সামাজিক বাস্তবতা নির্মাণে প্রতীকী নৃতত্ত্বের ভূমিকা

[নৃবিজ্ঞানে ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ একজন গুরত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক। গিয়ার্টজ তার প্রতীকি নৃবিজ্ঞানে অবদানের জন্য বিখ্যাত। ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজকে কেন্দ্র করে প্রতীকি নৃবিজ্ঞানের উপর লেখাটি লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী রিফাত হাসান আদর]

আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে এই প্রকৃতির সকল ঘটনাকে সকল মানুষ একইভাবে ধারণ করে কিনা? একজন সাহিত্যিক যেভাবে প্রকৃতিকে ধারণ করেন কিংবা প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন, একজন রাজনীতিবিদ কি একইভাবে ধারণ/ব্যাখ্যা করেন? অথবা একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি যেভাবে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করেন, একজন শিল্পীও কি একইভাবে উপলব্ধি করেন? এর উত্তর হলো – না। তারা একইভাবে প্রকৃতিকে ধারণ করেন না, একইভাবে উপলব্ধি করেন না। তারা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে পৃথিবীকে উপলব্ধি করেন। একইভাবে নৃবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ সংস্কৃতিকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে একটি “পাঠ” (text)। এই পাঠে থাকবে আমরা পৃথিবীকে কিভাবে দেখছি, কিভাবে উপলব্ধি করছি এবং কিভাবে বিভিন্ন ঘটনাকে ব্যাখা করছি এবং কি বুঝে করছি সেসব বোঝাপড়া। তিনি মনে করেন নৃবিজ্ঞানীদের কাজ হলো এই বোঝাপড়াগুলোকে পুনরায় বোঝা। গিয়ার্টজ ‘পাঠ” বলতে আসলে কী বুঝিয়েছেন, এটাই আমরা আলোচনা করবো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘THE INTERPRETATION OF CULTURES‘ এবং সেখানে উল্লেখিত এবং নৃবিজ্ঞানের বহুল আলোচিত বিষয় ‘Thick Description’ এর আলোকে।  

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের একটি উপশাখা হিসেবে প্রতীকী নৃতত্ত্ব (Symbolic Anthropology)-কে বিবেচনা করা হয়। প্রতীকী নৃতত্ত্বের মূল আলোচনা প্রতীকী ব্যবস্থা নিয়ে – যা মূলত প্রাকৃতিক জগতের ক্ষেত্রে মানুষের ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত হয়। প্রতীকী নৃতাত্ত্বিকরা সমাজ এবং সংস্কৃতিকে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মানুষের ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দেন এবং বিশ্বাস করেন যে মানুষের এই ব্যাখ্যার উৎস স্পষ্টভাবেই তাদের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া ও যোগাযোগ। কিন্তু উল্লেখিত এই উপশাখার যাত্রা নৃবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের হাত ধরে শুরু হয়নি। সর্বপ্রথম জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার এই ব্যাখ্যামূলক অধ্যায়নকে প্রাধান্য দিয়ে ‘ব্যাখ্যামূলক সমাজবিজ্ঞান’ (Interpretive Sociology)-এর প্রবর্তন করেন। যদিও ‘ব্যাখ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা নিয়ে মতবিবাদ আছে, কিন্তু বাংলা ভাষায় Interpretation এর অর্থ হিসেবে ‘ব্যাখ্যা’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়। এই শব্দটির ব্যবহার নিয়ে মতবিবাদের কারণ হলো, ইংরেজি ভাষায় ‘explanation’ এবং ‘interpretation’ দুটি আলাদা অর্থ বহন করলেও বাংলা ভাষায় উভয় শব্দের অর্থ একই, এবং সেটি হলো ‘ব্যাখ্যা’। কিন্তু বাংলা ভাষায় ‘interpreter’ কে ‘অনুবাদক’ বলা হলেও ব্যাখামূলক নৃতত্ত্বে Interpreter বলতে অনুবাদক বোঝায় না। যেহেতু বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্ব চর্চায় ‘ব্যাখ্যা’ শব্দটি ব্যবহৃত, সেহেতু interpretation বলতে আমরা আপাতত ব্যাখ্যাই বুঝবো। কারণ ইন্টারপ্রেটিভিস্টরা কোনো সামাজিক প্রপঞ্চকে ‘explain’ করেন না বরং তারা ‘interpret’ করেন। ম্যাক্স ওয়েবার মূলত দৃষ্টবাদী (positivist) সমাজবিজ্ঞানীদের সমালোচনা করার মাধ্যমে এই ধরণের সামাজিক প্রপঞ্চকে বোঝার জন্য ব্যাখ্যামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচলন করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি দৃষ্টবাদী সমাজবিজ্ঞান থেকে বেরিয়ে এসে স্বীকার করে যে মানুষের পর্যবেক্ষণযোগ্য, বস্তুনিষ্ঠ বিষয়গুলির পাশাপাশি মানুষের আত্মনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং আচরণ অধ্যয়ন করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম একজন দৃষ্টবাদী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সামাজিক সংগঠনগুলোর বিশেষ পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞান সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম। তিনি আরো মনে করতেন, সমাজবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে পাঠ করা সম্ভব।  সমাজবিজ্ঞানে এমিল ডুর্খেইম-এর গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘সোশ্যাল ফ্যাক্ট’। সোশ্যাল ফ্যাক্ট বলতে সাধারণত সমাজের প্রতিষ্ঠান, নিয়ম এবং মূল্যবোধ – এর মতো ব্যাপারগুলোকে বোঝায়, যেগুলার অস্তিত্ব ব্যক্তি বহিঃস্থ এবং এগুলো ব্যক্তির উপর বিধি-বিধান আরোপ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তির সমষ্টি থেকে ‘সোশ্যাল ফ্যাক্ট’ বেরিয়ে আসে, কিন্তু সেগুলোকে ‘ব্যক্তি’ (individual) স্তরে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এই সোশ্যাল ফ্যাক্ট বাস্তব এবং এটি একক ব্যক্তিসত্তার উপরের স্তরে বিদ্যমান। ম্যাক্স ওয়েবার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বস্তুনিষ্ঠ (objective) বলে খারিজ করেন এবং তত্ত্ব ও গবেষণার পদ্ধতি হিসেবে কোনো জনগোষ্ঠিকে আত্মনিষ্ঠভাবে (subjectively) অধ্যয়ন করতে সমাজবিজ্ঞানীদেরকে উৎসাহিত করেন। ফলে এর মাধ্যমে, একজন ব্যাখ্যাবাদী (interpretivist) তাঁর গবেষিত জনগোষ্ঠিকে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে পর্যবেক্ষন করেন এবং তাদের সংস্কৃতিকে তাদের মতো করেই বোঝার চেষ্টা করেন। কিংবা বলা যায়, একজন ব্যাখ্যাবাদী তাঁর গবেষিত জনগোষ্ঠির জুতা পরে তাদের সংস্কৃতিতে হাঁটার চেষ্টা করেন।

উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীতে নৃবিজ্ঞানীরা রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে যায় সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করার কাজে। যদিও এই প্রতিযোগিতা আরো অনেক আগে থেকেই চলমান ছিল, কিন্তু আধুনিক নৃতত্ত্বের আলোকে এই প্রতিযোগিতা একটি নতুন মাত্রা পায়। নৃতাত্ত্বিক ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ তখন তাঁর ব্যাখ্যামূলক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করেন। ক্লিফোর্ড জেমস গিয়ার্টজ ছিলেন একজন আমেরিকান সাংস্কৃতিক নৃতাত্ত্বিক, প্রতীকী নৃতাত্ত্বিক এবং নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রে ব্যাখ্যামূলক নৃতত্ত্বের প্রবক্তা। তিনি ওহাইয়োর এন্টিওক কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ. সম্পন্ন করেন এবং ১৯৫৬ সালে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি  নিউ জার্সির ইনস্টিটিউট ফর এডভান্সড স্টাডিতে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০০ সালে এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন। তিনি মূলত সংস্কৃতির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং সংস্কৃতির অধ্যয়নের ক্ষেত্রে প্রতীকের প্রয়োগের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত।

তিনি বলার চেষ্টা করেন যে সংস্কৃতিকে বিশ্লেণের জন্য কোন সর্বজনীন সূত্রের খোঁজে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বদলে সংস্কৃতির ব্যাখ্যামূলক অনুন্ধানের উপর গুরত্ব আরোপ করা উচিত। এই অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য হবে অন্তর্নিহিত অর্থ বের করা। তিনি বলার চেষ্টা করেন সামাজিক নৃবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি যেহেতু এথনোগ্রাফি বা সংস্কৃতি অধ্যয়ন, সেহেতু সংস্কৃতিকে বোঝা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর সংস্কৃতিকে বুঝতে গেলে সেসকল প্রতীক বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো সামাজিক আচরণকে পরিচালনা করে। তিনি আরো বলেন যে, এই প্রতীকগুলো তখনই অর্থবহ হয় যখন মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এগুলোকে ব্যাখা দেয়। তিনি সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়ন করেন এভাবে, “সংস্কৃতি হলো  ঐতিহাসিকভাবে প্রেরিত প্রতীকগুলির মূর্ত অর্থের প্যাটার্ন, সংস্কৃতি এমন একটি পদ্ধতি যা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রতীকী রূপে প্রকাশিত ধারণাগুলির মাধ্যমে মানুষদের মধ্যকার যোগাযোগকে সম্ভব করে তুলে এবং তাদের নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞান ও জীবনের প্রতি তাদের মনোভাবকে বিকশিত  করে।” (Geertz, 1973)

ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ সংস্কৃতিকে বোঝার পদ্ধতি হিসেবে একটি বহুল আলোচিত পদ ব্যবহার করেন, যার নাম ‘Thick description’. সর্বপ্রথম ‘Thick description’ এর ধারণা দেন ব্রিটিশ দার্শনিক গিলবার্ট রাইল। তিনি মূলত একটি নির্দিষ্ট আচরণকে ব্যাখ্যা করার দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য এই টার্মটি ব্যবহার করেন। তারপর ১৯৭৩ সালে গিয়ার্টজের বিখ্যাত বই ‘THE INTERPRETATION OF CULTURES’-এ Thick description এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হলো এই Thick description বলতে আসলে কি বোঝায়? আমরা জানি এথনোগ্রাফি হলো কোনো নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে অধ্যয়ন করে লিখিত এক ধরনের নথিপত্র। নৃবিজ্ঞানীরা সাধারণত গবেষণার স্বার্থে মাঠকর্মে যান এবং সেখানে তাদের গবেষিত জনগোষ্ঠীর উপর এথনোগ্রাফি প্রস্তুত করেন। সেখানে তাদের পর্যবেক্ষিত উপাত্ত (observable data) বর্ণনা করে থাকে। Thick description হলো এমন একটি লিখিত বিবরণ যেখানে একজন গবেষক মানুষের শারীরিক আচরণকেই কেবল পর্যবেক্ষণ করবেন না, তাদের সাপেক্ষে তাদের নিজস্ব অনুবৃত্তির ব্যাখামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে গবেষিত মানুষদের সামাজিক কর্মের বর্ণনা করবেন। সেই বর্ণনা এমন হতে হবে যেন একজন বহিরাগত দ্বারাও ব্যাপারগুলো বোধগম্য হয়। অর্থাৎ একটি Thick description প্রস্তুত করতে হলে কোনো সামাজিক ক্রিয়াকলাপকে শুধু নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষন করলেই চলবে না, বরং উক্ত ক্রিয়ার অন্তর্নিহিত অর্থে দৃষ্টি আরোপ করতে হবে। অর্থাৎ গবেষিত মানুষদের উক্ত কর্ম বিষয়ক জ্ঞানের সাপেক্ষে অংশগ্রহণমূলক অধ্যায়নের মধ্য দিয়ে ঐ সামাজিক ক্রিয়াকে ব্যাখা করতে হবে। গিয়ার্টজ এর মতে, Thick description পদ্ধতি অবলম্বন করে এথনোগ্রাফি প্রস্তুত করলে সামাজিক প্রতীকগুলোর সুপ্ত অন্তর্নিহিত অর্থ উদঘাটন করা সম্ভব যা প্রতীকী নৃতত্বের প্রধান লক্ষ্য।

এখন চলে যাই আমরা গিয়ার্টজ এর ব্যবহৃত একটি উদাহরণে যেখানে তিনি Thin description এবং Thick description এর মধ্যে তুলনা করেছেন।

তিনি চোখ মিটমিট করা এবং চোখ টেপা – এই দুই ধরণের (যা আপাতদৃষ্টিতে প্রায় একই) শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে Thin description এবং Thick description এর মধ্যে তুলনা করার চেষ্টা করেন। একজন গবেষক যদি এই ঘটনাকে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষন করে হুবহু বর্ণনা করে ফেলেন তাহলে সেটা হবে এক ধরণের Thin description। আর তিনি যদি চোখ মিটমিট করা এবং চোখ টেপা – এই দুই ধরণের কাজে সুপ্ত অন্তর্নিহিত ব্যাখাগুলো সামনে তুলে ধরেন তাহলে তাকে বলা যায় Thick description। যেমন, চোখ মিটমিট করা (eye twitching) কোনো ধরনের সংকেত বা বার্তা বহন করে না, এটি অনেকক্ষেত্রে একটি অনৈচ্ছিক শারীরিক ক্রিয়া। অন্যদিকে, চোখ টেপা (eye winking) একটি সংকেত বা বার্তা বহন করে, একে সাধারণত কাউকে নির্দেশ করে কোনো ধরনের যোগাযোগ করার ঐচ্ছিক প্রচেষ্টা হিসেবে ধরা যায়।

এখন কথা হলো, প্রতীকী নৃতাত্ত্বিক হিসেবে ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের এই ব্যাখ্যাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে তাকে অন্যান্য সমসাময়িক নৃবিজ্ঞানীদের থেকে আলাদা করে? প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, প্রতীকী নৃতত্ত্বের যাত্রা শুরু হয় মূলত কাঠামোবাদের (structuralism) প্রতিক্রিয়া হিসেবে। গিয়ার্টজ নিজেই তাঁর উল্লেখিত বইয়ের একটি অধ্যায়ে (The Cerebral Savage: On the Work of Claude Levi-Strauss) ক্লদ লেভি-স্ট্রসের কাঠামোবাদের বিপরীতে প্রতীকী নৃতত্ত্বের অবস্থান তুলে ধরেন। খুব সহজে বলতে গেলে, লেভি-স্ট্রস তাঁর আলোচনায় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে বোঝার ক্ষেত্রে বাইনারি অপোজিশনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। অন্যদিকে, প্রতীকী নৃতাত্ত্বিকরা সংস্কৃতির পৃথক দিকগুলোকে বোঝার ক্ষেত্রে পৃথক প্রতীকী অনুবিদ্ধ ব্যাখ্যার উপর জোর দেন। কাঠামোবাদীরা যেখানে তাদের বিশ্লেষণে ব্যক্তিসত্তার একক কর্তার (individual actor) ভূমিকা অবহেলা করেন, সেখানে প্রতীকী নৃতাত্ত্বিকরা তাদের বিশ্লেষণে “কর্তা-কেন্দ্রিক ব্যাখা” (actor-centric interpretation) -এর উপর অধিক জোর দেন। এছাড়া প্রতীকী নৃতত্ত্বকে বস্তুবাদ (materialism) এবং মার্কসবাদের (marxism) প্রতিক্রিয়া হিসেবেও ধরা যায়। বস্তুবাদীরা মূলত সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়ন করেন কিছু পর্যবেক্ষণমূলক আচরণের প্যাটার্নের সাপেক্ষে, যেখানে প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত উপাদানগুলো প্রাথমিকভাবে কার্যকারণসম্বন্ধীয়। অন্যদিকে, প্রতীকী নৃতাত্ত্বিকরা সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করেন উক্ত সংস্কৃতির প্রতীকী এবং মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণের মধ্য দিয়ে। প্রাথমিকভাবে মার্কসবাদের সাথে প্রতীকি নৃতত্ত্বের মতের অমিলের জায়গা হলো মানুষের বস্তুগত এবং অর্থনৈতিক চাহিদা নিয়ে। মার্কসবাদীরা ঐতিহাসিক নির্ধারণবাদের সাহায্যে মানুষের বস্তুগত এবং অর্থনৈতিক চাহিদাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতীকী নৃতাত্ত্বিকদের মতে এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অ-পাশ্চাত্য সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। কারন, ঐসকল সমাজের মানুষের ক্ষেত্রে তাদের বস্তুগত এবং অর্থনৈতিক চাহিদার ধারণা পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের; যার জন্য দায়ী উক্ত সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে সেসবের সামাজিক নির্মাণ।  

ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ সামজিক বাস্তবতা ব্যাখা-বিশ্লষণের ক্ষেত্রে ঐ সমাজের বিভিন্ন প্রতীকের সাহায্য নেওয়ার কথা বলেন। কারণ প্রতীকগুলো সংস্কৃতিসাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তিনি Thick description এর মাধ্যমে কোনো সামাজিক আচরণে জড়িত ব্যক্তিদের নিজস্ব আত্মনিষ্ঠ ব্যাখার সাপেক্ষে উক্ত সামাজিক আচরণকে অধ্যয়নের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর এই নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতীকী নৃতত্ত্বে এক অনন্য কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়।   

[এই লেখাটি ঢাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্র‍য়াত অধ্যাপক রাশীদ মাহমুদকে উৎসর্গ করে লেখা]

References:

1.    Geertz, C. 1973, The Interpretation of Cultures, Basic books Inc., New York.

2.    Luhrmann, T.M. 2015, International Encyclopedia of the Social & Behavioral Sciences, Second edition

3.    A visual online lecture on “Interpretive Approach: Cultural Meaning” by Dr. Raasheed Mahmood sir. 

One thought on “সামাজিক বাস্তবতা নির্মাণে প্রতীকী নৃতত্ত্বের ভূমিকা

Comments are closed.