কাহিনীতে থাকা কোন পক্ষকে এই দুই ছাঁচে ফেলা হবে তা নির্ভর করবে দর্শকের চিন্তার উপর। শাখা প্রশাখার কাহিনীটুকু চরিত্র বিশ্লেষণের বর্ণনাতেই উঠে আসবে। তার আগে প্রথমেই দেখা যাক, কাহিনীর মূল অংশে কি রয়েছে-

এই চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দিক, এর মধ্যে থাকা প্যারাডক্স! সিনেমার ভেতরে আরেকটা সিনেমা, তাও আবার সেইটাও আকাল নিয়েই। এই মুভির কাহিনী আবর্তিত হয় একটি ফিল্ম ইউনিটকে কেন্দ্র করে। যারা ‘হাতুই’ নামক গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হয় তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি সিনেমার শ্যুটিংয়ের উদ্দেশ্যে।

তারা গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে এক ক্ষয়িষ্ণু পুরাতন বনেদি বাড়িতে, ২১ কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ির বর্তমানে ১৭ খানা শরিক। যেখানে আগেকার সময়কার বনেদিয়ানার ছাপ আছে, পরিত্যাক্ত লাইব্রেরীতে আছে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ এর ব্যক্তিগত কালেকশান! কিন্তু এইসব এক্সপ্লোর করবার জন্যে তারা আসেনি, তাই তারা ফিরে যায় তাদের আসল কাজে। 

তোড়জোড় করে শ্যুটিং শুরু হয়ে যায়। পাড়াগাঁয়ের অতিউৎসাহী জনতা শ্যুটিং দেখতে ভীড় করে থাকে। এই ফিল্ম ইউনিটটা পুরো গাঁয়ের মনোযোগের মধ্যমণি হয়ে ওঠে। ফিল্ম ইউনিটের লোকগুলোর কাছে এটি কেবল অভিনয় হলেও, গাঁয়ের মানুষগুলোর কাছে ‘আকাল’ তাদের যাপিত জীবনের অংশ। কেবল তেতাল্লিশ নয়, রোজ রোজ, যুগে যুগে তারা এই আকালের, ক্ষুধার সাথে পরিচিত। হাতুই গ্রামের কিছু অংশ এইসব অভিনয় দেখে যেমন তাদের দুঃখের স্মৃতি তাজা হয়ে উঠতে দেখছে! তেমনি অন্য এক নব্য উচ্চশ্রেনীর মানুষের আঁতে ঘা লাগছিলো, সিনেমাটির শ্যুটিংয়ে আকাল গ্রস্ত হাড্ডিসার মানুষগুলোর জমি-জিরেত পানির দরে কিনতে চাওয়া হবু জমিদারদের বাড়বাড়ন্ত দেখে। 

ছবিঃ তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের বর্ণনায় ধৃতিমান মুখার্জি

  

কিন্তু শ্যুটিংয়ের বিপত্তি ঘটে যখন সিনেমাটির পরিচালক সিদ্ধান্ত নেন তিনি পর্দায় তুলে ধরতে চান যে, আকালের সময় বহু নারী কেবল নিজে ও নিজের পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রাখতে কিভাবে কলিকাতার বাবুদের কাছে পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য হন। এরই মধ্যে এই চরিত্রের অভিনেত্রী, ইউনিটের ম্যানেজারবাবুর সাথে মনোমালিন্যের জের ধরে কন্ট্রাক্ট ভেঙে দিয়ে, শ্যুটিংয়ে ইস্তফা দিতে চলে যান। পরিচালক জেদ ধরেন, এই গাঁয়েরই কোনো মেয়েকে এই চরিত্রে অভিনয় করাবেন। কিছু লোকে আগ্রহ দেখালেও যখনই শোনেন চরিত্রটি একজন পতিতার, তারা গাঁয়ের নারীদের অসম্মানের ধোঁয়া তুলে ফুঁসে উঠতে থাকে। শেষে যখন সমস্ত অসন্তোষ অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত হয় প্রয়োজনে পুলিশি নিরাপত্তায় শ্যুটিং সম্পন্ন করা হবে, তখনই এসে হাজির হন গ্রামের বিবেকখ্যাত মাস্টার মশাই। তিনি গ্রামবাসী আর ফিল্ম ইউনিটের লোক গুলোর মাঝে সমঝোতার দায়িত্ব তুলে নেন। তিনি ফিল্মের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা যেন ফিরে যায়। মাস্টার মশাইয়ের মতে, যুগে যুগে এমন উচ্চ শ্রেনীর শিক্ষিত,  শিল্পবোদ্ধা বুর্জোয়ারা তথাকথিত গাঁইয়া মূর্খ পাড়াগাঁয়ের মানুষদের দাবিয়ে রাখার পায়তারা করেছে, এখন যখন তারা অসন্তোষ প্রকাশ করছে তখন উচিত হবে শ্যুটিং বন্ধ রেখে কলকাতায় ফিরে যাওয়া। অবশেষে তাই হয়। হাতুই গ্রামে ফিল্ম ইউনিটটির ‘আকালের সন্ধান’ অসমাপ্ত রেখে চলে আসতে হয়। 

নির্মাণশৈলী

সিনেমার নির্মাণশৈলী কিংবা সিনেমাবোধ প্রকাশ করবার জন্যে মোটাদাগে যে কয়টি বিষয় (কারো কারো মতে তা ‘Elements of a film’) মাথায় রেখে এই আলোচনা সামনে এগিয়ে যাবে তা হলো- 

১. একদম প্রথমে ও প্রাথমিক বিষয়টি হলো “ন্যারেটিভ”, যেটা ইতোমধ্যে কাহিনী সংক্ষেপেই উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যারেটিভ একটা চলচ্চিত্রের খুঁটিস্বরূপ। এই সিনেমার ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে আকালের উপর নির্ভর করে, শুধুই অতীতের আকাল নয়, বর্তমানের ক্ষুধ-পীড়িত মানুষের নিত্যকার আকালও তাঁর অংশ। এই ন্যারেটিভ বলতে কিন্তু কেবল সিনেমার প্লট নয়, সেটা হতে পারে গল্পের থিম। ছোট বড় নানান প্লট জুড়ে গোটা ন্যারেটিভ-টা দাঁড়ায়। এই সিনেমায় অতীতের আকালের সাথে, বর্তমান হাতুই গ্রামের পেটে-ভাতে বেঁচে থাকা চরিত্রগুলোর জীবনের যোগসূত্র টেনে কয়েকটি প্লটকে জোড়া দিয়ে সেই চেষ্টা করা হয়েছে, ওদের গল্পগুলো ছিলো সাব-প্লট। একটা মোটাদাগের তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আসা ফিল্ম ইউনিটের প্লট, এছাড়াও বাকি সাব-প্লট গুলো নিম্নরূপ–

২.হাতুই গ্রামের জমিদার বাড়িতে থাকা শয্যাশায়ী বৃদ্ধ ও তাঁর প্রৌঢ়া স্ত্রী। যাদের দিন কাটে অতীতের জৌলুস স্মরণ করে। 

৩. বাড়ি বাড়ি ঠিকে ঝিঁয়ের কাজ করা দূর্গা। যার অক্ষম হাত কাটা স্বামী-সন্তানকে টিকিয়ে রাখতে দিন রাত কাজ করেও ভরপেট অন্ন ও বাচ্চার ঔষধটি যোগাড় করে উঠতে পারেনা! তাই সে যখন শ্যুটিংয়ে স্মিতা পাতিলকে দেখে তেমনই এক চরিত্রে অভিনয় করছেন, মিনতি করছেন নিজের বাচ্চাটিকে বাঁচানোর জন্যে, ঠিক তখনই আঁতকে ওঠেন দূর্গা! কারণ অন্যদের কাছে তা নেহায়েত অভিনয় হতে পারে, কিন্তু এটাই তাঁর বাস্তবতা। 

৪. আরেকজন আছেন পৈতৃক সূত্রে কিছু অর্থকরী পাওয়া, মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের চাটুজ্জে মশাই। যিনি মেয়েকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু যেই শুনলেন চরিত্রটি এক নব্য তাঁর পতিতার, সমাজ-সংস্কার মেনে চলা মন বেঁকে বসে। গাল-মন্দ করে পরিচালক ও হরেনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।

৫. হরেন, বাকি গ্রামবাসীদের তুলনায় একটু আলাদা। তাঁর নিজেরও কিছু গল্প আছে, সে নাটকের দল করতো, কখনো কখনো নারীরূপে, কখনো রুশ সেজে। কিন্তু ক্ষুধা আর আকাল তাঁকেও ঘিরে ধরেছিলো, খালি পেটে বিপ্লব হয়না, তাই হরেনের শিল্পী জীবনেরও ইতি টানতে হয়। তাঁর মুখে স্তালিন, লেনিন কিংবা মার্ক্সের নাম শুনে পরিচালকও অবাক হন। তবে তাঁর অতি উৎসাহী স্বভাব সময়েতে বিরক্তিরও উদ্রেক করে, সেটা ফিল্ম ইউনিটের লোক এবং গ্রামবাসী উভয়পক্ষেই। 

৬. মাস্টার মশাইয়ের গল্পটুকুও জরুরি। খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাঁর জীবনবোধ অসামান্য, তিনি গ্রামবাসী আর ফিল্মের দলের লোকেদের মাঝে মধ্যস্থতা করেন। সুদূর কলকাতার উন্নত জীবন ছেড়ে হাতুই গ্রামে মাস্টারি করে জীবন কাটিয়েছেন বটে, তবে গ্রামের গন্ডিতেই তাঁর ক্ষুরধার চিন্তা আটকে থাকেনি, ঘটনা/জীবন/অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করবার নজর তাঁর অসামান্য। 

চিত্রঃ কাহিনীতে মাস্টার মশাইয়ের আগমনের দৃশ্য

২. সিনেমাটোগ্রাফি হলো সিনেমার আরেকটা জরুরি বিষয়। একদম সহজ কথায় বললে এটা হলো “লেখার চিত্রিত রূপ”। ফ্রেমিং, কালার গ্রেডিং, টোনিংয়ের বিচার করতে গেলে আশির দশকের ভিনটেইজ রঙা চলচ্চিত্র যেমন হয় তেমনই, কিন্তু ফ্রেমিংয়ের ক্ষেত্রে আছে যথেষ্ট ডিটেইলিং। পরিচালক যখন কলাকুশলীদের সামনে আকালের ছবিগুলো দেখাচ্ছেন তখন ফোকাসটা ঠিক ছবিতেই থাকছে। কিংবা আটপৌরে গাঁয়ের মাঝবয়েসী নারী যেমন কচুরিপানায় ভরা ডোবায় স্নানে নামেন, পাশে দিয়ে লোকে হেঁটে চলে যাচ্ছে, কিন্তু এইটাও জরুরি ছিলো বাস্তবতার কাছাকাছি যাওয়ার জন্যে।

ছবিঃ The Starving Buddha ভাস্কর্যের ছবির ফ্রেমিং

৩. তৃতীয় বিষয় হচ্ছে Mise-en-scène, এর দ্বারা বোঝায়, যা কিছু ফ্রেমে ভেসে ওঠে। সেট ডিজাইন থেকে শুরু করে, অভিনেতাদের পজিশনিং, চারপাশের পরিবেশ। আকালের সন্ধানে-তে যেহেতু ফিল্ম উইদিন ফিল্মের কনসেপ্ট রয়েছে, তাই সেটআপও ছিলো একটা সত্যিকার শ্যুটিং স্পটের মতো। চারধারে অতিউৎসাহী জনতার ভীড়, অন্যদিকে ক্যামেরা ঘুরে চলেছে, ডায়ালগ ডেলিভারির সময় সবার পিনপতন নীরবতা। এইসব কিছুই আকালের সন্ধানে দৃষ্টিগোচর হয়। 

এইবার আলোচনা মোড় নেবে এর সবচেয়ে জরুরি বাতচিতের দিকে, নৃবিজ্ঞানের লেন্স দিয়ে এই মুভিটিকে কিভাবে দেখা যায় সেদিকে।

এছাড়াও, চলচ্চিত্রের কাহিনীর ভাব বুঝে আবহ সংগীত, শব্দও জরুরি। সেটি এই চলচ্চিত্রেও ব্যত্যয় ঘটেনি। 

নৃ-ভাবনা 

একদম প্রথমেই যা আলোচ্য তা হলো, ‘Representation’-এর এক বড়সড় আইরনি! কেননা, যাদের জীবনের গল্প সেলুলয়েডের ফিতায় তুলে ধরার জন্য হাতুই গ্রামে সিনেমার লোকেরা যায়, তারা কলকাতার শিক্ষা-প্রাচুর্য্য, জৌলুসে বাস করা শহুরে দাদা। তারা পেটের ক্ষুধা কি তা জানেনা, গ্রামের একটা মানুষের কাছে ক্ষুধার কি মানে তাও তারা জানেনা। তবে সমস্যাটা হলো তারা ডকুমেন্টস পড়ে, ইতিহাস পড়ে, মোটকথা জ্ঞানের পুঁথিগত রূপটা দেখেই ধরে নিয়েছে ‘আকাল’ কি সেটা তারা খুব ভালো জানে। এই যে একটা পেটে-ভাতে বেঁচে থাকা শ্রেনীর গল্পের রিপ্রেজেন্টেসনের গুরুভার কিংবা হক একটা বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে! 

আইরনিটা বুঝতে হবে কয়েকটি ঘটনা দিয়ে- 

এক. এক হাড়জিরজিরে বুড়ো সিনেমার প্রথম সংলাপটি উচ্চারণ করেন- 

“বাবুরা এসেছেন আকালের ছবি তুলতে,

আকাল তো আমাদের সর্বাঙ্গে…!” 

চিত্রঃ সিনেমার প্রথম উচ্চারিত সংলাপ 

দুই. ম্যানেজার জয়ন্ত বাবু “আকালের সন্ধানে” এর কলাকুশলীদের প্রথম দিনের মেন্যু ঠিক করে দিচ্ছিলেন, ফ্রাইড রাইস আর চিকেন! 

অর্থাৎ, যে মানুষেরা খেতেই পায়না তাদের গল্প বলা হবে সুস্বাদু খাবার পেটে নিয়ে! আসল জীবনবোধে কি করে আসা করা যায়? 

তিন. এক ব্রাহ্মণ নারী পেটের ক্ষুধায় সদ্য পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত হয়েছে সেই দৃশ্যের জন্যে অভিনেত্রী দেবিকা হাজির হন ভ্রু-প্লাক করে, চুল কেটে! অর্থাৎ, যে নারীদের গল্প সে পর্দায় ফুটিয়ে তুলবে, সেটার জন্যে সে তাঁর শহুরে নায়িকাসুলভ আদবকেতায় কোনো পার্থক্য করতে নারাজ। সে নায়িকা বটে, পাঁকা অভিনেত্রী হয়তো নন। এইযে নিজের ধরাবাঁধা সামাজিক অবস্থান ভুলে অন্যের জীবন আপন করে নেবার দ্বিধা সেটা লক্ষ্যনীয়। 

চার. হরেনের দেয়া তাঁর পরিবারের অবস্থার বিবরণটায় একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া জরুরি। পরিচালক ধৃতিমান যখন গ্রামে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সেখানকার মানুষদের দেখছিলেন, তখন তাঁর দেখা হয় হরেনের সাথে। হরেনের পরিবার তাঁতশিল্পের সাথে যুক্ত। সে বলে এতে করে এখন আর পেট চলেনা, উপাদানের দাম অনেক বেশি, তাও তাঁরা এই কাজ করেই দিন গুজরান করছে। না তাদের দারিদ্র্য মিটছে, না তারা এই কাজ ছেড়ে অন্য কিছু করতে আগ্রহী হচ্ছে। এইযে এক দারিদ্যের জীবনে বংশ পরম্পরায় আবদ্ধ হয়ে যাওয়া। এটা অনেকটা সেই দারিদ্রের সংস্কৃতির মতো,  যেটার কথা অস্কার লুইস বলে গেছেন। যদিও এ নিয়ে বিস্তর বিবাদ, বিতর্ক করাই যায়। তবে প্রাথমিকভাবে হরেনের পরিবারের দশাটি এই কাতারে ফেলাই যায়। 

চিত্রঃ পরিচালককে নিজের অবস্থা বর্ণনা করছেন হরেন

পাঁচ. মাস্টার মশাইয়ের আগমন থেকে শুরু করে তাঁর সংক্ষিপ্ত স্ক্রিনটাইমের পুরোটাই খুব অর্থবহ। শেষে যখন ফিল্ম ইউনিটের লোকেদের কাছে গ্রামের মানুষের হয়ে তিনি সমঝোতা করতে গিয়ে বললেন, 

“চিরটাকাল আপনারা ওদের ওপর নিজেদের চাপিয়ে দিয়ে এসেছেন,

নিজের শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে,

সামাজিক কৌলিন্য দিয়ে, 

ওরা কেনো সহ্য করবে?” 

এইযে কুলীন বাবুদের মুখের ওপর অবদমিত মানুষগুলোর কথা কেউ এসে বলে দিয়ে গেলো, এ সম্ভব হয়েছে তাঁর বিদগ্ধ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থেকে। দুটো শ্রেনীর জীবন সমন্ধেই যার গভীর জ্ঞান আছে, তবে বাবুদের সাথে তাঁর জ্ঞানের ফারাক হলো তিনি সেটা শুধু পুঁথি পড়ে পাননি, উনি নিজে দুইদলের মানুষের মাঝে তাদেরই একজন হয়ে বাস করেছেন। যেমনটা হয়তো একজন নৃবিজ্ঞানীও করবার চেষ্টা করেন, যার প্রাতিষ্ঠানিক নাম “Participant Observation” বা “অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ”। 

ছয়. স্মিতা পাতিল দূর্গার বাচ্চা অসুস্থ হওয়ায় ছুটি নিতে বলেন। তাঁকে এই ছুটির দিনের পুরো সাতটাকা মাইনেও দেন। কিন্তু দূর্গার স্বামী সিনেমার লোকেদের জন্য কাজ করতে না দেয়ায় হত-দরিদ্র দূর্গা টাকাটা স্মিতাকে গিন্নিমার হাতে করে ফিরিয়ে দেন। উত্তরে জানায়, কাজ না করে সে টাকা নেবেনা! 

চিত্রঃ গিন্নিমার হাতে করে টাকা ফিরিয়ে দেয় দূর্গা

স্মিতা দূর্গার ন্যায়বোধ আর আত্নসম্মান দেখে অভিভূত হয়ে কেঁদে ফেলেন। একজন দরিদ্র গেঁয়ো ঝির এই সততা সে আশাই করেনি বোধহয়। এইখানেই দেখা যায় একই ভূমিতে বাস করা সত্বেও সবাইকে জানতে না পারার ফাঁক ও নিজের গন্ডি বাদে সকলকে ‘অপর’ ধরে নেবার স্বভাব। 

এই মুভিটির কাহিনীতে থাকা ফিল্মের লোকেরা ‘অপর” কে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। আর যদি তাদের রিপ্রেন্টেসনকে বুঝতে হয় তবে স্টুয়ার্ট হলের মত করে বলতে হয়- 

“Representation is the ability to describe or imagine”. 

এই Imagine আর Describe এর কর্তৃত্বটা কাদের হাতে তা লক্ষনীয়। বলা বাহুল্য, আকালের সন্ধানে দেখা যায় সেটি উচ্চশ্রেণীর শিল্পবোদ্ধাদের হাতেই ন্যস্ত। এইখানেই আসল প্রশ্নটা, কার জীবনের গল্প কারা এসে বলে যায়! 

আকালের সন্ধান এ যুগেও চলমান। ক্ষিদের জ্বালায় আজও অসংখ্য মানুষ তাঁর পাকস্থলীতে অনুভব করে রোজ কেয়ামত। পাঠকগণ নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেননা, অনাহার আর আকালের মত ধ্রুব সত্যি আর কিইবা আছে? 

স্থিরচিত্রসমূহের সূত্র: YouTube