থিওরি: বিবর্তনবাদ ও স্পেন্সার

নৃবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব নিয়ে প্রাথমিক ধারণাগুলো জানার জন্য এনথ্রোসার্কেলের পাঠকদের জন্য শুরু করা হয়েছে ‘থিওরি সিরিজ’।  থিওরি সিরিজের প্রথম লেখা ‘বিবর্তনবাদ ও স্পেন্সার’ দিয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। এই পর্বে আমাদের জন্য লিখেছেন তাসনিম রিফাত। 

বিবর্তনবাদের মূল ধারনা হচ্ছে, কোনকিছুর গঠন তার পূর্বেকার সরল রুপ থেকে আরেক জটিল রুপে পরিবর্তিত হয়। যেমন কোন প্রজাতি পরিবর্তিত হয়ে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। সমাজবিজ্ঞান বা নৃবিজ্ঞানে এই ধারনাটি ব্যবহৃত হয় মানব সমাজ বা সংস্কৃতির ক্রমাগত বিকশিত হওয়া বুঝাতে। সংস্কৃতি বলতে এখানে তীর-ধনুক বা হাতিয়ারের মতো বস্তুগত প্রযুক্তিও বুঝাতে পারে, আবার ধর্মের মতো ধারনাও বুঝাতে পারে।  বলা যায় নৃবিজ্ঞানের প্রথম প্রভাবশালী চিন্তাই হচ্ছে বিবর্তনবাদী চিন্তাধারা। উনবিংশ শতাব্দীতে নৃবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা টাইলর, মর্গান, ফ্রেজারসহ অনেকেই ছিলেন বিবর্তনবাদী।  

নৃবিজ্ঞানে বিবর্তনবাদের রূপ বুঝতে গেলে কিছু সংকট উপস্থিত হয়। একটি সংকট শুরু হয়  জৈব-বিবর্তনবাদ আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদকে গুলিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে। এইক্ষেত্রে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। সামাজিক বিজ্ঞানে বিবর্তনবাদের ধারনা বিকশিত হয়েছে মূলত স্পেন্সারের হাত ধরে। ডারউইন প্রাণীর বিবর্তনের ধারণা দেওয়ার আগেই স্পেন্সার সমাজের বিবর্তন নিয়ে তার ধারণাগুলো নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। 

তবে স্পেন্সারের সামাজিক বিবর্তনের তত্ত্ব আর অন্যদিকে জৈব-বিবর্তনের তত্ত্ব  উভয়ই একে অন্যকে ভিত গড়তে সাহায্য করেছে। আবার তাদের মধ্যে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্যও আছে। তেমনি স্পেন্সারের ধারনার সাথে কিছু পার্থক্য আছে নৃবিজ্ঞানের বিবর্তনবাদী চিন্তাধারার। 

ডারউইনের বিবর্তনবাদের আলাপটি ছিল প্রজাতিকে ঘিরে। প্রজাতি হচ্ছে এমন একদল সর্বাধিক মিলসম্পন্ন প্রাণী , যারা নিজেদের মধ্যে প্রজনন করে উর্বর সন্তান উৎপাদনে সক্ষম। ডারউইন দেখিয়েছেন বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে কোন প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলে এমনকি এক প্রজাতি থেকে নতুন কোন প্রজাতিরও উদ্ভব হতে পারে। যাই হোক, এখানে মূল আলাপটা সামাজিক বিবর্তনবাদ নিয়েই দেওয়া হবে।

সামাজিক বিবর্তনবাদ 

সামাজিক বিবর্তনবাদের ধারণাকে সাধারণত সামাজিক-ডারউইনবাদ বলা হলেও তা আসলে এসেছে স্পেন্সারের হাত ধরে। প্রকৃতপক্ষে ডারউইনের আগে স্পেন্সারই বিবর্তন পদটিকে পরিচিত করে তোলেন । তিনি ১৮৫৭ সালে তার ‘The Ultimate law of Physiology’ বইতে প্রথমবারের মতো বিবর্তন শব্দটি ব্যবহার করেন। এমনকি ‘যোগ্যতমের বেঁচে থাকা’ (Survival Of the Fittest) ধারনাটিও স্পেন্সারের কৃতিত্ব। কাজেই সামাজিক ডারউইনবাদ পদটি আসলে এই সম্পর্কিত বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সমস্যাজনক। কেননা সামাজিক বিবর্তনকে বুঝতে হলে মূলত স্পেন্সার আর তার উত্তরসূরিদের দিকে বেশি চোখ ফেরাতে হবে। 

হার্বাট স্পেন্সার ছিলেন একজন ইংরেজ সমাজবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী। তার কাজের ক্ষেত্র অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, ইথিক্সসহ অনেককিছুকেই স্পর্শ করেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে যেসব তাত্ত্বিক ইংল্যান্ডের বিদ্যাজগতে প্রভাবশালী, তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। 

স্পেন্সারের চিন্তার একটা বাঁকবদল প্রকাশ পায় যখন ১৮৫২ সালে তিনি  ‘The Development Hypothesis’ আর ‘A theory of Population’  নামে দুইটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রথম লেখাটিতে স্পেন্সার চার্লস লয়েলের ‘সকল প্রজাতির স্থিরতার’ (Fixed Species) ধারনাকে আক্রমন করেন। বইটি ডারউইনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এরপর ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হওয়া তার  ‘The Principle of Psychology’ বইতে তিনি যুক্তি দেন, মানবমনের কার্যপ্রণালীকে বিবর্তনের নির্দিষ্ট নীতিগুলোর সাহায্যে বুঝা সম্ভব। এরপরের বছরগুলোয় স্পেন্সার কেবলমাত্র মনের কার্যপ্রণালী নয়, সমাজের বিকাশ, নৈতিকতার উদ্ভবের মতো বিষয়গুলোকেও বিবর্তনবাদী ভাবধারায় নির্দিষ্ট নীতির সাপেক্ষে বুঝার চেষ্টা করেন। তার এই ধারণাকে তিনি ‘সিন্থেটিক ফিলসফি’ নামে অভিহিত করেছিলেন। এইসময় তার কাজে ধর্ম আর বিজ্ঞানের বিরোধ, ডারউইনের তত্ত্ব, ল্যামার্কের তত্ত্বের মতো বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। 

নৃবিজ্ঞানে স্পেন্সারের প্রভাব 

সামাজিক বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাস্ত্রেই স্পেন্সারের প্রভাব ছিল, এরমধ্যে সমাজতত্ত্ব আর নৃবিজ্ঞান নিঃসন্দেহে অন্যতম। স্পেন্সারের প্রভাব একদিকে ছিল বিবর্তনবাদের ধারনা দেওয়ার ক্ষেত্রে, আরেকদিকে ছিল মানবমনের কার্যকারীতা আর সমাজের কার্যপ্রণালী বুঝার ক্ষেত্রে। 

স্পেন্সার বিবর্তনকে একটা সাধারন ও  সার্বজনীন ঘটনা আকারে দেখতেন। তার মতে বিবর্তন জগতের একটা মৌলিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। স্পেন্সারের ধারনায় বিবর্তন হচ্ছে একটা প্রগতির দিকে যাওয়ার প্রক্রিয়া। এছাড়া তিনি মনে করতেন জীববৈজ্ঞানিক, সামাজিক বা যেকোন বিবর্তনের ক্ষেত্রেই হোমোজেনাস অবস্থান থেকে হেটেরোজেনাস অবস্থানে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। তবে সকল বিবর্তনের ধারাই শেষপর্যন্ত সংহতি (Coherence) আর সুস্থিতির (Equilibrium) দিকে যায়। তার মতে, জগতের সকলক্ষেত্রে যেহেতু বিভিন্ন ফেনোমেনার একইধরনের প্রভাব থাকে না, একই শক্তি (Force)  সবখানে একইভাবে কার্যকরী থাকে না, কাজেই প্রথমে সুস্থিতি দেখা যায় না। আবার প্রত্যেকটা শক্তির একের অধিক প্রভাব থাকায় বহুমুখী হেটেরোজেনিটি তৈরি হয়। বিবর্তনের এই গতির মধ্যেই পুনরায় পশ্চাদগমনের ঘটনাও ঘটতে পারে। এভাবে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সুস্থিতি অর্জিত হয়। এইক্ষেত্রে তার ধারনায় ল্যামার্কের প্রভাব দেখা যায়, যিনি মনে করতেন সুস্থিতি অর্জনের জন্যই প্রাণীর জীবসত্তা নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে নেয়। বিবর্তনের ধারণার দিক দিয়ে স্পেন্সারকে ল্যামার্কের কাছাকাছিই বলা যায়। ল্যামার্ক যেমন মনে করতেন শিক্ষণের ফলে অর্জিত গুণই পরবর্তী প্রজন্মে বাহিত হয়, স্পেন্সারের ধারণা অনুসারে একটা সমাজের সংস্কৃতি বা রীতিনীতি ঠিক একই কাজই করে। প্রকৃতির নানা জটিল প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে, এই পরিবর্তন পরবর্তীতে সমস্ত কিছুকে প্রভাবিত করে, নতুন বিকাশের পথ সূচিত করে।

স্পেন্সার দেখান কিভাবে সমাজও সরল থেকে জটিল গঠনের দিকে যায়, যাকে তিনি প্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।  এই প্রগতির ধারনা অবশ্য স্পেন্সার পেয়েছেন তার আগেরকার ইউরোপীয় চিন্তার ঐতিহ্য থেকে। মূলত আঠার শতাব্দী থেকেই ইউরোপের অনেক চিন্তকদের মধ্যে প্রগতির ধারণা অঙ্কুরিত হতে থাকে।  প্রগতির ধারনাটা অনেকটা এমন যে যেকোন সমাজ একটা আদিম অবস্থা থেকে ক্রমশ বিকশিত হয়ে আধুনিক অবস্থায় যায়। আঠারশ শতাব্দীর দিকে ইউরোপে এই বিশ্বাসও দানা বাঁধে যে প্রগতির পথে ইউরোপ সবচেয়ে এগিয়ে আছে, তারাই জগতের সবচেয়ে উন্নত জাতি। স্পেন্সারও এই প্রগতির ধারনাগুলো তার চিন্তায় যুক্ত করেছিলেন। 

স্পেন্সার প্রাচীন সমাজ আর আধুনিক সমাজের পার্থক্য খোঁজার  চেষ্টাও করেছিলেন, যেটা উনবিংশ শতাব্দীর নৃবিজ্ঞানচর্চায় খুব প্রচলিত ছিল। তিনি মনে করতেন, প্রাচীন সমাজগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, সেখানে সামাজিক স্তরায়নের উপর অধিক জোর দেওয়া হয়। অধিক নিয়ন্ত্রণ আর বাঁধা-ধরা নিয়মকানুন থাকে সেখানে। সেসব সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও কোন ধারনা থাকে না। অন্যদিকে আধুনিক সমাজগুলোতে সকলের সমান সুযোগ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, ন্যায্যতার ধারনা উপস্থিত থাকে। তাকে সেই সময়কার উদারনৈতিক রাষ্ট্রের একজন সমর্থক হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। স্পেন্সারের মত ছিল, ক্রমশ সামাজিক বিবর্তনের চাপে প্রাচীন ধারার সমাজগুলো আধুনিক সমাজে বিলীন হয়ে যাবে। তিনি আশা করতেন, সর্বশেষ এমন একটা সমাজ আসবে, যেখানে অতিরিক্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা না থেকে সর্বোচ্চ পরিমানে সামাজিক সহযোগীতা থাকবে।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে ডারউইন আর ওয়ালেসের জৈববৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদ আর সমাজবিজ্ঞানের ধারা থেকে আসা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারণা পুরপুরি এক নয়। দুইটির উদ্ভব ও বিকাশের কিছু স্বতন্ত্র পথ আছে। তারা ডারউইনের জৈব-বৈজ্ঞানিক বিবর্তনের ধারণাকে একরোখাভাবে সংস্কৃতিতে প্রয়োগ করেননি, তারা বরং আগ্রহী ছিলেন ইতিহাসের সর্বজনীন বিকাশের পথরেখা খোঁজা নিয়ে। তার সাথে সাথে তাদের কাজে এথনোগ্রাফি আর প্রত্নতত্ত্বের ব্যবহারও দেখা যায়।  আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে নৃবিজ্ঞানে বিবর্তনের ধারণা যেমন স্পেন্সার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিকশিত হয়েছে, তেমনি তার সাথে আরো নতুন নতুন ধারণাও যুক্ত হয়েছে। আর স্পেন্সারের মতো করে টাইলর, ফ্রেজার আর মর্গান- কোনো নৃবিজ্ঞানীই ‘প্রতিযোগীতা’ কিংবা ‘যোগ্যতমের টিকে থাকা’কে তাদের বিবর্তনের কেন্দ্রে রাখেন নাই। তাদের বিবর্তনের ধারণা ডারউইন আর স্পেন্সার থেকে কিছুদিক দিয়ে আলাদা। 

নৃবিজ্ঞানে বিবর্তনবাদী  চিন্তকদের মধ্যে টাইলর, মর্গান ও ফ্রেজার অন্যতম। মর্গান এবং টাইলর দুইজনেই মনে করতেন আদিম সমাজ থেকে বর্তমান জটিল সমাজে উত্তরণের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির যে বিকাশ প্রয়োজন, তার জন্য সর্বজনীন কিছু পর্যায় প্রত্যেক সমাজকেই পার হতে হয়। যার কারনে মর্গান আর  টাইলরকে কেউ কেউ একরৈখিক বিবর্তনবাদী  (Unilineal evolutionist) হিসেবে দেখেছেন। মর্গান আর টাইলরের বিবর্তনবাদী চিন্তাধারা কাছাকাছি হলেও কাজের ক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মর্গানের কাজ ছিল পূর্বেকার সমাজের পরিবার, ব্যক্তিসম্পত্তি আর সামাজিক সংগঠনকে কেন্দ্র করে, অন্যদিকে টাইলর কাজ করেছেন ধর্মবিশ্বাসের উদ্ভব নিয়ে। আবার টাইলরের ধারণাগুলো ব্যবহার করে ফ্রেজার জাদুবিশ্বাস নিয়ে তার মত প্রদান করেছিলেন। সমগ্র উনবিংশ শতাব্দী জুড়েই বিবর্তনবাদী চিন্তকরা নৃবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছিলেন, যেসবের উপর ভিত্তি করে নৃবিজ্ঞানের সৌধ নির্মিত হতে থাকে।  

Source

  1. Vision of Culture, Jerry D. Moore
  2. The Rise of Anthropological Theory, Marvin Harris
  3. Theory in Social and Cultural Anthropology: An Encyclopedia,  R. Jon Mcgee, Richard L. Warms

One thought on “থিওরি: বিবর্তনবাদ ও স্পেন্সার

Comments are closed.