দর্শনের মানসচক্ষে মানুষ ভাবনা

[লেখাটি লিখেছেন এসভি আনোয়ার আহমেদ চৌধুরী আনিকা ফারাহ]

দর্শন শাস্ত্রের অন্বেষণে কিংবা তার বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত আলোচনায় অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মন, জগৎ, জীবন, মানুষ, মানুষের সমাজসহ বিভিন্ন সাধারণ ও মৌলিক ধারণাগুলো গুরুত্বের সাথেই জায়গা পায়৷ এগুলোকে আমরা বিমূর্ত (abstract) ধারণা হিসেবেও বুঝে থাকি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ফেলি। অনেকে আবার দর্শনকে “Guess work”এর আওতায় ফেলেও জগতকে দেখতে-বুঝতে চান, যদিও কেবল অনুমান নির্ভর ধারণা থেকে এককভাবে দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ কম।

অন্যদিকে, নৃবিজ্ঞান এসব বিমূর্ত ধারণা নিয়ে কাজ করলেও সেখানে বাস্তব অভিজ্ঞতা, বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, প্রয়োগিক দিক ইত্যাদি বিষয়াদি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। নৃবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ –Anthropology; এটি ánthrōpos ও lógos এই দুটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। ánthrōpos শব্দের অর্থ ‘মানুষ’ আর lógos শব্দের অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। অর্থাৎ শব্দের উৎপত্তিগত জায়গা থেকে Anthropology হচ্ছে মানুষ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। অনেক নৃবিজ্ঞানী একে আবারHuman Science ও বলে থাকেন, যার কেন্দ্রেই রয়েছে মানুষ।

এই “মানুষ” ধারণাটিকে ইতোমধ্যে নৃবিজ্ঞান, দর্শনসহ বিভিন্ন শাস্ত্রীয় উপায় ও পদ্ধতিতে ফেলে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে কি না মানুষকে মূর্ত, বিমূর্ত উভয় অবস্থান থেকেই দেখা হচ্ছে এবং এই বাইনারি অবস্থানকে ছাপিয়েও বিচিত্র সব দেখার চোখ তৈরি হচ্ছে। মানুষ বোঝাবুঝিতে দর্শনের অন্যতম কায়দা কিংবা পদ্ধতিগত (Methodological) জায়গাটাকে যদি বিমূর্ত ধরি, সেক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানকে বলা যায় মূর্ত। নৃবিজ্ঞানের পদ্ধতি মাঠকর্ম নির্ভর এবং কখনো কখনো তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও গ্রহণ করে। নৃবিজ্ঞানীরা কেবল মানুষ ধারণার বিমূর্ত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, মানুষের প্রতিদিনকার বাস্তব জীবনে অর্থাৎ তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে মানুষ সম্পর্কিত বুঝাবুঝিটা কিভাবে কাজ করছে সেটাও তারা বোঝার চেষ্টা করেন।

একটা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটাকে আরেকটু খোলাসা করা যায়। মানুষ, মানুষের আত্মসত্তা এই ধারণাগুলোর সাথে মানুষের কর্তাসত্তা (Agency) এর ধারণাও সম্পর্কযুক্ত। প্রাথমিকভাবে Agency একটি বিমূর্ত ব্যাপার। একে দর্শন পাঠের একটি অন্যতম ক্ষেত্র ধরা হলেও নৃবিজ্ঞানসহ সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাগুলোতেও Agency এর আলোচনা আসে। যেমন – আমরা যদি ঢাকার একটি এলাকার হিজড়া সংস্কৃতির মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কর্তাসত্তার প্রশ্নে কোন নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাই, সেক্ষেত্রে এজেন্সি কেবল বিমূর্ত হিসেবেই থাকছে না, পাশাপাশি তার একটা মূর্ত অর্থাৎ বাস্তব রূপায়ণও তৈরি হচ্ছে। এটাকে আমরা Empirical Engagement বলে থাকি।

যাই হোক, শুরুতেই এই আলাপ দেয়ার উদ্দেশ্যটা হচ্ছে “দর্শনের মানসচক্ষে মানুষ ভাবনা” শিরোনামে এই লেখাটিতে আমরা যা আলোচনা করতে যাচ্ছি, সেটা আপাতত দর্শনের জমিনে দাঁড়িয়ে, দর্শন শাস্ত্রের পদ্ধতি ব্যবহার করে করলেও আমরা সেখানে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না, আমরা এই দার্শনিক ধারণাগুলোকে নৃবিজ্ঞানের জমিনে ফেলেই চাষবাসে যেতে চাই। আর আমাদের এই ধারাবাহিক আলোচনার প্রথম কিস্তিতে থাকছে মানুষ সম্পর্কিত বিচিত্র দার্শনিক ভাবনার এক সিলসিলা।

আমি কে?

“আমি কে?”, “মানুষ হিসাবে আমার স্বরূপ কী?”, “আত্মসত্ত্বার কি কোনো উদ্দেশ্য ও পরিণতি আছে?” “থাকলেও তার বিস্তৃতি কতখানি?” – এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর অন্বেষণের তাগিদ চলবে পুরো আলাপ জুড়ে। বোধদয় হওয়ার পর থেকেই এই প্রশ্নগুলো আমাদের সকলেরই মাথায় অল্পবিস্তর ঘুরপাক খায়, আমাদের ভাবিত করে, চিন্তার জায়গায় শান দেয়ার তাগিদ জানায়। দর্শনের জগতে মানুষ নিয়ে এই প্রশ্নগুলো যারপরনাই চর্চিত; তবুও এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর আজও পাওয়া যায়নি।

অধিকাংশ দার্শনিকের মতে, আমরা যাকে ‘আমি’ বলি তা চেতনা ও কর্মের উৎস ও ধারাবাহিক কর্তা হিসাবে বিদ্যমান। সেই সূত্র ধরে, মানুষ বলতে জীবনের শুরু থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একটি ধারাবাহিক চেতনাকে বোঝায়। ধারাবাহিকতা মূলত নিশ্চিত করে মানবসত্তার প্রবাহমানতা এবং প্রজন্ম ধরে চেতনার বিকাশের সমান্তরাল প্রবণতা, যা মানুষের সাথে অন্যান্য বস্তুর পার্থক্যকে নির্দেশ করে। অন্য কথায়, মানুষের ব্যক্তিত্ব অপরাপর বস্তুর ন্যায় নিছক বস্তু নয়, তা এমন এক সত্তা যেখানে সচেতন মূল্যায়ন উপস্থিত থাকে এবং যা চিন্তাভাবনা বা অভিজ্ঞতার পূর্বশর্ত। আত্মসত্তার এই ধারণা আমাদের প্রচলিত সহজবুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা সাধারণ মানুষ একবাক্যে স্বীকার করে নিলেও দার্শনিকরা এক্ষেত্রে দিয়েছেন ভিন্নমত। ‘মানুষের স্বরূপ’ প্রশ্নে আদৌ কি কোনো সর্বজনগ্রাহ্য অবস্থানে যাওয়া সম্ভব? বা এই আলাপের নিরিখে আমাদের অবস্থান কেমন হতে পারে? আপেক্ষিকতার প্রশ্ন কি আমরা জারি রাখতে পারি? চলুন, আমরা বরং সেটাই খোঁজার চেষ্টা করি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কিছু প্রভাবশালী ও ভিন্ন ঘরানার দার্শনিকেরা মানুষ ও আত্মসত্তা (Self) নিয়ে যে আলাপ দিয়েছেন তাই এখন আমাদের আলোচনার জায়গা।

ভারতীয় দর্শনে মানুষ

ভারতীয় দর্শনে বেদ-উপনিষদের আমলেই মানুষ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়। ভারতীয় দর্শন মানুষের উপর এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে যে, দর্শন বলতেই তা বুঝাতো আত্মবিদ্যাকে। ভারতীয় দার্শনিকরা মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি আবিষ্কারেই মূলত আগ্রহী ছিলেন; ফলে উদ্ভব ঘটে বেদান্ত দর্শনের। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখায় সব জিনিসকে ঈশ্বরের অভিব্যক্তি হিসাবে দেখা হয়েছে। মানুষকে ঘোষণা করা হয়েছে ঈশ্বরের সর্বোচ্চ প্রকাশ, গোটা বিশ্বের শেষ আশ্রয়স্থল, শাশ্বত ঐশী নিয়মের অন্তর্নিহিত অভিভাবক ও মুখ্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে (গীতা ১১:১২)। ভারতীয় মতে, মানুষের অন্তঃসার তার দেহে নয়, বরং দেহের অভ্যন্তরস্থ আত্মায় নিহিত। ব্যক্তি-আত্মা চিরন্তন, শাশ্বত পরমাত্মার অংশবিশেষ এবং এর মতোই অক্ষয় অবিনশ্বর। ছান্দগ্য উপনিষদে মানুষকে বর্ণনা করা হয়েছে যেঃ “ওটি বাস্তবসত্তা। ওটি আত্মা। এবং তা-ই তুমি (১:৪)।”

মৃত্যুতে দেহ বিনাশের পর আত্মা বিনিষ্ট হয় না, ক্রমবিকাশমান হয়ে পরমাত্মার সঙ্গে সম্মিলনের লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। তার মানে ভারতীয় দর্শনে মানুষের স্বরূপ উদঘাটনের জন্য শুধুমাত্র বিমূর্ত আত্মাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় না। মানুষ বলতে আরো বুঝানো হয়েছে জড়ীয়, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির অধিকারী এক যৌগিক সত্তাকে। এ প্রসঙ্গে চার্বাক দর্শনই ব্যতিক্রমী। ভারতীয় দর্শনের এই বস্তুবাদী শাখা আধ্যাত্মবাদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী। এ দর্শন অনুসারে প্রমাণ-ই যথার্থ জ্ঞানের উৎস। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত।

ভারতীয় দর্শনের প্রভাবশালী সব ধারা যেখানে একই সুরে সুর মিলিয়েছে, সেখানে চার্বাক দর্শনের বস্তুবাদী আলাপ ভিন্নমাত্রা যোগ করে। প্রসঙ্গত, ভারতীয় দর্শনের প্রধান প্রধান সবকটি শাখায় মানুষকে বর্ণনা করা হয়েছে সদাচঞ্চল পথযাত্রী হিসেবে। এ পথযাত্রা বস্তুজগতের আওতা থেকে অন্তর্লোক বা আত্মার অভিমুখে অগ্রগমন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মতা অর্জনই মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং এ লক্ষ্য সম্পাদনের জন্যই সকল কর্ম সাধিত হওয়া উচিত। অনেকটা একই ধরনের চিন্তার সমর্থন পাওয়া যায় বাংলাদেশের মরমি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক লালন শাহের দর্শনে। লালনের মতে, মানব-আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনো দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা নেই। এই চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার রচিত বিভিন্ন গানে ও সুরের আচ্ছাদনে। যেমন-

“ক্ষেপা তুই না জেনে তোর আপন খবর

যাবি কোথায়?

আপন ঘর না বুঝে বাহিরে খুঁজে

পড়বি ধাঁধায়।।”

কিংবা

“খাঁচার ভিতর অচিন পাখী

কেমনে আসে যায়

ধরতে পারলে মন-বেড়ী

দিতাম তার পায়।।”

ইসলামি দর্শনে মানুষ

প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মতো মুসলিম দর্শনেও মানুষ পেয়েছে বিশিষ্ট ও অনন্য মর্যাদা। ইসলাম ধর্মে মানুষকে ঘোষণা করা হয়েছে অফুরন্ত শক্তি ও সম্ভাবনার অধিকারী, এবং আল্লাহর পার্থিব প্রতিনিধি বলে (আল-কোরআন ২:৩০)। তার মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে স্বয়ং আল্লাহর গুণ, এবং তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহরই আদলে (৩৮:৭২)। পার্থিব জীবনেই শুধু নয়, মানুষের স্থায়ী অধিষ্ঠানও স্বয়ং আল্লাহর নিজ সত্তায়। মুসলিম দার্শনিকদের অনেকেই গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাদের অনেকে যুক্তিবাদী যেমন – ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখ যুক্তি দিয়ে মানুষকে আল্লাহর পার্থিব প্রতিনিধি হিসাবে সমর্থন করেছেন। তাছাড়া আল-গাজালি, আল-রাজির মতো অনেক মুসলিম চিন্তকের রচনাতেই এ ধারণার সমর্থন ও সম্প্রসারণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে, সুফিজমেও মানুষকে দেখা হয়েছে আল্লাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। সেখানে বলা হয়েছে, সসীম মানুষের নিজেকে অনন্ত ঐশী সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে অনুধাবনের মাধ্যমেই জ্ঞানের জানালা উন্মুক্ত হয়।

পাশ্চাত্য দর্শনে মানুষ 

পূর্বের আলোচনা থেকে এপর্যন্ত প্রাচ্য ধারার যেসব বিবরণ পেলাম পাশ্চাত্য ধারায়ও তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। বস্তুত, প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতি থেকে শুরু করে রোমান সংস্কৃতি এবং রেনেসাঁ ও আলোকায়নের (Enlightenment) আমল পর্যন্ত পাশ্চাত্য দার্শনিকদের অনেকেই মানুষকে বুদ্ধিমান সত্তা বলে বর্ননা করেছেন। সক্রেটিস ও প্লেটোর চিন্তাও ছিল এমন আধ্যাত্মবাদী। প্লেটো মানুষকে শাশ্বত প্রত্যয়জগৎ এবং প্রজ্ঞা-পরিচালিত সত্তা হিসাবে বুঝতেন। এছাড়াও ফরাসি চিন্তাবিদ জ্য জ্যাক রুশোমহৎ বর্বর’ তত্ত্বের ধারণা দেন, যেখানে তিনি ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা ও বিষয়বুদ্ধির চেয়ে মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও নান্দনিক চেতনার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের উচিত যতটুকু সম্ভব প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক আবেগ-অনুভূতির কাছাকাছি থাকা। দর্শনের এই ভাববাদী সময়কালকে ‘Romantic era’ আখ্যা দেওয়া হয়। এই ঘরানার দার্শনিকদের মতে, মানুষের সৌন্দর্য উপভোগের যে স্পৃহা, প্রেম-ভালোবাসার যে নান্দনিক বোধ, তাতেই তাঁর স্বকীয়তা, তাতেই নিহিত অন্যান্য প্রানীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য।

বস্তুবাদী মানবতত্ত্ব

সময়ের সাথে সাথে জনপ্রিয় হয়ে উঠে বস্তুবাদী দর্শন। এই দর্শনের প্রভাবশালী ধারাগুলো মানুষের অনন্যতায় বিশ্বাস করে না; আত্মা বা মন বলে মানুষের কোনো স্বতন্ত্র সত্তা আছে বলেও স্বীকার করে না। এই দর্শন মতে, মানুষ জড়বস্তু থেকে উৎপন্ন, যার দেহ ও মস্তিষ্ক রয়েছ; মানুষ ও তার ব্যক্তিত্ব কোনো আধ্যাত্মিক দ্রব্য নয়, বরং অন্যান্য পদার্থিক দ্রব্যের চেয়ে অধিকতর জটিল দেহধারী ভৌত-রাসায়নিক জীবস্বরূপ। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাসলিউসিপাস এর মতে, পরমাণুর কণা থেকেই ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে বর্তমান জগতের মানুষসহ অন্য সবকিছু, যা হালের বিশ্বসৃষ্টি রহস্যের ধারণাকেও প্রভাবিত করেছে৷ বস্তুবাদীরা দাবী করেন, মানুষের সকল কর্মকান্ডকে প্রাকৃতিক নিয়মেই ব্যখ্যা করা যায় এবং যা আজও রহস্য রয়ে গিয়েছে তাও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুশীলনে কালক্রমে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

প্লেটোবাদী দর্শন ও খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে পাশ্চাত্যে যে ভাববাদী ধারা ছিলো তার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেল। হেগেল মানুষকে দেখেছেন Spirit বা আত্মা হিসেবে যা জাগতিক পথ বেয়ে উপনীত হয় পরমাত্মার জগতে। কিন্তু তার মতটি বস্তুবাদী মহলে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কারণ এতে মূর্ত ব্যক্তিত্বকে বিমূর্ত চিদাত্মায় পরিণত করা হয়েছে, অস্বীকার করা হয়েছে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাকে। হেগেলের ভাববাদী মতের বিরুদ্ধে প্রথম এগিয়ে আসেন লুডভিগ ফয়েরবাখ। তিনি এক প্রগতিশীল বস্তুবাদী মতবাদ হাজির করেন যা এক যান্ত্রিক মতবাদ এবং আঠারো শতকের ফরাসি বস্তুবাদী মতবাদ দ্বারা উদ্বুদ্ধ। ফয়েরবাখের মত অনুসারে, মানুষের দৈহিক প্রক্রিয়াবলিই প্রভাবিত করে তার চিন্তাকে। মানুষকে তিনি জড়বস্তুর অংশবিশেষ হিসেবে উপস্থাপন করলেন এবং যুক্তি দিলেন যে মানুষ প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ মানুষ তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না।

ফয়েরবাখের স্থবির মানবতত্ত্বে গতির সঞ্চার করলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-৮৩)। মার্ক্সবাদী দর্শন দাবী করে, মানুষ ও তার আত্মচেতনা প্রকৃতি-বহির্ভূত কিছু নয়, বরং প্রকৃতিরই অর্জিত গুণ। মনের অস্তিত্ব কতগুলো দৈহিক কিংবা ভৌত শর্তের অধীন। শ্রম ও কর্মের কল্যাণেই প্রকৃতি থেকে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে উচ্চতর মানবীয় পর্যায়ে, শ্রমই বর্ধিত ও বিকশিত করেছে মানুষের দেহকে, সমৃদ্ধ করেছে বুদ্ধিমত্তাকে। মানুষের আধ্যাত্মিক উৎপত্তি এবং অনন্য মর্যাদার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করেছেন কার্ল মার্ক্সের সমসাময়িক বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদ চার্লস ডারউইন (১৮০৮-৮২)। ডারউইন তার Descent of Man এবং Origin of Species গ্রন্থদুটিতে বিবর্তনবিষয়ক দীর্ঘদিনের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। আদিম অবস্থা থেকে ক্রমাগত বিবর্তিত হয়ে বর্তমানের উন্নত পর্যায়ে মানুষ উপনীত হয়েছে বলেই তিনি মনে করতেন এবং এর মাধ্যমে মানুষের স্বর্গীয় উৎস ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার দীর্ঘদিনের ধর্মীয় বিশ্বাসকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন।

অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী সিগমান্ড ফ্রয়েড বলেন, মানুষ প্রাণীকুলের সঙ্গে আজও অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। মানুষের অভ্যন্তরে বিচরণ করছে আদিম পাশবিক প্রবৃত্তি, যদিও বুদ্ধি ও বিবেক নিরন্তর সচেষ্ট রয়েছে সেসব প্রবৃত্তি দমনে। এর আগে ইমানুয়েল কান্ট ও সমসাময়িক দার্শনিকরা যেসব নৈতিক নিয়মকে অকাট্য ঘোষণা করেছিলেন, বিবর্তনবাদী মতের প্রভাবে সেগুলোকে দেখা হয় ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসাবে। নীতিও যে আপেক্ষিক হতে পারে এই ধারণা সে বক্তব্যকেই জোরালো করে তোলে।

আচরণবাদ ও বিশ্লেষণবাদ

বস্তুবাদী মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায় আচরণবাদী দর্শনে। আচরণবাদ অনুসারে, মানুষের আচরণকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। আর এই প্রক্রিয়ায় উন্মোচিত হয় মানুষের স্বরূপ, ব্যাখ্যা করা যায় তার সমগ্র আচরণকে। তিনজন বিখ্যাত আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানী – প্যাভলভ, ওয়াটসন, ও বি এফ স্কিনার গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ মত প্রকাশ করেছেন। তারা দাবী করেন, মানুষের আচরণ পরিচালনার মূলে মন বলে কিছু নেই। মানুষের সমগ্র আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় বাহ্যিক পরিবেশ থেকে আগত উদ্দীপক দ্বারা। এ উদ্দীপকের তাড়নাতেই মানুষ যাপিত করে তার জীবন, দর্শায় তার কাজের কারণ।

মানুষমাত্রই স্বতন্ত্রধর্মী আধ্যাত্মিক সত্তা – এ ধারণা আরো সমালোচিত হয় সাম্প্রতিক কালের বিশ্লেষণবাদী দার্শনিকদের রচনায়। যেমন – ব্রিটিশ দার্শনিক গিলবার্ট রাইল দেহের অভ্যন্তরে আত্মার ধারণাকে অভিহিত করেন ‘যন্ত্রে ভূতের ধারণা’’ হিসেবে। তাঁর ভাষ্যে, আমরা যাকে মানসিক প্রক্রিয়া বলি, তা আসলে এক ধরনের দৈহিক প্রক্রিয়া। রাইলের সাথে সুর মেলান অপর এক বিশিষ্ট দার্শনিক এ জে এয়ার। তিনি বলেন, “এক সপ্তাহ আগে এ কামরায় আমি যে কার্পেটটি দেখেছিলাম, এটি যে সেটিই তা প্রমাণ করা, আর এই ব্যক্তি যে আগের দেখা সে একই ব্যক্তি তা প্রমাণ করা একই ধরনের ব্যাপার।” মানুষের এ স্বাতন্ত্র্য অপরাপর বস্তুর স্বাতন্ত্র্যর অনুরূপ, এর বেশি কিছু নয়।

এবং, শুরুর শেষ কথা…

আমরা যদি ক্যাটাগরিক্যালি আধ্যাত্ববাদী ও বস্তুবাদী এই দুই দার্শনিক অবস্থানকে (এই ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যেও আরো অনেক ক্যাটাগরি আছে যেখানে মানুষ/মানবসত্তা সম্পর্কিত দার্শনিক অবস্থানগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে) ডমিন্যান্ট ধরে নিই, এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের আধ্যাত্ববাদ, বস্তুবাদী মানবতত্ত্ব, আচরণবাদ এবং বিশ্লেষণবাদের মতো স্কুলগুলোতে মানুষের স্বরূপ নিয়ে যেসব চিন্তা এসেছে সেগুলোকে দেখতে যাই, তাহলে পরে আমরা দেখবো যে ভারতীয় দর্শন মূলত বস্তুবাদ বিরোধী (ব্যতিক্রম – চার্বাক দর্শন); এতে প্রাধান্য পেয়েছে আধ্যাত্মবাদ আর আত্মার সর্বোচ্চ বিকাশ। মুদ্রার ওপিঠে বস্তুবাদী মানবতত্ত্ব আধ্যাত্মবাদবিরোধী এবং আত্মা/মনের স্বতন্ত্র ক্ষমতাকে নাকোচ করে দেয়। তারপর আসে আচরণবাদ এবং বিশ্লেষণবাদ। আচরণবাদ সমর্থন করে বস্তুবাদকে যেখানে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের উপরই সিদ্ধান্ত ন্যাস্ত করা হয় এবং বিশ্লেষণবাদ শরণাপন্ন হয়েছে দৈহিক ও পদার্থিক মানদণ্ডের।

আচ্ছা, মানুষকে শুধুমাত্রই জড়দেহবিশিষ্ট, পদার্থিক মানদণ্ডের পাল্লায় আনীত উচ্চতর জীব হিসেবে দেখার সুযোগ আছে কি? নাকি এর সাথে মানুষকে চিন্তা, কল্পনা, অনুভব মিশিয়ে এর দেহ ও চেতনা নামক দুটি ভিন্নধর্মী উপকরণের এক চমৎকার সংমিশ্রণ হিসেবেও দেখা যায়? “মানুষের স্বরূপ” প্রশ্নে মানুষের পক্ষে কি আদৌ কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সূত্রের সন্ধান পাওয়া সম্ভব? এই আবরণ উন্মোচন, এই সত্যের অনুসন্ধান কি বর্তমান ও আগামীদিনের মানব সংকট কাটাতে, দীর্ঘস্থায়ী মানবকল্যাণ নিশ্চিত করে পৃথিবীকে প্রাণ-প্রকৃতির কল্যাণে আরো সুন্দর করে গড়তে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে? প্রশ্নগুলো আমার, আপনার, আপনার আশেপাশের মানুষজন সবার জন্যই তোলা রইলো।

কাজের ঋণ:

“What is Anthropology?”. American Anthropological Association. Archived from the original on 16 February 2016. Retrieved 10 August 2013.

Karl Marx’s Selected Works, Eng. ed., vol. 1, pp. 430-31

B. F. Skinner, Science and Human Behaviour (New Youk, 1965), pp. 30-31.

G. Ryle, The Concept of Mind, (London, 1944), p. 151

A. J. Ayer, The Problem of Knowledge, (Middlesex, 1956), p. 189

anthropology”. Encyclopædia Britannica. Archived from the original on 15 April 2015. Retrieved 23 March 2015.

Sociocultural Anthropology and Ethnography | Department of Anthropology”. Retrieved

Philosophy”. Lexico. University of Oxford Press. 2020. Archived from the original on 28 March 2019. Retrieved 28 March 2019.

Spamer EE (29 January 1999). “Know Thyself: Responsible Science and the Lectotype of Homo sapiens Linnaeus, 1758”. Proceedings of the Academy of Natural Sciences. 149 (1): 109–114. JSTOR 4065043.

Seyyed Hossein Nasr and Oliver Leaman (1996), History of Islamic Philosophy, p. 315, Routledge, ISBN 0415131596.

 Hume, David. A Treatise of Human Nature. I, IV, vi

Baumeister, R. F., and Bushman, B. J. (2013). Social psychology and human nature. Cengage Learning: Wadsworth.

Fasching, W. (2016). The non-plurality of the I. on the question of the ultimate subject of experience. J. Consciousness. Stud. 23, 140–157.

Polkinghorne, D. E. (1991). Narrative and self-concept. J. Narrat. Life Hist. 1, 135–153. doi: 10.1075/jnlh.1.2-3.04nar

Schlegel, R. J., Hicks, J. A., Arndt, J., and King, L. A. (2009). Thine own self: true self-concept accessibility and meaning in life. J. Pers. Soc. Psychol. 2, 473–490. doi: 10.1037/a0014060

Taylor, C. (2012). Sources of the self. The making of modern identity. Cambridge, MA: Harvard University Press.

Karl Marx, Theses on Feuerbach in: K. Marx and F. Engels, Collected Works, Vol. 5, Progress Publishers, Moscow, 1976, p. 4.

Dennett, Daniel (1986). The Self as a Center of Narrative Gravity. URL accessed on 2009-03-30. [dead link]

Gaynesford, M. de I: The Meaning of the First Person Term, Oxford, Oxford University Press, UK. 

ইসলাম, আমিনুল (২০০৯), দর্শন ভাবনা: সমস্যা ও সম্ভাবনা, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা।