কান্ট এবং মানবসত্ত্বা

[দুইদিন আগেই চলে গেল ইমানুয়েল কান্টের ৩০০ তম জন্মবার্ষিকী। এই উপলক্ষ্যে ব্রায়ান মরিসের ‘Kant & The Human Subject’ এর অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ হেল বুবুন]

সাম্প্রতিক কালের অনেক বই অনুযায়ী নৃবিজ্ঞানকে বলা হয়ে থাকে “মানুষ হওয়া বলতে কি বোঝায়”- এই প্রশ্ন উৎঘাটনের শাস্ত্র।  নৃবিজ্ঞানের এই একই সংজ্ঞা আমরা ইমানুয়েল কান্টের কাছেও দেখতে পাই। রুশো, হার্ডার ও ফার্গুসনের পাশাপাশি কান্টও ছিল এই জ্ঞানশাস্ত্রের একজন প্রতিষ্ঠাতা।

আলোকায়ন ও রোমান্টিকতাবাদ, এই দুই ধারার প্রভাবের কারণে জন্মের শুরু থেকেই নৃবিজ্ঞান ধারণ করেছে এক “দ্বৈত ঐতিহ্য” (মরিস ব্লখ)। অর্থ্যাৎ  মানবতাবাদ ও প্রকৃতিবাদের মিশ্রণ। পদ্ধতিগতভাবে, নৃবিজ্ঞান বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফেনোমেনা বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং হারমিনেটিউক্স ও বায়োসেমিওটিক্স এর মিশ্রণ ঘটায়৷ যদিও কেউ কেউ নৃবিজ্ঞানের ভেতর নানারকম বিভেদের অস্তিত্ব বিদ্যমান বলে দাবী করে থাকেন। নৃবিজ্ঞানে সবসময়ই উদ্দেশ্য ও দূরদর্শিতায় একটি নির্দিষ্ট ধরণের একতা ছিল। নৃবিজ্ঞান একটি সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে, যা মানুষকে ব্যাখ্যা করে প্রকৃতির মাঝে গভীরভাবে প্রোথিত হিসেবে। একারনেই, নৃবিজ্ঞান নিজেকে স্থাপিত করেছে মানবিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মাঝখানে, বিশেষে করে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের সাথে এর সম্পর্ক নিবিড়। অনেক দিক থেকেই, নৃবিজ্ঞান অনেক গুলো জ্ঞানশাস্ত্রের সমষ্টি। তবে নৃবিজ্ঞানকে অখন্ড রেখেছে এথনোগ্রাফিক গবেষণার উপর এর ফোকাস, যা একটি নির্দিষ্ট জীবনধারা কিংবা সংস্কৃতির নিবিড় পাঠ। কার্ল পপার ও মারিও বাঙ্গে উভয়ই নৃবিজ্ঞানকে প্রধান সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ, সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে অধ্যয়ন করার দিক থেকে এটা মানব বিজ্ঞানগুলোর মাঝে অদ্বিতীয়। যার অর্থ, এটা যেমন একদিকে পশ্চিমা সভ্যতা ও দর্শনের একটি সাংস্কৃতিক ক্রিটিক নিয়ে হাজির হতে পারে, অন্যদিকে পৃথিবীর সকলের সার্বজনীন মানবতার উপর গুরুত্ব প্রদান করে বিশ্ব মানবতার একতা সম্পর্কে অনুভূতি শক্তিশালী করতে পারে।

কান্ট মনে করতেন, সত্যম (জ্ঞানতত্ত্ব), সুন্দরম (নন্দনতত্ত্ব) ও শিবম (নীতিবিদ্যা), এই যেসব বিষয়গুলো দার্শনিকদের মুগ্ধ করে আসছে— কোনোটাই দর্শনের মূল প্রশ্ন নয়। বরং, “মানুষ আসলে কি”— এটা ছিল কান্টের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কান্টের মতে, এই প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র অভিজ্ঞতালব্ধ (ইম্পিরিকাল) জ্ঞান থেকেই প্রদান করা সম্ভব, অধিবিদ্যার সাহায্যে নয়। যার অর্থ, আমরা মানুষ সম্পর্কে হুসার্ল, হাইডেগার কিংবা দেরিদাদের অনুমানমূলক অ্যাকাডেমিক দর্শন থেকে নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র ও   বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে বেশী জানতে পারি।

সমগ্র মানব ইতিহাস জুড়ে সকল সংস্কৃতিই বিভিন্ন ভাবে কান্টের এই মৌলিক প্রশ্নের (মানুষ আসলে কি) উত্তর দিয়েছে। কেউ কেই এমনকি বস্তুগত দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ককেই  অস্বীকার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষ্ণের অনুসারীরা যেভাবে বলে ” তুমি তোমার দেহ নও।” পশ্চিমা দর্শনেও একটা শক্তিশালী ধারা রয়েছে যা সাব্জেক্ট কিংবা সত্ত্বাকে তার “চৈতন্য” হিসেবে চিহ্নিত করে। নৃবিজ্ঞানীরা অনেক আগেই দেখিয়েছেন যে, সংস্কৃতিভেদে মানুষ (হিউম্যান সাব্জেক্ট) ধারণাটির অর্থ একেবারেই ভিন্ন। অবশ্য, শুধুমাত্র পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যেই মানুষ-কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত কিংবা কন্সেপচুয়ালাইজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে, কান্টের প্রশ্নের পশ্চিমা উত্তর বহুমুখী ও পরস্পর বিরোধী। তবে এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে আমি তিনটি অ্যাপ্রোচ নিয়ে আলোচনা করতে চাইঃ দি এসেনশিয়ালিস্ট, দি ডুয়ালিস্ট এবং দি কান্টিয়ান ট্রায়াডিক অন্টোলজি অব সাব্জেক্ট।

মানব সারবত্তা (দি হিউম্যান এসেন্স)

এই অ্যাপ্রোচটি মানু্ষ বা মানব সত্ত্বাকে ব্যাখ্যা করতে চায় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য দ্বারা। এরকম কয়েকটি বহুল পরিচিত অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিংবা হচ্ছে, তা হলো হোমো ইকোনোমিকাস (অর্থনৈতিক মানব), হোমো ফেবার (যন্ত্র তৈরিতে সক্ষম প্রাইমেট), হোমো সেপিয়েন্স (বুদ্ধিমান প্রাণী) ও হোমো লুডেনস (ম্যান দ্যা প্লেয়ার)। অ্যারিস্টটল মানুষকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন “যুক্তিবোধ সম্পন্ন জন্তু” হিসেবে (এই সংজ্ঞা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে)। হাল আমলে দ্বৈতবাদী অধিবিদ্যার ধারক হিসেবে অ্যারিস্টটলকে দেকার্তে, কান্ট ও হেইডাগারের সাথে রাখা হচ্ছে, যা কিছুটা অসামঞ্জস্যজনক। কারণ, (যেমনটা আর্নস্ট মায়র সবসময় বলেছেন) অ্যারিস্টটল সবসময়ই একজন জীববৈজ্ঞানিক চিন্তক ছিলেন। সে নিঃসন্দেহে প্রাণি জগত নিয়ে প্রিটেনশাস দেরিদা ও দেরিদার বিড়ালের থেকে বেশী জানতেন। অন্যদিকে, রবার্ট অব্রে মানবতাকে ব্যাখ্যা করেছে “ঘাতক বানর” হিসেবে। আবার, জুলিয়ান লা মেট্রি ও রিচার্ড ডকিন্স মানুষকে দেখছেন একটি জৈবিক যন্ত্র হিসেবে। সাম্প্রতিক কালে মানুষের প্রকৃতিকে আরো হবসীয় ফ্যাশানে দেখা হচ্ছে শিকারী ও ধ্বংসাত্মক হিসেবেঃ হোমো রেপিয়েন্স (জন গ্রে)। এই ধরণের মানব-বিদ্বেষ বিতর্কযোগ্য। বলা যায়, এটা নিৎসের — “এই সুন্দর দুনিয়াতে মানুষ হলো মহামারী”—এই ধারণারই হালনাগাদ মাত্র। বিংশ শতকের অনেক ডিপ ইকোলজিস্টই একই ধরণের নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তাদের কাছে, জীবমন্ডলে মানুষ একটি পরজীবী৷ একারণেই তারা মানব সংখ্যা হ্রাসের মাধ্যম হিসেবে ম্যালেরিয়া, দুর্ভিক্ষ ও এইডস মহামারী প্রভৃতিকে উদযাপিত করেছেন। এই ধরণের অ্যান্টি-হিউম্যানিজমের সমালোচনা অনেক আগেই সোশ্যাল ইকোলজিস্ট মারে বুকচিন করেছেন।

মানুষের অপরিহার্য চরিত্র বলতে যা বোঝায় তার তালিকা আসলে অশেষ। তবে প্রধানত, অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে নেয়া মানবতা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা সাধারণত দুটি প্রধান ধারা রয়েছে। একদিকে রয়েছে ওইসব বুদ্ধিজীবী যারা দৃঢ়ভাবে একটি সার্বজনীন মানব প্রকৃতির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। এই অ্যাপ্রোচ সাধারণত একটি ব্যক্তি-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে করে হয় মানব প্রকৃতিকে বিশুদ্ধ যৌক্তিক সত্ত্বা হিসেবে দেখে অথবা  প্রকৃতিজাত প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যের ধারক হিসেবে দেখে মানুষকে— যে সার্বজনীন প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য মানুষ অর্জন করেছে প্যালিওলিথিক যুগে ন্যাচারাল সিলেকশানের মাধ্যমে, যখন মানুষ শিকারী-সংগ্রাহী ছিল। একারণেই, রবিন ফক্স বলেন, মানুষের একটি সার্বজনীন প্রবৃত্তি রয়েছে এবং এটি অপরিহার্যরূপে গোত্রীয়।

অন্যদিকে, অনেক পন্ডিত (বিশেষ করে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী, অস্তিত্ববাদী ও উত্তরাধুনিকরা) মানুষের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য তথা সার্বজনিন প্রকৃতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করে৷ তাদের মতে, ভাষা, প্রতীকী চিন্তা, আত্ম-সচেতনতা ও জটিল সামজিকতার বিকাশের মাধ্যমে মানূষ প্রকৃতি ও এর সাথে জড়িত প্রবৃত্তিগুলোর শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর্নেস্ট ক্যাসিয়ের তাই মানুষকে বলেছেন, হোমো সিম্বোলিকাস। মানুষ কিংবা তার প্রকৃতি নিয়ে এই ধরণের সংজ্ঞায়ন প্রায়ই সমালোচিত হয়েছে (স্টিভেন পিংকার এই সংজ্ঞায়নের একজন গুরুত্বপূর্ণ সমালোচক)। কারণ, এই সংজ্ঞায়ন ধরে নেয় যে, মানুষের মন সম্পূর্ণরূপে একটি ব্লাংক স্লেট, যেখানে মানুষের জৈবিক ইতিহাসের কোন জায়গা নেই৷ একইভাবে, এই সংজ্ঞায়নে উপেক্ষিত হয় উত্তরাধিকার দ্বারা অর্জিত মানব মস্তিষ্ক ও মনের নির্দিষ্ট সক্ষমতা।

হোমো ডুপ্লেক্স

এটা অনেক দিন ধরেই স্বীকৃত যে, মানুষ একইসাথে একটি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক জীব। এই ধারণাটিও স্বীকৃত যে, ভাষা, আত্ম-পরিচিতি ও সামাজিক অস্তিত্ব একে অপরের সাথে সংযুক্ত এবং পুরো মানব ইতিহাসজুড়েই এমনটা ছিল। ঠিক একারণেই কেনান মালিক বলেছেন, মানব প্রকৃতি যতোটা জৈবিক উত্তরাধিকারের ফসল, ঠিক ততোটাই ঐতিহাসিক বিকাশের ফলাফল। মানব সত্ত্বা সম্পর্কিত এই দ্বৈত ধারণাটিকে ইমিল দুর্খেইম বিখ্যাতভাবে বলেছিলেন “হোমো ডুপ্লেক্স”:

“মানুষ আসলে দ্বি-ভাজিত। তার মাঝে দুটি সত্ত্বা আছে: একদিকে, মানুষ একটি প্রানী যার ভিত্তি জৈবসত্ত্বা এবং অন্যদিকে, একটি সামাজিক জীব, যা বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক বিকাশের শিখরকে প্রতিনিধিত্ব করে।” (দি এলিমেন্টারি ফর্মস অব রিলিজিয়াস লাইফ)

অস্তিস্তবাদী চিন্তা তো দূরে থাক, দুর্খেইম তার তত্ত্বে (ব্যক্তিকেন্দ্রিক) মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার জন্য খুব অল্প স্থানই রেখেছিলেন। এদিক থেকে তিনি ও তার শিক্ষক অগাস্ট কোতের মাঝে মিল রয়েছে।

এডমন্ড হুসার্ল, এরিখ ফর্ম ও লিউস মামফোর্ডের মতো পন্ডিতরা অনেক দিন ধরেই মানব জীবনের কেন্দ্রে একটি অপরিহার্য প্যারাডক্স কিংবা স্ব-বিরোধীতার কথা বলে আসছেন। কারণ, জীব হিসেবে মানুষ যেমন একদিকে প্রকৃতির অংশ, অন্যদিকে আমাদের সচেতন অভিজ্ঞতা, প্রতীকী সত্ত্বা এবং সর্বোপরি আমাদের সংস্কৃতির বদৌলতে আমরা নিজেদেরকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করেছি। একারণেই রেমন্ড টালিস মানুষকে সংজ্ঞায়িত করেছে একটি  “explicit animal” হিসেবে। সিসেরো বলেছেন, মানুষের রয়েছে “দ্বিতীয় প্রকৃতি” (সেকেন্ড ন্যাচার)। এই দ্বৈততা বা দ্বান্দ্বিকতা সবথেকে দারুণভাবে ফুটে উঠে ভ্যাটিকানে রাফায়ালের বিখ্যাত চিত্রকর্ম স্কুল অব এথেন্সে, যেখানে প্লেটোকে দেখানো হয়েছে আকাশের দিকে (স্বর্গে) আঙ্গুল তুলে রয়েছেন, আর এরিস্টটলের হাত নিচের দিকে।

মানুষের মস্তিষ্ক যে দুইটি হেমিস্ফিয়ার নিয়ে গঠিত [এই দুটি হেমিস্ফিয়ারের ক্রিয়া যেমন ভিন্ন, অন্যদিকে এরা মানব অস্তিত্বের দুটি ভিন্ন পথের প্রতিনিধিত্ব করে], এই বৈজ্ঞানিক সত্যটিও মানব দ্বৈততাকে প্রতিনিধিত্ব করে। মস্তিষ্কের বাম হেমিস্ফিয়ার ভাষা, প্রতীকী চিন্তা, বিশ্লেষণ, ফ্যাক্টস, নিবিড় মনোযোগ ও দুনিয়ার অ-প্রাণিবাচক দিকগুলোর সাথে জড়িত; অন্যদিকে মস্তিষ্কের ডান হেমিস্ফিয়ার দৃশ্যকল্প, প্রাক-ভাষা চিন্তা, সমন্বয়, সাদৃশ্যতা ও সম্পর্ক, পরিপ্রেক্ষিত (কন্টেক্সট) ও জৈব জীবনের সাথে সম্পর্কিত। আবার, যুক্তিবোধ, বিজ্ঞান, সৃজনশীলতা ও আত্মচেতনা মস্তিষ্কের দুই পার্শ্বের সাথেই জড়িত। আবার, এটা বলা জরুরী যে ব্রেইনের হেমিস্ফিরিকাল পার্থক্য এবং লিঙ্গ, জাতীয়তা ও শ্রেণির মাঝে কোন সরলীকৃত সম্পর্ক নেই।

গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোন ব্যক্তির ব্রেইনের ডান পাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন ব্রেইনের বাম পাশ অধিক পরিমাণে ক্রিয়াশীল হয় এবং ফলশ্রুতিতে অতিরিক্ত যুক্তিবাদী চেতনা বিকাশিত হতে পারে। এই চেতনা বা সংবেদনশীলতা বিমূর্ততা ও জ্যামিতিক নকশার প্রতি এক ধরণের অগ্রাধিকার প্রকাশ করে। এরকম আরো কিছু প্রবণতা হলোঃ দেহ থেকে বিচ্ছিন্নতা, অন্যের জন্য সহমর্মিতা অনুভব না করা (ইগোইজম) এবং দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা— এটাই সম্ভবত উত্তরাধুনিক বাস্তবতা অথবা ডেলুজ কর্তৃক প্রশংসিত শিযোফ্রেনিক ব্যক্তিত্ব।

মানব সত্ত্বার এই দ্বৈত ধারণায় যা উপেক্ষিত হয়, সেটা হলো মানুষের অনন্যতা ও কর্তাসত্ত্বা। এক্ষেত্রে কান্টের মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত অধিক জটিল ট্রায়াডিক অন্টোলজি (ত্রয়ী সত্ত্বাবিদ্যা) ধারণা সহায়ক হতে পারে।

অ্যা ট্রায়াডিক অন্টোলজি

জীবদ্দশায় দর্শন সম্বন্ধীয় লেখালেখি ও পরবর্তীতে জ্ঞানকাণ্ডে তার গভীর প্রভাবের কারণে যথার্থভাবেই কান্টকে পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসের একজন মৌলিক অবদানকারী হিসেবে উদযাপন করা হয়। কান্টের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে প্রাকৃতিক ভূগোল নিয়ে গভীর আগ্রহ ছিল। তবে যে বিষয়টি অজানা কিংবা খুব কম পরিচিত সেটা হলো কান্ট বিশ বছরেরও অধিক সময়ে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে লেকচার দিয়েছেন। তার শিক্ষার্থী জোহান হার্ডার আমাদের জানায় যে, এই লেকচারে যেসব বিষয় আলোচিত হতো, তা আকর্ষণীয় ছিল। চুয়াত্তর বছর বয়সে কান্ট “অ্যান্থ্রোপলজি ফ্রম অ্যা প্রাগম্যাটিক পয়েন্ট অব ভিউ” (১৭৯৮) প্রকাশ করেন। [এখানে, প্রাগম্যাটিক শব্দটির মাধ্যমে কান্ট “জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে মানব স্বাধীনতার পরিধি বৃদ্ধি ও মানবীয় মর্যাদাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া”-কে বুঝিয়েছেন]

এই গ্রন্থে, কান্ট দেখানোর চেষ্টা করেন যে, মানুষকে বোঝার জন্য তিনটি ভিন্ন তবে আন্ত-সম্পর্কিত উপায় আছে। এক, পৃথিবীতে জন্ম নেয়া যুক্তিবোধ সম্পন্ন একটি প্রাণী (মেন্‌শ) হিসেবে। এই সর্বজনীন মানবতার ধারণাই কান্টের নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় ফোকাস। দুই, একটি অনন্য সত্ত্বা (সেল্ফ) হিসেবে। তিন, কোন একটি সামাজিক গোষ্ঠীর (ফোক, volk) অংশ হিসেবে। কান্টের তত্ত্বে সামাজিক গোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও হার্ডার সবসময়ই এই যুক্তি দিয়েছেন যে, কল্পনা, স্মৃতি, অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা ও উপলব্ধি প্রভৃতি মানব সক্ষমতায় জোরারোপ করার মাধ্যমে কান্ট মানব জীবনকে বোঝার ক্ষেত্রে ভাষা, কবিতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের তাৎপর্যকে উপেক্ষা করেছেন। নৃবিজ্ঞানের একজন পথিকৃৎ হিসেবে হার্ডার অনুমানমূলক অধিবিদ্যা ও যুক্তিবিদ্যার বদলে নৃবিজ্ঞানকে মানুষ, তার প্রকৃতি এবং তার সংস্কৃতিকে উপলব্ধির চাবিকাঠি মনে করতেন।

অনেক দিন আগে নৃবিজ্ঞানী ক্লাকহোন, কান্টের মতোই একটি স্টেটমেন্ট প্রদান করেছিলেন যা কোন কোন দিক থেকে মামুলি হলেও, আমার কাছে সবসময়ই এই স্টেটমেন্ট ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সত্যের ধারক। মানব সত্ত্বা ও মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত “ন্যাচার-কালচার”  দ্বৈত ধারণা নিয়ে ক্রিটিকাল ক্লাকহোনের (তার সাথে কাজ করেন প্রথম দিকের মনোবিজ্ঞানী হেনরি মারে) মতে, একজন মানুষ একটি প্রজাতির (হোমো স্যাপিয়েন্স) অংশ হিসেবে কিছু দিক থেকে পৃথিবীর অন্য সকল মানুষের মতোই, আবার একটি অনন্য ব্যক্তিত্ব তথা সত্ত্বা থাকার দিক থেকে সে অন্য কোন মানুষের সাথে তুলনাযোগ্য নয়। একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণি বা ব্যক্তি হিসেবে তার কোন কোন (সামাজিক/সাংস্কৃতিক) জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক রয়েছে। অর্থ্যাৎ, কান্টের মতো করে ক্লাকহোনও মনে করতেন, মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে তিনটি আন্তঃসম্পর্কিত দিকের সাহায্যেঃ একটি প্রজাতি যার জৈব-মনস্তাত্বিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং যে জটিল সামাজিকতা অর্জন করেছে; একটি অদ্বিতীয় ব্যক্তি সত্ত্বা; সর্বশেষ, একটি সামাজিক সত্তা হিসেবে— যা সামাজিক পরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রাখে এবং এই সামাজিক সত্তা প্রত্যেক সমাজেই বহুবিধ, পরবর্তনশীল ও আন্ত-সম্পর্কিত। ক্লাকহোনের মতো একজন নৃবিজ্ঞানীর জন্য মানুষ ও ব্যক্তির মাঝের পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক গোত্র মানব নয় এমন জীবকে ব্যক্তি হিসেবে মনে করে, আবার, দাসত্ব কালীন সময়ের আইনে মানব দাসকে ব্যক্তি নয়, বরং বস্তু তথা পণ্য হিসেবে বিবেচনা করতো।

উপসংহার

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের নৃবিজ্ঞানীরা মানব সত্ত্বা কিংবা মানব প্রকৃতির এই তিনটি দিকের মাঝে যেকোনো একটির উপর গুরুত্ব প্রদান করে। নব্য-ডারউইনবাদী তাত্ত্বিকরা, বিশেষ করে বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানী ও সোশিওবায়োলজিস্টরা মানুষকে দেখে শুধুমাত্র একটি প্রানী হিসেবে। মানুষ কিংবা মানব আচরণকে বোঝার ক্ষেত্রে জৈবিক অথবা জেনেটিক উপাদানের উপর জোরারোপ করে এই ধারার তাত্ত্বিকরা অস্তিস্ত্ববাদী ও সামাজিক ফ্যাক্টরগুলোকে উপেক্ষা করে। এর বিপরীতে অস্তিত্ববাদী, র‍্যাডিকাল ফেনোমেনোলজিস্ট ও (লিটেরারি) নৃবিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত একটি ধারা রয়েছে, যা সবথেকে বেশী গুরুত্ব প্রদান করে মানুষের অন্যন্য সত্তা ও তার সাব্জেক্টিভ অভিজ্ঞতার উপর (দেরিদার অটোবায়োগ্রাফিকাল অ্যানিমাল) এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে বিবর্তনবাদী নৃবিজ্ঞান ও ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ইন্সাইটগুলোকে। এর পাশাপাশি আরেক ধারার তাত্ত্বিক রয়েছে, যারা মানব প্রকৃতিকে দেখে অপরিহার্যরূপে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সত্ত্বা হিসেবে। এই ধারার সবথেকে উজ্জ্বল প্রতিনিধিরা হলো দূর্খেমীয় সমাজবিজ্ঞান, আমেরিকার সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান (উদাহরণস্বরূপ, লেসলি হোয়াইট সংস্কৃতিকে এমনভাবে পাঠ করতে বলেছেন, যেখানে মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই) এবং লেভি স্ট্রস ও আলথুসারের কাঠামোবাদ। এই ধারার তাত্ত্বিকরা মনে করেন, মানব চৈতন্যকে নির্ধারণ করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন উপাদান। আবার, এই ধারার কিছু উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক মানব চৈতন্যকে শুধুমাত্র বয়ানের (ডিসকোর্স) ফলাফল হিসেবেও দেখে থাকে। মানব প্রকৃতি কিংবা সত্ত্বার ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে এই ধারা মানব জীবনে জৈবিকতা ও বস্তুসংস্থানতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতাকে উপেক্ষা করে; আবার কোন কোন তাত্ত্বিক সরাসরি মানব কর্তাসত্ত্বাকেও প্রত্যাখ্যান করে। ডেনিস রঙের ভাষায়, এই অ্যাপ্রোচ নিয়ে কাজ করা পন্ডিতরা মানব প্রকৃতি নিয়ে একটি অতি-সমাজিকৃত কন্সেপশন ধারণ করে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, উপরে আলোচিত তিনটি অ্যাপ্রোচের (দি বায়োলজিকাল, দি সাইকোলোজিকাল অ্যান্ড দি সোশ্যাল) প্রত্যেকটিরই ন্যায্যতা রয়েছে এবং “মানু্ষ আসলে কি?” এই প্রশ্নের উত্তর প্রদানে প্রত্যেককেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে মানব প্রকৃতিকে এককভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে এদের কার্যকারীতা সীমিত। যেটা দরকার সেটা হলো একটি সমন্বিত অ্যাপ্রোচ যা এই তিনটি ধারাকেই একত্রিত করতে সক্ষম হবে, কারণ বহুবিধ কার্যকারণের মেকানিজম ও জেনারেটিভ প্রক্রিয়ার— জৈবিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত— প্রক্রিয়ার ফসল।

কান্টের মতোই, মানব প্রকৃতিকে বোঝার ক্ষেত্রে জটিল মডেল তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে পুরো বিংশ শতক জুড়ে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের বহুবিধ পন্ডিত আরো সমন্বিত অ্যাপ্রোচ নির্মাণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দুর্খেইমের হোমো ডুপ্লেক্সের বিপরীতে সমাজবিজ্ঞানী মার্সেল মস মানু্ষকে হোমে টোটাল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে, যার জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক সত্ত্বা করেছে। একইভাবে, প্রাগম্যাটিস্ট ট্রেডিশানের জর্জ হার্বার্ট মিড ও সি রাইটস মিল যুক্তি দিয়েছেন যে, মানুষ একইসাথে একটি জীব, যার একটি সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো সম্পন্ন সত্ত্বা রয়েছে এবং ব্যক্তি হিসেবে মানুষ সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পটভূমিকায় অবস্থিত। মার্ক্সীয় ফেনোমেনোলজিস্ট মরিস মার্লেপন্টি ও হার্বার্ট মারকিউজা, নব্য ফ্রয়েডীয় তাত্ত্বিক এরিখ ফ্রম ও এরিক এরিকসন (যে সাইকোঅ্যানালাইসিস, মার্ক্সিজম ও নৃবিজ্ঞানের মাঝে সিন্থেসিস করতে চেয়েছিলেন) এবং ক্লাইড ক্লাকহোন, আর্ভিং হালোয়েল এবং মেলফোর্ড স্পিরো র মতো সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা বিবিধ উপায়ে মানব সত্ত্বার ত্রয়ী প্রকৃতিকে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। জৈবপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার সাইন্সের বিকাশের সাথে সাথে আমরা আর “মানুষ নই” (সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ের টাইটেল)— এই উত্তরাধুনিক মন্ত্রকে অনেকটা উপেক্ষিত ফরাসি পন্ডিত গ্যাস্টন বাখেলার্ডের ভাষায় বলতে পারি “দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।”

নিশ্চিন্তে থাকুন, মানুষ এখনো অস্তিত্বশীল  এবং নৃবিজ্ঞান এখনো অনেকগুলো অ্যাকাডেমিক বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি একটি সফল জ্ঞানশাস্ত্র।

মূল লেখাটি পড়ুন এখানে