টাইলরের সর্বপ্রাণবাদ

[এনথ্রোসার্কেলে টাইলরের সর্বপ্রাণবাদ নিয়ে লিখেছেন আনিয়া ফাহমিন]

নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রপঞ্চ। অন্য যেকোনো সামাজিক প্রপঞ্চের মতই ধর্মের উৎস ও বিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ও প্রকৃতিগত অনুসন্ধান প্রয়োজন। ধর্ম নিয়ে আলোচনার শুরুতেই যে প্রশ্নটি আসে তা হল– ধর্ম কী? ধর্মের সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পণ্ডিত এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মাঝে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইম ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করেন পবিত্র জিনিসের সাথে সম্পর্কিত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের একটি একীভূত ব্যবস্থা হিসেবে। ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টাইলর এর মতে ধর্ম বলতে বোঝায় যে কোন প্রকার আধ্যাত্মিক সত্তায় বিশ্বাস। এই সংজ্ঞাটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক কেননা এটি ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনার গণ্ডিকে মূল ধারার প্রচলিত ধর্মের বাইরে প্রসারিত করে।

টাইলর তাঁর ‘প্রিমিটিভ কালচার’ বইতে অসংখ্য নৃতাত্ত্বিক উদাহরণের মাধ্যমে ধর্মের উৎপত্তি ও বিবর্তন ব্যাখ্যা করেন। টাইলরের সর্বপ্রাণবাদ (Animism) এর তত্ত্ব অনুযায়ী ধর্মের মূল ভিত্তি আত্মায় বিশ্বাস। Animism এর উৎপত্তি ল্যাটিন অ্যানিমা শব্দটি থেকে যার অর্থ আত্মা। আদিম মানুষের আত্মা সম্পর্কিত ধারণাটি তৈরি হয় মূলত চেতনার দুটি অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। একটি স্বপ্নের অভিজ্ঞতা, অপরটি হল জীবন ও মৃত্যুর চেতনা। স্বপ্নে প্রত্যক্ষ করা মানবাকৃতি গুলো কে বা কারা?  জীবন বা চেতনার উৎস কি এবং জীবিত ও মৃতদেহের মধ্যে পার্থক্যই বা কি? এই দুটি প্রশ্নের উত্তরে আদিম মানুষেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যেকোনো ব্যক্তির স্বত্বাধিকারে মূলত দুটি জিনিস রয়েছে- জীবন ও একটি অলীক দ্বিতীয় সত্ত্বা, উভয়ই শরীর হতে বিচ্ছিন্ন অথবা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষমতা রাখে। যেহেতু উভয়ই মানবদেহে অবস্থান করে, এক্ষেত্রে সহজেই তাদের মধ্যে কাল্পনিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। এই সংমিশ্রণের ফলে জন্ম নেয় আমাদের চির পরিচিত আত্মার ধারণা। আত্মা- ছায়া শরীরি মানব সত্তা, জীবন ও চেতনার উৎস, দেহ হতে বিচ্ছিন্ন এবং দেহের মৃত্যুর পরেও যার অস্তিত্ব বহাল থাকে (কেননা মৃত ব্যক্তিকেও স্বপ্ন দেখা যায়)।

টাইলরের তত্ত্ব অনুযায়ী, আত্মার ধারণার ভিত্তিতে ধর্মের একটি প্রাথমিক রূপ হিসাবে পূর্বপুরুষের আরাধনার (ancestor worship) প্রচলন ঘটে। মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মাসমূহের সন্তুষ্টি বিধান ও সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে উত্তরসূরিরা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করত। ধর্মের বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য প্রাণী ও জড় বস্তুর মাঝেও আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়। সভ্যতার আদি পর্যায়ে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে বর্তমান সময়ের মতো বিশেষ পার্থক্য কল্পনা করা হত না। ফলে মানব দেহে আত্মার অস্তিত্ব থাকলে যেকোনো প্রাণী, এমনকি উদ্ভিদ বা জড় বস্তুতেও তার অস্তিত্ব থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক। কেননা নির্জীব বস্তুকে ব্যক্তিরূপ দানের প্রথা আদিম সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো। ডেভিড হিউমের মতে, মানবজাতির একটি সর্বজনীন প্রবণতা হল যেকোনো বস্তুর উপর তাদের অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্যসমূহ আরোপ করা, যেমনটা এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এ ধরনের বিশ্বাসের ভিত্তিতে এক পর্যায়ে গড়ে ওঠে প্রকৃতিপূজা (nature worship), যে ব্যবস্থায় জীবজন্তু, গাছপলা প্রভৃতি মানুষের কাছে আরাধ্য হয়ে ওঠে। প্রকৃতি পূজার পরবর্তী ধাপে মানুষ প্রাকৃতিক উপাদানের বদলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রপঞ্চে (চাঁদ, সূর্য, বনজঙ্গল) দেবদেবীর অস্তিত্বের সন্ধান পায়। 

আত্মার ধারনায় আদিম ও আধুনিক উভয় সভ্যতায়ই যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় তা হল, দেহের মৃত্যু ঘটলেও আত্মা অমর। আদিম সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসেই এ ধারণাটির উৎপত্তি ঘটে। তবে দেহের মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে দুটি ভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা যায়- আত্মার স্থানান্তর ও পরকালে আত্মার স্বাধীন অস্তিত্ব। আত্মার স্থানান্তরের ধারণাটি মূলত পুনর্জন্ম হিসেবে অধিক পরিচিত। টাইলর তার ‘প্রিমিটিভ কালচার’ বইয়ে আত্মার স্থানান্তর সম্পর্কে আদিম সমাজের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন উদাহরণ উপস্থাপন করেন।  কিছু আধুনিক ধর্ম বিশ্বাসেও এই ধারণাটির প্রচলন রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ ধর্মেই পুনর্জন্মের ধারনাটি প্রচলিত। বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি পুনর্জন্ম ও নির্বাণ। হিন্দু, শিখ, বা জৈন ধর্মেও পুনর্জন্মে বিশ্বাস রয়েছে।

মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থান সম্পর্কিত দ্বিতীয় ধারনাটি হল পরকাল তথা স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস। পরকালের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ইহ জীবনের বিভিন্ন উপাদানের উপর ভিত্তি করে। ফলে স্বর্গ বা নরক উভয়ই পৃথিবীতে মানুষের জীবন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, কামনা-বাসনা ও ভয়-ভীতির প্রতিচ্ছবি মাত্র। অনেক ক্ষেত্রে পরকাল বিবেচিত হয় ইহ-জীবনের কর্মফল লাভের উপযুক্ত সময় হিসেবে। অর্থাৎ পরজীবনের সুখ বা দুঃখ লাভ নির্ধারিত হয় পৃথিবীতে মানুষের কর্মের ওপর ভিত্তি করে। সভ্য সমাজে এই নীতিটি ব্যবহৃত হয় মানুষের মাঝে নৈতিক বিধি নিষেধ আরোপের জন্য।

অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতই ধর্মও স্থির নয়, বরং সময়ের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের  বিবর্তন ঘটে। আত্মার ধারনা সৃষ্টির আদি পর্বে আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা করা হত কেবল মানুষ, প্রাণী, বা বিশেষ কোনো গাছে। পরবর্তীতে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, নির্দিষ্ট গাছের বদলে আদিম মানুষেরা সম্পূর্ণ জঙ্গলের আত্মার উপাসনা আরম্ভ করে। আদিম যুগের মানুষেরা জীবনধারণের জন্য শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল ছিল। এ সকল গোত্র ছিল তুলনামূলকভাবে সমতাবাদী। খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবিষ্কারের পর সময়ের সাথে সাথে সমাজ বিবর্তিত হয়ে আরো জটিল হয়ে ওঠে। বর্বর যুগের মানুষের মাঝে সামাজিক স্তরবিন্যাস ও শ্রমবিভাজন তৈরি হয়। এই জটিল সামাজিক কাঠামো ও ক্ষমতার ক্রমবিন্যাসই প্রতিফলিত হয় উক্ত সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসে। ফলে সর্বপ্রাণবাদের পরিবর্তে প্রচলন ঘটে জটিল কাঠামোর বহুদেববাদ (Polytheism) এর। মানব সমাজের মতো দেবতাদের মাঝেও ক্ষমতার অনুক্রমের ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস করা হয়। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় এই কাঠামোটি পরিলক্ষিত হয়। কাঠামোটি বিবর্তিত হয়ে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায় যখন একজন দেবতা বা ঈশ্বরকে সকলের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা হয়, যাকে বলা হয় এক-ইশ্বরবাদ (Monotheism)। ইহুদি,  খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্ম এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

ক্রিয়াবাদি তত্ত্বানুসারে মানব সমাজে ধর্মের নির্দিষ্ট কিছু ক্রিয়া রয়েছে যা সামাজিক সংহতি ও কাঠামো বজায় রাখতে সাহায্য করে। দুর্খেইম এর মতে, ধর্ম একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমষ্টিগত চেতনার জন্ম দেয়।  ফলে সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির প্রতি ব্যক্তি দায়বদ্ধতা অনুভব করে। নৃবিজ্ঞানী ব্রনিসলো ম্যালিনস্কির মতে প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনা যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেগুলোকে ব্যাখ্যা ও নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাই ধর্মের প্রধান কার্যকারিতা। ধর্মের উৎস সম্পর্কে টাইলরের মতামত ম্যালিনস্কির ক্রিয়াবাদী ব্যাখ্যার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অর্থাৎ আদিম মানুষ তার পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনাকে ব্যাখ্যা ও নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা হিসেবেই সর্বপ্রাণবাদী ধ্যান-ধারণা ও আচার অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করে।  

পরিশেষে, টাইলরের সর্বপ্রাণবাদী তত্ত্ব অনুসারে, ধর্মের বিবর্তন নির্দেশ করে যে সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যায় ধর্মের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে কমে যাবে। এই তত্ত্ব মতে, ধর্মের উদ্ভব ঘটে প্রকৃতি ও মানব জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে। তৎকালীন সমাজের যুক্তিবোধ অনুযায়ী ধর্মীয় বিশ্বাসের মাধ্যমেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার সবচাইতে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব ছিল। তবে আধুনিক “সভ্য” সমাজে প্রকৃতিকে বিশ্লেষণের কাজটি করে থাকে বিজ্ঞান। ফলে আধুনিক যুগে যেকোন ঘটনার ব্যাখ্যায় মানুষ আর আগের মতো ধর্মীয় ব্যাখ্যার দ্বারস্থ হয় না। এভাবে মানুষ ধীরে ধীরে সর্বপ্রাণবাদী বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ, ধর্ম সংস্কৃতির এমন একটি উপাদান যা সুদূর অতীতে উদ্ভাবিত হয়েছিল প্রকৃতি ও মানব জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে, কিন্তু বর্তমানে এই কাজে তার প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে, ধর্মীয় ব্যাখ্যার জায়গা দখল করে নিচ্ছে বিজ্ঞানের ঘরানার যৌক্তিক চিন্তাপদ্ধতি। কিন্তু তবুও সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের যেটুকু প্রভাব টিকে রয়েছে টাইলর সেটাকে আখ্যায়িত করেন Cultural survival হিসেবে।

The Elementary forms of the religious life- Emile Durkheim

Eight theories of religion Book – Daniel L. Pals

Primitive Culture- Edward Burnett Tylor

An Introduction to Theory in Anthropology – Robert Hugh Layton