অন্তর্যাত্রাঃ একটি নৃতাত্ত্বিক ভাবনা
[এনথ্রোসার্কেলের ভিজ্যুয়াল সেকশনে আমরা বিভিন্ন চলচ্চিত্রকে নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করবো। এর সূত্র ধরে আজকে প্রকাশিত হল ‘অন্তর্যাত্রা’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে একটি লেখা। লেখাটি লিখেছেন শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট-গ্রেজুয়েট কলেজের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আসমাউল হুসনা।]
কাহিনী সংক্ষেপ
“ক্লাসের বন্ধুরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আমি সবসময় বিব্রতবোধ করেছি। বাংলাদেশ আমার কাছে পোস্টকার্ডের বেশি ছিল না। অনেকটা বাবার মতো, যিনি আমার কাছে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি মাত্র। এখন এই পোস্ট কার্ডটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে।”
তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত অন্তর্যাত্রা চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রটির নাম সোহেল, যার বাংলাদেশের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন হয় এই অনুভূতির মধ্য দিয়ে। অন্তর্যাত্রা চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে প্রবাসী মানুষের শেকড় খোঁজার গল্পকে কেন্দ্র করে। সোহেলের মা শিরিন সোহেলের বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর পাড়ি জমায় লন্ডনে। একদিন খবর আসে সোহেলের বাবা মারা গেছে। সেই সূত্র ধরেই কৈশোর পার করা সোহেল তার মার সাথে বাংলাদেশে আসে। আজীবন আড়ালে পড়ে থাকা আপনজনদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। বিশেষভাবে পরিচয় ঘটে দুজন মানুষের সাথে, একজন হলো তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী এবং অপরজন তার বোন রিনি। সহোদর-সহোদরা না হয়েও খুব চমৎকার সম্পর্ক হয়ে যায় তাদের মধ্যে।
বাবার কুলখানিতে অংশগ্রহণ করে পরিচয় হয় দাদা, ফুফা, ফুফু আর মৃত বাবার অজস্র স্মৃতির সাথে। সোহেল ঠিক তখনই প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করে তার জন্মভূমিকে।
অন্যদিকে সোহেলের মা শিরিন বাংলাদেশে শেষবারের মতো আসে ১৫ বছর আগে। ঢাকায় পা দেবার সাথে সাথে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে অতীত হাতড়ে ফেরেন শিরিন। পরিবর্তিত এক শহর তার চোখে ধরা দেয়। যেই বিষয়গুলো শিরিনের চোখে অনুপস্থিত সেই বিষয়গুলোকেই আনন্দের স্মৃতি বলে মনে হতে থাকে। খুব সহজেই অতীতকে দেখে নেয় বর্তমানের তীরে দাঁড়িয়ে।
দাদাবাড়ি যাবার পর সোহেল নতুন করে ভাবতে শুরু করে তার মা-বাবাকে নিয়ে। এতোদিন যে বিষয়গুলো তার কাছে সত্য ছিল সেগুলো অসত্য মনে হতে থাকে। একপ্রকার দ্বৈত সত্ত্বার উদ্ভব হয় তার মধ্যে। মায়ের প্রতি অভিমান বাড়তে থাকে। অন্যদিকে শিরিন ভাবতে থাকে কীভাবে তার আক্ষেপগুলো ছেলেকে বুঝাবে, অপ্রাপ্তিগুলোকে উন্মোচন করবে!
সোহেল অন্য একটা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা তরুণ। সে আগে এভাবে ধর্মীয় বিধিবিধানের মুখোমুখি হয়নি,, যেভাবে সিলেটে আসার পর সে পরিচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তাকে সাংস্কৃতিক অভিঘাতের মুখোমুখি হতে দেখা যায়। সৎবোন রিনির ছেলেমানুষী আর সরলতায় বাঁধা পড়ার সাথে সাথে দাদুর মুখে শোনা ঐতিহাসিক গল্প শোনার দৃশ্যটাও নজর কাড়ে। প্রচুর তথ্যনির্ভরতার সাথে এই অংশটি নির্মিত হয়েছে। সোহেলের একটা সময় পর মনে হতে থাকে এই ভ্রমণটা তার কাছে স্রেফ আদিগন্ত সবুজে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নয়, বরং দেখার চাইতে উপলব্ধির মাত্রাটাই ঢের বেশি। গল্পের শেষাংশে চমৎকারভাবে দেখানো হয় সোহেলের ভাবনার সারাংশ। সোহেল বুঝতে পারে বাবার মৃত্যুটা শুধুমাত্র তাকে নয়, মাকেও বাবার কাছাকাছি এনে দিয়েছে। তাকে বারবার আসতে হবে এই দেশে!
নৃভাবনা
মানুষ মূলত তার সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই অন্য মানুষদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়। সাংস্কৃতিক ভিন্নতাই তাকে আলাদা করে তোলে। আর মানুষ যে সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠে তা থেকে যখন বের হয়ে নতুন ( তার পূর্ববর্তী সংস্কৃতিও হতে পারে) কোন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে তখন তার কালচারাল শক বা সাংস্কৃতিক অভিঘাত হয়। অন্য কোন দেশে বা সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এই ধরণের ঘটনা ঘটে থাকে। ফলে, সোহেল ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। শিরিনের ক্ষেত্রে দেখা যায় সাংস্কৃতিক অভিঘাতের ফলে তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। মূলত সংস্কৃতিই আমাদের অভিজ্ঞতা গড়ে দেয়। স্মৃতিকাতরতার একটি সাংস্কৃতিক মাত্রাও আছে।
তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদের অনবদ্য সৃষ্টি ‘অন্তর্যাত্রা’। গল্পে বিশেষ কোনো জটিলতা নেই, বরং কোথায় যেনো একপ্রকার সারল্য আছে। তবে গল্পকে আরো শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে তথ্য ও চিন্তনের মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে। পুরো চলচ্চিত্র ধরে ছিল একটা জার্নি, যার ওপর ভর করে পরিচালকদ্বয় টেনে নিয়ে গেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।পাশাপাশি থাকা দুটি প্রজন্মের মধ্যে ভিনদেশে নাগরিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কাহিনীচিত্র উঠে এসেছে এখানে। জ্ঞাতিসম্পর্কীয় বয়ান ও দেশ নিয়ে আলাপচারিতার সুচারু ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। নতুনকে দেখার কৌতুহল এবং বহুবিধ সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কারের প্রচ্ছন্ন ছায়া দর্শককে অবলীলায় টেনে নিয়ে যায় অন্তর্যাত্রায়।
নৃবিজ্ঞানে সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে জ্ঞাতি সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। জ্ঞাতিসম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যক্তির ভূমিকা নির্ধারিত হয়। জ্ঞাতিসম্পর্কের উপর ভিত্তি করে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। সমাজের একে অন্যকে কিভাবে গ্রহণ করে তাও জ্ঞাতিসম্পর্ক ধারণ করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাবার দিকের জ্ঞাতিরা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সোহেলের ক্ষেত্রেও তার পিতার দিকের জ্ঞাতিদের সাথে সম্পর্ক নতুন করে উপলব্ধি করার বিষয়টি দেখা যায়। তাছাড়া ইউরোপীয় সমাজের জ্ঞাতি সম্পর্কের তুলনায় বাংলাদেশী সমাজের জ্ঞাতিসম্পর্ক অনেকটাই ভিন্ন। এই ব্যাপারটিও চলচ্চিত্রটিকে সোহেলের অভিজ্ঞতা মধ্য দিয়ে চোখে পড়ে।
এবার আসি চলচ্চিত্রটিকে নৃবৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশ্লেষণে। অন্তর্যাত্রা চলচ্চিত্রটি মানুষের অবস্থানের গল্প বুনেছে। মাইগ্রেশনের নানা দিক এখানে বিদ্যমান। সোহেলের দাদা বা নানার পুশ ফ্যাক্টরকে মেনে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো অথবা সোহেল আর তার মায়ের পুল ফ্যাক্টরের ওপর ভর করে লন্ডন প্রবাস। এমনকি চা বাগানের শ্রমিকদের জোরপূর্বক আজীবন বেঁধে রাখার গল্পও বাদ যায়নি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর উড়িয়া শ্রমিকদের মাদলের করুণ সুর খুব সহজেই মন ভারাক্রান্ত করে দিতে পারে। দূর থেকে একটা বিষয়ের ওপর জানা আর মাঠে নেমে ব্যবহারিক উপায়ে অনুধাবন করার মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে নিবিড়ভাবে। জ্ঞাতি সম্পর্কের অজানা অধ্যায় খুব সহজেই পর্দা ভেদ করে চলে আসে সোহেলের সামনে। সে এই সম্পর্কগুলোর সাথে দেশীয় সংস্কৃতির যুক্ততা খুঁজে পায়। সোহেল আর দাদুর গল্পচ্ছলে উঠে আসে অভিবাসী মানুষদের প্রসঙ্গ, যেখানে চা শ্রমিক, ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মানুষদের গল্প এমনকি ঔপনিবেশিক শাসনামলের অভিবাসী ইংরেজদের কবরস্থানের চিত্র তুলে ধরা হয়।
ঐতিহাসিক ভেদচিহ্ন দিয়েই তৈরি হয় সংস্কৃতির অবয়ব আর সংস্কৃতির শেকলে বন্দী হয়ে যেতে হয় সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে। যার পরিচয় রচনা হয় কাঁটাতারের অবস্থানকে ঘিরে। পরিচালকদ্বয় তাঁদের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোকে দেখিয়েছেন পর্যবেক্ষণের জায়গা থেকে এবং এর সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন বিচারমূলক চিন্তা আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে। সম্ভবত, ‘অন্তর্যাত্রা’ চলচ্চিত্রের পরিচালকদ্বয়ের নিজস্ব জার্নির বাইরের কোনো গল্প নয়। তাদের নিজ এবং অন্য সংস্কৃতি সম্পর্কে উপলব্ধ জ্ঞানেরই অবতারণা ঘটেছে চলচ্চিত্রটিতে। মা-ছেলের কথোপকথনের এক পর্যায়ে মায়ের ঘুমিয়ে যাওয়া আর কুয়াশার মধ্য দিয়ে ভোরের আলো ফোটার দৃশ্য অদ্ভূত এক নান্দনিকতার ছোঁয়া আনে শেষাংশে। অন্তর্যাত্রা অভিবাসী মানুষদের গল্প, অন্তর্যাত্রা এক শ্রেণীর মানুষের স্মৃতি-বিস্মৃতির অনুভবের স্থান। এই চলচ্চিত্রটি সকলের জন্য তথ্যবহুল বিভিন্ন তত্ত্বের মিশেল বলা যেতে পারে। কিংবা, মানুষ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কিত চিন্তা তুলে ধরার একটি প্রয়াস।
চলচ্চিত্রঃ অন্তর্যাত্রা।
পরিচালকঃ তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদ।
কাহিনিঃ তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদ।
স্থায়ীত্বঃ ৮৬ মিনিট
মুক্তিঃ ২০০৫(যুক্তরাজ্য)
২০০৬(বাংলাদেশ)
ভাষাঃ বাংলা এবং ইংরেজি।
দেশঃ বাংলাদেশ
প্রধান চরিত্রেঃ-
* সারা জাকের
* জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
* আব্দুল মমিন চৌধুরী
* নাসরিন করিম
* রোকেয়া প্রাচী
* হারল্দ রশিদ
* রিফাকাত রশিদ তিয়াস