ট্যাটু সংস্কৃতির আদ্যোপান্তঃ লার্স ক্রুটাকের নৃভাবনা
ট্যাটু সংস্কৃতি বর্তমান সময়ে খুব জনপ্রিয়। বিশ্বের বহু নামকরা তারকা, ফুটবল খেলোয়াড়, কুস্তিগির ও শিল্পীর শরীরেই ট্যাটু অঙ্কিত থাকে। যেকারনে ধরেই নেওয়া হয় ট্যাটু একটি শহুরে সংস্কৃতির অংশ। একটা সময় পর্যন্ত আমারও একই ধারণা ছিল যে, ট্যাটু শিল্পটির সূত্রপাত আধুনিক শহুরে সংস্কৃতিতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরই একটা ভিডিও গেইম আর একটা এনিমেটেড মুভি ট্যাটু সংস্কৃতির সূত্রপাতের ইতিহাস নিয়ে আমার মনে সংশয় তৈরী করল।
Farcry 3 একটা ভিডিও গেইম যেখানে দেখা যায় যে, একদল বন্ধু একটা দ্বীপে ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে যায়। গেইমটির মূল চরিত্র জেসন ব্রডি ওই দ্বীপে টিকে থাকার লড়াই করতে থাকে। ধীরে ধীরে সে সেখানকার আদিবাসী সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় ও তাদের সাংস্কৃতিক আচার রপ্ত করে ফেলে। জেসন ব্রডি তার টিকে থাকার সংগ্রামে যখনই কোন পশু বধ করতো, কিংবা ওই আদিবাসী গোষ্ঠির সাথে যখনই কোন “অশুভ শক্তি” কে পরাজিত করতো, সেসব অর্জন তার শরীরে ট্যাটু হিসেবে অঙ্কিত হয়ে থাকতো।
আবার এনিমেটেড মুভি “মোয়ানা” (Moana) এর কাহিনী কাল্পনিক হলেও সেখানে যে সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে তা পলিনেশিয়ার সংস্কৃতি, বিশেষ করে সামোয়া সংস্কৃতিকে ইঙ্গিত করে। মোয়ানা-তে দেখা যায় এক দুরন্ত কিশোরী মোয়ানা, যে কিনা তার গোত্রের মানুষদের কল্যাণে সমুদ্রে পাড়ি জমায় দেবী তে-ফিতি কে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। সেই দু:সাহসিক যাত্রায় মোয়ানার সঙ্গী হয় উপদেবতা মাউই। মজার ব্যাপার হলো, মাউই যখনই কোন কিছু অর্জন করতো তখনি তা আপনা-আপনি তার শরীরে চিত্রিত হয়ে যেত।
এভাবে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, ট্যাটু কি তবে শহুরে সংস্কৃতি নয়? আদিম সমাজেও কি এর ইতিহাস আছে? ট্যাটু শিল্পের সূত্রপাতটা তবে কোথায়, কবে, কিভাবে হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ থেকেই ট্যাটু নিয়ে নৃবিজ্ঞানের লেখাপত্র ঘাটতে লাগলাম। আর তখন জানতে পারলাম, নৃবিজ্ঞানীরা বহু আগেই ট্যাটু সংস্কৃতির সূত্রপাতের অনুসন্ধান করেছেন আফ্রিকার বিভিন্ন আদিবাসী সংস্কৃতি ও তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে। সেসব গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর নামকরা ও শুরুর দিকের সব ট্যাটুশিল্পীরা মূলত আদিবাসী সংস্কৃতির সদস্য। অর্থাৎ তাদের হাত ধরেই চালু হয়েছে ট্যাটু শিল্পের চর্চা যা পরবর্তীতে শহুরে সংস্কৃতিতেও বহুলভাবে চর্চিত হয়!
ট্যাটু (Tattoo) শব্দটির বাংলা পরিভাষা “উলকি” হিসেবে প্রচলিত। ট্যাটু বা উলকি হলো শরীরে অঙ্কিত চিহ্ন বা চিত্র, যা ত্বকের দ্বিতীয় স্তরে সুচ ফুটিয়ে নকশা করা হয়। এটি ত্বকে স্থায়ীভাবে বসে যায়। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে শরীরে ট্যাটু করে। কোন কোন সংস্কৃতিতে আবার এটি নিষিদ্ধ ও অপসংস্কৃতি হিসেবেও বিবেচিত হয়। ট্যাটু করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার সাংস্কৃতিক পরিচয়, আদর্শ, রীতিনীতি ও চর্চাকে বিবেচনায় রাখে। কেননা সংস্কৃতিভেদে ট্যাটুর ধারণা ও উদ্দেশ্য বদলায়। কোন সংস্কৃতিতে হয়তো ধর্মীয় চর্চার অংশ হিসেবে ট্যাটু আঁকানো হয়। কোথাও আবার সাজসজ্জা হিসেবে, কিংবা বীরত্ব, পদবি ও সামাজিক মর্যাদা ফুটিয়ে তুলতে ট্যাটু আঁকানো হয়। কোন কোন ধর্ম মতে ট্যাটু আঁকানো একেবারেই নিষিদ্ধ।
ট্যাটু সংস্কৃতিকে ঘিরে রয়েছে নানা রকম বিতর্ক। এই লেখায় আমরা ট্যাটু সংস্কৃতির ইতিহাস, এই চর্চাকে ঘিরে সমসাময়িক বিতর্ক ও ট্যাটু সংস্কৃতি অধ্যয়নে নৃবিজ্ঞানি লার্স ক্রুটাকের অবদান নিয়ে আলোচনা করব।
ট্যাটু সংস্কৃতির সূত্রপাত
প্রত্নতাত্ত্বিকরা গবেষণার মধ্য দিয়ে ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং স্ক্যান্ড্যানভিয়ান দেশগুলো থেকে ট্যাটু শিল্পে ব্যবহৃত কিছু হস্তনির্মিত বস্তু সংগ্রহ করেন এবং বিশেষ ডেটিং মেথড ব্যবহার করে সেগুলার বয়স নির্ধারণ করেন। তাদের রেকর্ড অনুযায়ী ট্যাটু করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি সর্বপ্রথম সামগ্রীটি প্রায় ১২ হাজার বছর পুরনো! তবে কি ট্যাটু শিল্পের যাত্রাও অতো বছর পুরনো?
ট্যাটুর সাংস্কৃতিক ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ট্যাটু সংস্কৃতির আমদানি হয়েছে।
- সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ট্যাটু করার প্রবণতা সর্বপ্রথম দেখা যায় প্রাচীন জার্মান ও সেলটিক সভ্যতায়।
- সিথিয়ান (Scythian) সম্প্রদায়েও প্রাচীনকাল থেকেই ট্যাটু আঁকার চর্চা দেখা যায়। তাদের শরীরে প্রাণী কিংবা পৌরাণিক চরিত্র অঙ্কিত করা হতো। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এর মতে সিথিয়ানরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান নির্দেশ করার উদ্দেশ্যে শরীরে ট্যাটু করতো।
- মিশরের মমীগুলোর দেহেও ট্যাটুর হদিস পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্বিকদের মতে প্রায় ৩০০০ বছর আগে থেকে মিশরে ট্যাটু সংস্কৃতির চর্চা হয়ে আসছে। মিশরে ট্যাটু সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয় ধর্মীয় উপাসনা ও আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে ট্যাটুর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতীকী বর্ণনা দেওয়া শুরু হয়। যেমন- মিশরীয় সভ্যতায় সবুজ রঙের ট্যাটু দিয়ে প্রতীকীরূপে জন্ম, কালো রঙের ট্যাটু দিয়ে মৃত্যু ও নীল রঙের ট্যাটু দিয়ে প্রজননক্ষমতাকে নির্দেশ করা হতো।
- মিশরে ট্যাটু সংস্কৃতির সম্প্রসারণের পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যেও আধ্যাত্মিকতা এবং সাজসজ্জার অংশ হিসেবে ট্যাটুর প্রচলণ দেখা যায়। ধীরে ধীরে ঐ অঞ্চলের মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে ট্যাটু করা শুরু করে। যেমন- ভবঘুরেরা ট্যাটু করতো শয়তান বা প্রেতাত্মা থেকে রক্ষা পেতে, নারীরা ট্যাটু করতো সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য, আর পুরুষরা ট্যাটু করতো তাদের পুরুষত্বকে তুলে ধরতে।
- এশিয়া মহাদেশকেও ট্যাটু সংস্কৃতির আতুরঘর হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে চাইনিজ এবং জাপানিজরা এই ট্যাটু সংস্কৃতিকে অনেকটা সামনের দিকে নিয়ে গেছে। চাইনিজদের ট্যাটুকে বলা হয় “চি শেন” (Chi Shen)। চাইনিজদের মধ্যে দুলং (Dulong/Derung) গোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের সমাজের নারীদের মুখে ট্যাটু করে দিত যেন তাদেরকে দেখে বাইরের কেউ আকৃষ্ট না হয়। দুলং সমাজে এখনো নারীরা ট্যাটু করে। কিন্তু এখন তাদের ট্যাটু করার ব্যাপারটাকে সৌন্দর্য্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। অন্যদিকে, দাই (Dai) সমাজে মানুষেরা সারা শরীরে ট্যাটু বহন করে। তারা তাদের জীবদ্দশার বিভিন্ন পর্যায়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ট্যাটু করে যা নৃবিজ্ঞানে Rites of passage এর ধারণাকে ইঙ্গিত করে।
- চাইনিজ ইতিহাসে ট্যাটু সংস্কৃতির কুখ্যাতিও রয়েছে। চাইনিজরা একসময় তাদের অঞ্চলের অপরাধীদের শরীরে ট্যাটু করার মাধ্যমে তাদেরকে চিহ্নিত করে রাখতো। আধুনিক চাইনিজ সমাজেও ট্যাটুর সাথে অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে মিলিয়ে দেখা হয়।
- জাপানিজদের মধ্যে ট্যাটু সংস্কৃতি প্রায় ৪০০০ বছর আগে শুরু হয়। সেসময় তারা নিজেদের শরীরে ট্যাটু করতো কিনা জানা যায়নি, তবে তাদের মাটির কিছু আসবাবপত্রে ট্যাটুর হদিস পাওয়া গেছে। প্রাচীনকালে জাপানিজরা মাটির তৈরি পাত্রের গায়ে ট্যাটু করে আত্মীয়দের মৃত লাশের সাথে কবর দিতো। এর মাধ্যমে তারা মৃতব্যক্তির আত্মার নিরাপত্তা কামনা করতো।
- জাপানিজদের ইতিহাসেও ট্যাটুর কুখ্যাতি লক্ষণীয়। জাপানিজরা এক ধরনের ভিন্ন উপায়ে ট্যাটু করতো যার নাম ইরেজুমি (Irezumi)। ইরেজুমি ট্যাটুগুলো রঙিন ধরনের এবং এতে আতঙ্কজনক চিত্র অঙ্কিত থাকে। যেমন- গর্জনরত বাঘ কিংবা ড্রাগনের চিত্র। এই ফ্যাশনে ট্যাটু সংস্কৃতি দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। জাপানের একদল গ্যাংস্টার যারা ইয়াকুজা (Yakuza) নামে পরিচিত, তারা এই ট্যাটু নিজেদের শরীরে আঁকানো শুরু করে। পরবর্তীতে জাপানে ইরেজুমি ট্যাটু নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এটি আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ আরো অনেক দেশেই প্রচলিত।
- প্রাচীন ভারতেও বিভিন্ন জাতিদের মধ্যে ট্যাটুর প্রচলন দেখা যায়। প্রাচীন ভারতের নারীদের মধ্যে ট্যাটু চর্চার প্রচলন ছিল। অন্যদিকে পুরুষদের শরীরে তাদের অর্জন ফু্টিয়ে তোলতে ট্যাটু করা হতো। আবার, ভারতের অরুণাচল প্রদেশের অপতনি (Apatani) গোষ্ঠীর নারীদের মুখে ট্যাটু করা হয় যাতে তারা শত্রুপক্ষের যৌনাচার থেকে রক্ষা পায়।
সর্বপ্রথম ট্যাটু নিয়ে মতবিবাদ
“সর্বপ্রথম কার শরীরে ট্যাটু করা হয়?” এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষণা মহলে তৈরী হয়েছে নানা মতবিবাদ। ট্যাটু গবেষকরা মূলত দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। এক দল বিশ্বাস করতো চিলির এল মোরো (El Morro) অঞ্চলের চিনচড়ো (Chinchorro) সংস্কৃতির এক মমির দেহে সর্বপ্রথম ট্যাটু পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, তার শরীরে ট্যাটু করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ সালে! ইতিহাসে ঐ মমিটিকেই প্রাচীনতম ট্যাটু বহনকারী হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আর এরই সাপেক্ষে বছরের পর বছর বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হয়ে আসছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে এক সময় দ্বিতীয় দলটির বিকাশ ঘটে নৃবিজ্ঞানী লার্স ক্রুটাক ও তার তিন গবেষণা সহযোগীর হাত ধরে। তারা দাবি করেন যে চিনচড়ো মমির বয়স পরিমাপে ত্রুটি আছে। তারা আরো দাবি করেন যে ট্যাটু বহনকারী সবথেকে পুরাতন মানুষটি চিনচড়োর সেই মমি নয়! বরং, ইউরোপের ওতজি (Ötzi) নামক এক বরফমানবের, যেকিনা অস্ট্রিয়া-ইতালির বর্ডারের মাঝে আলপীয় গ্লেসিয়ারের পাদদেশে মারা যায়। ক্রুটাক ও তার সহকর্মীরা রেডিওকার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখান যে বরফমানব ওতজির শরীরে পাওয়া ৬১টি ট্যাটুর বয়স চিনচড়ো মমির তুলনায় কমপক্ষে ৫০০ বছর বেশি! অনেক বিজ্ঞানীই গবেষণার এই পরিবর্তনীয় ফলাফলটিকে চূড়ান্ত ধরে নেন।
কিন্তু ইতিমধ্যে চিনচড়ো মমিকে সবথেকে প্রাচীন ট্যাটু বহনকারী হিসেবে ধরে নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশ করা হয়ে গিয়েছিল। নৃবিজ্ঞানী ক্রুটাক যখন তার নতুন গবেষণা প্রবন্ধের মাধ্যমে ট্যাটু বিতর্কের অবসান ঘটান, তখন তিনি এই বিষয়ে ইতিমধ্যে যারা গবেষণা করেছেন তাদেরও নতুন করে ট্যাটু সংস্কৃতি অধ্যয়নের অনুরোধ জানান। তিনি পরামর্শ দেন, ট্যাটু গবেষকরা যেন ট্যাটুকে শুধু ঐতিহাসিক কিংবা প্রত্নতাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে এর প্রবর্তন ও প্রচলনকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখেন।
ট্যাটুর ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
নৃবিজ্ঞানী লার্স ক্রুটাক অনেকটা ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন কারণে ট্যাটুর ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেন। ক্রিয়াবাদ নৃবিজ্ঞানের জ্ঞানকান্ডে বহুল ব্যবহৃত এক ধরণের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি মতে, সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান উক্ত সমাজে বসবাসরত মানুষের জৈব-মনস্তাত্বিক (psycho-biological) চাহিদা পূরণে কাজ করে থাকে এবং এর মাধ্যমেই সমাজে সংহতি বজায় থাকে। ক্রুটাক তার বই “The Cultural Heritage of Tattooing” – এ ট্যাটুকে মানবদেহের দৃশ্যমান ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে ট্যাটুর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে হলে ট্যাটুকে ওই নির্দিষ্ট সংস্কৃতি ও ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাপেক্ষে অধ্যয়ন করতে হবে। ক্রুটাক ট্যাটু সংস্কৃতি চর্চাকে ৫ ধরনের ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরেছেন।
১। সাজসজ্জাঃ অনেক আদিবাসী সমাজে ট্যাটুকে সাজসজ্জা বা সৌন্দর্য্যবর্ধকের মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। কিছু প্রাচীনতম ট্যাটু বহনকারী (যেমন নুবিয়ান মমি ও সাইবেরিয়ান আলতাই) এর উপর গবেষণা করে দেখা যায় যে ট্যাটু তাদের শরীরের সৌন্দর্য্যবর্ধক হিসেবে কাজ করতো। তারা এও বিশ্বাস করতো যে ট্যাটু করার মাধ্যমে তাদের যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান সময়ে এসেও ট্যাটু সাজসজ্জা বা সৌন্দর্য্যবর্ধক হিসেবে ব্যক্তিচাহিদা মেটাতে কাজ করে। বর্তমান শহুরে সমাজেও বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে ট্যাটু এক ধরণের শিল্প যেটা তাদের শরীরের সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে দেয়। এই কারণেই বিভিন্ন নায়ক-নায়িকা, তারকা, কুস্তিগির কিংবা খেলোয়াড়ের শরীরে ট্যাটু করার ফ্যাশন বহুলভাবে চর্চিত হয়।
২। পরিচয়ঃ অনেক আদিবাসী সমাজেই উৎসব-আয়োজনের মাধ্যমে ট্যাটু করা হয়। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে ট্যাটু-ই আদিবাসী হিসেবে তাদের সামাজিক পরিচয়কে অক্ষুণ্ণ রাখবে। ট্যাটু এভাবে ব্যক্তির পরিচয়ের বাহক হিসেবে কাজ করে। প্রাগৈতিহাসিক কিছু সমাজে ট্যাটুকে জীবন উত্তরণের আচার (Rites of passage) হিসেবে গণ্য করা হতো। অর্থাৎ সমাজে কেউ জন্ম নিলে তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অর্জন সাপেক্ষে ট্যাটু আঁকা হতো। বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে এখনো ট্যাটু সংস্কৃতিকে তাদের এনকালচারেশন প্রক্রিয়া অর্থাৎ উক্ত আদিবাসী পরিচয়ে তাদের বেড়ে ওঠার শর্ত হিসেবে দেখা হয়। উত্তর আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের কাছে ট্যাটু করার উদ্দেশ্য হলো তার পূর্বপুরুষের আত্মা নিজের মধ্যে ধারণ করা। অর্থাৎ তাদের সংস্কৃতিতে ট্যাটু কোন ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয়ের পাশাপাশি তার বংশীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতেও কাজ করে।
৩। সামাজিক অবস্থানঃ কোন কোন সংস্কৃতিতে ট্যাটু ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করে। ভিন্ন পেশা বা সামাজিক অবস্থানের মানুষেরা (যেমন- ধর্মীয় গুরু, যাজক, ওঝা, বৈদ্য ইত্যাদি) ট্যাটু করার মাধ্যমে তাদের সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে।
- সামোয়ান সমাজে যারা ট্যাটুশিল্পী (Tattooist), তাদেরকে অন্যদের তুলনায় একটু বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসন এবং নিয়ম-কানুন মেনে মানুষের শরীরে ট্যাটু অঙ্কন করে। এই কারণে সামোয়ানদের মাঝে যারা ট্যাটুশিল্পী তাদেরকে অনেকক্ষেত্রে ধর্মযাজক হিসেবেও সমাজে দেখা হয়।
- এশিয়া, আফ্রিকা, ম্যালেনেশিয়া, পলিনেশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকায় যোদ্ধা ট্যাটুর প্রচলন আছে। যারা যুদ্ধে যায় অথবা যুদ্ধ জয় করে আসে, বীরত্বের পরিচয় হিসেবে তাদের শরীরে ট্যাটু করা হয়।
- ভারতের ইয়ামচুংড়ু নাগা (Yimchungru Naga) এবং মায়ানমারের মাছাম এবং পনয়ো নাগা (Macham and Ponyo Naga) সম্প্রদায়ের মাঝেও যোদ্ধা ট্যাটুর প্রচলন আছে। তবে তারা যদি কোনো বাঘ শিকার করতে পারে, শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে তাদেরকে যোদ্ধার সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে তাদের সামাজিক অবস্থানকে নির্দেশ করতে ট্যাটু অঙ্কন মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
- ঠিক উলটোভাবে, চাইনিজ এবং জাপানিজ সংস্কৃতিতে অনেক সময় অপরাধীদের শরীরে ট্যাটু করে দেওয়া হয়, যেন তাদেরকে সহজে চিহ্নিত করা যায়। এই চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ট্যাটু তাদেরও সামাজিক অবস্থানের জানান দেয়।
৪। চিকিৎসাঃ চিকিৎসাবিদ্যার অংশ হিসেবে ট্যাটু সংস্কৃতি বিভিন্ন সভ্যতায় প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত।
- সবথেকে প্রাচীন ট্যাটু যে “ওতজি” নামক বরফমানবের শরীরে পাওয়া যায়, সেই ট্যাটু পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে তার শরীরের ৬১টি ট্যাটু মূলত চিকিৎসার জন্য করা হয়েছিল।
- প্রায় ২৫০০ বছর আগে সাইবেরিয়ার যাযাবর গোষ্ঠী পাজিরিকদের (Pazyryk) মাঝেও পিঠের নিচের দিকে এবং গোড়ালির দিকে ব্যাথা নিরসনের জন্য ট্যাটু করার প্রচলন ছিল।
- বর্তমান যুগেও বিভিন্ন সমাজের চিকিৎসাশাস্ত্রে ট্যাটু অঙ্কনের চর্চা রয়েছে। জাপানের আইনু (Ainu) জনগোষ্ঠী, ক্যালিফোর্নিয়ার ইউকি (Yuki) এবং মিওক (Miwok) জনগোষ্ঠী, উত্তর আমেরিকার চিপ্পেয়া (Chippewa), মেনোমিনি (Menominee) এবং মেসকোয়াকি (Meskwaki) জনগোষ্ঠীসহ আরো অনেক সংস্কৃতিতে হাড়ের গিটের ব্যথা এবং বাতজ্বর থেকে রক্ষা পেতে ট্যাটু করার প্রচলন রয়েছে।
৫। মন্দভাগ্য থেকে সুরক্ষাঃ অনেক সংস্কৃতিতে “মন্দভাগ্য” অথবা “বদনজর” থেকে সুরক্ষিত থাকতে ট্যাটু শিল্পের চর্চা করা হয়। বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে অতিপ্রাকৃত জিনিস (যেমন- ভুত, প্রেত, শয়তান) কিংবা কুনজর থেকে সুরক্ষিত থাকতে ট্যাটু করা হয়ে থাকে।আবার অনেক সমাজের মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের সমাজে মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন আত্মাও ঘোরাফেরা করে। সেসব আত্মা থেকে নিজেদের আলাদা করতে এবং আত্মারা যেন ট্যাটু দেখে বুঝতে পারে যে এরা মানুষ, এই কারণেও অনেকে ট্যাটু করে থাকে। আর সেসব সমাজে বিশ্বাস করা হয় যে ট্যাটুশিল্পীরা বিশেষভাবে জাদুবিদ্যায় দক্ষ।
লার্স ক্রুটাক ট্যাটু নিয়ে আরো বেশ কিছু গবেষণাকর্ম প্রকাশ করেছেন। প্রাচীনতম ট্যাটুর অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে তিনি ২০১৮ সালে “Ancient Ink: The Archaeology of Tattooing” বইটি রচনা করেন। একবিংশ শতাব্দীর ট্যাটু শিল্প এবং চর্চা নিয়ে গবেষণা করে তিনি বিখ্যাত “The World Atlas of Tattoo” বইটি রচনা করেন ২০১৫ সালে। আদিবাসী নারীদের মাঝে ট্যাটু সংস্কৃতির উপর আলোকপাত করে তিনি ২০০৭ সালে রচনা করেন “The Tattooing Arts of Tribal Women”. এছাড়াও তিনি উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মাঝে গবেষণাকর্মের উপর ভিত্তি করে আরো বেশ কিছু বই রচনা করেছেন। লার্স ক্রুটাকের ট্যাটু নিয়ে গবেষণাকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালে একটি ডকুমেন্টরি সিরিজ রিলিজ হয় “Tattoo Hunter” নামে। এখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে ক্রুটাক তার গবেষণা শুরু করেন, বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে গিয়ে ট্রাইবাল ট্যাটুর ইতিহাসের খোঁজ করেন, ও ট্যাটু শিল্পের প্রাচীন প্রথাগুলোকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। ট্যাটু সংস্কৃতি নিয়ে যারা আরো বিস্তারিত জানতে আগ্রহী তারা এই সিরিজটি দেখা শুরু করতে পারেন।
ট্যাটুর সূত্রপাত, ইতিহাস, আদিম যুগ থেকে বর্তমান যুগে ট্যাটু আঁকার ধরন ও পরিবর্তন নিয়ে তো আমরা জেনে নিলাম। তবে ধারণা করা যায় কি ভবিষ্যতে ট্যাটু শিল্পের চর্চা কেমন হতে পারে? কিংবা ভাবুন তো, ট্যাটু কি একটা সময় প্রতিবাদের ভাষাও হয়ে উঠতে পারে? নৃবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এই প্রশ্নগুলো আমার মনে চিন্তার খোরাক জোগায়।