মহামারীর পর, আমরা ফের ঘুমিয়ে থাকতে পারি নাঃ ডেভিড গ্রেবার

নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্রেবার মারা যান ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই করোনা পরবর্তী দুনিয়ার হাল-হকিকত নিয়ে ‘After the Pandemic, We Can’t Go Back to Sleep’ নামে এই লেখাটি লেখেন। যেটি প্রকাশিত হয় Jacobin এ৷ মহামারী পরবর্তী দুনিয়া যে আগের দুনিয়ার অনেক তথাকথিত যৌক্তিক কাঠামোকে উলটে দিতে পারে, তারই একটা ভাষ্য দেওয়া আছে এই লেখায়। এনথ্রোসার্কেলের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন মাসিয়াত জাহিন৷ 

আগামী মাসগুলোর যে কোন সময়ে এই সংকটকে সমাপ্ত ঘোষণা করা হবে আর আমরা আমাদের ‘ফাঁপা’ কাজগুলোতে ফিরে যেতে পারবো। অনেকের জন্য এটা হবে একটা স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার মতো।

মিডিয়া এবং রাজনৈতিক শ্রেণীগুলো অবশ্যই আমাদেরকে এভাবে ভাবতে উৎসাহিত করবে। ২০০৮- এর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরেও এটাই হয়েছিল। 

 সেইসময় কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলার মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল। (‘ফিন্যান্স’ আসলে কি? এটা কি শুধু অন্য মানুষের প্রতি দেনা নয়? টাকা কি? এটাও কি কেবল দেনা? দেনাই বা কি? এটা কি একটা প্রতিশ্রুতি না? যদি টাকা আর দেনা কেবল একে অন্যের নিকট করা প্রতিশ্রুতির সমষ্টি হয়, তাহলে কি আমরা খুব সহজেই অন্য কোন প্রতিশ্রুতি করতে পারতাম না?) জানালাটা প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলো তারা- আমাদের জোর করা হয়েছিল যাতে আমরা চুপ থাকি, চিন্তা বন্ধ করি এবং কাজে ফিরে যাই, অন্তত কাজ খোঁজা আরম্ভ করি৷ 

শেষ বার, আমাদের মধ্যে বেশিরভাগেরা এটাই মেনে নিয়েছিলো। এইবার, আমাদের বিশ্বাস সংকটপূর্ণ।

 কারণ, বাস্তবে, যেই বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা মাত্রই গিয়েছি তা ছিল একটা স্বপ্ন থেকে জাগরণ, মানবজীবনের সত্যিকার বাস্তবতার সাথে মুখোমুখি হওয়া আর সেই বাস্তবতা হলো আমরা একে অন্যের তত্ত্বাবধানে থাকা কিছু ভঙ্গুর প্রাণের সমষ্টি। আর তারা, যারা এই কাজের সিংহভাগ করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ট্যাক্স নেয়া হয়, কম মজুরি দেয়া হয় এবং প্রতিনিয়ত তারা লাঞ্ছিত হয়। আর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ কল্পনার জাল বোনা, ভাড়া সংগ্রহ করা ছাড়া কিছুই করেনা এবং সাধারণত তাদের পথে বাঁধা সৃষ্টি করে যারা দ্রব্য তৈরি, মেরামত ও পরিবহন করছে, অন্যের প্রয়োজন তত্ত্বাবধান করে চলেছে। আমাদের  উচিত আবারো এমন এক বাস্তবতায় ফিরে না যাওয়া যেখানে এই সবকিছু একধরণের ব্যাখ্যাতীত যৌক্তিকতা তৈরি করে (স্বপ্নে অর্থহীন বস্তুকে যেমন যৌক্তিক মনে হয়)। 

যেমন বলা যায়ঃ  কেন আমরা এই ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবা বন্ধ করতে পারি না যে কারো কাজ দ্বারা অন্য কারো একতরফা লাভবান হওয়ার সম্ভাভনা যত বেশি, ততটাই কম সম্ভব সে কাজের জন্য তার প্রাপ্য মজুরি পাওয়া?  অথবা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সবচেয়ে ভালো উপায় আর্থিক বাজার, যদিও সেটা পৃথিবীর বেশিরভাগ জীবনকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে? 

এর বদলে কেন আমরা ভাবতে পারি না, যখন এই বিপর্যয় শেষ হবে, আমরা যাতে মনে রাখি এই শিক্ষাঃ 

যদি ‘অর্থনীতি’ কোন অর্থ বহন করে তা হলো একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা একে অপরের যোগানদার ( শব্দটির সর্বাত্নক অর্থ), আমরা মনে রাখি যে ‘বাজার’ মূলত ধনী লোকদের সামগ্রিক চাহিদার তালিকাভুক্তকরণের একটা পদ্ধতি- যারা সবাই কিছুটা হলেও প্যাথলজিকাল, যাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীরা ইতোমধ্যে বাংকারের ডিজাইন সম্পূর্ণ করে ফেলেছে; যেখানে তারা পালাবে। আমরা যদি আবারো তাদের চাটুকারদের বক্তৃতায়  বোকা বনতে থাকি, যেমনটা আগেও হয়েছিলো, তাহলে আসন্ন বিপর্যয়গুলোকে সামলানোর জন্য ন্যুনতম সাধারণ বোধও আমাদের থাকবে না।

এইবার, আমরা কি দয়া করে তাদের উপেক্ষা করতে পারি?

বর্তমানে আমাদের করা বেশিরভাগ কাজই ভিত্তিহীন কাজ। এই কাজ কেবল কাজের স্বার্থেই, অথবা ধনকুবেরদের আত্নতুষ্টির জন্য বা গরীবদের হীনম্মন্যতার হাতিয়ার। তবে আমরা যদি থেমে যাই, হয়তো সম্ভব হবে নিজেদের কাছে অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত কিছু প্রতিশ্রুতি করা, যেমন, একটা ‘অর্থনীতি’ তৈরি করা যেখানে আমরা তাদের যোগান দিতে ও যত্ন নিতে পারবো, যারা প্রকৃতপক্ষে আমাদেরকেই দেখে রাখে৷

মূল লেখা