বাংলা ভাষায় প্রোটো-এনথ্রোপলজির দিশা- তাসনিম রিফাত

প্রোটো-এনথ্রোপলজি পদটি প্রথম ব্যবহার করেন এরিকসেন আর নিয়েলসেন তাদের ‘A History Of Anthropology’ বইটিতে। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় প্রাক-নৃবিজ্ঞান। নিয়েলসন আর এরিকসেন মূলত প্রাচীন গ্রিসের সময়কাল থেকে এনলাইটেনমেন্টের (আলোকময়তা) আগ পর্যন্ত নৃবিজ্ঞানের কাছাকাছি যে লেখাগুলো আছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য এই পদটি ব্যবহার করেন।

যেকোনো শাস্ত্র গড়ে উঠার জন্য সুনিদৃষ্ট সামাজিক  ও জ্ঞানতত্ত্বীয় পরিস্থিতির দরকার হয়। যেমন প্রাশ্চাত্যে নৃবিজ্ঞান বিকশিত হয়েছিল এনলাইটেনমেন্টের পরে, যখন তত্ত্ব আর গবেষণার তথ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হতে থাকে, এবং তা সুনিদৃষ্ট সমাজবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে ধারণ করে।  তবে ১৮-১৯ শতকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞান বিকশিত হলেও, তার আগের বহু লেখায় নৃবিজ্ঞানের কিছু নমুনা দেখা গেছে। এইক্ষেত্রে খুব আগেভাগে আসে গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাসের নাম।  

হেরোডটাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন গ্রিসের এক ঔপনিবেশিক শহরে। তিনি যেমন পারস্য যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলেন, তেমনি পশ্চিম এশিয়া আর মিশরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তাদের জীবনপ্রণালীর বিস্তারিত বিবরণও লিখেছিলেন। এসব বিবরণে অনেকসময়ই এথনোসেন্ট্রিক বা স্বজাতিপ্রীতি দিয়ে আক্রান্ত ছিল। তবে তার কাজের মধ্যে সেইসব সমাজের ভাষা,পোশাক, রাজনীতি, আইনসহ নানা বিষয়ের বর্ণনামূলক উপস্থিতি ছিল। কখনো কখনো ছিল অপরকে তার নিজের সাপেক্ষে বুঝতে চেষ্টা করার ঝোঁকও। তার লেখাগুলো থেকে ধারনা পাওয়া যায়, সেসময়েও গ্রিসের বিদ্যাজগতে  ‘অন্য’ বা ‘অপরকে’ কোন মানদন্ডে বাখ্যা করবো- সে তর্ক উপস্থিত ছিল; যা পরবর্তীতেও নৃবিজ্ঞানের গুরত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক বিতর্ক আকারে হাজির হয়। শুধু হেরোডটাস না, এইধরনের সামাজিক ইতিহাস লেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় পরবর্তীতে খালদুন, ভিকোসহ অনেকের লেখায়। ইবনে খালদুন তার কাজগুলোতে গোষ্ঠীর সাথে গোষ্ঠীর সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে আত্মীয়তার সম্পর্ক (Kinship) আর ধর্মের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে ডুর্খেইম থেকে শুরু করে বহু তাত্ত্বিকরা এই ধারনাগুলোকে ব্যবহার করেছেন। 

আমার ধারনা, এই অঞ্চলে এবং বাংলা ভাষাতেও এইধরনের বহু লেখা আছে৷ আমার একটা উদ্দেশ্য হলো বাংলা ভাষায় নৃবিজ্ঞানের কাছাকাছি লেখাগুলোকে চিহ্নিত করে তাকে একটা আলাপের মধ্যে নিয়ে আসা৷ তাহলে হয়তো এই অঞ্চলের নৃবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য, ধরন, এমনকি এথনোগ্রাফিক রিপোর্ট লেখার ধরন নিয়েও পর্যালোচনা করা যাবে৷

তবে এইক্ষেত্রে একটি সমস্যাও দেখা দেয়। প্রাশ্চাত্যে ডিসিপ্লিন হিসেবে নৃবিজ্ঞানের বিকাশকাল ধরা হয় মূলত উনিশ শতক থেকে৷ এইজন্য সেখানে এর আগেরকার লেখাগুলোকে প্রাক-নৃবিজ্ঞান হিসেবে সহজেই চিহ্নিত করা যায়৷ কিন্তু ভারতবর্ষে যেহেতু নৃবিজ্ঞানের বিকশিত হওয়ার সেইধরনের  নিদৃষ্ট ঐতিহাসিক রেখা জোরালোভাবে নেই , সেক্ষেত্রে আমরা একাডেমিতে ডিসিপ্লিন হিসেবে নৃবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত  যেসমস্ত লেখাপত্র আছে, সেগুলোকে নৃবিজ্ঞানের ছাঁচ দিয়ে বিবেচনা করতে পারি। সেজন্য এই লেখায়ও সময়কালের চেয়ে নৃবৈজ্ঞানিক প্রবণতাকেই বেশি গুরত্ব দেওয়া হয়েছে,  অর্থাৎ  প্রায়-নৃবিজ্ঞান গোছের লেখাগুলোর খোঁজ করাই মূল উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা হয়েছে। 

বাংলা ভাষা প্রোটো-এনথ্রোপলজির খোঁজের জন্য সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ‘ নামের লেখাটির প্রসঙ্গ তোলা যায়। ‘পালামৌ’ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় খন্ডাকারে প্রকাশিত হওয়া শুরু করে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে৷ সঞ্জীবচন্দ্র  ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিহারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তার সেইসময়কার কর্মক্ষেত্রে ছিল পালামৌ। সেখান থেকে ফিরে আসার পরেই তিনি ‘পালামৌ’ লেখায় হাত দেন। সোজাসুজিভাবে একে ভ্রমণকাহিনীই বলা যায়৷ তবে একটু তলিয়ে দেখলে এখানে লেখকের পালামৌ ভ্রমণের আত্মগত (Subjective) অভিজ্ঞতাগুলোই শুধু নয়, এর পাশাপাশি পর্যবেক্ষনের ব্যাপারগুলোও চোখে পড়বে। পাঠকের সুবিধার্থে পালামৌ রচনার পঞ্চম অংশটি এখানে (নিচে) প্রকাশিত হল। আমি মূলত এই অংশকে ঘিরেই একটি নৃবৈজ্ঞানিক আলোচনার চেষ্টা করবো৷ 

নৃবৈজ্ঞানিক রচনার একটা বড় লক্ষণ হলো লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে তার পর্যবেক্ষণকে সামনে আনা। এমনকি কখনো কখনো গবেষকের সাথে তার গবেষিত জনগোষ্ঠীর কিংবা স্থানের মিথস্ক্রিয়াও নৃবিজ্ঞানে মূল আলাপের বিষয় হয়ে উঠে। অন্তত প্রথমদিকের নৃবিজ্ঞানের যেকোনো তত্ত্বের দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, একজন গবেষক তার ফিল্ডে গিয়ে কিভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন, কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করবেন- তার খাতিরেই তত্ত্বীয় কাঠামোগুলো নির্মিত হচ্ছে। যেমন- ম্যালিনোস্কির ক্রিয়াবাদী ব্যাখ্যার মধ্যে তার অন্তরঙ্গ গবেষণা পদ্ধতি (Participating Observation) জোরালোভাবে কার্যকরী ছিল। আবার বোয়াসের তত্ত্বীয় ধারণারও অন্যতম ভিত্তি ছিল তার পদ্ধতি। এইজন্যই নৃবিজ্ঞানে তত্ত্বভেদে বিভিন্নধারার এথনোগ্রাফিক রিপোর্টেও পার্থক্য দেখা যায়।

এবার পালামৌ’র প্রসঙ্গে আসি। সঞ্জীবচন্দ্র এই অংশের প্রথমেই কোলদের বিবাহপ্রথা নিয়ে আলাপ করেন। তার এই পর্যবেক্ষণ কিন্তু নিছক আত্মস্মৃতি নয়, বরং অনেকটা নৈব্যাক্তিক৷ লেখক এখানে বলেন, তিনি নিজেও  কোলদের এক জাতির বিয়েতে গিয়েছিলেন। লেখক একইসাথে কোলদের যে চারটা জাতি আছে, সে তথ্যও দিয়ে দিচ্ছেন। এই লেখার একটি বড় অংশ জুড়েই আছে কোলদের বিবাহরীতির বর্ণনা। 

কোলদের বিবাহরীতির ক্ষেত্রেও লেখক তার পর্যবেক্ষণের উপর গুরত্ব দিয়েছেন। তাদের বিবাহরীতির সাথে ভারতীয় শাস্ত্রীয় রীতির তুলনার মাধ্যমে তুলনামূলক রীতির ব্যবহার করেন। যেমন এখানে তিনি একজায়গায় বলেন, ‘প্রণয় কথাটি ঠিক নহে। কোলেরা প্রেম প্রীতের বড় সম্বন্ধ রাখে না। মনোনীত কথাটি ঠিক। নৃত্য হাস্য উপহাস্যের পর পরস্পর মনোনীত হইলে সঙ্গী, সঙ্গিনীরা তাহা কাণাকাণি করিতে থাকে।’ অর্থাৎ কোলদের বিবাহে প্রেম-প্রীতি নয়, বরং অন্যান্যা অনেকগুলো বিষয় গুরত্বপূর্ণ। নৃবিজ্ঞানের অনেক গবেষণায়, বিভিন্ন গোষ্ঠীসমাজে বিবাহপ্রথা কিভাবে ব্যক্তিমানুষের আবেগ-অনুভূতি নয়, বরং সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন ধরন হিসেবে কাজ করে- সেটা দেখা যায়। সঞ্জীবচন্দ্রের এই পর্যবেক্ষণ যারসাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

শুধু বিবাহের রীতি-নীতি নয়, সঞ্জীবচন্দ্র এখানে বিবাহের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করেছেন। কোলদের বিয়েতে অত্যাধিক ব্যয়, এবং সে টাকা জোগাড় করতে তাকে যে মহাজনের দ্বারস্থ হতে হয়- একারণে কোলদের কারো কারো জীবন কি ধরণের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়- তাও সঞ্জীবচন্দ্র ‘পালামৌ’তে তুলে আনেন। 

সংস্কৃতি কিভাবে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়ায় (কালচারাল ডিফিউসনিজম), সঞ্জীবচন্দ্র সে প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন ঋণ নামক প্রথাটির মাধ্যমে। তার মতে, কোলদের মধ্যে ঋণের প্রচলন ছিল না। মূলত হিন্দুস্থানী মহাজনদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ঋণের প্রথা চালু হয়৷ সঞ্জীবচন্দ্র এখানে ঋণের মতো কোন প্রথা অন্য কোন সংস্কৃতিতে কৃত্রিমভাবে ঢুকালে কি ঘটতে পারে- সে বিষয়ে নিজের ধারণা দেন । এক্ষেত্রে বলা যায়- সংস্কৃতির যে একটি স্থানিক রূপ আছে, সেই সম্পর্কেও তিনি সজাগ ছিলেন।

সঞ্জীবচন্দ্রের পালামৌ সম্পূর্ণভাবে নৃবৈজ্ঞানিক নয়। কারণ নৃবিজ্ঞানে যেকোন গবেষণায় সুনিদৃষ্ট পদ্ধতি (Method) খুব গুরুত্বপূর্ণ । বেশিরভাগক্ষেত্রেই নৃবিজ্ঞান যেহেতু হাওয়াই তত্ত্বের বদলে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গড়ে উঠা সুনিদৃষ্ট চিন্তাকে গুরত্ব দেয় এবং যেকোন গবেষণা ক্ষেত্রের (ফিল্ড) উপস্থিত মানুষ এবং অন্যান্যা বস্তুগত উপাদানের সচল উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দিতে চায় , সেইজন্য কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির একক ধারণার উপরে নৃবিজ্ঞান নির্ভর করে না। সঞ্জীবচন্দ্র এখানে শেষপর্যন্ত একক ব্যক্তি হিসেবেই নিজের পর্যবেক্ষণের কথা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া এ লেখার এক অংশে তিনি সভ্য-অসভ্যের রেখা টানার চেষ্টা করেছেন, যা নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমস্যাজনক। তবে সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, বিভিন্ন প্রথাকে একটা জনগোষ্ঠীর  জীবন-যাপনের সাথে সংযুক্ত করে দেখা, এবং এই জীবনপ্রনালির বিভিন্ন অংশের আন্তঃসম্পর্ক নির্ণয় করা নৃবিজ্ঞানের একটি প্রধাণ কাজ। ’পালামৌ’ রচনায় সঞ্জীবচন্দ্রও অনেকক্ষেত্রেই এই কাজটি করার চেষ্টা করেছেন। তার তার কাজটি নৃবিজ্ঞানের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য ধারন করেছে। সেইসূত্র ধরে হয়তো বাংলাভাষায় নৃবিজ্ঞানের রূপ কেমন হতে পারে- তার সম্ভাবনা কিংবা সংকটের ধরন যাচাইয়ের আরো সম্ভাবনা আছে।  

পালামৌ রচনার পঞ্চম অংশ  

কোলের নৃত্য সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিত  বলা হইয়াছে, এবার তাহাদের বিবাহের পরিচয় দিতে ইচ্ছা হইতেছে। কোলের অনেক শাখা আছে। আমার স্মরণ নাই, বোধ হয় যেন উরাঙ, মুণ্ডা, খেরওয়ার এবং দোসাদ এই চারি জাতি তাহার মধ্যে প্রধান। ইহার এক জাতির বিবাহে আমি বরযাত্রী হইয়া কতক দূর গিয়াছিলাম। বরকর্ত্তা আমার পাল্‌কী লইয়া গেল, কিন্তু আমায় নিমন্ত্রণ করিল না; ভাবিলাম—না করুক, আমি রবাহূত যাইব। সেই অভিপ্রায়ে অপরাহ্ণে পথে দাঁড়াইয়া থাকিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি, পাল্‌কীতে বর আসিতেছে। সঙ্গে দশ বার জন পুরুষ আর পাঁচ ছয় জন যুবতী, যুবতীরাও বরযাত্রী। পুরুষেরা আমায় কেহই ডাকিল না, স্ত্রীলোকের চক্ষুলজ্জা আছে, তাহারা হাসিয়া আমায় ডাকিল, আমিও হাসিয়া তাহাদের সঙ্গে চলিলাম; কিন্তু অধিক দূর যাইতে পারিলাম না; তাহারা যেরূপ বুক ফুলাইয়া, মুখ তুলিয়া, বায়ু ঠেলিয়া মহাদম্ভে চলিতেছিল, আমি দুর্ব্বল বাঙ্গালী, আমার সে দম্ভ, সে শক্তি কোথায়? সুতরাং কতক দূর গিয়া পিছাইলাম; তাহারা তাহা লক্ষ করিল না; হয়ত দেখিয়াও দেখিল না; আমি বাঁচিলাম। তখন পথপ্রান্তে এক প্রস্তরস্তূপে বসিয়া ঘর্ম্ম মুছিতে লাগিলাম, আর রাগভরে পাথুরে মেয়েগুলাকে গালি দিতে লাগিলাম। তাহাদিগকে সেপাই বলিলাম, সিদ্ধেশ্বরীর পাল বলিলাম, আর কত কি বলিলাম। আর একবার বহু পূর্ব্বে এইরূপ গালি দিয়াছিলাম। একদিন বেলা দুই প্রহরের সময় টিটাগড়ের বাগানে “লসিংটন লজ” হইতে গজেন্দ্রগমনে আমি আসিতেছিলাম—তখন রেলওয়ে ছিল না, সুতরাং এখনকার মত বেগে পথ চলা বাঙ্গালীর মধ্যে বড় ফেসন হয় নাই—আসিতে আসিতে পশ্চাতে একটা অল্প টক টক শব্দ শুনিতে পাইলাম। ফিরিয়া দেখি, গবর্ণর জেনেরল কাউন্‌সলের অমুক মেম্বারের কুলকন্যা একা আসিতেছেন। আমি তখন বালক, ষোড়শ বৎসরের অধিক আমার বয়স নহে, সুতরাং বয়সের মত স্থির করিলাম, স্ত্রীলোকের নিকট পিছাইয়া পড়া হইবে না, অতএব যথাসাধ্য চলিতে লাগিলাম। হয়ত যুবতীও তাহা বুঝিলেন। আর একটু অধিক বয়স হইলে এদিকে তাঁহার মন যাইত না। তিনি নিজে অল্পবয়স্কা; আমার অপেক্ষা কিঞ্চিৎমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠা, সুতরাং এই উপলক্ষে বাইচ খেলার আমোদ তাঁহার মনে আসা সম্ভব। সেই জন্য একটু যেন তিনি জোরে বাহিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে পশ্চিমে মেঘের মতো আমাকে ছাড়াইয়া গেলেন, যেন সেইসঙ্গে একটু “দুয়ো” দিয়া গেলেন,—অবশ্য তাহা মনে মনে, তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্তে একটু হাসি ছিল, তাহাই বলিতেছি। আমি লজ্জিত হইয়া নিকটস্থ বটমূলে বসিয়া সুন্দরীদের উপর রাগ করিয়া নানা কথা বলিতে লাগিলাম। যাহারা এত জোরে পথ চলে, তাহারা আবার কোমলাঙ্গী? খোশামুদেরা বলে, তাহাদের অলকদাম সরাইবার নিমিত্ত বায়ু ধীরে ধীরে বহে। কলাগাছে ঝড়, আর শিমূল গাছে সমীরণ?

 সে সকল রাগের কথা এখন যাক; যে হারে, সেই রাগে। কোলের কথা হইতেছিল। তাহাদের সকল জাতির মধ্যে একরূপ বিবাহ নহে। এক জাতি কোল আছে, তাহারা উরাঙ কি, কি তাহা স্মরণ নাই, তাহাদের বিবাহপ্রথা অতি পুরাতন। তাহাদের প্রত্যেক গ্রামের প্রান্তে একখানি করিয়া বড় ঘর থাকে। সেই ঘরে সন্ধ্যার পর একে একে গ্রামের সমুদয় কুমারীরা আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই ঘর তাহাদের ডিপো। বিবাহযোগ্য হইলে আর তাহারা পিতৃগৃহে রাত্রি যাপন করিতে পায় না। সকলে উপস্থিত হইয়া শয়ন করিলে গ্রামের অবিবাহিত যুবারা ক্রমে ক্রমে সকলে সেই ঘরের নিকটে আসিয়া রসিকতা আরম্ভ করে, কেহ গীত গায়, কেহ নৃত্য করে, কেহ বা রহস্য করে। যে কুমারীর বিবাহের সময় হয় নাই, সে অবাধে নিদ্রা যায়। কিন্তু যাহাদের সময় উপস্থিত, তাহারা বসন্তকালের পক্ষিণীর ন্যায় অনিমেষলোচনে সেই নৃত্য দেখিতে থাকে, একাগ্রচিত্তে সেই গীত শুনিতে থাকে। হয়ত থাকিতে না পারিয়া শেষে ঠাট্টার উত্তর দেয়, কেহ বা গালি পর্য্যন্তও দেয়। গালি আর ঠাট্টা উভয়ে প্রভেদ অল্প, বিশেষ যুবতীর মুখবিনির্গত হইলে যুবার কর্ণে উভয়ই সুধাবর্ষণ। কুমারীরা গালি আরম্ভ করিলে কুমারেরা আনন্দে মাতিয়া উঠে।

এইরূপে প্রতি রাত্রে কুমার কুমারীর বাক্‌চাতুরী হইতে থাকে, শেষ তাহাদের মধ্যে প্রণয় উপস্থিত হয়। প্রণয় কথাটি ঠিক নহে। কোলেরা প্রেম প্রীতের বড় সম্বন্ধ রাখে না। মনোনীত কথাটি ঠিক। নৃত্য হাস্য উপহাস্যের পর পরস্পর মনোনীত হইলে সঙ্গী, সঙ্গিনীরা তাহা কাণাকাণি করিতে থাকে। ক্রমে গ্রামে রাষ্ট্র হইয়া পড়ে। রাষ্ট্র কথা শুনিয়া উভয় পক্ষের পিতৃকুল সাবধান হইতে থাকে। সাবধানতা অন্য বিষয়ে নহে। কুমারীর আত্মীয় বন্ধুরা বড় বড় বাঁশ কাটে, তীর ধনুক সংগ্রহ করে, অস্ত্রশস্ত্রে শান দেয়। আর অনবরত কুমারের আত্মীয় বন্ধুকে গালি দিতে থাকে। চীৎকার আর আস্ফালনের সীমা থাকে না। আবার এদিকে উভয় পক্ষে গোপনে গোপনে বিবাহের আয়োজনও আরম্ভ করে।

শেষ একদিন অপরাহ্ণে কুমারী হাসি হাসি মুখে বেশ বিন্যাস করিতে বসে। সকলে বুঝিয়া চারি পার্শ্বে দাঁড়ায়, হয়তো ছোট ভগিনী বন হইতে নূতন ফুল আনিয়া মাথায় পরাইয়া দেয়, বেশ বিন্যাস হইলে কুমারী উঠিয়া গাগরি লইয়া একা জল আনিতে যায়। অন্য দিনের মত নহে, এ দিনে ধীরে ধীরে যায়, তবু মাথায় গাগরি টলে। বনের ধারে জল, যেন কতই দূর! কুমারী যাইতেছে আর অনিমেষলোচনে বনের দিকে চাহিতেছে। চাহিতে চাহিতে বনের দুই একটি ডাল দুলিয়া উঠিল। তাহার পর এক নবযুবা, সখা সুবলের মত লাফাইতে লাফাইতে সেই বন হইতে বহির্গত হইল, সঙ্গে সঙ্গে হয়তো দুটা চারিটা ভ্রমরও ছুটিয়া আসিল। কোল-কুমারীর মাথা হইতে গাগরি পড়িয়া গেল। কুমারীকে বুকে করিয়া যুবা অমনি ছুটিল। কুমারী সুতরাং এ অবস্থায় চীৎকার করিতে বাধ্য, চীৎকারও সে করিতে লাগিল। হাত পাও আছড়াইল। এবং চড়টা চাপড়টা যুবাকেও মারিল; নতুবা ভাল দেখায় না! কুমারীর চীৎকারে তাহার আত্মীয়েরা “মার মার” রবে আসিয়া পড়িল। যুবার আত্মীয়েরাও নিকটে এখানে সেখানে লুকাইয়া ছিল, তাহারাও বাহির হইয়া পথরোধ করিল। শেষে যুদ্ধ আরম্ভ হইল। যুদ্ধ রুক্মিণীহরণের যাত্রার মতো, সকলের তীর আকাশমুখী। কিন্তু শুনিয়াছি, দুই একবার নাকি সত্য সত্যই মাথা ফাটাফাটিও হইয়া গিয়াছে। যাহাই হউক, শেষ যুদ্ধের পর আপোষ হইয়া যায় এবং তৎক্ষণাৎ উভয় পক্ষ একত্র আহার করিতে বসে। 

এইরূপ কন্যা হরণ করাই তাহাদের বিবাহ। আর স্বতন্ত্র কোনো মন্ত্র তন্ত্র নাই। আমাদের শাস্ত্রে এই বিবাহকে আসুরিক বিবাহ বলে। এক সময় পৃথিবীর সর্ব্বত্র এই বিবাহ প্রচলিত ছিল। আমাদের দেশে স্ত্রী-আচারের সময় বরের পৃষ্ঠে বাউটি-বেষ্টিত নানা ওজনের করকমল যে সংস্পর্শ হয়, তাহাও এই মারপিট প্রথার অবশেষ। হিন্দুস্থান অঞ্চলের বরকন্যার মাসী পিসী একত্র জুটিয়া নানা ভঙ্গীতে, নানা ছন্দে, মেছুয়াবাজারের ভাষায় পরস্পরকে যে গালি দিবার রীতি আছে, তাহাও এই মারপিট প্রথার নূতন সংস্কার। ইংরেজদের বরকন্যা গির্জ্জা হইতে গাড়ীতে উঠিবার সময় পুষ্পবৃষ্টির ন্যায় তাহাদের অঙ্গে যে জুতাবৃষ্টি হয়, তাহাও এই পূর্ব্বপ্রথার অন্তর্গত।[১]

কোলদের উৎসব সর্ব্বাপেক্ষা বিবাহে। তদুপলক্ষে ব্যয়ও বিস্তর। আট টাকা, দশ টাকা, কখন কখন পনর টাকা পর্য্যন্ত ব্যয় হয়। বাঙ্গালীর পক্ষে ইহা অতি সামান্য, কিন্তু বন্যের পক্ষে অতিরিক্ত। এত টাকা তাহারা কোথা পাইবে? তাহাদের এক পয়সা সঞ্চয় নাই, কোন উপার্জ্জনও নাই, সুতরাং ব্যয় নির্ব্বাহ করিবার নিমিত্ত কর্জ্জ করিতে হয়। দুই চারি গ্রাম অন্তর এক জন করিয়া হিন্দুস্থানী মহাজন বাস করে, তাহারাই কর্জ্জ দেয়। এই হিন্দুস্থানীরা মহাজন কি মহাপিশাচ, সে বিষয়ে আমার বিশেষ সন্দেহ আছে। তাহাদের নিকট একবার কর্জ্জ করিলে আর উদ্ধার নাই। যে একবার পাঁচ টাকা মাত্র কর্জ্জ করিল সে সেই দিন হইতে আপন গৃহে আর কিছুই লইয়া যাইতে পাইবে না, যাহা উপার্জ্জন করিবে, তাহা মহাজনকে আনিয়া দিতে হইবে।  খাতকের ভূমিতে দুই মণ কার্পাস, কি চারি মণ যব জন্মিয়াছে, মহাজনের গৃহে তাহা আনিতে হইবে; তিনি তাহা ওজন করিবেন, পরীক্ষা করিবেন, কত কি করিবেন, শেষ হিসাব করিয়া বলিবেন যে, আসল পাঁচ টাকার মধ্যে এই কার্পাসে কেবল এক টাকা শোধ গেল, আর চারি টাকা বাকি থাকিল। খাতক যে আজ্ঞা বলিয়া চলিয়া যায়। কিন্তু তাহার পরিবার খায় কি? চাষে যাহা জন্মিয়াছিল, মহাজন তাহা সমুদয় লইল। খাতক হিসাব জানে না, এক হইতে দশ গণনা করিতে পারে না, সকলের উপর তাহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস। মহাজন যে অন্যায় করিবে, ইহা তাহার বুদ্ধিতে আইসে না। সুতরাং মহাজনের জালে বদ্ধ হইল। তাহার পর পরিবার আহার পায় না, আবার মহাজনের নিকট খোরাকী কর্জ্জ করা আবশ্যক, সুতরাং খাতক জন্মের মত মহাজনের নিকট বিক্রীত হইল। যাহা সে উপার্জ্জন করিবে, তাহা মহাজনের। মহাজন তাহাকে কেবল যৎসামান্য খোরাকি দিবে। এই তাহার এ জন্মের বন্দোবস্ত। 

কেহ কেহ এই উপলক্ষে “সামকনামা” লিখিয়া দেয়। সামকনামা অর্থাৎ দাসখত। যে ইহা লিখিয়া দিল, সে রীতিমত গোলাম হইল। মহাজন গোলামকে কেবল আহার দেন, গোলাম বিনা বেতনে তাঁহার সমুদয় কর্ম্ম করে; চাষ করে, মোট বহে, সর্ব্বত্র সঙ্গে যায়। আপনার সংসারের সঙ্গে আর তাহার কোন সম্বন্ধ থাকে না। সংসারও তাহাদের অন্নাভাবে শীঘ্রই লোপ পায়।

কোলদের এই দুর্দ্দশা অতি সাধারণ। তাহাদের কেবল এক উপায় আছে—পলায়ন। অনেকেই পলাইয়া রক্ষা পায়। যে না পলাইল, সে জন্মের মত মহাজনের নিকট বিক্রীত থাকিল।

 পুত্রের বিবাহ দিতে গিয়া যে কেবল কোলের জীবনযাত্রা বৃথা হয় এমত নহে, আমাদের বাঙ্গালীর মধ্যে অনেকের দুর্দ্দশা পুত্রের বিবাহ উপলক্ষে অথবা পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে। সকলেই মনে মনে জানেন, আমি বড় লোক, আমি “ধুমধাম” না করিলে লোকে আমার নিন্দা করিবে। সুতরাং কর্জ্জ করিয়া সেই বড়লোকত্ব রক্ষা করেন, তাহার পর যথাসর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া সে কর্জ্জ হইতে উদ্ধার হওয়া ভার হয়। প্রায় দেখা যায়, “আমি ধনবান্” বলিয়া প্রথমে অভিমান জন্মিলে শেষ দারিদ্র্যদশায় জীবন শেষ করিতে হয়।

 কোলেরা সকলেই বিবাহ করে। বাঙ্গালা শস্যশালিনী, এখানে অল্পেই গুজরান চলে, তাই বাঙ্গালায় বিবাহ এত সাধারণ। কিন্তু পালামৌ অঞ্চলে সম্পূর্ণ অন্নাভাব, সেখানে বিবাহ এরূপ সাধারণ কেন, তদ্বিষয়ে সমাজতত্ত্ববিদেরা কি বলেন জানি না। কিন্তু বোধ হয় হিন্দুস্থানী মহাজনেরা তথায় বাস করিবার পূর্ব্বে কোলদের এত অন্নাভাব ছিল না। তাহাই বিবাহ সাধারণ হইয়াছিল। এক্ষণে মহাজনেরা তাহাদের সর্ব্বস্ব লয়। তাহাদের অন্নাভাব হইয়াছে, সুতরাং বিবাহ আর পূর্ব্বমত সাধারণ থাকিবে না বলিয়া বোধ হয়।

 কোলের সমাজ এক্ষণে যে অবস্থায় আছে দেখা যায়, তাহাতে সেখানে মহাজনের আবশ্যক নাই, যদি হিন্দুস্থানী সভ্যতা তথায় প্রবিষ্ট না হইত, তাহা হইলে অদ্যাপি কোলের মধ্যে ঋণের প্রথা উৎপত্তি হইত না। ঋণের সময় হয় নাই। ঋণ উন্নত সমাজের সৃষ্টি। কোলদিগের মধ্যে সে উন্নতির বিলম্ব আছে। সমাজের স্বভাবতঃ যে অবস্থা হয় নাই, কৃত্রিম উপায়ে সে অবস্থা ঘটাইতে গেলে, অথবা সভ্য দেশের নিমাদি অসময়ে অসভ্য দেশে প্রবিষ্ট করাইতে গেলে, ফল ভাল হয় না। আমাদের বাঙ্গালায় এ কথার অনেক পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। এক সময় ইহুদি মহাজনেরা ঋণ দানের সভ্য নিয়ম অসভ্য বিলাতে প্রবেশ করাইয়া অনেক অনিষ্ট ঘটাইয়াছিল। এক্ষণে হিন্দুস্থানী মহাজনেরা কোলদের সেইরূপ অনিষ্ট ঘটাইতেছে। 

 কোলের নববধূ আমি কখন দেখি নাই। কুমারী এক রাত্রের মধ্যে নববধূ! দেখিতে আশ্চর্য্য! বাঙ্গালায় দুরন্ত ছুঁড়ীরা ধূলাখেলা করিয়া বেড়াইতেছে, ভাইকে পিটাইতেছে, পরের গোরুকে গাল দিতেছে, পাড়ার ভালখাকীদের সঙ্গে কোঁদল করিতেছে, বিবাহের কথা উঠিলে ছুঁড়ী গালি দিয়া পলাইতেছে। তাহার পর এক রাত্রে ভাবান্তর। বিবাহের পরদিন প্রাতে আর সে পূর্ব্বমতো দুরন্ত ছুঁড়ী নাই। এক রাত্রে তার আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন হইয়া গিয়াছে। আমি একটি এইরূপ নববধূ দেখিয়াছি। তাহার পরিচয় দিতে ইচ্ছা হয়।

 বিবাহের রাত্রি আমোদে গেল। পরদিন প্রাতে উঠিয়া নববধূ ছোট ভাইকে আদর করিল, নিকটে মা ছিলেন, নববধূ মার মুখ প্রতি এক বার চাহিল, মার চক্ষে জল আসিল, নববধূ মুখাবনত করিল, কাঁদিল না। তাহার পর ধীরে ঘীরে এক নির্জ্জন স্থানে গিয়া দ্বারে মাথা রাখিয়া অন্যমনস্কে দাঁড়াইয়া শিশিরসিক্ত সামিয়ানার প্রতি চাহিয়া রহিল। সামিয়ানা হইতে টোপে টোপে উঠানে শিশির পড়িতেছে। সামিয়ানা হইতে উঠানের দিকে তাহার দৃষ্টি গেল, উঠানের এখানে সেখানে পূর্ব্বরাত্রের উচ্ছিষ্টপত্র পড়িয়া রহিয়াছে, রাত্রের কথা নববধূর মনে হইল, কত আলো! কত বাদ্য! কত লোক! কত কলবর! যেন স্বপ্ন! এখন সেখানে ভাঙা ভাঁড়, ছেঁড়া পাতা! নববধুর সেই দিকে দৃষ্টি গেল। একটি দুর্ব্বলা কুক্কুরী—নবপ্রসূতি—পেটের জ্বালায় শুষ্ক পত্রে ভগ্ন ভাণ্ডে আহার খুঁজিতেছে, নববধূর চোখে জল আসিল। জল মুছিয়া নববধূ ধীরে ধীরে মাতৃকক্ষে গিয়া লুচি আনিয়া কুক্কুরীকে দিল। এই সময় নববধূর পিতা অন্দরে আসিতেছিলেন, কুক্কুরীভোজন দেখিয়া একটু হাসিলেন, নববধূ আর পূর্ব্ববমত দৌড়িয়া পিতার কাছে গেল না, অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। পিতা বলিলেন, ব্রাহ্মণভোজনের পর কুক্কুর ভোজনই হইয়া থাকে, রাত্রে তাহা হইয়া গিয়াছে, অদ্য আবার এ কেন মা? নববধূ কথা কহিল না! কহিলে হয়ত বলিত, এই কুক্কুরী সংসারী।

 পূর্ব্বে বলিয়াছি, নববধূ লুচি আনিতে যাইবার সময় ধীরে ধীরে গিয়াছিল, আর দুই দিন পূর্ব্বে হইলে দৌড়িয়া যাইত। যখন সেই ঘরে গেল, তখন দেখিল, মাতার সম্মুখে কতকগুলি লুচি সন্দেশ রহিয়াছে। নববধূ জিজ্ঞাসা করিল, “মা! লুচি নেব?” মাতা লুচিগুলি হাতে তুলিয়া দিয়া বলিলেন, “কেন মা আজ চাহিয়া নিলে? যাহা তোমার ইচ্ছা তুমি আপনি লও, ছড়াও, ফেলিয়া দাও, নষ্ট কর; কখন কাহাকেও ত জিজ্ঞাসা করে লও না? আজ কেন মা চাহিয়া নিলে? তবে সত্যই আজ থেকে কি তুমি পর হ’লে, আমায় পর ভাবিলে?” এই বলিয়া মা কাঁদিতে লাগিলেন। নববধূ বলিল, “না মা! আমি বলি বুঝি কার জন্য রেখেছ?” নববধূ হয়ত মনে করিল, পূর্ব্বে আমায় “ওই” বলিতে আজ কেন তবে আমায় “তুমি” বলিয়া কথা কহিতেছ?

 নববধূর পরিবর্ত্তন সকলের নিকট স্পষ্ট নহে সত্য, কিন্তু যিনি অনুধাবন করিয়াছেন, তিনিই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, পরিবর্ত্তন অতি আশ্চর্য্য! এক রাত্রের পরিবর্ত্তন বলিয়া আশ্চর্য্য! নববধূর মুখশ্রী এক রাত্রে একটু গম্ভীর হয়, অথচ তাহাতে একটু আহ্লাদের আভাসও থাকে। তদ্ব্যতীত যেন একটু সাবধান, একটু নম্র, একটু সঙ্কুচিত বলিয়া বোধ হয়। ঠিক যেন শেষ রাত্রের পদ্ম। বালিকা কী বুঝিল যে, মনের এই পরিবর্ত্তন হঠাৎ এক রাত্রের মধ্যে হইল!

১. যে আসুরিক বিবাহের পরিচয় দিলাম, তাহা Exogamy নহে। কেন না, ইহা স্বজাতিবিবাহ।

দোহাই

One thought on “বাংলা ভাষায় প্রোটো-এনথ্রোপলজির দিশা- তাসনিম রিফাত

Comments are closed.