নৃবৈজ্ঞানিক ফিল্ডওয়ার্ক: সময়ের ধাঁধা
[নৃবৈজ্ঞানিক ফিল্ডওয়ার্কে সময়সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে লিখেছেন তাসনিম রিফাত]
ম্যালিনস্কি যখন ১৯১৪ সালের দিকে অস্ট্রেলিয়ায় ফিল্ডওয়ার্ক করতে যান, তখনোই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। বেচারা ম্যালিনস্কির পক্ষে তখন আর জাহাজে করে তার নিজ দেশে ফেরা সম্ভব ছিল না। নতুন এই আপদে পড়ে তিনি নিউ গিনি অঞ্চলে ফিল্ডওয়ার্ক করার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। সে সময়টাতেই তিনি পাপুয়া নিউ গিনি অঞ্চলের ট্রব্রিয়ান্ড আইল্যান্ডে যান তার বিখ্যাত সেই নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পন্ন করতে। নৃবিজ্ঞানীদের কাছে ট্রব্রিয়ান্ড আইল্যান্ড বোধহয় তীর্থস্থানের মর্যাদা পেয়েছেন। ম্যালিনস্কি যখন সেখানে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন, তখন তার কাছে সলোমন সাগরে ভেসে থাকা দ্বীপগুলোকে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং স্থির একেকটা স্থান বলে মনে হয়েছিল। ম্যালিনস্কির দেখা ট্রবিয়ান্ড আসলেই বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল কিনা সেটা নিয়ে অনেক তর্ক আছে, তবে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা যে সেই সময় খুব একটা ভালো ছিল না, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
ম্যালিনস্কির ১০৮ বছর পরে, আমার মতো একজন নবিশ নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী যখন একাডেমিক কাজে একটা ছোট ফিল্ডওয়ার্ক করতে যায়, তখন তার মাথায় প্রথম যে ভাবনাটা এসেছিল, সেটা হলো- আমাদের ফিল্ডটাও যদি নিজেদের থাকার জায়গা থেকে অনেক দূরে হতো, আর ফোনে কিংবা ইন্টারনেটে কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকতো, তাহলে পরিস্থিতি কেমন হতো?
আমাদের অবশ্য সে অভিজ্ঞতা হয়নি। আমরা এমন একটা জায়গায় ফিল্ডওয়ার্কে গিয়েছিলাম যেখানে আধুনিকতার মহান আবিষ্কার কোকাকোলাও পৌছে গেছে। বর্তমানে পৃথিবীর সব প্রান্তই কমবেশি অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যুক্ত এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কৃতিগুলোও কোন না কোনভাবে বিশ্বায়নের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তবে, সেই সময় ঐ ভাবনার সাথে আরো যে চিন্তাটি আমার মাথায় এসেছিল, সেটা হলো নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্থান আর সময়ের জটিলতা।
একজন নৃবিজ্ঞানীকে কাজ করতে হয় কোন একটি স্থানে আর নির্দিষ্ট সময়ে। স্থান বলতে বর্তমানে আর বাঁধা-ধরা কোন বদ্ধ জায়গা না বুঝালেও, তার যে একটা দৃশ্যমান উপস্থিতি আছে সেটা কেউ অস্বীকার করবে না। একইসাথে, একজন নৃবিজ্ঞানীকে তার বর্তমান সময়ের পর্যবেক্ষণ এবং অতীতের নানা উপাত্ত দিয়েই যেকোনো সংস্কৃতির সাথে বোঝাপড়ায় যেতে হয়। তবে, নৃবিজ্ঞানীদের মূল কাজ যেহেতু সমাজ আর সংস্কৃতি ঘিরে এবং সমাজ-সংস্কৃতি মাত্রই সময় আর স্থানভেদে ভিন্ন ও পরিবর্তনশীল, কাজেই সময় আর স্থানের ধাঁধা কিভাবে নৃবিজ্ঞানে সমাধান করা যায়, সেটা এখনো অমীমাংসিত। আমরা নৃবিজ্ঞানের চিন্তক হিসেবে এইটুকু বলতে পারি যে, এই ধাঁধার হয়তো সমাধান সম্ভব না, তবে এই জটিলতা নিয়ে অবশ্যই আমাদের গবেষণার সময় চোখ-কান-নাক এবং পদ্ধতিগত ও তত্ত্বীয় মাথাটা সজাগ রাখতে হবে।
এই লেখায় আমি মূলত নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় সময়ের জটিলতা নিয়েই কথা বলবো। আমি বিখ্যাত একটি কেসের মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানে সময় নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতার ব্যাপারটি দেখাবো। কেসটির সাথে আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী এলিনর লিককের নাম জড়িত।
পূর্বের সমাজগুলোতে কি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল: লিককের এনকাউন্টার
নৃবৈজ্ঞানিক সাহিত্যে খুব প্রচলিত একটি ধারনা হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু সমাজের ধরন ছিল যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারনা ছিল না এবং সেই অর্থে উদ্বৃত্ত ছিল না। সেখানে সম্পত্তির ধারনা ছিল সামষ্টিক। নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন শিকারী-সংগ্রহকারী ও পশুচারণকারী প্রভৃতি সমাজগুলোতে এই ধরনের ব্যবস্থা ছিল । তবে, পরবর্তীতে মার্কিন নৃবিজ্ঞানে এই সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠতে থাকে। কয়েকজন নৃবিজ্ঞানী দাবি করতে থাকে যে, শিকারি-সংগ্রহকারী কিংবা পশুচারণকারী সমাজগুলোতেও পরিবারনিয়ন্ত্রিত সম্পত্তির ধারনা দেখা যায়, সেখানে আবার উত্তরাধিকারসূত্রও থাকে।
ফ্র্যাংক জি. স্পেক নামে একজন নৃবিজ্ঞানী ল্যাব্রাডরের আলগোংকিয়ান সমাজের উপর কাজ করতে গিয়ে বলেন যে, সে সমাজের শিকারিরা মনে করেন তাদের ব্যক্তিগত জমি আছে। তার মতে, সেই সমাজের মানুষরা তাদের নিজস্ব জমি এবং অপরের জমির মধ্যে সীমানা চিহ্নিত করতে পারে এবং তাদের এখানেও বাবা থেকে ছেলের কাছে জমির অধিকার পরিবাহিত হয়। স্পেকের মতে, এই ধরনের উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিকানা আলগোংকিয়ান সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
তবে, পররবর্তীতে এলিনর লিকক সেখানে কাজ করতে গিয়ে আবার ভিন্নধরনের পর্যবেক্ষণ করেন। লিককের মতে, স্পেকের কাজের মূল সমস্যা হলো তিনি আলগোংকিয়ানদের উপরে ইউরোপীয় সমাজের প্রভাব এবং বাজার অর্থনীতির প্রভাবটা বুঝতে পারেননি, যার একটা অন্যতম কারণ হলো, ল্যাব্রাডরে ইউরোপীয়দের আবির্ভাবের আগের সময়টাকে স্পেক তেমন গুরত্ব দেননি। কিন্তু লিককের গবেষবণায় দেখা যায়, ইউরোপীয়দের আসার আগে আর পরে ল্যাব্রাডরের আদিবাসী সমাজগুলোর সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ব্যাপক তফাত দেখা গেছে।
লিকক প্রি-কলোনিয়াল সময়ের আগের তথ্য-উপাত্ত ঘেটে দেখান, ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের আগে ল্যাব্রাডরের সমাজগুলোতে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোন জমির ধারনা ছিল না। এমনকি সেসব সমাজে কোন আনুষ্ঠানিক চিফের ধারনাও ছিল না। আলগোংকিয়ানদের মধ্যে নারীরাও সে সময় তুলনামূলক স্বাধীন ছিলেন। তবে, পরবর্তীতে ইউরোপীয়দের আগমনের পরে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যেতে থাকে।
ইউরোপিয় বণিকদের আগমনে প্রথম ধাক্কাটা লাগে ল্যাব্রাডরের ভূমিব্যবস্থায়। কলোনিয়াল যুগের আগে সেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধীনে জমির সংখ্যা ছিল অনেক। যার ফলে, সেখানে আলাদা টেরিটরির কোন প্রয়োজন ছিল না। তবে পরবর্তীতে, যখন ইউরোপীয়রা সেখানকার অনেক জমি দখল করে নেয়, তখন তার চাপ পড়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর। তাদের জমির সংখ্যা অনেকটাই কমে আসে, যার প্রভাব পড়ে তাদের শিকারব্যবস্থাতেও। আবার, কলোনিয়াল যুগের আগে স্থানীয় জনগোষ্ঠী মূলত শিকার করতো তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মিটানোর জন্য। নৃবিজ্ঞানীরা একে ‘সাবসিস্টেন্স ইকোনমি’ নামে বলে থাকেন। এই ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি পরিবার বা গোষ্ঠী তাদের খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মেটানোর জন্য যতটুকু উৎপাদন বা খাবার সংগ্রহ দরকার ততটুকুই সংগ্রহ করে থাকে। এই ধরনের ব্যবস্থায় সাধারণত উদ্বৃত্ত তৈরি হয় না কিংবা হলেও খুব কম পরিমানে থাকে। যার ফলে এইধরনের সমাজে পরিবারগুলোর মধ্যে তেমন একটা অর্থনৈতিক পার্থক্যও দেখা যায় না। পশ্চিমা বাজার অর্থনীতির বাইরে এই ধরনের সাবসিস্টেন্স ইকোনমি অনেক জায়গাতেই টিকে ছিল এবং এখনো এই ধরনের কিছু কিছু চরিত্র অনেক উৎপাদন ব্যবস্থায় দেখা যায়।
যাই হোক, ইউরোপীয়রা ল্যাব্রাডরে আসার পরে সেখানে তারা পশমের ব্যবসা শুরু করেছিল। ফরাসি অর্থনীতির জন্য সেই সময় পশমের ব্যবসা খুবই গুরত্বপূর্ণ ছিল। পশম তৈরির জন্য তারা ল্যাব্রাডরের স্থানীয় শিকারিদের উপরই নির্ভর করা শুরু করে। এই ঘটনা ল্যাব্রাডরের শিকারিদের অবস্থাও পুরোপুরি বদলে দেয়। পশমের বাজারের চাপে তাদের শিকারের ধরন আর উদ্দেশ্যও বদলে গিয়েছিল। একদিকে ইউরোপের চাপে জমি হারানো আরেকদিকে বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য শিকার- এই দুইয়ের চাপে শিকারকার্য তার সামষ্টিক রূপ হারায় এবং সেখানে ব্যক্তিশিকারির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একই প্রক্রিয়ায় ল্যাব্রাডরে সামষ্টিক ভূমির অধিকারকে হটিয়ে পরিবারকেন্দ্রিক ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। লিকক আরেকটা বিষয়ও খেয়াল করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, কলোনিয়াল সময়ের আগে আলগোংকিয়ানদের কোন কোন ব্যান্ডের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোন চিফ বা দলনেতার ধারনাও ছিল না, বরং ইউরোপীয়দের আগমনের পরে স্থানীয় গোষ্ঠীর সাথে ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিক একজন চিফের আগমন ঘটে।
স্পেক আর তার অনুসারী কিছু নৃবিজ্ঞানীর কাজে প্রি-কলোনিয়াল সময়ের ল্যাব্রাডরের জনগোষ্ঠীগুলোর সমাজব্যবস্থা এবং কলোনিয়াল শক্তি কিভাবে তাদের সমাজব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে সে সম্পর্কিত কোন ডাইনামিক্স নিয়ে পাঠ ছিল না। এই প্রবণতা আমরা অনেক নৃবিজ্ঞানীদের মাঝেই দেখি। ব্রিটেনের ক্রিয়াবাদী ধারার তাত্ত্বিকরাও কলোনিয়াল সময়ের প্রভাবকে উপেক্ষা করে আফ্রিকার সমাজগুলোকে স্থির এবং সময়হীন সমাজ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই কাজগুলোর অন্যতম দূর্বলতার জায়গা ছিল সময়ের সাথে সমাজগুলোর পরিবর্তনের বিষয়গুলো ধরতে না পারা।
শেষের কথা
আমরা নৃবিজ্ঞানীরা, যেকোনো মানুষের মতোই- সময়ের কাছে ক্ষুদ্র ক্রীড়নক মাত্র। সময়ের সাথে সমাজগুলোর যেভাবে পরিবর্তন হয়, সেটা অনেকক্ষেত্রেই নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা পুরোপুরি ধরতে পারে না। নৃবিজ্ঞানের প্রচলিত যে গবেষণা পদ্ধতি, সেখানে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বহুসময় ধরে অবস্থান করে একজন গবেষক সেখানকার সংস্কৃতিসহ সামগ্রিক জীবনপ্রণালীকে বুঝতে চান। এই ধরনের গভীর সংযোগের কারণেও একজনের নৃবিজ্ঞানীর কাছে গবেষণাকালীন পর্যবেক্ষণকে অন্যান্য সময়ের বাস্তবতার চেয়ে বেশি বাস্তব মনে হতে পারে। একটা এনালজি টানি। যেমন, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের একটি খেলা হচ্ছে ৯০ মিনিট ধরে। একজন ব্যক্তি সেই খেলাটি শুধুমাত্র ৫১-৭৬ মিনিট দেখতে পারলো। তার কাছে মনে হতে পারে সেই খেলাটির ২৫ মিনিটই সবচেয়ে অর্থপূর্ণ এবং আকর্ষনীয় ছিল। কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত থাকার কারণে এই পক্ষপাত তৈরি হতে পারে। নৃবিজ্ঞানীদের ফিল্ডওয়ার্কে ঠিক একই বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। যদিও বর্তমানে নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রে এই সমস্যা কাটানোর জন্য বহু নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতির ব্যবহার যাচ্ছে, রুপান্তর ঘটেছে গবেষণা পদ্ধতিতেও। এলিনর লিকক যেমন প্রি-কলোনিয়াল ও কলোনিয়াল সময়ের ডাইরি থেকে শুরু করে নানা তথ্য-উপাত্ত ঘেটে এবং একইসাথে এথনোগ্রাফির মাধ্যমে আলগোংকিয়ান সমাজের পরিবর্তন দেখিয়েছেন, তেমনি অনেক নৃবিজ্ঞানীই এখন বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।
সময় একটা ধাঁধা, আর এই ধাঁধার কোন চূড়ান্ত সমাধান নেই। নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আমরা সময়সংক্রান্ত সংকট পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারি না, তবে অতিক্রমের চেষ্টা করতে পারি। আর সমগ্র জ্ঞানের ইতিহাস তো ‘চেষ্টা’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
রেফারেন্স
Anthropology and anthropologists- Adam Kuper