বই রিভিউ: নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমগ্র

[‘নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমগ্র’ বইটির রিভিউ লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন]

ভূমিকা

আগে বলে নেই, আমি নৃবিজ্ঞানের ছাত্র নই, পড়াশোনা করি প্রকৌশলবিদ্যায়। তবে, ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য, দর্শন ও তার কাছাকাছি বিষয়গুলো নিয়ে সবসময় আগ্রহ ছিল। এইজন্যই ‘নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমগ্র’ বইটা বের হওয়ার পর কিনে ফেলি। বইটি পড়ার পর এটি নিয়ে লেখার ইচ্ছা হয়েছে, এই কারণে যে আমাদের এখানে ভালো কাজের কদর খুব কম লোকই করতে চায়। যাই হোক, বলে রাখি, আমার এই রিভিউ মূলত তিনটি চ্যাপ্টারকে কেন্দ্র করে। যেহেতু বইটি সাইজে বিশাল, প্রায় ৬০০ পেইজ, তাই পুরো বইয়ের উপর আমি কিছু বলছি না। 

‘নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমগ্র’ বইটা শুরু হয়েছে আর দশটা বইয়ের মতই। মুখবন্ধ দেখে অনেকেই পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চলে যায়, তবে এ বইটার মুখবন্ধ না পড়লে অনেক কিছু মিস যাবে।মুখবন্ধ আর ভূমিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞানের চর্চার সংকট নিয়ে লেখকদের নিজস্ব কিছু মতামত। ভূমিকায় তারা বইটির কাঠামো দিয়েও কথা বলেছেন। আপনার ধৈর্য্য এখানে কাজে আসবে।

‘নৃ’ মানে মানুষ৷ লেখাটা আপনি যেহেতু পড়ছেন,আপনি মানুষই হবেন৷ এ.আই হতে পারেন, সেক্ষেত্রেও আপনি লাভবান এবং বলতে চাই কিপ রিডিং। আপনার ডাটা-বেইজ যথেষ্ট সমৃদ্ধ হবে। মানুষ

নিয়ে আপনার আমার ধারণা কতটুকু? মানুষ নিয়ে আমাদের সবার ধারণা আমাদের চারপাশে এদের কাজকর্ম দিয়েই৷ কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয় সেটা নিশ্চিত। সে জন্যই মানুষকে বোঝা ও জানার ক্ষেত্রে মানুষ নিয়ে পড়াশোনার একটা কার্যকারিতা আছে। মানুষ নিয়ে আমার আগ্রহ থাকায় নৃবিজ্ঞান -এর খোঁজ পেতেই হতো, পেয়েছিও। কিন্তু বাংলা ভাষায় এ শাখায় লেখা বই একদমই হাতে গোনা । নৃবিজ্ঞানের থিওরির উপর তো দূরের আলাপ৷ তাই বেশ নড়েচড়ে পড়া।

পাঠক হিসাবে আমি বই পড়ার ক্ষেত্রে যতটা খুতঁখুতে তার চাইতে অলস। আর থিওরির বই হলে তো শ্যাষ।  বাংলা ভাষায় খুব কম থিওরির বই পড়েছি দাঁত ভাঙ্গার ঝুঁকি ছাড়া। থিওরি যে কঠিন জিনিস, এতে সন্দেহ নাই। তবে কঠিনরে আরো কঠিন করে লেখা কিংবা বলা যায় ‘আউলা’ করে লেখা- সেটা বড় সমস্যা নিশ্চয়ই। সেক্ষেত্রে এই বইটা থিওরি লেখার ঝামেলা উৎরে যেতে পেরেছে। হ্যাঁ পাঠক (বিজ্ঞাপনের ভঙ্গিতে!), এই বই পড়ে আপনার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করবে না, তাই দুর্মূল্যের বাজারে বাড়তি তেল খরচের ঝক্কি নাই। 

আঠারো অধ্যায়ের এ বইটিতে ১৩ টি নৃবৈজ্ঞানিক থিওরিটিক্যাল ধারার আলাপ আছে৷ এরমধ্যে তাত্ত্বিকের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। বিজ্ঞানের ছাত্র  এবং গণিতপ্রেমী বলে গুনেও দেখেছি, তাত্ত্বিকের সংখ্যাটা আসলে ৫৯।  বইটির ‘ভূমিকা’ দু’পাতায় শেষ হয়ে যাবার পরই ‘নৃবৈজ্ঞানিক পূর্বপাঠ’র ৩৬ পৃষ্ঠা শেষ করি। পূর্বপাঠের উপর একটু কথা বলে নেই। 

নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমগ্রের প্রচ্ছদ

নৃবৈজ্ঞানিক পূর্বপাঠ

নৃবিজ্ঞানের চিন্তাধারারটা বুঝতে হলে এর উদ্ভবের ইতিহাসটাও জানা দরকার৷ লেখকত্রয় এ ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ভাবে চেষ্টা করেছেন— নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসটিকে আগে নিয়ে আসা। কেবল তারিখ সালের বন্যা বয়ে যায়নি এখানে। বরং আপনাকে নিয়ে যাবে সুপ্রাচীন গ্রিসে৷ গ্রিক সভ্যতার তিনটি স্তরকে বিশদ তুলে ধরার মাধ্যমে পরবর্তী সময়গুলো এগিয়ে আসে। আমরা দেখতে পাই মানুষ নিয়ে গবেষণার এই শাখাটি তখনও ভ্রুণ অবস্থায়৷ পরবর্তীতে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে এসে নৃবিজ্ঞানের জন্ম ও বিকাশের আলাপ টানার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বিষয় বারবার উঠে এসেছে, তা হলো মানুষের মানুষকে জানার ক্ষেত্রে ‘আমি’ ও ‘তারা’র  (Us and Them) যে দ্বন্দ্ব ৷ ঐসময়ের কাজগুলোতে তাই নিজেকে দিয়ে অন্যকে মাপার ঝোঁকটাও ছিল বেশি। এরপর মধ্যযুগ হয়ে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন থেকে ইউরোপের বহির্বিশ্বে গমন-এসবের মধ্যে দিয়ে নৃবিজ্ঞান শাখাটির জন্মলগ্ন আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে। 

নাহ, এতেই পূর্বপাঠ শেষ হয়ে যায়নি। ইউরোপের এনলাইটমেন্ট,রোমান্টিকবাদ, উপনিবেশবাদ, শিল্পবিপ্লব- এর মত ঐতিহাসিক স্রোতের নদীতে জলপান করেছে এই নৃবিজ্ঞান। এভাবে  বেড়ে উঠেছে নৃবিজ্ঞানের ভান্ডার। 

প্রতিটি জ্ঞানের শাখা মানুষ নিজের হাতে নির্মাণ করেছে,আর মানুষ নিজেরা ইতিহাসের অংশ কিংবা ইতিহাসই মানুষের তৈরি। কিন্তু সে ইতিহাস যখন উঠে আসে পাতায়, তাও লিখছে মানুষ নিজে। তাই সেই ‘আমরা-তারা’ রেষারেষিতে ইতিহাস যেমন সঠিক ভাবে লেখা হয়না। তেমনই ইতিহাসের গতিপথে আমরা দেখি মানুষের সম্পর্কে মানুষ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মতামত দিয়েছে বিভিন্ন৷ সেসব ভিন্নমতগুলি সেইসব মনীষিদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন দ্বারা প্রভাবিত ছিলো৷ লেখকদের ভাষায়, “নৃবিজ্ঞানে ইতিহাস দর্শনের বীজ নিহিত— যদিও পদ্ধতি গত জায়গায় নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাসের স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে৷ ইতিহাসের যেমন প্রধাণ চরিত্র হলো অতীতকে ধারণ ও বর্ণনা,অন্যদিকে নৃবিজ্ঞানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তির মূলে রয়েছে স্থান ও কালভেদে কীভাবে স্থানিক ও বৈশ্বিকভাবে মানবজাতির জীবণপ্রণালী বিন্যস্ত করা যায়৷ “

নৃবিজ্ঞান এভাবে এগিয়ে গেছে সেই ছোটবেলার সাপ খেলার মত, সাপটা খাচ্ছে ও বেড়েই চলছে চলছে,সাপের মাথা যতই বড়ো হচ্ছে, সে তত তার লেজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু লেজ ছাড়া কি মাথা চলবে? নৃবিজ্ঞানের বিকাশের গল্পটা এমনই৷ এর থিওরি গুলো গুহা থেকে শুরু করে মরুতে দপদপা আগুন গরমে বসে লেখা ইবনে খালিদুনের হলুদ পাতাকে গিলতে গিলতে এগিয়ে গিয়েছে কান্টের মতন পায়চারি করা দার্শনিককের বারান্দাতে।

সাপের খেলাটির মতন,নৃবিজ্ঞানের থিওরিগুলোর বিকাশের ক্ষেত্রে,নিজের লেজে কামড় দেয়ার মত অঘটন কি ঘটেনি? ঘটেছে। আমরা দেখেছি বহু সময় এমন চিন্তাও এসে পড়েছে যেটা জ্ঞানের নামে আধিপত্যকে কায়েম করেছে৷ কখনো দেখেছি একটি চমৎকার থিওরি যা কিনা এসেছে মানুষকে বোঝার জন্য, সেটি পরে কাজে লেগেছে মানুষের জীবনকে আরো বিষাক্ত করতে। এমন সব চড়াই-উত্রাই পার হতে হয়েছে নৃবিজ্ঞানকে। 

এ বইটা পড়তে যেয়ে আমি নৃবিজ্ঞান নিয়েই যে জানলাম,বা এর থিউরি বা ইতিহাসই জানলাম তাতো নয় বরং একজন “চিন্তক/লেখক” হিসাবে বইটি আমার নজরকে করে তুলেছে শার্প, কেননা নিজের লেজেই কামড় বসিয়ে তো নিস্তার নেই৷ আমরা দেখতে পাই থিওরি গুলোর পরস্পর বিরোধিতা ও পরবর্তীতে এর সংস্কার। এ ক্রমবর্ধমান সংস্কারই নৃবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার গতিপথ তৈরি করেছে।  

নৃবিজ্ঞান বইটি অনান্য যেকোনো থিউরির বই থেকে মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে,তা হচ্ছে থিউরি পড়ানো ক্ষেত্রে থিউরির প্রেক্ষাপট আলোচনা ও একটি থিওরি গঠনের সময় থিওরিতে যে প্রচুর ভাঙ্গাগড়া হয়, সীমাবদ্ধতা গুলো যথাসম্ভব কাটিয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া সেটাও উঠে এসেছে বইতে ।খুব স্মুথলি প্রেক্ষাপট থেকে থিউরির উপর আলোচনায় মোড় নিচ্ছিলো৷ যা একজন পাঠককে থিউরিগুলো বুঝতেই সাহায্য করেনি,নতুন থিওরি গুলোকে কিভাবে গ্রহণ করবে তার জন্যও একটা পথ তৈরি করেছে। 

বিবর্তনবাদ 

আমি এখন আমার পছন্দের অধ্যায়, বিবর্তনবাদ নিয়ে একটি আলোচনা করবো। 

বিবর্তন শব্দ দিয়ে আমরা কোনো কিছুর পরিবর্তন বুঝে থাকি। জৈবিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে সেটি দিয়ে বুঝানো প্রাণের সরল রূপ থেকে জটিল রূপে পরিবর্তন বুঝানো হয়।অন্যদিকে নৃবিজ্ঞানে প্রভাবশালী ছিল সামাজিক বিবর্তনবাদের তত্ত্ব। এটি মনে করতো প্রাণের মতো সমাজও সরল রূপ থেকে জটিল রূপে আসে। তবে, ‘নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমগ্র’ বইতে দেখানো হয়েছে, জৈবিক বিবর্তনবাদ আর সামাজিক বিবর্তনবাদ দুইটি পুরোপুরি এক বিষয় নয়। এই দুইটিরই ভিন্ন পথ আছে উদ্ভব ও বিকাশের। এখানে যুক্তি দেখানো হয়েছে, সামাজিক বিবর্তনবাদ মূলত এসেছে স্পেন্সারের হাত ধরে। স্পেন্সার তত্ত্ব আবার ছিল অনেকটাই ল্যামার্কিয়ান। বইটির এই অংশটি না পড়লে এই ব্যাপারটা কখনোই জানা হতো না। জৈবিক বিবর্তনবাদের সাথে সামাজিক বিবর্তনবাদের এই পার্থক্যটা খুবই জরুরি মনে হয়েছে নৃবিজ্ঞানকে বুঝার জন্য। 

বইটির সূচিপত্র

দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরেকটি দিক হলো, সামাজিক বিবর্তনবাদের ধারনা কিভাবে পরবর্তীতে বর্ণবাদ ও উপনিবেশের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে সেটি উঠে এসেছে এখানে। প্রগতির ধারনাকে কেন্দ্র করে দেখানো হয়েছে ইউরোপের তথাকথিত ‘জটিল’ সমাজগুলোই জাতি হিসেবে উন্নত, আর বাদবাকিরা এখনো উন্নত না। এই বইটিতে বারবার এটাই উঠে এসেছে যে, জ্ঞান ক্ষমতার বাইরের কোন শুদ্ধ বিষয় না।  

এই অধ্যায়ে আলোচিত টাইলরের কাজগুলো ১৯০০ সালের আগেই সংস্কৃতিকে নৃবৈজ্ঞানিক ঢংয়ে দেখার চল শুরু করেছিল। টাইলরের কাছে যে বড় সমস্যা ছিল, সেটা হলো সব মানুষ যদি একই উৎস থেকে আসে তাহলে তাদের মধ্যে কেন পার্থক্য থাকবে? টাইলর মনে করতেন মানসিকতার দিক দিয়ে সকল মানুষ এক হলেও তাদের মধ্যে বিকাশের পার্থক্য আছে, যার কারণে তাদের সাংস্কৃতিক রূপটাও ভিন্ন ভিন্ন। তবে এটি করতে গিয়ে তিনিও পড়েছিলেন বর্ণবাদের ফাঁদে ভেবেছিলেন বিকাশের পথে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রাই সবচেয়ে উচ্চাসনে আসীন। 

বিবর্তনবাদের অধ্যায়ে এরপর উঠে এসেছে টাইলর, ফ্রেজার আর স্পেন্সারের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ। এখানে ফ্রেজারের কাজের মধ্যে জাদু, ধর্ম আর বিজ্ঞানের যে তফাত, এবং কিভাবে একটি থেকে আরেকটির আবির্ভাব ঘটেছে, এই অংশটা আমার কাছে সবিচেয়ে ফ্যাসিনেটিং লেগেছে। যদিও ব্যাপারটি অনেক সমালোচিত। 

মানুষের আত্মীয়তার সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন মর্গান, নৃবিজ্ঞানে যাকে আবার বলে জ্ঞাতিসম্পর্ক।  মর্গান নিয়ে এখানে আলোচনা বেশ দীর্ঘ হয়েছে। মর্গানের ‘এনসিয়েন্ট সোসাইটি’তে থাকা আলাপগুলোকে কি সুন্দরভাবে উপস্থাপন সম্ভব,তা এ বই না পড়লে বুঝতামই না৷ এ বইটার একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম আগে। অভিজ্ঞতা ভালো ছিলনা।

এভাবে বিবর্তনবাদের অধ্যায়ে নৃবিজ্ঞানের প্রভাবশালী সব বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিকের কাজই উঠে এসেছে। একইসাথে উঠে এসেছে তাদের নিয়ে বিস্তর সমালোচনা। এই বইটির একটি চমৎকার ব্যাপার হলো লেখকরা সবসময় আলোচনার ঢংয়ে একেকটি লেখা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। যে কারণে মনে হয় পড়ার সময় আমি লেখকদের সাথেই আড্ডা মারছি। 

নারীবাদী নৃবিজ্ঞান

এবার আমি চলে যাবো ‘নারীবাদী নৃবিজ্ঞান’ চ্যাপ্টারে। তো এতক্ষণ যা বলছিলাম, একবারও কি সমাজ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ‘নারী’র কথা মাথায় এসেছে? দোষটা আপনার না কেবল, পুরো নৃবিজ্ঞানের। নৃবিজ্ঞানের প্রথমদিকটা ছিল মূলত পুরুষের চোখে দেখা। নারীবাদ এসে সেখানেই প্রশ্ন তুললো। 

ইলিয়ানর লিকক একজন নারীবদী এবং নৃবিজ্ঞান যার থিসিসের বিষয় ছিল আদিবাসী ইন্নুদের জমির ভাগ-বাঁটোয়ারা এবং শিকার অঞ্চলের ভাগ নিয়ে। এই গবেষণা  তার পরবর্তী কাজগুলোর ভিত রচনা করেছিল।  পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট ধাঁচের সমাজের নমুনাও তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে জীবিকার সাথে সম্পর্কিত বস্তুগুলো গোষ্ঠীগত সম্পত্তি হিসাবে ছিলো। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী সমাজগুলোতে যে একধরনের সাম্যবাদের প্রচলন ছিল এবং পরবর্তীতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কারণে সেখানে বৈষম্যের শুরু হয় সেটা তিনি দেখিয়েছেন।  শিকারি সমাজকে ঘিরে আমাদের যে পিতৃস্থানীয় ধারণা,তাও তিনি খতিয়ে দেখে জানান  যে মাতৃস্থানীয় শিকারী সমাজও বিরাজমান।  লিকক পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে আদর্শ মনে করা এবং সকল সমাজে এই তন্ত্রই প্রচলিত ছিল বলে ধারণা করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই, সেটা হলো সমাজের যেকোন কাঠামোই আসলে ঐতিহাসিক ঘটনার ফলাফল। মানবসমাজ শ্রেণীতে ভাগ হওয়ার পূর্বে  নারীর ক্ষমতার স্বরূপ এবং পরবর্তীকালে  উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের কবলে পরে নারীর সেই ক্ষমতা ও স্বাধিকার লোপ পাওয়া নিয়েও তার কাজে উঠে আসে।

লিকক  ক্রিটিকাল রিফ্লেক্সিবিলিটিও নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু এর মানে কি? এর মানে হচ্ছে মানুষ যখন গবেষণা করছে মানুষ নিয়ে, কিন্তু গবেষক নিজেই যেহেতু মানুষ তাই তার গবেষণায় কিন্তু তার লিঙ্গ, ধর্ম কিংবা মতাদর্শের প্রভাব পরে। একে আমলে নেওয়াই এটাই ক্রিটিকাল রিফ্লেক্সিবিলিটি। তিনি গবেষকদের এই নিয়ে সচেতন হওয়ার জন্য কাজ করেন এবং রাজনৈতিক ময়দানে তার গবেষণার ভিত্তিতে অবস্থান নেয়ার কথা বলেন। 

আরেক নারীবাদী নৃবিজ্ঞানী স্যালি স্লোকাম নৃবিজ্ঞানে পুরুষ পক্ষপাত নিয়ে কাজ করেন।স্যালি তিনি নৃবিজ্ঞানীদের পুরুষ পক্ষপাত নিয়ে কথা তোলেন  এবং নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কিভাবে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পায় সেটি তুলে ধরেছেন।  আমি মনে করি এদেশের প্রেক্ষাপটে এ ‘বোঝাপড়া’টা মানুষের জন্য জরুরি। 

তিনি দেখান Y ক্রোমোজমের সাথে বুদ্ধিমত্তার  সম্পর্ক নাই। শিকার করতে যখন পুরুষেরা যেতো,নারীরা তখন কি করতো? প্রথম হাতিয়ার কারা বানিয়েছিল? প্রথম পরিবার গঠন হয়েছিলো কিভাবে ভেবে দেখেছেন? স্যালি নিজেকে নারী এবং রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে ওঠার মাধ্যমেই এ প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন।

নারীদের নারী বিষয়ক নৃবৈজ্ঞানিক প্রশ্নগুলি তৈরির ক্ষেত্রে নারীদের রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে ওঠার জন্য আহ্বান করেন। সব মিলিয়ে পুরুষের চোখে দেখা নৃবিজ্ঞানের উৎপাদন করা জ্ঞানকে স্যালি প্রশ্ন করেন। ঠিক এরকম কাজই করেছিলেন মুসলিম নারীদের বিষয়ে ‘লিলা আবু-লুঘদ’ নামে একজন নারীবাদী নৃবিজ্ঞানী। তবে সেখানে পুরুষ পক্ষপাতের স্থলে বসতে পারে পশ্চিমা বিশ্ব ও নারীর স্থলে ‘মুসলিম নারী।’

লিলা আবু-লুঘদের কাজ নিয়ে বলেই এই রিভিউ শেষ হবে— তার নারীবাদী কাজগুলোতে মুসলিম নারী বিষয়ক আলোচনা আসে,আমার দারুন লাগছিলো পড়ে। ২০১৩ সালে বের হওয়া তার একটা বই “Do Muslim Women need savings?”  বেশ আলোচিত।  ‘Do Muslim Women need savings?’ বইটার ৬টা অধ্যায় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ছিলো এখানে।  এখানে দেখানে হয় পশ্চিমা বিশ্ব যখন মুসলিম নারীদের নিয়ে কাজ করে, তখন তাদেরকে শুধুমাত্র ‘পরাধীন’ এবং ‘নির্যাতিত’ হিসেবে দেখানো হয়। দেখানো হয় যে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের কোন এজেন্সি নেই। কিন্তু লিলা তার নিজের কাজের মাধ্যমে এই বক্তব্য একপেশে, এবং এসবের পেছনেও কাজ করে একধরনের পক্ষপাত। লিলা আবু-লুঘদের এই আলোচনাটি আমার পশ্চিমা নারীবাদ সম্পর্কে কিছু দিক দিয়ে চোখ খুলে দিয়েছে। 

লিলার কাজগুলো ইসলামিক সমাজে নারী স্বাধীনতার ব্যপারে পুনর্বিচার ও বিনির্মাণ করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। 

এই বইটিতে শেষদিকে উঠে এসেছে শেরি অর্টনার আর জুডিথ বাটলারের কাজ। দুইজনই দুই ঘরানার তাত্ত্বিক। একজন কাজ করেছেন প্রতীক নিয়ে, আরেকজন করেছেন জেন্ডারের ধারনাকে বিনির্মাণ করার ক্ষেত্রে। ‘নারীবাদ’ অধ্যায়টিতে এভাবে বিভিন্ন ধারার তাত্ত্বিকদের বিভিন্ন ধরনের মতামত উঠে এসেছে। প্রত্যেকের মতামতই নৃবিজ্ঞানের মৌলিক কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, পালটে দিয়েছে অনেক উত্তরের ধরনকেও! 

যাই হোক, আমি আসলে খুব একইটা রিভিউ লেখার লোক না। অনেকক্ষেত্রেই হয়তো অধ্যায়গুলোর সামারি দিয়েই বুঝানোর চেষ্টা করেছি কী দারুনভাবে লেখা হয়েছে এই বইটি। সে প্রমাণ পেতে অবশ্য পুরো বইটি পড়া ছাড়া উপায় নেই!