প্রোটো-এনথ্রোপলজির নমুনাঃ প্রমদারঞ্জন রায়ের ‘বনের খবর’, সারোয়ার রাফি

প্রোটো-এনথ্রোপলজি নিয়ে এর আগেও একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে৷ সেখানে আলাপের মূল বিষয় ছিল সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’। এই কাজটি একটি ধারাবাহিক প্রকল্প। এর আওতায় বাংলা ভাষায় নৃবিজ্ঞানের কাছাকাছি ধরনের লেখা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে। এই পর্বে লেখেছেন সারোয়ার রাফি। 

নৃবিজ্ঞানী হ্যারি ওলকটের সজ্ঞানুযায়ী- এথনোগ্রাফি বলতে, একটি গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের প্রচলিত ও স্বভাবগত সামাজিক আচরণসমূহের বিবরণকে বোঝায়।

এই  বিবরণ  অবশ্যই মাঠপর্যায়ের হতে হবে।অর্থাৎ ধরে নেওয়া হয় একজন এথনোগ্রাফার এ সমস্ত কিছু লিপিবদ্ধ করবে,পর্যবেক্ষণ করবে এবং সবকিছুর একটা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য তুলে আনবে। মাঠপর্যায় বলতে,  সাধারণত একজন নৃবিজ্ঞানী একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ঘিরে,  একটা সম্প্রদায় অথবা একটি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠীকে নিয়ে  কাজটি সম্পূর্ণ করে থাকে। 

গবেষিত জনগোষ্ঠীকে বাহির থেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে Etic view বা Outsider’s view বলা হয়।বাইরে থেকে সংস্কৃতির তুলনামূলক পাঠকে এর উদাহরণ বলা যায়। অপরদিকে Insider’s view বা Emic view হলো গবেষিত জনগোষ্ঠীর বা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সংস্কৃতি বা জনগোষ্ঠীকে পাঠ করার দৃষ্টিভঙ্গি। 

ম্যালিনোস্কির আগে নৃবিজ্ঞানীরা সাধারণত সেকেন্ড হ্যান্ড ডেটার উপর ভিত্তি করে গবেষণা করতেন। যেকারণে তারা ‘আরাম কেদারার নৃবিজ্ঞানী ‘ হিসেবেও পরিচিত। তখন তাতে গবেষিত সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর পার্সপেক্টিভ অনুধাবন করা সম্ভব হতো না। পরবর্তীতে ম্যালিনোস্কি নৃবিজ্ঞানে ‘অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ’ পদ্ধতির পরিচয় ঘটান। এতে গবেষিত জনগোষ্ঠীতে গবেষক অবস্থান করে তাদের ভাষা শিখে, তাদের সাথে বসবাস ও আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে গবেষণা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষিত জনগোষ্ঠীর সাথে অনস্থান করা পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থাৎ Emic view ম্যালিনোষ্কির ছাত্ররা জনপ্রিয় করে তোলেন।

আঠারো-উনিশ শতকের দিকে পাশ্চাত্যে  নৃবিজ্ঞান একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আসলেও, এর আগ থেকেই বিভিন্ন লেখায় নৃবিজ্ঞানের নানান বিষয়-আশয় লক্ষ করা যায়। এসব কাজগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য  এরিকসন এবং নিয়েলসন ‘প্রোটো-এনথ্রোপলজি‘ শব্দটি ব্যবহার করে । তেমনি, আমাদের বাংলা ভাষার বিভিন্ন টেক্সটেও নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির  নানান নমুনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে হয়তো বাংলা ভাষার নৃবিজ্ঞানের ধরণ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। 

প্রমদারঞ্জন রায়ের ‘বনের খবর’ বইটিতে এথনোগ্রাফিক অনেক বৈশিষ্ট্য  লক্ষ্য করা যায়। বইটি ১৮৯৯-১৯২০ সাল পর্যন্ত লেখকের সার্ভেয়ার জীবনের স্মৃতিকথা। তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে বাংলাসহ অন্যান্য জায়গার বন-জঙ্গল,পাহাড় ও মরুভূমির বিভিন্ন অংশ জরিপের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালের দিকে। এরও আরো আগে তার ভাই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকাতেও এর কিছু কিছু অংশ ছাপা হয়।

এই বইটা যেহেতু একজন সার্ভেয়ারের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে লেখা,  তিনি বিভিন্নসময়ই ওই জায়গাগুলো নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ লেখেছেন, তাদের জীবন-যাপনের ধরনের বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিটা ব্যাপারেরই একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকে তেমনি এথনোগ্রাফিরও রয়েছে। তাই সে হিসাবে, লেখকের মাঠপর্যায়ের এই কাজটিকে পুরোপুরি নৃবৈজ্ঞানিক এথনোগ্রাফির মধ্যেও ফেলা যায় না, বরং কিছু নমুনার খোঁজ করা যায়। কাজেই আমরা নৃবৈজ্ঞানিক  ছাঁচকে ব্যবহার করে এর বিভিন্ন অংশ বিবেচনা করা যায়। 

১৯১০-১৯১২ সালে আসামের খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়ের জরিপকালে লেখক বন-জঙ্গলের বিভিন্ন পশু যেমন বাঘ,নেকড়ে বা শেয়াল মারবার জন্যে সাত রকমের ফাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন। যেগুলোর মাধ্যমে জঙ্গলের লোকেরা হিংস্র, মানুষখেকো পশুগুলোকে মেরে ফেলে তাদের উৎপাতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। কারণ, এই বইয়ে উল্লেখিত  অনেকগুলো অঞ্চল, তন্মধ্যে একটি, শিবসাগর জেলার সীমানার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বর্গমাইল মানুষখেকো বাঘের ভয়ে উজাড় হয়ে গিয়েছিল। এই ফাঁদগুলো নিয়ে লেখকের এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ অনুসারে তিনি বলেন, ‘বর্মাই বল, আসামই বল আর বাঙলাদেশই বল, সব জায়গাতেই এই সব ফাঁদের একটা আশ্চর্য মিল রয়েছে।’ অর্থাৎ এই অঞ্চলগুলোর ফাঁদগুলোর মধ্যে কিছু মিল দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। 

তিনি যে সাত রকমের ফাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন, আমি বোঝার সুবিধার্থে এগুলোকে তাদের কৌশল অনুসারে আলাদা নাম দিয়ে অভিহিত করলামঃ

(১) বল্লম ফাঁদঃ জানোয়ারের চলতি বাসার (গেম্ ট্র্যাক-এর) ধারে, পাহাড়ের খুব ঢালু জায়গায় গভীর গর্ত খুঁড়ে, তার মধ্যে ভীষণ ধারাল সরু বল্লম পুঁতে রাখে। তার উপর বাঁশের কঞ্চি বা বাঁখারির চাল তৈরি করে, মাটি,ঘাস,লতাপাতা দিয়ে এমন করে ঢেকে রেখে দেয় যে কিছু বোঝাই যায় না। তারপর ঐ মাচার উপর বেশ মোটাসোটা একটা কুকুর-ছানা বা শূয়োরছানা বেঁধে রেখে দেয়।বাঘ আপন মনে হেলে-দুলে ঐ পথে চলতে গিয়ে দেখতে পায় সামনে খাবার তৈরি! হাল্লুম! আর যাবে কোথায়,বল্লম বিঁধে প্রাণ হারায়!

(২) কাদার ফাঁদঃ রাস্তার মাঝে,মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, ঢাকা দিয়ে টোপ বেঁধে রেখে দেয়। মাচার নিচে বল্লমের বদলে থাকে কাদা। এর মধ্যে পড়লে বাঘ প্রাণে মরে না বটে কিন্তু কাদায় পড়ে নড়বার যো থাকে না, চেঁচিয়ে দেশ মাথায় করে।

(৩) বেড়ার ফাঁদঃ বেড়ার মধ্যে ফুটো করে তাতে পাকা বেতের ফাঁস ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফাঁসটা একটা মজবুত বাঁশের ডগায় বেঁধে, জোর করে বাঁশটা নিচু করে আটকিয়ে রাখা হয়। বেড়ার ফুটোর সামনেই মোরগ বা অন্য কিছু টোপ কায়দা করে দঁড়ি দিয়ে ফাঁসের সঙ্গে জড়ানো থাকে। বাঘ বা শেয়াল খাবার লোভে, ফুটো দিয়ে ঢুকে যেমনি মোরগ ধরে টান দেয়, অমনি কল খুলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে জানোয়ারটারও হাতে, পায়ে বা গলায় ফাঁস লেগে সে শূন্যে ঝুলতে থাকে।

(৪) খোয়াড় ফাঁদঃ মাটিতে মজবুত খুঁটি পুঁতে খোঁয়াড় তৈরি করা হয়। তার মধ্যে একটা ছোট কুঠুরিতে কুকুর বা ছাগল বেঁধে রাখে। খোঁয়াড়ের দরজা কল এঁটে খুলে রাখা হয়। বাঘ ভিতরে ঢুকে সেই টোপটি খেতে যায় অমনি হড়াৎ করে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর মারো আর ধরো, যেমন ইচ্ছা। 

(৫)তীর বা বন্দুকের ফাঁদঃ বাঘ চলবার রাস্তা বা তার মারা শিকারের উপর তীর বা বন্দুক পেতে রাখে। বাঘ এসে শিকার ধরে টানলেই, তীর বা বন্দুকের গুলিতে মারা যায়। তীরটা অবশ্য বিষাক্ত থাকে। 

(৬)কাঠের মাচার ফাঁদঃ মজবুত কাঠের মাচা তৈরি করে তার উপর ভারি ভারি পাথর বা কাঠ চাপিয়ে রাখে।মাচার একটা দিক বেশ শক্ত করে মাটিতে আটকিয়ে দেয়।অন্য দিকটা তুলে ধরে দড়ি দিয়ে নিচের টোপের সঙ্গে কৌশল করে বেঁধে রাখে। বাঘ বা শেয়াল টোপ ধরে টানবামাত্র কল খুলে যায় আর ঐ প্রকাণ্ড বোঝা তার ঘাড়ে পড়ে।এই ফাঁকে শেয়াল বা ছোট বাঘ চাপা পড়ে।

(৭)পাথরের ফাঁদঃ এরই আবার একটা রকমারি খাসিয়া পাহাড়ে পেয়েছিলাম।যেটাতে মাচা তৈরি করে ওজন চাপানো নয়, প্রকাণ্ড একটা পাথর চমৎকার ব্যালান্স করে রাখা। আর তার উপরে টোপ।লাফিয়ে ছাড়া ঐ টোপ ধরা যায় না, আর লাফালেই পাথর উলটিয়ে গিয়ে জানোয়ারটা চাপা পড়ে প্রাণ হারায়।

লেখকের এই বন-জঙ্গলের ফাঁদের বর্ণনাকে বিভিন্ন ধরণকে এথনোগ্রাফিক পদ্ধতির সাথে মিলিয়ে দেখা যায় । কারণ, দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তিনি বন-জঙ্গল,পাহাড়ে জরীপের কাজ করেছেন, সে অঞ্চলে থেকে গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেখানকার পরিবেশের সাথে মিশেছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি এই পদ্ধতির মধ্যে সন্নিহিত করা যায়। এছাড়া এই বইটি আরো বহুবছর আগে এই অঞ্চলের বনগুলোর উপর নির্ভরশীল মানুষদের নিয়েও চমকপ্রদ তথ্য দেয়। সেইক্ষেত্রে এটিকে সামাজিক ইতিহাসের একটা গুরত্বপূর্ণ দলিলও বলা যেতে পারে। 

দোহাইঃ

(১) বনের খবর- প্রমদারঞ্জন রায়

(২) নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়- মাহফুজ সরকার, শাহারিয়ার জিম