ইউরোপের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রথম পর্ব
প্রাথমিক নৃবিজ্ঞান সেকশনটির উদ্দেশ্য হল নৃবিজ্ঞান বিষয়ক প্রাথমিক ধারনাগুলোকে বাংলা ভাষায় পাঠকদের কাছে পৌছে দেওয়া। প্রাথনিক নৃবিজ্ঞানের এই পর্বে থাকলো ইউরোপীয় ইতিহাসবিষয়ক কিছু সংক্ষিপ্ত ধারণা, যেগুলো নৃবিজ্ঞানের বিকাশ বুঝার জন্য জরুরি। এই পর্বে অবদান রেখেছেন সাইয়েদা মেহের আফরোজ শাঁওলি, মাহমুদুর রহমান খান, সাদিয়া শান্তা, লুবাবা তাহসিন রহমান, আতেকা জোয়ার্দার এবং মাহীন হক।
প্রাচীন গ্রিস
প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসচর্চা, সাহিত্য আর দর্শন সমগ্র ইউরোপের জ্ঞান জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। বলা যায় ওইসময়কার বহু চিন্তাই ঘুরেফিরে আবার ফিরে এসেছে বিভিন্ন সময়। সেইসময়কার গ্রিসে ছোট ছোট কিছু সমৃদ্ধ নগর রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল। এই নগর রাষ্ট্রগুলোতে একদল চিন্তকের আবির্ভাব ঘটেছিল যারা পৃথিবীর হালচাল নিয়ে দার্শনিক বিতর্কে মগ্ন থাকতো। এই চিন্তকদের মধ্যে একজন ছিলেন হেরোডটাস। হেরোডটাসকে অনেকেই ‘পারস্য যুদ্ধের ইতিহাস’- এর জন্য চিনেন। কিন্তু হেরোডটাসের আরেকটি কাজ ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সেই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও জীবন-যাপন নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা লেখা। তার লেখাগুলোয় আমরা নৃবিজ্ঞানের একটি অন্যতম বড় তর্কের উপস্থিতি দেখতে পাই, সেটা হচ্ছে ‘অপর’ বনাম ‘নিজ’। অপরকে কিভাবে দেখবো- তা নৃবিজ্ঞানের আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয়। এইক্ষেত্রে হেরোডটাসের অবস্থান কখনো কখনো ছিল এথনোসেন্ট্রিক বা স্বজাত্যবোধে আক্রান্ত। অর্থাৎ তিনি নিজের সংস্কৃতির মানদন্ডেই অন্য সংস্কৃতিগুলোকে বিচার করেছিলেন। তবে মাঝেমাঝে তার মধ্যে এই উপলদ্ধিরও দেখা মেলে যে, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের কারণেই মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধের অধিকারী হয়, এবং এই ভিন্নতা বেশ স্বাভাবিক।
এই তর্ক উপস্থিত ছিল গ্রিসের দার্শনিক ঘরানাতেও। এই তর্ককে বলা হয় বৈশ্বিকতাবাদ আর আপেক্ষবাদের বিরোধ। সরলভাবে বলতে গেলে, একজন বৈশ্বিকতাবাদী জোর দেন জগতের সকল সমাজের একক মিলগুলোর উপর, আর আপেক্ষবাদী তাত্ত্বিক জোর দেন একেক সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের উপর। এথেন্সের সোফিস্টরা ছিল আপেক্ষবাদী ধারার। অন্যদিকে সক্রেটিসের ধারা ছিল বৈশ্বিকতাবাদী। সুতরাং দেখা যায়, প্রাচীন গ্রিক সমাজেই মানুষে মানুষের মিল আর অমিল নিয়ে বিভিন্ন ধরণের চিন্তাভাবনা হাজির ছিল। তার সাথে সাথে হাজির ছিল মানব সমাজের বিভিন্ন ধরণ নিয়েও নানাধরনের ব্যাখ্যা। এই সমস্ত আলাপের প্রভাব পরবর্তীতে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানেও পড়েছে।
রেনেসাঁ (Renaissance)
রেনেসাঁ হল সেই সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্টিস্টিক আন্দোলন যা মধ্যযুগের চিন্তাচেতনার রূপান্তর ঘটিয়ে ইতিহাসকে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ৷ দীর্ঘ মধ্যযুগের পর প্রাণপ্রাচুর্যের বিস্ফোরণ ও জীবন তৃষ্ণার মধ্য দিয়ে ১৫ শতকে ইউরোপ রেনেসাঁ যুগে পা রাখে। সেন্ট অগাস্টিনের মৃত্যুর পর খ্রিস্ট ধর্মের সমন্বিত সংস্কৃতির মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছিলো। গীর্জার ইশ্বরতত্ত্ব থেকে সরে দর্শন ও বিজ্ঞান দূরে সরে যেতে শুরু করে। ধর্মীয় জীবনের পক্ষে যুক্তি-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাবলীল সম্পর্ক তৈরী হলো। ধর্ম ও বিজ্ঞান আগের থেকে সাবলীলভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারছিল বলে নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর ধর্মীয় উদ্দীপনার দ্বার উন্মুক্ত হয়। এর ফলেই রেনেসাঁ নামক অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বিকাশের ভিত্তি রচিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষে উত্তর ইতালিতে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক বিকাশ খুব দ্রুত পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
‘রেনেসাঁ’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ পুনর্জন্ম ( Rebirth)। আর পুনর্জন্ম বলতে প্রাচীন যুগের শিল্প আর সংস্কৃতির পুনর্জন্ম ঘটছিলো। রাইফেল, গান পাউডার, কম্পাস, কাগজ আর ছাপাখানা আবিষ্কার ‘রেনেসাঁ’ বিকাশে জ্বালানী জুগিয়েছিল।
গ্রীস ও রোমের ক্ল্যাসিক্যাল পৃথিবীর পতন এবং তার পুনরুজ্জীবিত করার মধ্যবর্তী সময় কে রেনেসাঁ যুগের দার্শনিকরা ‘মধ্যযুগ’ বলে চিহ্নিত করেন। ১২শ শতাব্দী থেকে শুরু হওয়া সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ রেনেসাঁর সময়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। রেনেসাঁর উদ্দীপনার নানান ধরণ থাকলেও তা ‘মানবতাবাদ’ এর মধ্য দিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘মধ্যযুগে যেখানে সব দেখা হতো স্বর্গীয় আলোতে, রেনেসাঁর সময়ে তা মানুষকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে। দান্তে এবং পেত্রার্কের মাধ্যমে মানবতাবাদ প্রথম ইতালিতে সফলতা লাভ করে। মানবতাবাদ মানুষকে ধর্মীয় গোড়ামীর মানসিক বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয় এবং মুক্তচিন্তা, সৃষ্টি ও সমালোচনা করতে উৎসাহিত করে। মানবতাবাদের চিন্তা ছাপাখানার কল্যাণে দ্রুত ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি ‘ধ্রুপদী পাঠ’- এর (Classical text) লভ্যতা বিস্ফোরণের মত কাজ করে।
রেনেসাঁর উদ্দীপনা সবচে প্রখর রূপ পায় Art বা শিল্পে। জ্ঞানকাণ্ডের শাখা হিসেবে শিল্প কে দেখা শুরু হয়। মানুষ আবার স্বাধীন ভাবে ছবি আঁকতে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে চেপে থাকা চার্চের পাপের ধারণা ভেঙ্গে নগ্ন ছবি আঁকা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। লিওনার্দো ভিঞ্চির হাত ধরে শিল্প হয়ে উঠে বিজ্ঞান, আবিষ্কারের দলিল এবং প্রকৃতির অন্বেষণের উপায়। ভারসাম্য, সম্প্রীতি ও মনোভাবের গাণিতিক নীতি অনুসারে অনুশীলন এবং দৃশ্যমান বিশ্বের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে ছবি আঁকার প্রচলন রাফায়েল, অ্যামব্রোগিও প্রমুখের হাত ধরে রেনেসাঁর সময়ে বিকাশ লাভ করে।
১৪৯০-১৫২৭ এর মধ্যে মাইকেল্যাঞ্জেলো, রাফায়েল, ভিঞ্চির মাধ্যমে ‘High Renaissance art’ ছড়িয়ে পড়ে। মাইকেল্যাঞ্জেলো সিস্টিন চ্যাপেলে করা তার বিখ্যাত দেয়াল চিত্রে অ্যারিস্টটলিয়ান ও প্লেটনিক স্কুলের চিন্তা একত্রে তুলে আনেন।
রেনেসাঁর সময়ে স্থাপত্য শিল্পেও ধ্রপদী ঐতিহ্যের চর্চা দেখা গেছে। রেনেসাঁর স্থাপত্য শিল্পের স্থাপত্য শিল্পী দোনাতো ব্রামান্তে ‘ধ্রপদী মন্দির বা গীর্জার’ আদলে তার রোমান মাস্টারপিস ‘Tempietto’ গীর্জা তৈরী করেন।
আলোকময়তা (Enlightenment)
রেনেসাঁর হাত ধরে আঠারো শতকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও দর্শনের যে বিস্তারের ফলে খ্রীস্ট ধর্ম তথা চার্চের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং এর স্থলে মনুষ্যত্ব বা Humanity আধিপত্যশীল প্রত্যয় হিসেবে আবির্ভূত হয় সেই সময়টাতেই আলোকময়তার আবির্ভাব হয়। এই সময়ে, বুর্জোয়ারা আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে এবং এই বিশ্বাসের মাঝে নাগরিকেরা তাদের বিশ্ব এবং স্থানের প্রতিফলন ঘটানোর উদ্যোগ নেয়। তারা শীঘ্রই সঠিক, যৌক্তিক, সম্ভাব্য ও স্বচ্ছ সমাজের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে দাবি জানায়। আলোকময়তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান বিকশিত করে প্রধানত প্রথাগত বিশ্বাস এবং কুসংস্কারের শাসন থেকে মানুষকে মুক্ত করা। সমাজকে মানবিকতার পথে পরিচালনা করাও আলোকময়তার অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষকে বিজ্ঞানচর্চা, সংশয়বাদ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শনের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে আলোকময়তার যুগ।
রেনেসাঁস এবং প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন এর প্রভাবে মধ্যযুগে দুর্ভেদ্য খ্রিস্ট ধর্মের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইমারত মানবতাবাদে রূপান্তরিত হয়। মানবতাবাদ বেকন, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিওর পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান এবং দেকার্তে, নিউটনের গাণিতিক পর্যবেক্ষণের জন্ম দেয়।
যুক্তির ক্ষমতা ও ব্যবহার সর্বপ্রথম চর্চা করেন গ্রীক দার্শনিকরা। গ্রীক সংস্কৃতির অনেককিছুই রোমানরা ধারণ এবং সংরক্ষণ করেছিলো। রেনেসা বা পুনর্জাগরণের সময় ‘ধ্রুপদী সংস্কৃতি’র (classical culture) পুনরুত্থান ঘটে। খ্রিস্টান চিন্তকেরা ধীরে ধীরে তারে গ্রেকো-রোমান ঐতিহ্যের ব্যবহার খুঁজে পান। দেকার্তে এবং বেকনের মতে, মানুষের যুক্তির প্রয়োগের মধ্যে সত্যের পথ লুকায়িত। যুক্তির সঠিক প্রয়োগের উপর যুক্তির সাফল্য নির্ভর করে। যুক্তিবিদ্যার পদ্ধতি নিজের বৈধতার গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করে। আর এমন পদ্ধতি কার্যত বিজ্ঞান এবং গণিতের মধ্য দিয়েই স্বীকৃত হয়। এর মধ্যে নিউটনের পৃথিবীর গতি সম্পর্কিত কিছু গাণিতিক সমাধানের সফলতা এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়ন কে প্রভাবিত করে।
অবধারিতভাবে ‘যুক্তি পদ্ধতি’ ধর্মের ব্যাপারেও কার্যকর হয়। প্রাকৃতিক বা যৌক্তিক ঈশ্বরবাদীদের ধারণায় ঈশ্বর নির্মাতা, পুরস্কার এবং শাস্তিদাতা এবং মানুষের ভূমিকা আনুগত্যের; এটাই যৌক্তিক বলে অবশিষ্ট ছিলো। একেশ্বরবাদীদের প্রাকৃতিক ধর্মের ধারণার বাহিরে যুক্তির প্রয়োগের মৌলিক উপাদান হিসেবে সংশয়বাদ, নাস্তিকতা এবং বস্তুবাদ আলোচনায় আসে।
জন লকের মতে, “প্রত্যেক নবজাতকের মন সাদা, ধীরে ধীরে এতে অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়।” রুশোর বইয়ে কেন এবং কিভাবে মানবসমাজের বিবর্তন ঘটেছে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। জোসেফ লাফিতাও, মন্টেস্কুর দর্শন দ্বারাও আলোকময়তার যুগ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। তবে আলোকময়তা দার্শনিক একটি আন্দোলন হিসেবে রূপ নেয় ইমানুয়েল কান্ট এবং জ্যাঁ জ্যাক রুশোর লেখনীর মাধ্যমে। কান্ট যেখানে শিক্ষাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার কোনো বিকল্প খুঁজে পান নি সেখানে রুশো পাল্টা দিক থেকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছে দুই ধরনের ডিসকোর্সের পরিচয়, তার দুইটি বইয়ের মাধ্যমে।
মারভিন হ্যারিসের মতে, Enlightenment বা আলোকময়তার আগে নৃবিজ্ঞানের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। আঠারো শতাব্দীতে নৃবিজ্ঞানকে একটি শাস্ত্র হিসেবে গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই সময়ের শুরুর দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ভিকোর (১৬৮৮-১৭৪৪) ‘নতুন বিজ্ঞান’ (The New Science)। ভিকো ছিলো সামাজিক অগ্রগতি ধারণার প্রথমদিকের ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। তিনি সামাজিক অগ্রগতি বিষয়ক ধারণার একটি প্রস্তাবনা দেন, যেখানে বলা হয়েছিলো সমাজ নির্দিষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যের তিনটি স্তরের মাধ্যমে এগোয়। প্রথম স্তর ছিলো ঈশ্বরের যুগ (age of god), যখন প্রকৃতি পূজা করা হতো। এই সামাজিক কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য কে ভিকো ‘আদিম’ মানুষের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারপর আসে বীরের যুগ (age of heroes) যখন সামাজিক অসাম্যের জন্য সর্বব্যাপী অশান্তি বিরাজমান ছিলো। সামাজিক অগ্রগতির কল্পিত চূড়ান্ত ধাপ হচ্ছে যুক্তির যুগ ( age of reason) যাকে ভিকো অভিহিত করেছিলেন মানুষের যুগ বলে। ভিকো ফ্রান্সে থেকে সর্বপ্রথম নৃবিজ্ঞান কে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
নৃবিজ্ঞানের আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলো ফ্রান্সের একদল তরুণ। এই দলটি ছিলো জ্ঞানকোষবাদী (encyclopedist)। তারা যুক্তি, প্রগতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান সংগ্রহ এবং তা শ্রেণিবদ্ধ করে কাঠামো তৈরী করার লক্ষ্যে কাজ করেন। এতে রুশো, ভলতেয়ার ও মন্তেস্কুর লেখা প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এই এনসাইক্লোপিডিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী অবদানকারী ছিলেন জ্যাঁ জ্যাক রুশো। তার বিখ্যাত বই ‘সামাজিক চুক্তি’তে ( Social contract) তিনি বলেন, “মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সে পদে পদে শৃঙ্খলিত।” ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে শাসকদের শাসনকে তিনি প্রশ্নের মুখে ফেলেন। স্বর্গীয় প্রতিনিধিত্বের আলাপ খারিজ করে দেন। তা সত্ত্বেও রুশো যে আদর্শ সমাজের মডেল প্রণয়ন করেন তা আদতে ইউটোপিয়ান সমাজই। তার এই আদর্শ সমাজ দেখতে পাওয়া যায় মুক্ত, রাষ্ট্রহীন ‘মহান অসভ্য’দের মাঝে। তার এই আপেক্ষবাদী চিন্তা অগভীর হলেও সাংস্কৃতিক আপেক্ষবাদের জন্য এটি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। পরবর্তী সময়ের মার্ক্স থেকে লেভি স্ট্রাউসদের মত সামাজিক বিজ্ঞানীদের জন্যে রুশো ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস।
উপনিবেশবাদ (Colonialism)
ইংরেজি ‘Colonialism’ শব্দটি লাটিন শব্দ ‘Colonous’ (যার অর্থ কৃষক) ও ‘Colony’ (যার অর্থ কৃষিকাজের জায়গা) হতে এসেছে। কলোনিয়ালিজম বা উপনিবেশবাদ হচ্ছে এক ধরনের কর্তৃত্বের চর্চা যার মাধ্যমে এক দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলে নিজেদের ক্ষমতার অধীন করে রাখে। বিউপনিবেশবাদী কিছু তাত্ত্বিক বলে থাকেন, পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে উপনিবেশবাদের ইতিহাস। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধাপে ধাপে উপনিবেশবাদের সূচনা হয়।
‘উপনিবেশবাদ আমাদের সাথে সবচে বাজে যে কাজটা করেছে সেটা হল অতীত ইতিহাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ধোঁয়াশা করে দেয়া’
-ওবামা, বারাক ১৯৯৫
উপনিবেশবাদ মূলত কোনো নির্দিষ্ট অধিনস্ত এলাকা বা জাতির মানুষের উপর ক্ষমতাবলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। উপনিবেশবাদে কোনো একটি দেশ দূরবর্তী কোনো অঞ্চলে বা দেশে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে, সেখানকার মানুষের স্বাভাবিক আচরণ ও জীবন ব্যবস্থায় নিজেদের নীতি, সংস্কৃতি, ভাষা, মূল্যবোধ ক্ষমতাবলে চাপিয়ে দেওয়া হয়। ইউরোপীয় উপনিবেশিক সময় ছিল ষোড়শ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে। ইউরোপের ধনী, শক্তিশালী দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন এবং নেদারল্যান্ড – এই দেশগুলো মূলত ১৭ ও ১৮ শতকে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া এবং ক্যারিবিয়ানে উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৯১৪ সালের মধ্যে পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদের আওতায় চলে আসে।
আধুনিক উপনিবেশবাদ এর শুরু হয় ১৫শ শতকে। পর্তুগীজরা ব্যবসার জন্য নতুন বাজার খুঁজতে থাকে ইউরোপের বাইরের অঞ্চলে। ১৪১৫ সালের দিকে পর্তুগীজ সফরকারীরা সিউটা নামে উত্তর আফ্রিকার একটি অঞ্চল দখল করে। যেখানে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। ধীরে ধীরে পর্তুগীজরা আশেপাশের বিভিন্ন জনবহুল অঞ্চল দখল করতে থাকে। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলিও নিজেদের ক্ষমতা ও বাজার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়। ১৯৪২ সালে ক্রিস্টোফার কলোম্বাস ভারত ও চীন অঞ্চলে প্রবেশ করতে যেয়ে ভুল করে বাহামা অঞ্চলে পৌছান এবং সেখানে স্প্যানিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপীয় দেশগুলি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং একপর্যায়ে আমেরিকা, ভারতীয় উপমহাদেশ, আফ্রিকা ও এশিয়া আঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি একসময় সবথেকে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে।
সাম্রাজ্যবাদের সাথে উপনিবেশবাদ এর যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই উর্ধ্বতন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি জাতি অন্য জাতি বা অঞ্চলের মানুষের উপর শাসন কায়েম করে, সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ, মানুষের জীবনযাত্রা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সবকিছুকে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। এ দুটোর পার্থক্য কেবল এই যে উপনিবেশবাদে ক্ষমতা আরোপকারী রাষ্ট্র, শোষিত রাষ্ট্র থেকে ভৌগোলিক দুরত্বে অবস্থান করে৷ অর্থাৎ উপনিবেশ স্থাপন করে শাসন কায়েম করে।
যখন পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়, ব্যবসায় টিকে থাকতে এবং অন্য উপনিবেশিক শক্তি থেকে নিজেদের ক্ষমতা জোড়ালো করতে তারা শুধুমাত্র ব্যবসায় আবদ্ধ না থেকে একপর্যায়ে সরকার ব্যবস্থা নিজেদের আওতায় নিয়ে আসে। অনেক ক্ষেত্রে কলোনাইজাররা নিজেরাই সরকার ব্যবস্থার ধারণা আরোপ করে, এবং উপনিবেশের অধিনস্ত অঞ্চলের মানুষের উপর শাসন, শোষণ চালিয়ে যায়।
এ আলোচনা থেকে বোধগম্য যে উপনিবেশবাদের আলোচনায় মূখ্য দুটি ব্যাপার হলো সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ সম্পর্কে বলতে গেলে আরো উল্লেখ্য যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় যখন পুঁজির পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে চলে, অথচ উৎপাদিত পণ্যের বিক্রির পরিমাণ সেই অনুযায়ী বৃদ্ধি পায় না, পুঁজিপতিদের তখন বাড়তি পুঁজিতে কোন লাভই হয়না। কারণ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সাধারণ জনগণ তথা শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি হয়না। তাদের স্বল্প পারিশ্রমিকে জীবিকা নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে পুঁজিপতিদের কারখানার নানান জাত পণ্য কেনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। একদিকে যদিও শ্রমিক শ্রেণীর খাদ্যের অভাবে দুর্দশার কোন অন্ত থাকে না, অন্য দিকে পুঁজিপতিদের কারখানার বাড়তি উৎপাদিত পণ্যে বাজার বোঝাই হয়ে থাকে। শ্রমিকদেরও তখন বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। পুঁজিবাদের এই অবস্থাকে বলা হয় ‘ব্যবসা সংকট’। এমতাবস্থায় এসকল সমস্যা এড়াতে পুঁজিপতিগণ তাদের বাড়তি পন্য বিক্রির জন্য নতুন বাজারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তারা এমন একটি অঞ্চলে নিজেদের বাজার স্থাপন করতে চায় যেখান তারা অতিরিক্ত জমা হওয়া পণ্য বিক্রি করতে পারবে এবং সেখান থেকে সস্তায় কাঁচামাল এবং খাদ্যদ্রব্যও সংগ্রহ করতে পারবে। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ে থাকা অথচ প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর ও জনশক্তিতে শক্তিশালী এমন অঞ্চলে নিজেদের বাজার স্থাপনের পরিকল্পনা করে। আর এই বাজার স্থাপনের জন্য তারা সেসব অঞ্চলের গভর্নমেন্টকেও কৌশলে নিজেদের হাতে রাখে। এভাবেই এক দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষদের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে । আর তার ফলে শুরু হয় কলোনিয়ালিজম বা উপনিবেশবাদ।
সহজে বললে, যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পিছিয়ে পড়ে থাকা কোন দেশ বা অঞ্চলে নিজেদের বাজার, কারখানা স্থাপন করে দখল করে নেয় সেই দেশকে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ। আর যে পিছিয়ে পড়া দেশটি সাম্রাজ্যবাদীদের দখলে চলে যায় তাকে বলা হয় কলোনি বা উপনিবেশ। সুতরাং, কলোনির উপর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের এরূপ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বা কর্তৃত্ব বিস্তার করাই হলো উপনিবেশবাদ।
শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution)
শিল্প বিপ্লব মূলত অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধের এমন একটা সময়কে নির্দেশ করে যখন ইউরোপ, আমেরিকার গ্রামীণ ও কৃষিপ্রধান সমাজগুলো ধীরে ধীরে শহরকেন্দ্রিক ও শিল্পোন্নত হয়ে উঠলো।
যেসকল পণ্য এর আগে হাতে হাতে বানানো হতো, তা উন্নত প্রযুক্তির কারণে ফ্যাক্টরির মেশিনে বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হতে লাগলো।
তার উপর বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ফলে ইংল্যান্ডে এই শিল্প বিপ্লব আরো ব্যাপকভাবে শুরু হয় এবং ১৮৩০ ও ১৮৪০ এর মাঝামাঝি তা আমেরিকাসহ শীঘ্রই পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়টাকে ইতিহাসবিদগণ ‘প্রাথমিক শিল্প বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেন। এর দ্বিতীয় দফা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন স্টিল, ইলেক্ট্রিক ও মোটরচালিত যানবাহনের ব্যাপক অগ্রগতি দেখা যায়।
যদিও ফরাসি লেখকেরা আগেই এই শব্দ প্রয়োগ করেছেন, তবে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশন’ টার্মটা বিখ্যাত হয় ইংরেজ অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি’র হাত ধরে।
শিল্প বিপ্লবের জন্মও ইংল্যান্ডে। আর্দ্র জলবায়ুর কারণে ইংল্যান্ডে সবসময়ই প্রচুর তুলা, লিনেন, উল ইত্যাদি উৎপাদিত হতো। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর মেশিনের মাধ্যমে এর উৎপাদনের পরিমাণ আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, এবং সেসময় স্টিল উৎপাদনেও ইংল্যান্ড প্রচুর এগিয়ে যায়। এদিকে জেমস ওয়াটের আবিষ্কৃত বাষ্প ইঞ্জিন একটা বিশাল প্রভাব ফেলে। এই বাষ্প ইঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে গড়ে ওঠে অসংখ্য ফ্যাক্টরি যাতে মেশিনের সাহায্যে বিপুল পরিমাণে পণ্য উৎপাদিত হতে থাকে, এছাড়াও এর দ্বারা বাষ্পচালিত যানবাহন যেমন রেলগাড়ির উদ্ভব ঘটে। ফলে ইংল্যান্ডের যানবাহন ব্যবস্থারও ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। এবং বাষ্প ইঞ্জিন চালানোর জন্য তখন কয়লার চাহিদাও খুবই বেড়ে যায়। এবং কয়লার খনি হতে কয়লা তুলে আনার জন্য প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক নিয়োগ হতে থাকে।
অন্যদিকে, শিল্প বিপ্লবের ফলে গড়ে ওঠা ফ্যাক্টরিগুলো ও বাষ্পচালিত যানবাহন হতে নিঃসৃত বর্জ্য পদার্থ ও ধোঁয়ার কারণে পরিবেশ দূষণ প্রচুর বেড়ে যায়। পুঁজিবাদের প্রসারের সাথে সাথে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যকার আর্থিক বৈষম্য প্রকট হতে থাকে। এবং শিল্পপতিদের লাভের জন্য শ্রমিকদের খুবই স্বল্প আয়ে প্রচণ্ড অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
শিল্প বিপ্লবের ফলস্বরূপ সমাজের বিভিন্ন সমীকরণও নানা রূপ পেতে থাকলো, তার মাঝে বিশেষ উল্লেখ্য হল নারীর গৃহীসত্ত্বার আবির্ভাব ও লিঙ্গীয় বৈষম্যের নতুন বিনির্মান। কারখানায় কাজ করলে বেতন পাওয়া যায়৷ সুতরাং অর্থকড়ি কামাই করা হয়ে গেল কাজের নতুন সংজ্ঞায়ন, সে ক্ষেত্রে নারীর যে চিরাচরিত কাজ, যে কাজে কোনো অর্থকরি পাওয়া যায় না তা হয়ে গেল গৌন, এবং পুরুষের কাজটি হয়ে গেল মুখ্য, তা নিঃসন্দেহে তৈরি করলো এক নতুন ধরনের বৈষম্য। তাছাড়া তখন নারীদের গৃহিনী হিসেবে তৈরি করারও এক প্রচলন দেখা গেল, কেননা যদি নারী তার সঙ্গিনীর জন্যে খাবার রান্না না করে, শার্টটা ধুয়ে না দেয় তবে হোটেলে খাওয়া ও ধোপায় জামা দেয়ার জন্যে হলেও মালিকপক্ষকে দুটো টাকা বেশি দিতে হত।
শিল্প বিপ্লবের ফলে এমন ভাঙা গড়া, নতুন নতুন নির্মান ও বিনির্মানের মধ্য দিয়েই সমাজ এগিয়ে যেতে থাকে।
তথ্যসূত্রঃ
- নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ-রেহনুমা আহমেদ, মানস চৌধুরী
- History and Theory in Anthropology- Alan Barnard
- নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়- মাহফুজ সরকার, শাহারিয়ার জিম
- Source of the Western Tradition, Volume 1- Marvin পের্য
- A history of anthropology- Thomas Hylland Eriksen