লিপ প্লেট : ইথিওপিয়ার মুরসি জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য

[এনথ্রোসার্কেলে এবার প্রকাশিত হল আফ্রিকার মুরসি নৃ-গোষ্ঠীর আলোচিত প্রথা ‘লিপ প্লেট’ নিয়ে একটি বিবরণমূলক লেখা। লেখাটি লিখেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের শিক্ষার্থী অমৃতা বিশ্বাস  এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের শিক্ষার্থী রাজদীপ ঘোষ]

মুরসি জনগোষ্ঠী (মুনি) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইথিওপিয়ার নিম্ন ওমো উপত্যকায় বসবাস করে। এই অঞ্চলে দশ হাজারের চেয়েও কম সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন। জলবায়ুর কারনে মুরসিরা বছরে ২ বার, শীত ও গ্রীষ্মে তাদের স্থান পরিবর্তন করে থাকে। মুরসি জনগোষ্ঠীরা যে অঞ্চলে বসবাস করে তা সাউদার্ন ন্যাশনস, ন্যাশনালিটিজ এন্ড পিপলস রিজিওন (SNNPR) নামে পরিচিত। এটি ইথিওপিয়ায় অবস্থিত একটি বহুজাতিক রাজ্য, যার আয়তন প্রায় ২০০০ বর্গ কি.মি। অঞ্চলটি দক্ষিণ ওমো জোনে অবস্থিত, এবং এটি বাইরের জগৎ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এই অঞ্চল দিয়ে বয়ে গেছে ওমো (ওয়ারার) আর মাগো (মাকো) নদী।  মুরসিদের ভাষার নাম সুরমিক, যেটি নীলো-সাহারান ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মুরসির জনগোষ্ঠী পাঁচটি স্থানীয় গোষ্ঠীতে (Group) বিভক্ত, যেগুলো স্থানীয় ভাষায় ভুরান নামে পরিচিত। এগুলোর নাম হলঃ বারুবা, মুগজো, বায়োগোলোকরে, আরিহোলি এবং গঙ্গুলোবিবি । পৃথিবীর বিবিধ নৃ-গোষ্ঠীদের মতো তারাও কিছু স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক প্রথা অনুসরণ করে । ‘লিপ প্লেট’ তার মধ্যে একটি। লিপ প্লেট প্রথাটি মুরসি ও সুরমা এই দুই জাতির মধ্যে দেখা যায় । এটি  ঠোঁট প্লেট, ঠোঁট প্লাগ বা ঠোঁট ডিস্ক হিসাবেও পরিচিত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইথিওপিয়ার মুরসি নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা উল্লেখযোগ্যভাবে ঠোঁট প্লেট প্রথাটির অনুসরণ করে থাকে।  
       

চিত্র : একজন মুরসি নারীর ঠোঁট কাটার পক্রিয়াটি হচ্ছে

ঠোঁট প্লেট কাঠ বা মাটির  দ্বারা নির্মিত হয় । মুরসি মেয়েরা যখন বয়ঃসন্ধিতে পৌছায় (সাধারণত ১৫ থেকে ১৬ বছর) এবং তাদের বিয়ের প্রায় ৬ থেকে ১২ মাস আগে তাদের ঠোঁটের নিচের অংশ কেটে দেওয়া হয়। মেয়েটির মা বা সেই সম্প্রদায়ের অন্যান্য নারীরাই এই কাজটি করে থাকেন। কাটাটি নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত কোনো কাঠের প্লাগ দ্বারা খোলা রাখা হয় । এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত তিন মাস সময় নেয়। এরপরে বড় প্লাগগুলি দিয়ে ঠোঁটটি প্রসারিত করা হয়। ঠোঁট প্রসারিত করার সিদ্ধান্তটি তাদের সমাজের আগে যারা ঠোঁট প্রসারিত করেছেন তাদের উপর নির্ভর করে। কথিত আছে, ঠোঁট প্লেট পরার রীতিটি নারীর উর্বরতা এবং বিবাহযোগ্যতার সাথে যুক্ত । মুরসি সমাজের নারীরা মনে করে, ঠোঁট-প্লেটগুলি হলো তাদের শক্তি আর সৌন্দর্যের প্রতীক, এটি একধরণের অলঙ্কার হিসেবেও বিবেচিত হয় । লিপ প্লেট বয়স্কদের তুলনায় অবিবাহিত মেয়েরা এবং নবধূরাই বেশি পরে থাকেন। এগুলি সাধারণত তিনটি প্রধাণ উপলক্ষ্যে পরিধান করা হয়: পুরুষদের খাবার পরিবেশন করার সময়, গরুর দুধ দোয়ানোর সময় এবং অন্যান্য  গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সময় (যেমন বিবাহ, ডাঙ্গা প্রতিযোগিতা, নৃত্য ইত্যাদি)। গবেষকরা দাবি করেন, মুরসি নারীরা ঠোঁট প্লেট পরিধান করাকে যৌবন এবং প্রজনন সম্ভাবনার সামাজিক অভিব্যক্তি হিসাবে মনে করে । ঠোঁট-প্লাগ করার সময় মেয়েদের নিচের চোয়ালের দাঁতগুলি, বিশেষত ৪টি কৃন্তক দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া হয়।   বছরের পর বছর ধরে ঠোঁটের গর্তটি কেবল বিশাল আকার ধারণ করে পরে। বিবাহের সময় কাঠের প্লেটটি “দেবি” নামে একটি কাদা মাটির প্লেট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় । মুরসি সম্প্রদায়ে যে নারীদের ঠোঁট প্লেট নেই তারা অলস হিসাবে বিবেচিত হন। এই প্লেটগুলি যখন সরিয়ে ফেলা হয়, তখন ঠোঁট দড়ির মতো ঝুলে থাকে ।

চিত্র : মুরসি নারীর ঝুলে পড়া ঠোঁট

মুরসিদের এই প্রথার পিছনে নানা ব্যাখ্যা আছে। সর্বাধিক জনপ্রিয় মতটি হচ্ছে- দাস ব্যবসার সময় মুরসি নারীদের দাস হিসাবে বিক্রি থেকে বাঁচানোর জন্য এটি চালু হয়েছিল। কেননা ঠোঁট প্লাগ করাতে দাস মালিকরা তাদেরকে দাসবাজার থেকে কিনতে নিরুৎসাহিত হত। মেডিকেল ব্যাগের (Medical bag) মতে,  দাস ব্যবসায়ীরা যাতে মুরসি নারী এবং অল্পবয়সী মেয়েদেরকে কম আকর্ষণীয় বিবেচনা করে, তাই একটা ‘ইচ্ছাকৃত অনর্থক’ হিসেবে উক্ত প্রথাটি তৈরি হয়েছিল। 

১৯৯০ সালে বেকউইথ এবং কার্টার দাবি করেছিলেন, মুরসি এবং সুরমা নারীরা ঠোঁট প্লেটের আকার তাদের বিবাহের সময় যৌতুক হিসেবে গবাদি পশুর সংখ্যার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে । নৃবিজ্ঞানী টার্টন, যিনি ৩০ বছর ধরে মুরসি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তিনি অবশ্য এটিকে অস্বীকার করেন । অন্যদিকে লোটোস্কি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বেশিরভাগ মুরসি নারীরা ঠোঁট প্লেট ব্যবহার করেন, কারণ অলঙ্কারটি তাদের জন্য শক্তি এবং আত্ম-সম্মানের প্রতীক। এর একটা সাংস্কৃতিক মূল্য রয়েছে। কথিত আছে, স্বামীকে খাবার পরিবেশনের সময় এই ঠোঁট প্লেট নারীদের আরো আকর্ষনীয় হিসেবে উপস্থাপন করে। মুরসি নারীদের ঠোঁটের প্লেটটি যত বড় হবে, বিবাহের ক্ষেত্রে মেয়েটির পরিবার তার বরের পরিবারের  কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে আরো বেশি গবাদি পশু পাবে। বড় ঠোঁট প্লেটযুক্ত নারীরা ছোটদের তুলনায় বেশি যৌতুক পান। স্ত্রী হিসাবে বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়াতে ঠোঁট প্লেটগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঠোঁট প্লেগ সর্বোচ্চ ২০ সেন্টিমিটারেরও বেশি হতে দেখা গেছে । এটি কোন চিরস্থায়ী বিষয় নয়। এগুলি যে কোনো সময় খুলে রাখা যেতে পারে। মুরসি নারীরা যখন খেতে চান, তারা ঠোঁট প্লেটটি খুলে রাখেন । যদি কারো স্বামী মারা যায়, যেহেতু কোনো নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে ঠোঁট প্লেট সম্পর্কিত, তাই এটিকে তখন খুলে রাখা হয়। মুরসি নারীদের মধ্যে ঠোঁটে ম্যাসাজ করার প্রবণতাও দেখা যায়। এমনকি শিশুদের সেই প্লেট দিয়ে খেলতে দেওয়া হয়। 

প্লেট এবং প্লাগ সহ সমস্ত ধরণের বিদ্ধ-ঠোঁটের অলঙ্কার বোঝাতে ল্যাবরেট (Labret) শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অনেকের মতেই, ঠোঁট প্লেটগুলি পরিধান করা বেদনাদায়ক ও অসুবিধাজনক ।  ঠোঁট-প্লেটটি পরার কিছু ঝামেলাও আছে।  একবার ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেলে তা কখনোই আর সংকুচিত হবে না। আবার নীচের চোয়ালের ৪টি  (কৃন্তক) দাঁত  ভেঙ্গে ফেলার ফলে নারীদের খাবার কামড়ে খাওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়, একই সাথে পানীয় গ্রহণও ঝুঁকিপূর্ণ হয় । উপরের চোয়ালের দাঁতের সাথে নিচের চোয়ালের সামঞ্জস্যতা হ্রাস পায় , অনেকক্ষেত্রেই স্পষ্টভাবে শব্দ উচ্চারনে  সমস্যার সৃষ্টি হয়।

সহায়ক  লিংক :

  1. https://www.mursi.org/documents-and-texts
  2. https://mursi-archaeology.com/
  3. https://jetsetbunny.com/ethiopian-mursi-tribe-andtheir-peculiar-lip-plates/
  4. https://m.guardian.ng/life/the-significance-of-lip-plates-among-african-tribes/
  5. https://www.tribes.world/mursi?hsLang=en
  6. https://ben.agromassidayu.com/plemya-mursi-strashnie-tajni-view-289340 
  7. https://biographyvision.blogspot.com/2020/11/Mursi-tribe-bangla.html?m=1