মাতৃসূত্রীয় পরিবারে নারীর স্বাস্থ্য সুবিধা ও নারীপ্রধান খানা গঠনের স্বাধীনতা
মাতৃসূত্রীয় খানাব্যবস্থা বনাম পিতৃসূত্রীয় খানাব্যবস্থায় স্বাস্থ্য সুবিধার দিকটিতে আলোকপাত করার আগে প্রথমেই আমাদের জ্ঞাতিত্ব, বংশধারা, মাতৃসূত্রীতা, পিতৃসূত্রীতা, খানাব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ের সংজ্ঞায়ন করা প্রয়োজন।
জ্ঞাতিত্ব (Kinship): কিনশিপ বা জ্ঞাতিসম্পর্ক হলো পরিবার বা সমাজের বিভিন্ন মানুষের সাথে গড়ে উঠা নানাবিধ সম্পর্ক। একটি পরিবারে আমরা একে অপরের সাথে বিভিন্ন সম্পর্কে আবদ্ধ। সমাজে বসবাস করতে গিয়েও নানা মানুষের সাথে আমাদের নানাবিধ সম্পর্ক গড়ে উঠে, যে সম্পর্কের নিরিখে আমরা একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকি। নৃবিজ্ঞানী র্যাডক্লিফ ব্রাউনের মতে, “আমরা যখন জ্ঞাতি বা আত্মীয়ের কথা বলি তখন আমাদের মধ্যে এমন একটি ধারণা জন্মে যে সেই জ্ঞাতির সাথে আমরা কোন এক বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ।”
বংশধারা (Descent): বংশধারা বলতে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের বংশের ধারার ধরণগুলোকে বুঝানো হয়। বংশধারা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাধারণত একটি পরিবারের সকল সদস্যকেই (বাবার দিকের পরিবার কিংবা মায়ের দিকের পরিবার) একই জ্ঞাতিসম্পর্কে যুক্ত বলে ভাবা হয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ সমাজেই বংশধারা নির্ধারিত হয় একরৈখিকভাবে। অর্থাৎ পিতৃসূত্রীয় কিংবা মাতৃসূত্রীয়।
পিতৃসূত্রীয় (Patrilineal): বাবার দিকের পরিবারের সঙ্গে জ্ঞাতিসম্পর্ককেন্দ্রিকতা থাকলে তাকে বলা হয় পিতৃসূত্রীয় পরিবার। পিতৃসূত্রীয় বংশধারায় পরিবারের হর্তাকর্তা হয় সাধারণত একজন পুরুষ। পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত ও খানাব্যবস্থা গড়ে উঠে পুরুষের কর্তৃত্বের অধীনে। সেই পরিবারে নারীদের মতামত কম গুরুত্ব পায়।
মাতৃসূত্রীয় (Matrilineal): মায়ের দিকের পরিবারের সঙ্গে জ্ঞাতিসম্পর্ককেন্দ্রিকতা থাকলে তাকে বলা হয় মাতৃসূত্রীয় পরিবার। মাতৃসূত্রীয় পরিবারে সাধারণত পরিবারের প্রধান হয় একজন নারী। নারীর অধীনস্তে পরিবারের খানাব্যবস্থা গঠিত হয়। পরিবারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তগুলোতে নারীদের বিশেষ প্রাধান্য থাকে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারসূত্রও নারীদের দিক থেকে বাহিত হয়।
খানাব্যবস্থা (Household): খানা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর একটি মৌলিক বিষয়। খানার আয়-ব্যয়ের সম্পর্ক পরিবার ও জ্ঞাতিসম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ। যারা একই হাড়িতে খাবার রাঁধে ও একইসাথে খায় তাদের নিয়ে গড়ে উঠে খানাব্যবস্থা।
নারীপ্রধান খানাব্যবস্থা (Matriarchal Household): পরিবারের নারী সদস্যকে প্রধান করে যে খানা গড়ে উঠে তা হলো নারীপ্রধান খানা ব্যবস্থা। নারীপ্রধান খানায় নারীই পরিচালনা করে খানার সমস্ত আয়োজন। অর্থাৎ নারীর উপর নির্ভর করে খানাব্যবস্থার সকল সদস্যরা।
এবার আসি মূল আলোচনায়ঃ
বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজব্যবস্থায় পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কার ধ্বনির আভাস পাওয়া যায়, বিশেষ করে যখন উচ্চারিত হয় “পুরুষতন্ত্রের পাঁচ হাজার বছর”। কিন্তু তার আগে? তার আগেও কি পৃথিবীতে ছিল পুরুষদেরই আধিপত্য? নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের অনেক লেখা ইঙ্গিত করে, তার আগে ছিল না পুরুষতন্ত্র নামক ব্যবস্থা । তখন নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে শিকারে যাওয়ারও প্রমাণ মিলেছে। উভয়ে জীবিকা নির্বাহের গুরুদায়িত্বে অংশগ্রহণ করতো। প্রাকৃতিক নিয়মে নারী তার গর্ভে সন্তান ধারণ করলে সেই সময়টাতে নারী কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারতো না। কিন্তু সন্তান জন্মদান ছিল এক বিস্ময়কর কাজ। তবে, কৃষিভিত্তিক সমাজের উদ্ভবের পরে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যায়। ধীরে ধীরে সমাজের নানা পরিবর্তনের কারণে লিঙ্গের ভিত্তিতে শ্রমবিভাজন বাড়তে থাকে। এর পিছনে একটা কারণ ছিল নারীদের গর্ভাবস্থা। নারী যখন গর্ভাবস্থায় গৃহে বিশ্রাম নেয়, তখন খাদ্যের জন্য নারী পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সেই সময়ে নারী কোন খাদ্য উৎপাদনে অংশ নিতে পারে না। ফলে কিছুটা সময়ের জন্য পুরুষ হয়ে উঠে নারীর খাদ্য ও আশ্রয়ের ভরসা। সেই থেকে নারীর স্থায়ী আবাস হয়ে উঠতে থাকে গৃহ। পরিবারে ও খাদ্য উৎপাদনের কর্তৃত্ব চলে যায় পুরুষের হাতে। পুরুষ একচ্ছত্রভাবে পরিবার ও সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে। সেই আধিপত্যের সূত্র ধরে পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজে এখনো টিকে আছে পাঁচ হাজার বছর আগে জন্ম নেওয়া পুরুষতন্ত্র।
বর্তমানে পৃথিবীতে কিছু কিছু মাতৃসূত্রীয় সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও সেসব সমাজেও রয়ে গেছে পুরুষতন্ত্রের প্রভাব। যেসব সমাজে মা তথা নারীই প্রধান হয় এবং মায়ের সূত্র ধরে সন্তান-সন্ততির বংশধারা নির্ধারিত হয়, সেসব সমাজেও পুরুষের প্রাধান্য দেখা যায়। সাধারণত যোদ্ধা হিসেবে কিংবা সমাজের নীতি নির্ধারক হিসেবে পুরুষকেই নির্বাচন করা হয়। তবে বংশধারায় মাতৃসূত্রীয় হওয়ায় সেসব পরিবারে নারী পুরুষের বৈষম্য পিতৃসূত্রীয় পরিবারের বৈষম্যের তুলনায় অনেকটা কম। ফলে মাতৃসূত্রীয় পরিবারে নারীতন্ত্র পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও পরিবারের অনেক ক্ষেত্রেই নারী কিছুটা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। যেমন- খানা ব্যবস্থায় নারীর হস্তক্ষেপের স্বাধীনতা (খাবার তালিকা তৈরী, খাবার আয়োজন, খাবার নির্বাচন ইত্যাদি কাজ)। ‘Sex at Dawn’ বইয়ের লেখক খ্রিস্টোফার রায়ান মনে করেন, “মাতৃতন্ত্র আসলে পিতৃতন্ত্রের উল্টোটি নয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যেমন কর্তৃত্ব খাটানোর জন্য নারীর উপর নিপীড়ন চালানো হয়, মাতৃতান্ত্রিক সমাজে তেমনটি ঘটে না। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বরং সহযোগিতা, শৃঙখলা, ক্ষমতার সুষম বণ্টন চর্চা হতে দেখা যায়।” এখানে খ্রিস্টোফার রায়ান মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলতে মূলত মাতৃসূত্রীয় সমাজকেও বুঝিয়েছেন।
অর্থাৎ মাতৃসূত্রীয় পরিবারের অস্তিত্ব থাকলেও মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রমাণ মেলে না। কিছু কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাজের মধ্যে মাতৃসূত্রীয় বংশধারার উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যেমন-
গারো সম্প্রদায়ঃ গারোরা বাংলাদেশে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। গারোরা সাধারণত টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার দিকে বসবাস করে। তাদের বংশধারা মাতৃসূত্রীয়। অর্থাৎ মা-ই পরিবারের কর্তা ও সম্পত্তির অধিকারী। পরিবারের সন্তানসন্ততিরা মায়ের পদবি ধারণ করে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নির্বাচিত মেয়েই সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করে। সেই নির্বাচিত মেয়েকে গারো ভাষায় নক্না বলে। গারো পরিবারে খানাব্যবস্থা গড়ে উঠে নক্নার কর্তৃত্বে।
মসুও সম্প্রদায়ঃ চীনের ইউনান ও সিচুয়ান অঞ্চলে বাস করে ‘মসুও’ জাতি, যাদের বংশধারায় মাতৃসূত্রীয়। মসুও পরিবারে নারীই প্রধান এবং নারীর মাধ্যমেই সন্তান-সন্ততির বংশধারা নির্ণয় করা হয়। মসুও পরিবারের খানাব্যবস্থাও নারীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে। অর্থাৎ নারীর কর্তৃত্বে তাদের খানা গঠিত হয়। তাদের মধ্যে এক ধরণের বিয়ের প্রচলন আছে। একে বলা হয় “ওয়াকিং ম্যারেজ” (walking marriage)। ওয়াকিং ম্যারেজে মসুও নারী শয্যার জন্য কোন পুরুষকে বাছাই করলে, সে পুরুষ রাতে পায়ে হেঁটে নারীর গৃহে প্রবেশ করে। সারা রাতের শয্যা শেষে সূর্যোদয়ের আগে পুরুষ নারীর গৃহ ত্যাগ করে। উভয় পক্ষের সম্মতিতে যতদিন খুশি এই সম্পর্ক চালু রাখা যায়। কিন্তু কোন এক পক্ষের সামান্য আপত্তিতেও সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই প্রচলনকে “র্যান্ডম” সম্পর্ক স্থাপন বলে মনে হলেও অধিকাংশ নৃবিজ্ঞানী একে “সিরিয়াল মনোগ্যামি” হিসেবে বিবেচনা করেন। মসুওদের পরিবারে নারী প্রধান হলেও তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা নীতিনির্ধারক হিসেবে পুরুষরাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
গারো ও মসুও জাতির মতো এমন আরো কিছু মাতৃসূত্রীয় সমাজের পরিবারগুলোর খানাব্যবস্থার উপর গবেষণা চালিয়ে নৃবিজ্ঞানীরা প্রস্তাব করেন যে, পরিবারে কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপের স্বাধীনতার উপর নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্ভর করে। মাতৃসূত্রীয় পরিবারের তুলনায় পিতৃসূত্রীয় পরিবারে বৈষম্যের হার বেশি। সেখানে সম্পত্তিতে পুরুষের স্বৈরাচারী মনোভাব ও খাদ্যে পুরুষের কর্তৃত্ব স্থাপন পরিবারের নারী ও শিশুর জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে মাতৃসূত্রীয় পরিবারে বৈষম্যের মাত্রা কম। তাছাড়া শিশুর পুষ্টির ব্যাপারে নারীরাই অধিক যত্নশীল হয়। সুতরাং, নারীর অধীনে খানা ব্যবস্থা গঠিত হলে সেই পরিবারে নারী-শিশু সহ পুরুষ সদস্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যায়।
তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বিচারে এদেশের নারীপ্রধান খানাব্যবস্থা ও মাতৃসূত্রীয় পরিবারের খানাব্যবস্থা ভিন্ন দৃশ্য তৈরী করে। মাতৃসূত্রীয় পরিবার বলতে কি বোঝায় আমরা জেনেছি। এবার আমরা দেখবো কিসের ভিত্তিতে ও কোন পরিস্থিতিতে নারীপ্রধান খানা গঠিত হয়।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক। এদেশের অধিকাংশ পরিবারে পুরুষই হয় সকল বিষয়ের হর্তাকর্তা। কিন্তু দিন দিন এদেশে নারী প্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। । ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রায় ১৪% পরিবার নারী প্রধান পরিবার (তথ্যসূত্র: বিবিসি)। এই ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালের দিকে দেশে নারী প্রধান পরিবার ২৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এদেশে বিভিন্ন পরিস্থিতির সাপেক্ষে পরিবারের প্রধান হয়ে উঠে নারী। যেমন- একক পরিবারে স্বামী মারা গেলে পরিবারের দায়িত্ব নেয় স্ত্রী। সেক্ষেত্রে বিধবা নারীটি হয়ে উঠে পরিবারের প্রধান। তখন সেই নারীটিকে ঘিরে গড়ে উঠে খানাব্যবস্থা। ক্ষেত্র বিশেষে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমেও নারীরা পরিবারের প্রধান হয়ে খানা গঠন করে থাকে। পরিবারের পুরুষ সদস্যটি যদি শারীরিকভাবে অক্ষম হয় এবং অক্ষমতার কারণে যদি পুরুষটি আয় রোজগার করতে না পারে, তখন কাজে সক্ষম নারীটি পরিবারের প্রধান হয়ে খানা গঠন করে। আবার অবিবাহিত অল্প বয়সী মেয়েরাও গার্মেন্টস-কারখানায় চাকরি নিয়ে তাদের দরিদ্র পরিবারের খানাব্যবস্থার দায়িত্ব নিচ্ছে। এছাড়া এদেশের কিছু আদিবাসীদের মধ্যে মাতৃসূত্রীয় পরিবারগুলোতে নারীই হয় পরিবারের প্রধান। সেখানে তাদের সমাজব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী নারীকে ঘিরেই গড়ে উঠে তাদের খানা ব্যবস্থা। যেমন- গারো কিংবা খাসিয়া সম্প্রদায়ের খানাব্যবস্থা।
বাংলাদেশে নারীপ্রধান পরিবারের খানাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য সুবিধার চিত্র অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা আলাদা। পরিবারের প্রধান হিসেবে এদেশের নারীরা নিজেদের কতটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পারছে সে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা মির্জা তাসলিমা সুলতানা। তিনি বলেন, “পরিবারের প্রধান হওয়ায় নারীদের ঘরে বাইরে দুই জায়গাতেই কাজ করতে হয়। কিন্তু বড় কোন ইস্যুতে, যেমন- মেয়ের বিয়ে বা জমি ক্রয়-বিক্রয়, ইত্যাদি ক্ষেত্রে সে আবার পুরুষদের সহযোগিতা চেয়ে থাকে। নারীর ভূমিকা প্রধান হলেও এদেশের সামাজিক কাঠামোর কারণে নারী বড় বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় পুরুষ বা স্বামীর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়”। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে নারী আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও এদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচারে নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দিন শেষে নির্ভর করে পুরুষেরই উপর। ফলে খানাব্যবস্থায়ও নারীর আধিপত্য সেভাবে থাকে না। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করা যায়। ধরুন, একটি পরিবারের প্রধান চালিকা একজন নারী। তার বাবা/ভাই/স্বামী/সন্তান/শ্বশুর অর্থাৎ তার পরিবারের পুরুষ সদস্যটি বেকার বা কর্মক্ষম নয়। সেই পরিবারে নারীটি কোন কাজের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সকলের সহযোগিতা করে থাকে। নারীই উপার্জন করে, বাজার করে, রান্না করে এবং পরিবারের সকলকে নিয়ে খানা গঠন করে। সেই খানাব্যবস্থায়ও কিন্তু নারীটিই পুরুষের তুলনায় কম প্রাধান্য পায়।কারণ, এদেশের নারীদের মানসিক গড়ন বলে দেয় ‘মাছের মাথাটা কিংবা মুরগির রানটা পুরুষের পাতেই মানানসই’। ফলে নারীপ্রধান খানা গঠিত হলেও এদেশে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হয় না।
২০২০ সালের জুন মাসে করোনা মহামারীতে এদেশের নারী ও পুরুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর ব্র্যাক একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, যেখানে পুরুষ প্রধান খানার আয় কমেছে ৭৫%, সেখানে নারীপ্রধান খানার আয় কমেছে ৮০%। নারীপ্রধান খানাগুলোর মধ্যে ৫৭% জানিয়েছে মহামারী পরিস্থিতিতে তাদের কোন উপার্জন নেই। অন্যদিকে, পুরুষপ্রধান খানাগুলোর ৪৯% এর উপার্জন নেই। সুতরাং, জরিপের ফলাফল থেকে অনুমান করা যায়, পুরুষ প্রধান খানার চেয়ে নারী প্রধান খানা আর্থিকভাবে বেশ কিছুটা নাজুক। কেননা, মহামারীতে লকডাউন অবস্থায় এদেশের পুরুষেরা কোন না কোন ভাবে কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেলেও নারীর জন্য কোন কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সুযোগ অনেক কম। ফলে নারীরা শুধু আর্থিক কিংবা সামাজিকভাবেই নয়, বরং কর্মক্ষেত্রেও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। এতে করে নারী পুরোপুরি এককভাবে ও স্বনির্ভর হয়ে খানা গঠন করতে পারছে না।
তবে খানা ব্যবস্থার পুষ্টিগুণ বিচারে এগিয়ে আছে নারীপ্রধান খানা। বাংলাদেশ ইনটিগ্রেডেট হাউসহোল্ড সার্ভের (বিআইএইচএস) তথ্য অনুসারে দেখা যায়, নারীপ্রধান পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ অনেক বেশি। মানসম্পন্ন খাবার গ্রহণের সচেতনতার দিক থেকে নারীই এগিয়ে থাকে। তাছাড়া এদেশের সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো সাপেক্ষে নারীরা পুরুষের তুলনায় অধিক যত্নশীলও বটে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিচারে এই অঞ্চলের নারীপ্রধান খানাব্যবস্থা ও অন্যান্য অঞ্চলের নারীপ্রধান খানাব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক রয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ নারীপ্রধান খানা কৃষিভিত্তিক। বিশেষকরে মাতৃসূত্রীয় সমাজগুলোর নারীপ্রধান পরিবার। চাষাবাদের উপর নির্ভর করে তাদের খানা গড়ে উঠে। অর্থাৎ যেসব নারীপ্রধান সমাজে প্রচুর চাষযোগ্য জমি রয়েছে তাদের খানাব্যবস্থা অধিক মজবুত। কারণ তারা বসতি স্থাপনের খুব নিকটেই চাষাবাদ করে ও যে ফলন ফলায় তা দিয়ে পরিবারের সকলের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করে। আর কৃষিকাজের ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়েও নেই। ফলে পুরুষের সহায়তা ছাড়াই এককভাবে স্বনির্ভর হয়ে নারীরা একটি মজবুত খানাব্যবস্থা গঠন করতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে চাষযোগ্য জমির অভাবে নারীপ্রধান খানা গঠন সম্ভব হয়ে উঠে না। এদেশের শহরাঞ্চলে যেসব নারীপ্রধান খানা গড়ে উঠে সেসব পরিবারের নারীরা কৃষিকাজের সুযোগ-সুবিধা পায় না। ফলে তাদেরকে নির্ভর করতে হয় কারখানার কাজ বা নিরাপত্তাহীন অস্থায়ী চাকরির উপর। তারা সরাসরি খাদ্য উৎপাদনে অংশ নিতে পারে না। ফলে তাদের খানাব্যবস্থাও নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠে। এতে করে এদেশের অধিকাংশ নারীপ্রধান খানাব্যবস্থা গঠনের দিক থেকে ভঙ্গুর হয়।
তবে নৃবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে ধারণা করা যায়, পিতৃসূত্রীয় পরিবারের চেয়ে মাতৃসূত্রীয় পরিবারের নারীপ্রধান খানাব্যবস্থা নারীর স্বাস্থ্যসুবিধা অধিক হারে নিশ্চিত করে। যদি কোন পরিবারে পুরুষের উপর নির্ভরশীল না হয়েই নারীপ্রধান খানাব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে গঠন করা যায়, তা কেবল নারীর জন্যই নয়, বরং পরিবারের পুরুষ সদস্যদের জন্যও অধিক স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করবে।