ম্যাক্স গ্লুকম্যানের ক্রিয়াবাদ

[থিওরি সিরিজে ম্যাক্স গ্লুকম্যানের তত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন আবদুল্লাহ হেল বুবুন]

অনৈতিহাসিক পাঠ পদ্ধতি, উদ্দেশ্যবাদ, আফ্রিকা, ও ভারসাম্য।  অনেক সমালোচকদের মতে, এই চারটি শব্দের মাধ্যমে কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। 

কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদীরা কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, প্রথা বা ভাবাদর্শের  উৎস সন্ধানে আগ্রহী ছিলেন না। বরং, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এইসব প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়া বা প্রভাবকে ব্যাখা করা। যেমনঃ ধর্ম সম্পর্কে কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদী ব্যাখ্যা কোনো সমাজে ধর্ম কি প্রভাব রাখে এবং ধর্ম কিভাবে সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে; কিন্তু কোন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় একটি সমাজ ঐ ধর্ম গ্রহণ করলো বা এর সাথে জড়িত অসম ক্ষমতার প্রশ্ন  কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদীদের আগ্রহের বিষয়বস্তু না।

অনৈতিহাসিক পাঠপদ্ধতির সাথে জড়িত আরেকটি প্রত্যয় হলো সামাজিক ভারসাম্য। ডুর্খেইম ও রেডক্লিফ ব্রাউন দ্বারা প্রভাবিত কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদীরা মনে করতেন সমাজ সবসময়ই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে। বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তন থাকা সত্ত্বেও, তা শেষ পর্যন্ত সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এই ধারার তাত্ত্বিকদের কাছে সামাজিক ভারসাম্য হলো সমাজের স্বাভাবিক অবস্থা আর দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তন হলো অস্বাভিকতা ও ব্যতিক্রম প্রপঞ্চ। দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তনের ব্যাপারে এরকম রক্ষণশীল ধারণার কারণে ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞান কখনোই পরিবর্তনকে যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়নি। 

অনৈতিহাসিক পাঠপদ্ধতি ও ভারসাম্যের ধারণার উপর জোরারোপ করতে গিয়ে ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা আফ্রিকার ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করেছেন; উপনিবেশবাদের কারণে আফ্রিকার সমাজে যে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটছিল, তা তাদের নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে ফুটে উঠেনি। 

উদ্দেশ্যবাদ ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। এই উদ্দেশ্যবাদ অ্যারিস্টোটলীয় কার্যকরণ নীতিকে উলটে দিয়েছিল। অ্যারিস্টোটলীয় কার্যকরণ নীতি অনুযায়ী কারণ সবসময়ই কার্যের পূর্বে অবস্থান করে। কিন্তু কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদী তত্ত্বানুযায়ী সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়া বা প্রভাব আগে থেকেই অনুমান করে নেয়া হতো। কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদীদের একটি শক্তিশালী পূর্বানুমান ছিল যে, সামাজিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠান সামাজিক সংহতি ও ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কাজ করে। 

ইতিহাস, পরিবর্তন, মানব কর্তাসত্ত্বাকে উপেক্ষা এবং সামাজিক দ্বন্দ্বকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারার কারণে কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদী প্যারাডাইমের ভেতরে ও বাইরে থেকে বিবিধ সমালোচনা শুরু হয়েছিল। এই প্যারাডাইমকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান না করেই সামাজিক পরিবর্তন ও দ্বন্দ্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন কিছু তাত্ত্বিক। এদের মধ্যে ম্যাক্স গ্লুকম্যান ও এডমুন্ড লিচ সবথেকে প্রখ্যাত, যাদেরকে অ্যাডাম কুপার ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞান নিয়ে লিখিত নিজ বইয়ে প্রথাবিরোধী (ম্যাভেরিকস) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

ম্যাক্স গ্লুকম্যান 

দক্ষিন আফ্রিকার এক ইহুদি পরিবারে ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ম্যাক্স গ্লুকম্যান। পড়াশুনা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্রান্ড ইউনির্ভাসিটিতে ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। দক্ষিন আফ্রিকায় তার শিক্ষক ছিলেন আইজ্যাক শাপিরা ও হোয়ের্নেল; উভয়ই র‍্যাডক্লিফ-ব্রাউনের কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদের অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে অক্সফোর্ডে থাকাকালীন তিনি র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন এবং ইভানস-প্রিচার্ড দ্বারা প্রভাবিত হন। ডুর্খেমীয় প্রভাবের কারণেই তিনি সমাজ ও মানব আচরণের যেকোনো ধরণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার তীব্র বিরোধীতা করেছেন। ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানের এই ডুর্খেমীয় ঐতিহ্যের প্রভাব গ্লুকম্যানের উপর প্রায় সারাজীবনই শক্তিশালী ছিল।

আবার “প্রথাবিরোধী” ম্যাক্স গ্লুকম্যানের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্ক্স। মার্ক্সের কাছে দ্বন্দ্ব ছিল শ্রেণি বিভক্ত সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ। অন্যদিকে পরিবর্তন মার্ক্সীয় দর্শনের একটি চিরন্তন নীতি। অন্যদিকে, দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তন –এই দুই প্রপঞ্চকে কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদে দেখা হতো অস্বাভাবিকতা হিসেবে, যা সমাজের সাধারণ নীতির ব্যাতিক্রমকে প্রতিনিধিত্ব করে। 

ম্যাক্স গ্লুকম্যানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে রয়েছে মার্ক্সীয় ও ডুর্খেমীয় ধারার সিন্থেসিস, যে সিন্থেসিস শেষ পর্যন্ত গ্লুকম্যানকে কাঠামোবাদী-ক্রিয়াবাদী কেন্দ্রীয় পূর্বানুমানের (সামাজিক ভারসাম্য) মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। এমন না যে, গ্লুকম্যানের পূর্বে কোন ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানী সমাজ জীবনে দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করেননি। র‍্যাডক্লিফ-ব্রাউন থেকে শুরু করে ইভান্স প্রিচার্ড উভয়ই দ্বন্দ্ব সম্পর্কে লিখেছেন এবং দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও কিভাবে সামাজিক সংহতি অর্জিত হয় তাও দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বন্দ্বকে তারা পাঠ করেছেন ‘ব্যাতিক্রম’ হিসেবে।

অন্যদিকে গ্লুকম্যানের নতুনত্ব ছিল এখানে যে, তিনি মনে করতেন, দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক এবং তা সমাজজীবনের সর্বত্র সর্বাবস্থায় উপস্থিত। এক্ষেত্রে তিনি দ্বন্দ্বকে একটি সমাজতত্ত্বীয় প্রপঞ্চ হিসেবেই দেখেছেন, যাকে ব্যক্তির স্বতন্ত্র মনস্তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। গ্লুকম্যানের তাত্ত্বিক অবস্থান বুঝতে আমাদের তাকাতে হবে তার ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত বই “কাস্টম অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ইন আফ্রিকা”। শুরুতেই গ্লুকম্যান তার কেন্দ্রীয় থিসিস স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেনঃ “আমার প্রধান যুক্তি হলো কোন নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কে দ্বন্দ্ব অন্যান্য বৃহত্তর সামাজিক সম্পর্কে সংহতি প্রতিষ্ঠা করে”। স্পষ্ট ভাষায়, একটি সমাজের দুজন ব্যক্তি দুটি পৃথক গোষ্ঠীর অংশ হতে পারে এবং ঐ গোষ্ঠীদ্বয়ের সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধ ধারণ করে। ধরা যাক, তারা দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক জোটের অংশ। আবার ঐ দুই ব্যক্তিই একই গোষ্ঠী বা দলের অংশ হতে পারে। যেমন: তারা একই ধর্ম পালন করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও একই ধর্ম সামাজিক সংহতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। 

জুলুল্যান্ড সম্পর্কিত আলোচনায় এথনোগ্রাফিক উদাহরণের মাধ্যমে গ্লুকম্যান তার থিসিসকে ব্যাখ্যা করেন। জুলুদের মধ্যে একজন রাজা রয়েছে। তার রাজত্ব কয়েকটি কাউন্টি নিয়ে গঠিত; প্রত্যেকটি কাউন্টির আবার আলাদা আলাদা শাসক বা নেতা রয়েছে। প্রায়শই বিদ্রোহ শুরু হয়, যেখানে কোন না কোন কাউন্টি নিজেদের শাসককে রাজা বানাতে চায়। গ্লুকম্যানের কাছে, এই দ্বন্দ্বগুলো আসলে ইতিবাচক, যা জুলু রাজ্যকে একত্রিত তথা সংহত করতে সাহায্য করে। কারণ, যখন কোন এক কাউন্টি তাদের নেতাকে রাজা বানানোর জন্য বিদ্রোহ করে তখন অন্যান্য কাউন্টিগুলো বর্তমান রাজার পক্ষ নিয়ে একত্রিত হয়। অধিকন্তু, বিদ্রোহের উদ্দেশ্য রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ নয়, বরং রাজত্ব দখল করা। অর্থ্যাৎ, এইসব বিদ্রোহ সামাজিক ব্যবস্থাকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে চায় না। 

গ্লুকম্যানের আরেকটি অবদান ছিল তার ‘এক্সটেন্ডেড কেস স্টাডি’। তার এই পদ্ধতির লক্ষ্য ছিল, মানুষের প্রতিদিনকার বাস্তব জীবনের কর্মকান্ডগুলোকে পরখ করে সামাজিক কাঠামোকে বুঝার চেষ্টা করা। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিবর্গের আর গোষ্ঠীসমূহের গতিশীল সম্পর্ককে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। এই কৌশলকে তিনি ‘সিচুয়েশনাল এনালাইসিস’ নামে অভিহিত করেছিলেন।

ম্যাক্স গ্লুকম্যান দ্বন্দ্ব, সামাজিক গতিশীলতা ও পরিবর্তনের উপর জোর আরোপের মাধ্যমে ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানে একটি নতুন স্কুলের জন্ম দেন। এই স্কুল নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসে ম্যানচেস্টার স্কুল নামে পরিচিত। 

সমালোচনা 

দ্বন্দ্বের উপর গুরুত্ব প্রদান করলেও ম্যাক্স গ্লুকম্যানের ‘কনফ্লিক্ট থিওরি’ শেষ পর্যন্ত সামাজিক ভারসাম্য অর্জনকেই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রীয় ক্রিয়া হিসেবে দেখেছে। তার তত্ত্বানুযায়ী, প্রত্যেক সমাজেরই একটি কেন্দ্রীয় মূল্যবোধ ব্যবস্থা রয়েছে, যার অভ্যন্তরেই সকল ধরণের দ্বন্দ্ব ক্রিয়া করে। বিবিধ দিক থেকেই এই তত্ত্ব সমালোচনার শিকার হয়েছে। মার্ক্সিয় তাত্ত্বিকদের মতে, সমাজে কোন নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় ভ্যালু সিস্টেম নেই যা সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম; দ্বন্দ্ব সমাজকে সংহত করেনা, বরং দ্বন্দ্বই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের নির্ধারক। সমালোচনা সত্ত্বেও নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসে ম্যাক্স গ্লুকম্যানের তত্ত্ব ও মেথোডোলজির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ব্রিটেনে প্রভাবশালী ক্রিয়াবাদী প্যারাডাইমে বহুদিন উপেক্ষিত প্রপঞ্চ –সামাজিক পরিবর্তন, দ্বন্দ্ব ও গতিশীলতা– কে তিনি নৃবৈজ্ঞানিক আলোচনার সম্মুখভাগে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।