ধর্মের নৃবৈজ্ঞানিক পাঠ
[ধর্মের নৃবৈজ্ঞানিক পাঠের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন সাব্বির হাসান রাকিব এবং রিফাত হাসান আদর]
নৃবিজ্ঞান “ধর্ম” ধারণাটি কে দেখে সাংস্কৃতিক নির্মাণ হিসেবে, যা সকল মানব সংস্কৃতিতেই দেখা যায়। তবে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও অনুশীলন। যদিও সংস্কৃতি ভেদে ধর্মের পার্থক্য প্রকাশ পেতে পারে, কিন্তু “ধর্ম” বিষয়টি অবিচ্ছেদ্য রূপে সকল সংস্কৃতিতেই নিবাস করে। তাই নৃবিজ্ঞানীরা যখন মানুষ বা সংস্কৃতি অধ্যয়ন করতে যান তখন ধর্ম নিয়ে তাদের ভাবতেই হয়। কেননা ধর্মকে বাদ দিয়ে মানুষ কিংবা সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন করা সম্ভব না।
ধর্মের কোন একক সংজ্ঞা নেই। কেননা যেসব সংজ্ঞা ধর্মকে ব্যাখা করার ক্ষেত্রে “এক ঈশ্বরে বিশ্বাস” এর উপর গুরুত্ব আরোপ করে, সেসব সংজ্ঞা “বহুদেবতায় বিশ্বাস” ব্যবস্থাগুলোকে খারিজ করার মাধ্যমে স্বীকৃত ধর্মের সংখ্যাকে সীমিত করে ফেলে। আবার একইভবে এর বিপরীত যুক্তিও প্রযোজ্য। তাই ধর্ম অধ্যয়ন করার সময় নৃবিজ্ঞানীরা এই ধরনের একক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করেন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি (Inclusive method) অবলম্বন করেন।
তবে নৃবিজ্ঞানীরা কি ধর্মের “সত্যতা”র অনুসন্ধান করেন? কিংবা, কোন ধর্মের ন্যায্যতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হন? নাকি “অপর” ধর্মের বিশ্বাসকে খারিজ করে দেন? –প্রকৃতপক্ষে, নৃবিজ্ঞানীরা ধর্ম অধ্যয়নের সময় এর কোনটাই করেন না। তারা যেটা করেন তা হলো – ব্যাখ্যা। নৃবিজ্ঞানীরা একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মকে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন করেন।
বিভিন্ন জ্ঞানকান্ড (যেমন- মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব) ধর্মকে বিশ্লেষণ করেছে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ এবং আগ্রহের জায়গা থেকে। ঠিক একইভাবে নৃবিজ্ঞানও তার স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধর্মকে অধ্যয়ন করে। যেহেতু নৃবিজ্ঞান মানুষের জৈবিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতার অনুসন্ধান করে সেহেতু ধর্মের নৃবিজ্ঞান (Anthropology of Religion) মানব ধর্মের সাদৃশ্য বা বৈচিত্র্যতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন।
নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের তিনটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছ যা ধর্ম অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়। প্রথমটি – Cross cultural study বা আন্তঃ সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন। এই দৃষ্টিকোণটি সংস্কৃতির মুখ্য প্রপঞ্চগুলোর অভিন্নতার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সংস্কৃতিভেদে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্যগুলোকে ফুটিয়ে তোলে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চার ভিন্নতা বা সাদৃশ্যতা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। আন্তঃ সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে ধর্ম কীভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে নৃবিজ্ঞগানিরা তা বুঝার চেষ্টা করেন।
দ্বিতীয়ত- Holism। এর মাধ্যমে নৃবিজ্ঞান একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে এবং একটি সংস্কৃতিকে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের একটি সমন্বিত সমগ্র হিসাবে বিবেচনা করে। যেমন কোন সংস্কৃতির ধর্ম অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সেই ধর্ম চর্চার সাথে ওই সংস্কৃতির অর্থনীতির সম্পর্ক, রাজনৈতিক সম্পর্ক ও জ্ঞাতিসম্পর্কের মতো সংস্কৃতির অন্যান্য মুখ্য প্রপঞ্চগুলোর যোগাযোগও বিশ্লেষণ করে দেখা হয়।
তৃতীয়টি- Cultural relativism বা সাংস্কৃতিক আপেক্ষবাদ। নৃবিজ্ঞান সাংস্কৃতিক আপেক্ষবাদের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে পাঠ করে। যা মনে করে প্রতিটি সংস্কৃতির ঘটনা বোঝার এবং মূল্যায়নের জন্য নিজস্ব মান রয়েছে। অর্থাৎ, কোন সংস্কৃতির ধর্মকে ওই সংস্কৃতির আদর্শ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ও নীতি দিয়েই বুঝতে হবে; অন্য সংস্কৃতির বিশ্বাস ও নীতি দিয়ে নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গ সুসংগঠিত করে যে কোনো ধর্মকে “সত্য” বলে নৃবিজ্ঞান প্রমাণিত করতে সক্ষম নয়, এবং একইভাবে কোনও ধর্মকে বাদ দেওয়াও সম্ভব নয়। নৃবিজ্ঞানীগণ শুধুমাত্র ধর্মীয় বৈচিত্র্যতাকে ঐ ধর্মের বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্য করার ক্ষমতা রাখেন।
এতক্ষণ আমরা নৃবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মকে অধ্যয়ন করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার একটু তত্ত্বে আসা যাক। তাত্ত্বিক জায়গা থেকেও বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে ব্যাখ্যা করেছেন।
নৃবিজ্ঞানের মতে নির্দিষ্ট কোনো জ্ঞানকান্ড বা তত্ত্ব দিয়ে ধর্মকে পুরোপুরি ব্যাখা করা সম্ভব না। ধর্মকে নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আলোকে দেখার আদিকল্প প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে প্রাক-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখা করা হতো। প্রাক-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মকে সংজ্ঞায়ন করার বদলে কেন ধর্ম সত্য এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতো। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের এরূপ নিয়মানুগ পক্ষসমর্থন করার এই অধিবিদ্যাকে এপোলোজেটিকস (Apologetics) বলা হয়। কিন্তু এপোলোজেটিকস দৃষ্টিকোণে ধর্মকে ব্যাখা করলে পক্ষপাতিত্ব করা হবে এবং ধর্মের বৈচিত্র্যকে এড়িয়ে যাওয়া হবে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকের দিকে গ্রীক দার্শনিক জেনোফেনস সর্বপ্রথম ধর্মের বৈচিত্র্যকে স্বীকার করেন এবং ধর্ম ও সমাজের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। পরবর্তীতে গ্রীক দার্শনিক হেরোডোটাস তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে দাবি করেন যে বিভিন্ন সংস্কৃতির ঈশ্বররা মূলত একই সার্বজনীন ঈশ্বরের স্থানীয় নাম মাত্র। তার মতে, মিশরীয় দেবতা হোরাস গ্রীক দেবতা এ্যাপোলোর প্রতিরূপ; আবার মিশরীয় দেবতা ওসিরিস গ্রীক দেবতা ডায়ানাইসিস এর প্রতিরূপ। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলে সমজাতীয় ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যাপ্তিবাদ (Diffusionism) এর আলোকে ব্যাখা করতে সাহায্য করে।
পরবর্তীতে সংশয়বাদী (Skepticism) যুগে এসে ইউফেমেরাস ধর্মের মানবতাবাদী তত্ত্বের ধারণা দেন, যেখানে তিনি বলেন যে দেবতারা মূলত মানুষদেরই পূর্ববপুরুষ বা তাদের পূর্বপুরুষদের নেতা। এই বিশ্বাসেরই আরেকটা প্রতিরূপ হিসেবে আমরা দেখতে পাই অনেক সময় জীবন্ত কিংবদন্তিদের এবং মৃত্যু পরবর্তীতে সম্মানার্থে তাদের মূর্তি স্থাপন করে একে পবিত্রজ্ঞান করা হয়। যেমন- মিশরে এখন অব্দি তাদের কিংবদন্তিদের সম্মানার্থে তাদের মৃত লাশ মমিরূপে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করা হয়।
তের শতকের দিকে রজার ব্যাকন ধর্মের একটি শ্রেণিবিন্যাস করেন যেখানে তিনি শুধুমাত্র প্যাগান, মূর্তি পূজারী, মঙ্গল, মুসলিম, ইহুদী এবং খ্রিস্টান ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করেন। যদিও তার এই চেষ্টাকে এথনোসেন্ট্রিক হিসেবে সমালোচনা করা হয়, কিন্তু এর মধ্যে দিয়েই অন্যান্য ধর্মকেও আলোচনায় নিয়ে আসার চর্চা শুরু হয়।
ধর্মকে তাত্ত্বিক আলোচনায় ক্রিয়াশীল রাখতে বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভূমিকা রয়েছে। উনিশ শতকে নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর বিবর্তনবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের কয়েকটা স্তরের ব্যাপারে ধারণা দেন। তার মতে ধর্ম চর্চা শুরু হয় সর্বপ্রাণবাদ (animism) বা প্রকৃতিপূজার মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তিতে পর্যায়ক্রমিকভাবে বহু ঈশ্বরবাদ এবং একেশ্বরবাদে উন্নিত হয়। তবে ধর্মকে ব্যাখা করার এসব বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি আপেক্ষিক না হওয়ার কারণে বহুলভাবে সমালোচিত এবং এথনোসেন্ট্রিক ধারণা বলে বিবেচিত হয়।
ধর্মকে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব দিয়েও ব্যখা করা হয়ে থাকে। যেমন- সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার কাজে ধর্মকে এক ধরণের মানসিক উদ্দীপনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ফ্রয়েডের মতে সকল মানুষের মধ্যে কিছু সমজাতীয় স্বভাব এবং তাড়না অবচেতন অবস্থায় থাকে। তিনি ইডিপাস কমপ্লেক্স এর আলোচনায় প্রথম ঈশ্বর এবং প্রথম বিবেক বা অধিসত্ত্বা (সুপার ইগো) এর দিকে আলোকপাত করেন। তিনি দাবি করেন, মানুষ এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চর্চা (যেমন- অজাচারের নিষেধাজ্ঞা, টটেমবাদ, ইত্যাদি) করে থাকে। তার দৃষ্টিকোণে ধর্ম মানুষের অন্যান্য আচরণের ন্যায় এক ধরণের স্নায়বিক অভিব্যক্তি।
বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে চিন্তা করলে ধর্মের সূচনা ঘটে প্রশ্ন করা বা সমস্যার সমাধান করার মধ্য দিয়ে। টাইলর যদিও বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মকে দেখেছেন, কিন্তু তার চিন্তায় বুদ্ধিবৃত্তিক মনোভাবও দেখা যায়। তিনি বলেন যে আদিম মানুষদের যখন স্বপ্ন বা কোনো ধরনের হ্যালুসিনেশনের অভিজ্ঞতা লাভ করতো, তখন তারা সেটাকে কোনোভাবে ব্যাখা করতে পারতো না। ফলে সেসব বিষয়কে ব্যাখ্যা করার তাড়না থেকে তারা অদৃশ্য, অবিনশ্বর এবং অতিপ্রাকৃতিক আত্মার ধারণা উদ্ভাবন করে।
পরবর্তীতে নৃবিজ্ঞানী এডলফ বাস্তিয়ানের কাজে মানুষের সমরূপ মনস্তত্ত্বের (psychic unity of humanity) ধারণা পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, সকল মানুষের মধ্যে সমজাতীয় প্রাথমিক ধারণা বিদ্যমান। তবে মানুষদের জাতিগত বিশ্বাসের সাপেক্ষে সেই ধারণাগুলোর বিন্যাস ভিন্ন ভিন্ন হয়। অর্থাৎ, সকলমানুষের মধ্যে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা থাকলে স্থান-কালভেদে এসব ধারণার প্রকৃতি আলাদা হয়। তিনি ধর্মীয় বৈচিত্র্যতাকে পর্যবেক্ষনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে সার্বজনীন আদর্শ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
নৃবিজ্ঞানী ক্লদ-লেভিস্ত্রস তার কাঠামোবাদী আলোচনায় সাইকিক ইউনিটিকে গুরুত্ত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় পুরাণ বা মিথ পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে এগুলার অন্তর্নিহিত অর্থগুলোর মধ্যবর্তী আন্তঃসম্পর্ক কে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে কাঠামোবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেন।
এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক তত্ত্ব দিয়েও ধর্মের নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সম্প্রদায়, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম “পবিত্র” এবং “অপবিত্র” ধারণার মধ্য দিয়ে সামাজিক গোষ্ঠীর একত্রীকরণ এবং সংহতি ব্যাখা করেন। তার মতে ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী ধর্মের ধারণার মধ্য দিয়ে সমাজে পবিত্রতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করে। তারা এক ধরণের নৈতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলে যেখানে সকলে একই মূল্যবোধের অন্তর্গত। আর এই নৈতিক সম্প্রদায় তারা গড়ে তোলে ধর্মীয় আদেশ-নির্দেশের সহায়তা নিয়ে যা তাদের সামাজিক স্বার্থে প্রয়োগ করা হয়।
নৃবিজ্ঞানী ব্রনিস্ল ম্যালিনস্কি ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Functionalist approach) এর মাধ্যমে দেখান যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজের মানুষের মনস্তাত্বিক চাহিদা পূরণ করে থাকে। অন্যদিকে, র্যাডক্লিফ ব্রাউনের কাঠামোবাদী ক্রিয়াবাদের মতে, ধর্ম শুধুমাত্র ব্যক্তি পর্যায়ে মনস্তাত্বিক চাহিদা পূরণ করে না, বরং সমাজে বিদ্যমান গোষ্ঠীর দলীয় চাহিদা পূরণেও ক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে।
জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স তার ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দিয়ে ধর্মকে বিশ্লেষণ করেন। তার মতে, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উৎপাদন সম্পর্ক সমাজে শ্রেণী বৈষম্য নির্মাণ করে। আর উচ্চবর্গীয় শ্রেণীর আধিপত্য কেবল অর্থনীতি বা শিক্ষাব্যবস্থায় নয়, বরং ধর্ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। অর্থাৎ যদি একটি শ্রেণী-বিভাজিত সমাজে অর্থনীতি এবং রাজনীতি কেন্দ্রীভূত হয় তাহলে ধর্মও কেন্দ্রীভূত হবে। মার্ক্স বলেন, সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষেরা অনেক সময় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিন্মশ্রেণীর মানুষদের উপর ধর্মীয় অনুভূতি চাপিয়ে দেয়। এজন্যই মার্ক্স ধর্মকে সংজ্ঞায়ন করেছিলেন “আফিম” হিসেবে, যে আফিম দিয়ে ধনী শ্রেণী তাদের শ্রেণী বৈষম্যের রাজনীতি ভুলিয়ে রাখে।
ধর্মকে বস্তুবাদের তাত্ত্বিক জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেন আরো একজন নৃবিজ্ঞানী – মারভিন হ্যারিস। তিনি ভারতে গরু ভক্তির উদাহরণ টেনে বলেন যে কোনো অঞ্চলের ধর্মীয় চর্চা সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অবস্থার উপর নির্ভরশীল। ভারতে মৃত গরুর থেকে জীবন্ত গরুর অর্থনৈতিক সুবিধা বেশি। কেননা ভারত কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। আর কৃষিতে গরুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গরুর গোবর থেকে সার বানানো যায়, গরু দিয়ে লাঙল টানা যায়, আবার চাষাবাদে উচ্ছিষ্ট শস্য, ঘাষ দিয়ে গরুকে সহজেই লালনপালন করা যায়। হ্যারিসের মতে, এজন্যই ভারতে হিন্দু ধর্ম গো হত্যার উপর ধর্মীয় নিষেদাজ্ঞা আরোপ করে।
এছাড়াও বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানীরা ধর্মকে বিভিন্ন সমসাময়িক তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেও ব্যাখা করে থাকেন। ম্যারি ডগলাস, ভিক্টর টার্নার এবং ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ প্রতীকী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ধর্মের ব্যাখামূলক অধ্যয়ন শুরু করেন। গিয়ার্টজের মতে ধর্ম একটা প্রতীকী ব্যবস্থা যেখানে একাধিক প্রতীক থাকবে। ভিক্টর টার্নার এরূপ প্রতীকী দৃষ্টিকোণকে আরো এক ধাপ সামনে নিয়ে যান তার ‘সোশ্যাল ড্রামা’ তত্ত্বের মাধ্যমে। টার্নার ধর্মীয় আচারকেও একটি সামাজিক নাটক হিসেবে বর্ণনা করে, যার মধ্যে কিছু প্রতীকি অর্থ, নির্দিষ্ট ধাপ ও চর্চা থাকে এবং যার মধ্য পৃথিবী ও সামাজিক যাপন নিয়ে কোন অর্থ তৈরি হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে লোকেরা যখন ধর্মীয় আচারগুলো চর্চা করে, তখন এটি অনেকটা একটি নাটকে অভিনয় করার মতো যা তাদের সমাজে কী ঘটছে তা দেখাতে সাহায্য করে। ধরা যাক, একটি নাটকের তিনটি মূল অংশ আছে। যথাঃ ১) একটি গল্প বা তথ্য যা মানুষরা ইতিমধ্যে জানে, ২) একটি কনটেক্সট যেটার উপর ভিত্তি করে নাটকটি সাজানো হয়েছে, ৩) নাটকের চরিত্রগুলো যার মধ্যে চলমান ও পরিবর্তিত ঘটনাগুলো দৃশ্যায়িত করা হয়। টার্নার এমনভাবেই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে ব্যাখা করেছিলেন যেখানে ধর্মের মাধ্যমে সমাজের মানুষদের মাঝে বিশ্বাসের পরিবর্তনকে তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো মূলত ঐ সমাজের মানুষদের জন্য যা কিছুই গুরুত্বপূর্ণ বা যা কিছুই চলমান সেগুলোকেই প্রদর্শন করে। এজন্যই তিনি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে “সোশ্যাল ড্রামা” হিসেবে আখ্যায়িত করে ধর্মকে ব্যাখাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করেছেন।
নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ধর্মকে কোন একক তত্ত্ব দিয়েই পুরোপুরি ব্যাখা করা সম্ভব হয়নি। তবে ধর্মের কতীপয় প্রত্যয় সম্পর্কে বোঝাপড়ার জায়গাগুলোকে পাকাপোক্ত করতে ধর্মের বহুমুখী নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নৃবিজ্ঞান ধর্মকে নির্দিষ্ট সমাজের মানুষদের বিশ্বাস ব্যবস্থা এবং তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অধ্যয়ন করে। তবে সমসাময়িক সময়ে এসে ধর্মকে বিভিন্ন মাল্টিডিসিপ্লিনারি এবং ইন্টারডিসিপ্লিনারি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়। ফলে ধর্মের পর্যালোচনা প্রসঙ্গে আসলে নৃবিজ্ঞানের পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানকান্ডের বোঝাপড়াকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
Reference: Eller, J. D. (2007). Introducing Anthropology of Religion: Culture to the Ultimate. Routledge.