মুভি রিভিউঃ “দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি” (১৯৮০)
[Anthro Circle Presents 1st Anthropological Film Review Competition- এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে মোঃ রিয়াদ হোসেনের লেখা ‘দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি’ রিভিউটি।]
চলচ্চিত্র পরিচিতি
দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি (১৯৮০)
স্বল্পদৈর্ঘ্য : ১০৯ মিনিট
ভাষা : ইংরেজি , আফ্রিকান , জু-হোওন
চরিত্রায়ন : নি-সাও তোমা, সেন্দ্রা প্রিন্সলো,
মেরিয়াস ওয়েয়া্রস্, নিক-দে
জাগেরস্, মাইকেল থাইস্, লৌ
ভারভৈ, কেন গাম্পু, সিমন
সাভেলস্
চলচ্চিত্র গ্রহণ : বাস্টার রেনলডস্ , রবার্ট লেওস
সম্পাদনা : জেমি আস
শব্দ মিশ্রণ : জন বোসফ
আলোচনা
ওয়েলসন চিন, বিলি চেন এবং জেমি আস নির্মিত একটি অনবদ্য চলচ্চিত্র হলো “দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি”। চলচ্চিত্রে নির্মাতাগণ একটি তথাকথিত আদিম ও সভ্য সমাজের মধ্যে এক ধরনের তুলনা করেন। দুটি সমাজের মধ্যকার প্রতিষ্ঠান গুলোরও তুলনা করেন। একদিকে বুশম্যান নৃগোষ্টি, যারা তাদের পরিবারের সাথে কালাহারি নামক মরুভূমিতে বসবাস করে। যেখানে পশুপাখি টিকে থাকতে পারেনা পানির অভাবে, সেখানে বুশম্যান নৃগোষ্ঠী তাদের স্থানীয় জ্ঞান ব্যবহার করে টিকে থাকে। তাদের সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষ জাতি শিকার করে এবং স্ত্রী বাসায় কাজ করে। শিকার করা খাবার সমান ভাগে ভাগ করে খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় এবং বেলা শেষে আগুনকে কেন্দ্র করে বসে পরিবারের প্রধান তার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা গুলো তুলে ধরেন। এটিই ছিল তাদের ‘পাঠশালা’যেখান থেকে তারা জ্ঞান আহরণ করত। ঠিক এভাবে করেই তাদের বংশ থেকে বংশ জ্ঞান স্থানান্তরিত হতো। অপরদিকে অর্থাৎ কালাহারি মরুভূমির থেকে
৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে তথাকথিত সভ্য মানুষ। যেখানে রয়েছে সকল ধরনের সুবিধা। তাদের রয়েছে জীবনকে সুন্দর করে তোলার এক হাতিয়ার অর্থাৎ টাকা। এই মুদ্রিত কাগজ অর্জনের
লক্ষ্যে ছুটে চলছে মানুষ এবং সময় বন্দী হচ্ছে মানুষ। এই মুদ্রিত কাগজের জন্য লড়াই করতে দেখেছি মানুষ রুপি রোবটকে। এমন এক রোবট যে কিনা সকলে নিয়ম করে গাড়ি চড়ে কাজ করতে যায়, সময় করে দুপুরের খাবার এবং যথা সময় বাড়ি ফিরে আসে।
এই দুই ধরনের জীবনের মাঝে তুলনা করে নির্মাতাগণ কিছু চমৎকার বিষয় সমূহ ফুটিয়ে তুলেছেন যেগুলো হলো:
- সমাজে পণ্যের চাহিদা কিভাবে বৃদ্ধি পায়।
- পৃথিবীর শেষ প্রান্তের কৌতুহল।
- বহু ঈশ্বরবাদ।
- প্রকৃতিতে মন্দ বলে কিছুই নেই।
- এক দল নৃগোষ্ঠীর সরলতাকে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে ব্যবহার করে।
তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ
একটি সমাজে পণ্যের চাহিদা কিভাবে বৃদ্ধি পায়
নির্মাতাগন “দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি” চলচ্চিত্রের প্রারম্বরিক সময়ে দেখিয়েছেন, একটি বিমান চালক একটি কোকের খালি বোতল নিক্ষেপ করেন কালাহারি মরুভূমির উপর দিয়ে যাওয়ার সময়। চলচ্চিত্রের মূল অভিনেতা সেটি লক্ষ্য করলেন। তিনি ভাবলেন দেবতা তাদেরকে একটি নতুন বস্তু দিলেন। কিন্তু মাত্র একটি দিলেন কেননা তারা সকল কিছুই ভাগাভাগি করে নেয়। তবু সে এই বোতলটি তার পরিবারের কাছে নিয়ে গেলে, সবাই এটি দেখে রীতিমতো অবাক-ই হলেন। পরিবারের বিভিন্ন সদস্য তাদের নিজের মত করে ব্যবহার করলেন। অতঃপর এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হলো যেন সবার নিজ নিজ কাজের জন্য ওই বস্তুটিরই প্রয়োজন। অর্থাৎ একটি সমাজব্যবস্থায় নতুন কোন পণ্যের ব্যবহার নির্ধারণ করে দিলে ওই বস্তুর চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। চাহিদা এবং যোগানের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ চলচ্চিত্রে মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
পৃথিবীর শেষ প্রান্তের কৌতুহল
কোকের বোতলটি যখন দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে উঠতে লাগলো, তখনই চলচ্চিত্রের মূল অভিনেতা সিদ্ধান্ত নিল এটিকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত ফেলে আসবে। পরিবারের প্রধান বললেন, এতে হয়তো তোমার ১৫-২০ দিন সময় লাগবে। নির্মাতাগণ বুশম্যান জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন, হয়তো ১ম বিশ্বের দেশগুলোতে প্রাক শিল্পায়িত সময়কালে এই ধরনের ধারণাই বিরাজমান ছিল। অতঃপর পৃথিবীর শেষটা খোঁজার তাগিদেই হয়তো ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং বিশ্বায়নের মতো ধারণার ফলাফল আজ আমরা দেখতে পাই। লেভি স্ট্রস তার তত্ত্বেও বলেছেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষদের ব্যাপ্তি না হওয়ার পরেও তাদের চেতনা একই”। নির্মাতাগন অত্যন্ত চমৎকারভাবে এই ধরনের ধারণা দিয়ে থাকেন ।
বহু ঈশ্বরবাদ
চলচ্চিত্রে কোকের বোতলটিকে পৃথিবীর বাহিরে নিক্ষেপ করার যাত্রা পথে তার দেখা হয় বিভিন্ন দেবতার (অভিনেতার দৃষ্টিতে) সাথে। সেই মানুষ গুলোকে বুশম্যান দেবতা মনে করলো তার কারণ, সে পূর্বে কোন মানুষকে দেখেনি কাপড় পরিধানকৃত অবস্থায়। তার কাছে মনে হলো এদের গায়ের চামড়া বিভিন্ন রঙের অর্থাৎ এরা হয়তো বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী তাই এরা নিশ্চয়ই দেবতা। সে তাদের (দেবতা) বলল্ , আপনি আমাদের মঙ্গলের জন্য এটি (কোকের বোতল) দিয়েছেন কিন্তু এটি আমাদের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করছে। এটি নিয়ে নেন। এটি আমাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই জীববিজ্ঞানী যখন নেয়ার জন্য অস্বীকার করল, তখন তার কাছে মনে হল “এ দেবতা ভালো নয়”। এই দেবতা হয়তো এই কাজ করে না। এই ধরনের চিন্তা থেকে বহু ঈশ্বরবাদের মত ধারণাকে জোরালোভাবে স্থাপন করে। টি.ভি টায়লর যিনি বিবর্তনবাদ তথ্য থেকে প্রভাবিত হয়ে ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি তার ধর্মের ব্যাখ্যায় বহু ঈশ্বরবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেখানে তিনি বলেছেন “মানুষ সর্বপ্রাণ বাদ হতে বহু ঈশ্বরবাদ বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন”।
প্রকৃতিতে মন্দ বলে কিছুই নেই
বুশম্যান নৃগোষ্টি অত্যন্ত সরল স্বভাবের। তাদের মতে প্রকৃতিতে সকল কিছুই ভালো। বিষ ধর সাপ ও ভালো যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ছোপ দিয়ে থাকে। এমনকি তারা শিকার করেও তার কাছ হতে ক্ষমা চেয়ে নেয়। চলচ্চিত্রের এই অংশগুলোতে বুশম্যান নৃগোষ্ঠীর সরলতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। তাদের (বুশম্যান) মধ্যে অপরাধ বলে কিছুই নেই। এর একটি চমৎকার উদাহরণ আমরা দেখতে পাই, মূল অভিনেতা একটি ছাগল হত্যা করে তাকে খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো এবং একটি বালক তা দেখে চেঁচিয়ে উঠলো। ঠিক ওই বালকটি যখন পালিয়ে পুলিশ আনতে গেল, তখন তার মনে হল যে তার পরিবারের বাকি সদস্যদের ডাকতে গিয়েছে। পুলিশ তাকে বাধা দিলে, “সে (অভিনেতা) বলল, তুমি লোভী, ভাগাভাগি করতে চাও না। আমি আমার জন্য অন্য একটি নিয়ে নেব”। নির্মাতাগন এই ধরনের দৃশ্য ধারা সমাজের সকল নিয়ম গুলোর প্রতি এক প্রশ্ন ছুড়লেন। কারন কোন কাজ একটি সমাজে খারাপ তবে ভিন্ন সমাজে খারাপ না ও হতে পারে। তাছাড়া সেই সমাজে কে নির্ধারণ করে দিবে? কে বলল, এই কাজটি খারাপ? কেন খারাপ? কেন মেনে নিতে হবে? এটি আসলে কে নির্মাণ করে? এই সকল প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে ঐই সকল প্রতিষ্ঠানগুলো বিপক্ষে এক প্রতিবাদ করলেন।
একদল নৃগোষ্ঠীর সরলতাকে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে ব্যবহার করে
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গুলো অত্যন্ত সরল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারা বিভিন্ন রাজনীতি সম্পর্কে অবগত থাকে না। তারা বৈশ্বিক রাজনীতি বুঝতে অক্ষম। কেননা, তারা ঐই রকম পরিবেশ হতে বেড়ে ওঠেনি। তাই তাদের (নৃগোষ্ঠী) দ্বারা খুব সহজভাবেই বিভিন্ন জঙ্গি হামলা ও নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করানো সম্ভব। ঠিক একই রকম ভাবে চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছে। দেশ বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম, ডাকাতি ও নীতি বিরোধী কাজগুলোতে নৃগোষ্ঠীদের উপস্থিতি। এই কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, একদল মানুষ নিজ স্বার্থে নৃগোষ্ঠীদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে এসব করিয়ে থাকেন। এই প্রসঙ্গটি তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ ২য় ও ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতে নৃগোষ্ঠীদের বাঁকা চোখে বিচার করা হয়।
সমালোচনা
“দি গডস মাস্ট বি ক্রেজি” চলচ্চিত্রে নির্মাতাগণ একটি বুশম্যান নৃগোষ্ঠী ও তথাকথিত সভ্য সমাজে মানুষের জীবনের ধরনকে ব্যাখ্যা করেছেন। দুটি সমাজের মধ্যকার ভিন্নতা ও প্রতিষ্ঠান গুলোর ভিন্নতাকে তুলে ধরেছেন। যার মাঝে তিনি নৃগোষ্ঠীর জীবনের শুধু সরলতাকেই তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যকার হিংস্রতাকে তুলে ধরেন-নি। কেননা উপনিবেশদের আগমনের পূর্বেও নৃগোষ্ঠীদের মধ্যকার সংগ্রাম রয়েছে। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে হয়েছে যুদ্ধ। তাদের মধ্যে কেউ হয়েছে অধিক বলবান, কেউ হয়েছে দাসী। কিন্তু এই হিংস্রতাকে নির্মাতাগন তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন।