বনের খবর ও প্রোটো-এনথ্রোপলজি, সারোয়ার রাফি

বনের খবর’ বইটি প্রমদারঞ্জন রায়ের লেখা, তার নিজের সার্ভেয়ার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। এই বইয়ের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে নৃবৈজ্ঞানিক ধারনাগুলোর সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেছেন সারোয়ার রাফি। তার সাথে যুক্ত করেছেন প্রোটো-এনথ্রোপলজির ধারণা। সাথে আছে ‘বনের কথা’ অবলম্বনে লেখকের নিজের আঁকা কিছু ছবিও/ লেখাটির প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

‘বনের খবর’ বইটার আগের আলোচনায় এমিক ও এটিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ফাঁদ ধরার কৌশলগুলো নিয়ে আলোকপাত করেছিলাম।

এ আলোচনায় আমি তার ২২ বছরের সার্ভেয়ার জীবনের কিছু পর্যবেক্ষণ দেখাবো। তিনি যে অঞ্চলগুলোতে জরিপের কাজে এতোগুলো বছর কাটিয়েছিলেন সে অঞ্চলের মানুষদের টিকে থাকা, জীবনযাপন, গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া, বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখবো আমরা।

প্রথমেই, লেখক ব্রক্ষদেশের শানস্টেটে (১৮৯৯-১৯০০) থাকাকালীন সেখানকার শান কুলিদের রান্না-বান্নার কৌশল বর্ণনা করেছেন।

এখানে রান্নার কৌশলের সাথে তাদের কিছু খাবারের ধারণাও পাওয়া যায়।যেমনঃ ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের চাটনি করে খাওয়া, বিশেষত গরমের দিনে। তাদের কাছে এটি খুব উপাদেয় খাবার।

তাছাড়া তিনি শানদের ‘ঙাপি’ নামে আরেকরকম খাবারের কথা বলছেন।তারা এ খাবারটি ‘মাছকে টুকরো-টুকরো করে কেটে হাঁড়ির ভিতর পুরে,হাঁড়ির মুখ ভালো করে বন্ধ করে মাটিতে তিন-চারমাস পুঁতে রাখে,তারপর সেটা পচে একেবারে গলে গেলে, সেটাকে বার করে খায়।’ শানদের মতে ‘এমন সরেস জিনিস নাকি এ দুনিয়ায় নেই।’

শিল্পীঃঃ সারোয়ার রাফি

দ্বিতীয়ত, আসা বলা যায় শান স্টেটের ওইখানে গ্রামের মানুষদের বিশ্বাসের ব্যাপার নিয়ে। লেখকের বর্ণনায়, ‘ঐ বছরই আমি একটা পাহাড়ে দূরবীণের কাজ করতে গিয়েছিলাম।গ্রাম অনেক দূরে,তাই মনে করেছিলাম যখন পাহাড়ের উপর জল আছে তখন সেখানেই জলের কাছে তাঁবু খাটাব আর দু-রাত ঐখানেই কাটাব।গ্রামের লোকেরা কিন্তু বেঁকে দাঁড়াল।”ও-পাহাড় ভালো না।ওখানে ‘নাট’ অপদেবতা আছে, লোকের উপর অত্যাচার করে,হাতি দিয়ে পিষিয়ে মারে” ইত্যাদি।’

এরপরের বছর লেখক যখন কাজে আবার অই পাহাড়ে যায় তখন দেখে সেখানকার গ্রামটা আর নেই। দু’মাইল দূরে আরেকটা পাহাড়ে চলে গেছে। কেন? বিশ্বাস কিরূপ আষ্টেপৃষ্টে থাকে তারই ফলস্বরূপ লেখক ঐ গ্রামের প্রধানকে জিজ্ঞেস করে, “গ্রাম ছেড়ে চলে এলে কেন?” তখন জবাবে প্রধান বলে, “সে তো তোমাদেরই দোষ। তোমরা সেই যে বন কেটে ফেলেছিলে তাতে দেবতা চটে গিয়ে বাঘ হয়ে এসে আমাদের কি যেমন-তেমন সাজা দিয়েছে ভেবেছ! মানুষ গরু শূয়োর সব মেরে আর কিছু বাকি রাখেনি।কাজেই আমাদের পালিয়ে আসতে হয়েছে।”

তখন এ নিয়ে লেখক এক চমৎকার মতামত দেয়, ‘বাঘের জ্বালায় গ্রাম ছেড়ে সকলে পালিয়ে গেল, দেবতাই এসব করেছেন বলে নিজেদের মনকে প্রবোধ দিল আর দেবতাকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে পাহাড়ের উপর ঘটা করে পুজো দিল। বাঘের সংখ্যা কিন্তু তাতে একটুও কমলো না।’

আসলে, মানুষদের বিশ্বাস,ভয় তা কিন্তু ‘কিছু হয়ে’ হানা দেয়,শাস্তি দেয়।যেমন সেখানে সাজা দেয় ‘বাঘ হয়ে’। মানে এই বিশ্বাসের বাস্তবায়নটা কোনো বিমূর্তরূপে নয় বরং কিছু হয়ে মূর্তরূপে প্রতিফলিত হয়।

তৃতীয়ত, বাঘের ভয়ে পুরো গ্রাম উজাড় হওয়া।লেখকের বর্ণনায়,’…একটু পুবেই শিবসাগর জেলার সীমানা।এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বর্গ মাইল জায়গা বাঘের ভয়ে উজাড় হয়েছিল।’ আবার ‘…বাঘের ভয়ে তো লোকজন সকলেই নিজের-নিজের ঘরদোর, খেত, ফসল, সমস্ত ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তৈরি ফসল ফেলে এসেছে বলে অনেকেই বড় কাতর হয়েছিল। প্রধানের তুলোর খেত ছিল ঐ পাহাড়ে।একেবারে তৈরি ফসল,তুলে আনলেই হল।’

আবার, আাসমেরই জৈন্তিয়া পাহাড়ে (১৯১৮-১৯২০) ‘সেখানে কতকটা জায়গা একেবারে দুর্গম আর মানুষখেকো বাঘের ও ভয়।তার অত্যাচারে কয়েকটা গ্রাম একেবারে উজাড় হয়ে গিয়েছিল।’

এজন্যে তাদের ঘরগুলো মাচা প্রকৃতির হয়ে থাকত।মাটি থেকে উপরে থাকার ফলে বাঘ হতে রক্ষা পাওয়া যেত। 

শিল্পীঃঃ সারোয়ার রাফি

বন্য জীবনযাপনে সেখানকার মানুষগুলোকে প্রবল সংগ্রামে টিকে থাকতে হত।

ব্রক্ষদেশের শান স্টেটে কাজ করতে গিয়ে লেখক শানদের ছাড়াও মুসো,পালাউং,কুই প্রভৃতি জাতির লোক বাস করার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন। বিশেষত মুসোদের জীবনপ্রণালি নিয়ে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন।

পাহাড়ের মাথায় মুসোদের গ্রাম।অন্য কোনো জায়গায় তারা খুব একটা যাতায়াত করে না।তাই পথঘাটেরও তাদের খুব একটা দরকার হয় না,নালায়-নালায়ই কাজ চালিয়ে নেয়।উৎপাদন ব্যবস্থা তাদের কৃষিপ্রধানই।খেতের ধান,খেতের লঙ্কা,খেতের কুমড়ো,খেতের রাই তাদের ফসল।তাদের কাছে উত্তম তরকারি হলো রাইপাতা।তারা শিকারিও।শিকার করে মাংস খায়।শিকারের তালিকায় হাতি,ঘোড়া,বাঘ,ভাল্লুক হতে কাঠবিড়ালিটি পর্যন্ত বাদ পড়ে না।তাদের অভাব বলতে আছে নুনের যোগান।লেখক জানাচ্ছেন, শুধু এজন্যেই এরা শানদের গ্রামে আসে।এজন্যে নালার ভিতর একটু রাস্তা আছে।নিজের খেতের তুলো দিয়ে এরা কাপড় বোনে।

হাতিয়ার হিসেবে তাদের রয়েছে তীর,ধনুক,দা,কুড়ুল আর বর্শা-মান্ধাতার আমলের বন্দুকও দেখা যায়।তীর-ধনুক তারা নিজেরাই কিনে আনে,দা-কুড়ুল কিনে আনে শানদের গ্রাম হতে।তারা নানারকম পাখিও পোষে।ভয় তাদের একবারই নেই।

একটা সাম্য সমাজের ধারণা এদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।উৎপাদন ব্যবস্থায় তারা কারো উপর নির্ভর করতো না।নিজেরাই সবকিছু দেখভাল করতো।খুব বেশি দরকার না পড়লে বিকিকিনিও করতো না।

‘বনের খবর’ বইটা নিয়ে এইটাই প্রোটো-এনথ্রোপলজি বিষয়ে শেষ লেখা।পরবর্তীতে আবার অন্য কোনো টেক্সট ঘেটে এর নির্দশনগুলো বের করা যাবে। দেখানো যাবে বাংলাভাষায় নৃবিজ্ঞানের আদি সম্ভাবনা।

One thought on “বনের খবর ও প্রোটো-এনথ্রোপলজি, সারোয়ার রাফি

Comments are closed.