নৃবিজ্ঞান ও কতিপয় কেন্দ্রীয় প্রত্যয়

[নৃবিজ্ঞান ও এর কিছু কেন্দ্রীয় প্রত্যয় নিয়ে লেখাটি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী খান মাহমুদ]

নৃবিজ্ঞান কী? সহজ ভাষায় বলতে গেলে ‘মানুষ’ (Humankind) এবং মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কিত অধ্যয়নই নৃবিজ্ঞান।

এনসাইক্লোপিডিয়া অব এন্থ্রোপোলজির’ সম্পাদকদ্বয় ডেভিড ই হান্টার ও ফিলিপ হুইটেনের মতে, নৃবিজ্ঞান নামক জ্ঞানশাস্ত্রটিকে মনুষ্যপ্রকৃতির একটি নিয়মতান্ত্রিক অধ্যয়ন হিসেবে দাবী করা যেতে পারে।

আমেরিকান এন্থ্রপোলজি এসোসিয়েশনের সংজ্ঞাটা অনুযায়ীঃ

মানুষ, মানুষের অতীত এবং বর্তমান নিয়ে অধ্যয়নই হচ্ছে নৃবিজ্ঞান। মানব ইতিহাসের বিবিধ জটিল সংস্কৃতি এবং সামগ্রিকভাবে মানব ইতিহাসকে মোকাবিলার জন্য নৃবিজ্ঞান সামাজিক, জৈবিক, মানবিক এবং দৈহিক- বিবিধ বিজ্ঞানের সমন্বিত পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। নানাবিধ মানব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কিভাবে অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করা যায় এটিও নৃবিজ্ঞানীদের একটি কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য। মার্কিন মুলুকের নৃবিজ্ঞানীরা ঐতিহাসিক পরম্পরা রক্ষা করে শুরু থেকেই চারটি ভিন্ন ভিন্ন নৃবৈজ্ঞানিক খাতে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেঃ সমাজসাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, জৈবিক নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব এবং ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান। প্রায়শই নৃবিজ্ঞানীরা এই সকল জ্ঞানকাণ্ডের বিবিধ গবেষণার আঙ্গিক নিজেদের গবেষণা, পাঠদান এবং পেশাদারী জীবনে ব্যবহার করে থাকেন।

কালচারাল এন্থ্রোপোলজিস্ট সেরিনা নন্দা নৃবিজ্ঞানকে মানব সমাজ ও সংস্কৃতির তুলনামূলক অধ্যয়ন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।

নৃবিজ্ঞান মানব অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সমগ্রতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Holistic approach), তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, মাঠকর্ম প্রভৃতি পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। বর্তমান ও অতীতের মানুষের, মানব সমাজের সমরূপতা ও ভিন্নতা নিয়ে কাজ করে। এক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞান বেশিরভাগক্ষেত্রেই ‘সংস্কৃতি’-কে কেন্দ্রীয় প্রত্যয় ধরে কাজ করে। মাঠকর্ম বা Fieldwork নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার মৌলিক ধরণ। অনেকে একে নৃবিজ্ঞানের Backbone বা মেরুদন্ড বলেও আখ্যা দেন। সেকেন্ডারি ডেটার পরিবর্তে (পাশাপাশি) গবেষণা ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানীরা তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন।

মাঠকর্মের সফলতা ভাষার বোঝাপড়ার উপর অনেকটাই নির্ভর করে। যে জনগোষ্ঠীর ওপর গবেষণাকর্ম সম্পাদন করা হচ্ছে, তাদের ভাষা না বুঝলে সাধারণত সঠিক তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করা জটিল হয়ে পড়ে। এজন্য গবেষণার ক্ষেত্রে ভাষার ওপর নৃবিজ্ঞানীরা গুরুত্বারোপ করে থাকেন।একথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যখন কোন ঘটনা নিয়ে আলাপ করি, তখন তা কেউ কিভাবে গ্রহণ করবে, সেটি তার ভাষাগত বোঝাপড়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। একজন হিন্দু যে অসংখ্য ঈশ্বরে ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে এবং একজন মুসলিম যে একেশ্বরবাদী ও মৃত্যু পরবর্তী স্বর্গের ধারণায় বিশ্বাস করে; উভয়ের ‘জীবন, মৃত্যু ও ভাগ্য’ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হবে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতার ব্যাপারটি কিছুটা ভাষার ওপর এসেও আলোকচ্ছটা ফেলে থাকে। তেমনি একাডেমিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট প্রত্যয়, কিছু নির্দিষ্ট ঘটনাকে একক সুগঠিত পদ্ধতি অবলম্বন করে পাঠ ও তৎপরতার দিকে উৎসাহিত করে থাকে। নৃবিজ্ঞান কী বা এ নিয়ে কোন ভূমিকা সূচক আলাপ আপাতত আমাদের চিন্তার বিষয় নয়।  বরং, এই নৃবিজ্ঞানকে ঘিরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, কনসেপ্ট বা প্রত্যয় গড়ে ওঠে। তদ্বিপরীত, এসব গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, কনসেপ্ট বা প্রত্যয়কে বাদ দিয়ে নৃবৈজ্ঞানিক বোঝাপড়া অসম্ভব, সেগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ই আমাদের আলোচ্য বিষয়।

ব্যক্তি

 “ব্যক্তি” শব্দটা আদতে সাধারণ ও স্পষ্ট মনে হতে পারে। এমনকি সকলেই সহজে “ব্যক্তি” প্রত্যয়টি বুঝতে পারে। তবে, কিছু নৃবৈজ্ঞানিক আলাপে সমাজভেদে “ব্যক্তি” প্রত্যয়ের বিভিন্ন পার্থক্য ও ধারণা উঠে এসেছে।

ভারতীয় সমাজে “ব্যক্তি”র ধারণা সমাজকেন্দ্রিক (sociocentric)। অর্থাৎ সবকিছুর কেন্দ্রে সমাজকে ধরা হয়।  ভারতীয় সমাজে বেশীরভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী যারা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। সেখানে মনে করা হয় প্রতিটি নবজাতক আসলে পুনর্জন্ম নেয়া কোন “ব্যক্তি”। “ব্যক্তি” কে একক কোন সত্তা হিসেবে ধরা হয় না। প্রতিটি “ব্যক্তি” নির্দিষ্ট ‘জাত’ (Cast), যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়- এর অংশ হিসেবে জন্ম নেয়। “ব্যক্তি”র এই জন্ম প্রক্রিয়া তার কর্ম ও ভাগ্যর উপর নির্ভর করে বলে মনে করা হয়।

অপরদিকে, পশ্চিমা সমাজে “ব্যক্তি”কে ধরা হয় স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে। “ব্যক্তি” তার জীবনে অসংখ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তার পরিণামের দায় ব্যক্তির উপর বর্তায়। মৃত্যুর সাথে সাথে “ব্যক্তি”র অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। আধুনিক পশ্চিমা সমাজের “ব্যক্তি” ধারণাকে বলা চলে ইগোসেন্ট্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক। 

আফ্রিকার গ্রামগুলোতে যেসব জায়গায় প্রথাগত ধর্মগুলো শক্তিশালী সেসব অঞ্চলে “ব্যক্তির” আরেকটি ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। “ব্যক্তি” স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সত্তা হিসেবে গণ্য হলেও পাশাপাশি পূর্বপুরুষদের আত্মার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। “ব্যক্তি” তাদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। আবার পূর্বপুরুষদের দ্বারা অন্যায়ের শাস্তি পাওয়ার ভয়ও সেখানে বর্তমান। “ব্যক্তি” মৃত্যুর সাথে সাথে পূর্বপুরুষদের আত্মার সাথে মিলিত হয় এবং তাদের অংশ হয়ে যায়। এই আত্মাদের সাথে যারা যোগাযোগ স্থাপন করার কাজ করে, যার ফলে তারা কিছু বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে বলে মনে করা হয়।

চতুর্থ উদাহরণ হিসেবে মেলানেশিয়া অঞ্চলের “ব্যক্তি” ধারণার উল্লেখ করা যায়। মেলানেশিয়ায় “ব্যক্তি” প্রত্যয়টিকে “সম্পর্কযুক্ত” হিসেবে দেখা হয়। অর্থাৎ অনান্য লোকেদের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে “ব্যক্তি” গড়ে ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেি “ব্যক্তি” কে মৃত ধরা হয় না। অনান্যদের সাথে তার সকল সম্পর্কের ইতি টানা, ঋণ পরিশোধ এবং কিছু আচার পালনের পরই কেবলমাত্র “ব্যক্তি” কে মৃত বলা হয়।

লিঙ্গ

বিষয়টি অবশ্যই আলাদা করে আলোচনার মতই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু ব্যক্তি’র ব্যক্তি হয়ে ওঠার সাথে লিঙ্গের ব্যাপারটি যেহেতু জড়িত সেহেতু ব্যক্তি আলাপের সাথেই আমরা এই আলাপটি টানছি। ব্যক্তি নিয়ে আলাপ প্রসঙ্গে অনান্য যেকোন কিছুর চেয়ে লিঙ্গ ধারণাটি বিশ্বজনীন। ভিন্নভাবে বলতে গেলে, পৃথিবীর সব মানুষকেই পুরুষ বা নারীর তালিকায় ফেলা হয়ে থাকে। লিঙ্গ ধারণাটি সার্বজনীন হলেও ব্যক্তি প্রত্যয়ের মত এটিকেও বিভিন্ন ভাবে বোঝাপড়া ও মোকাবিলা করা করা হয়।

আলাপের শুরুতে সেক্স এবং জেন্ডার এর মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন। সেক্স শরীরের গঠন, যৌনাঙ্গের আকার ও প্রকৃতি ইত্যাদি নির্দেশ করে। অপরদিকে জেন্ডার মূলত নারী-পুরুষ ধারণার সামাজিক নির্মাণ ও বিনির্মাণ। 

উৎপাদন ক্ষেত্র বা ব্যক্তিগত পরিসর উভয় জায়গাতেই নারী-পুরুষের শ্রমবিভাজন ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। অবশ্য বিগত ৫০ বছরে বিভিন্ন সমাজে লিঙ্গ সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ১৯৫০-এর দিকেও ইউরোপের বেশীরভাগ নারী ছিলেন গৃহিণী। বর্তমানে সিংহভাগ চাকুরিজীবী। 

অনেক নৃবিজ্ঞানী, বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানীরা, ক্ষমতায় লিঙ্গ সম্পর্কের ভূমিকা অধ্যয়নে আগ্রহী। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পুরুষের আধিপত্য দেখা যায়। নারীদের সাধারণত অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। সমাজের সবদিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া এবং নারীরা কিভাবে এই অবস্থা লাভ করছে তা জানা ছাড়া নারীরা নিপীড়িত বলে সিদ্ধান্ত নৃবিজ্ঞানীরা দিতে পারেন না। অনেক পশ্চিম এশিয়ান, মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের তুলনায় পশ্চিমা ‘স্বাধীন’ নারীরা নিজেদের বেশি নিপীড়িত মনে করেন,  কারণ পশ্চিমা নারীরা তাদের ক্যারিয়ার, আবেদনময়ী হওয়ার জন্য এশিয় বা মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের থেকে অধিক ব্যস্ত থাকেন। নৃবিজ্ঞানীরা এসব দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে কোন সরলীকৃত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। 

এরূপ পরিবর্তনশীল সমাজ অধ্যয়নের সময় নৃবিজ্ঞানীরা মূল্যবোধের সংঘাত এবং ভিন্ন প্রজন্মের মধ্যকার বিভিন্ন বিষয়ে বাকবিতন্ডা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। সাধারণত, লিঙ্গ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এসব ফ্যাসাদ প্রকাশ পায়। বর্তমানে উপার্জনক্ষম অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী কোন মেয়ে আধুনিক ব্যক্তি প্রত্যয় ধারণ করে ব্যক্তিগত অধিকার দাবী করতে পারে; সেখানে তার মা যিনি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন তিনি সমাজকেন্দ্রীক ব্যক্তি প্রত্যয় ধারণ করে তার প্রথা বা ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য পোষণ করবেন সেটিকেই “স্বাভাবিক” বলে মনে হয়। 

সমাজ 

প্রায় প্রতিদিনই আমরা সমাজ শব্দটি ব্যবহার করি। সাধারণত প্রতিদিনের ব্যবহারে (যেমন বাংলাদেশী সমাজ, ভারতীয় সমাজ) সমাজ শব্দটি রাষ্ট্রের সমার্থক মনে হলেও আদতে এটি তা নয়। কারণ, প্রথমত, রাষ্ট্রের ভিতরে অনেকগুলো জনগোষ্ঠী বাস করে যারা নিজস্ব আচার ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অনুসরণ করে। দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রে অনেকগুলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীও থাকতে পারে যাদের সংস্কৃতি এমনকি ভাষাও আলাদা থাকতে পারে৷ আবার অনেক সমাজ রাষ্ট্রের সাথে একাত্মতা পোষণ নাও করতে পারে। 

সমাজের একটু সহজ সংজ্ঞায়ন করলে বলা যায় যারা একত্রে বসবাস করে, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করে এবং নিজেরা একই নৈতিক মূল্যবোধ ধারণ বলে মনে করে তাদের নিয়েই সমাজ গড়ে ওঠে। অবশ্য এই সংজ্ঞানুসারে সমাজকে ক্ষুদ্র একক মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি সমাজই রাষ্ট্র বা বৃহৎ সিস্টেমের অংশ। বর্হিবাণিজ্য, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের শাসনে সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব বিবেচনা করতে গেলে সমাজের কোন সীমানা নির্ধারণ সম্ভব না, বড়জোর সংজ্ঞায়ন করা যেতে পারে। 

উনিশ শতকের মধ্যভাগের পর অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী সমাজকে, বৃহৎ সমাজ এবং ক্ষুদ্র সমাজ বা নিজ সমাজ এবং অপর সমাজ, দুইভাগে ভাগ করেন। হেনরি মেইন ( Henry Maine) নামক এক আইনজীবী ১৮৬১ সালে “Primitive Society” সম্পর্কিত লেখায় Status Society এবং Contract Society- এই দুই নামে সমাজকে ভাগ করেছেন। তার মতে স্ট্যাটাস সোসাইটি বা স্তরকেন্দ্রিক সমাজে প্রতিটি ব্যক্তির সম্পর্ক পূর্ব নির্ধারিত থাকে; যা তার জন্ম, পরিবারের সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। যেমন হিন্দু সমাজে ব্যক্তি কোন না কোন কাস্ট/জাতের অংশ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে এবং জীবদ্দশায় সে এটি অতিক্রম করতে পারে না। আর চুক্তিবদ্ধ সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা, ব্যক্তিগত অর্জন ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠে। সেখানে জন্ম বা পরিবারের অবস্থানের কোন ভূমিকা থাকে না। হেনরি মেইনের মতে স্তরকেন্দ্রিক সমাজের তুলনায় চুক্তিবদ্ধ সমাজ অধিক জটিল।

সমসাময়িক অনান্য তাত্ত্বিকরাও ক্ষুদ্র সমাজ, সরল সমাজ ও প্রথাগত সমাজ এবং বৃহৎ সমাজ, জটিল সমাজ ও আধুনিক সমাজের পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। এরমধ্যে প্রভাবশালী ছিল ফার্ডিনান্ড টনির করা Gemeinschaft বা কমিউনিটি এবং Gesellschaft বা সোসাইটি- এই দুটি বিভাগ। Gemeinschaft আদতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী যারা একইরকম মূল্যবোধ ধারণ করে, প্রথাগত নীতি বোধ এবং ব্যক্তিগত বন্ধনের উপর নির্ভর করে। অপরদিকে Gesellschaft আধুনিক বৃহৎ সমাজ যেখানে রাষ্ট্র এবং অনান্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবার ও প্রতিবেশীর জায়গাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। 

সমাজ কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে দেখা যাচ্ছে, মেইন বা টনি বা তাত্ত্বিকদের মতানুসারে, আগে সমাজের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ এবং সরল ও জটিল সমাজ যা জ্ঞাতি সম্পর্ক ও পারস্পরিক বিনিময়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, সেটি চিহ্নিত করা দরকার। বিশ শতকের মধ্যভাগের পর কাজ করা অনেক নৃবিজ্ঞানীই এই বিভাজনের ধারণাকে কোন রকম প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিয়ে কাজ করেছিলেন। অবশ্য, নৃবিজ্ঞানীদের কাজ করা বেশীরভাগ সমাজ টনির দেয়া Gemeinschaft বা Local community- এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার অনেকেই এই বিভক্তিকরণের সমস্যাও চিহ্নিত করেছিলেন। যেমন ভারতীয় সমাজ একই সাথে Gemeinschaft (গেমাইনশ্যাফ্‌ট) এবং বহুলাংশে Gesellschaft (গেজেলশ্যাফ্‌ট) এর অংশ। অন্যদিকে প্রথাগত আফ্রিকান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই নমনীয়। সাধারণত সমাজ, গ্রামের মানুষের জীবন ঘিরে থাকলেও বাণিজ্য ও রাজনৈতিক কারণে তা বৃহত্তর সিস্টেম বা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে হাজির হয়।

বর্তমান পৃথিবী অনেক বেশী জটিল। ফলে সমাজের ধরণেও ব্যাপক জটিলতা রয়েছে। এই কারণে বিভক্তির ধারণা নৃবিজ্ঞানে দীর্ঘদিন দিন থেকেই পরিত্যাগ করা হয়েছে। সাধারণত, সমাজ নিয়ে কাজ করা নৃবিজ্ঞানীরা সমাজ অধ্যয়নের চেয়ে সামাজিক জীবন নিয়ে অধ্যয়নেই অধিক নিবেশিত বলে দাবী করা হয়ে থাকে।

আবার একই সময়ে সমাজের সীমানা নির্ধারণ করাও জরুরী। সীমা নির্ধারণের সবচেয়ে প্রচলিত মানদন্ড হলো রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। এই মতাদর্শ অনুসারে একই রাজনৈতিক ভাবাদর্শের লোকেদের মিলে সমাজ গড়ে ওঠে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে একই সমাজে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী বসবাস করতেও দেখা যায়। 

মানুষ যেহেতু বিভিন্ন ( ক্ষুদ্র বা বৃহৎ) সমাজ ব্যবস্থাতেই বসবাস করে এবং বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করে তাই সমাজ প্রত্যয়টি ব্যাখ্যা করা জটিল। একারণে নৃবিজ্ঞানীরা গবেষিত সমাজের বর্ণনা লেখার সময় তারা তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে সমাজ চিহ্নিত করে নেন। 

সংস্কৃতি 

নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় সংস্কৃতি। ব্যক্তি আর সমাজ ধারণার মতই সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার অনেকের মতে নৃবিজ্ঞানের সবচে জটিল প্রত্যয়ই হচ্ছে এটি। ১৯৫২ সালে আলফ্রেড ক্রোয়েবার ও ক্লাইড ক্লুকন ‘Culture: A Critical Review of Concept and Definitions’ বইয়ে সংস্কৃতির ১৬২ টি সংজ্ঞা লিপিবদ্ধ করেন। এরমধ্যে কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও তারা এমন একটি সংজ্ঞাও খুঁজে পাননি যার সাথে বেশীরভাগ নৃবিজ্ঞানী একমত হবেন।

সংস্কৃতির সবচেয়ে পুরনো এবং বিখ্যাত সংজ্ঞাটি দিয়েছেন ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী ই বি টাইলর। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত “Culture” বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, “সংস্কৃতি মূলত বিশ্বাস, শিল্প, জ্ঞান, আইন, নৈতিকতা, প্রথা এবং বিভিন্ন অভ্যাসের যৌগিক সমন্বয় যা সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ পালন করে।” টাইলর প্রায় প্রতিটি সম্ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংজ্ঞায়ন করার চেষ্টা করেছেন। তাই, বেশীরভাগ নৃবিজ্ঞানী এটিকে সংস্কৃতির সংজ্ঞা হিসেবে ধরে নেন। পরবর্তী সময়ে কাজ করা নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়ন করার চেষ্টা খুব বেশি বিস্তৃত হয় নি। ১৯৬০-এর দিকে নৃবিজ্ঞানের অন্যতম তাত্ত্বিক সংস্কৃতিকে দেখেছেন প্রতীকি হিসাবে।তবে, সংস্কৃতির বিনিময় বলতে প্রত্যেকেই একই জিনিস গ্রহণ করে তা গিয়ার্টজ বুঝাননি। 

নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় সংস্কৃতি। ব্যক্তি তার সমাজের অন্যান্য মানুষ থেকে  সংস্কৃতি  শিখে থাকে। যে কারণে সংস্কৃতিকে বলা হয় শিখনফল বা Learned। শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে তার সাংস্কৃতিক অভিযোজন শুরু হয়। প্রাণীরা সাধারণত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ করে৷ যেমন কোন প্রাণী আগুনে পুড়লেই পরবর্তী সময় থেকে তা এড়িয়ে চলে। কিন্তু মানুষ তা তার সমাজের লোক থেকে শিক্ষা লাভ করেই আগুন এড়িয়ে চলে। মানুষের নিকটতম জৈবিক স্বজাতি বানর এবং Ape দের মধ্যেও গ্রুপের অনান্য সদস্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করতে দেখা যায়। 

নৃবিজ্ঞানী লেসলি হোয়াইট সংস্কৃতিকে দেখেছেন প্রতীকায়ন নির্ভর ব্যবস্থা  হিসেবে। তার মতে, “সংস্কৃতি ভাষা, শিল্প,  বিশ্বাস, আচার, প্রথা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পোশাক, গহনা, তৈজসপত্র, সরঞ্জাম প্রভৃতির সমন্বয়।” হোয়াইট মনে করেন আমাদের পূর্ব পুরুষরা যখন প্রতীক ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করেন তখনই সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। প্রকৃতপক্ষে, ভাষার উদ্ভবই সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন সরঞ্জামের ব্যবহার বিনিময়ের মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া ঘটে। 

এদিক থেকে বলা যায় সংস্কৃতি বিনিময় নির্ভর। আমরা পর্যবেক্ষণ, কথা বলা ও শুনা এবং ভাব বিনিময়ের মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক পাঠ লাভ করি। একই বিশ্বাস, মূল্যবোধ, স্মৃতি ধারণ করার মধ্য দিয়ে গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়। 

সংস্কৃতি এবং প্রকৃতি:- যেসব প্রাকৃতিক জৈবিক চাহিদা আমরা অনান্য প্রাণীদের সাথে বিনিময় বা গ্রহণ করি তা কীভাবে প্রকাশ করবো সেটি আমরা সংস্কৃতি থেকে শিক্ষা লাভ করি। মানুষকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, যৌন চাহিদা মিটাতে ও বংশধারা টিকিয়ে রাখতে যৌন সঙ্গম করতে হয় কিন্তু এগুলো কখন, কিভাবে করতে হবে তা মানুষ সংস্কৃতি থেকেই শিখে থাকে। সংস্কৃতি বিভিন্ন ভাবে “মানব প্রকৃতি” নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করে। মানুষকে স্বাভাবিক ভাবেই প্রাকৃতিক কর্ম সাধন করতে হয়। কিন্তু এর পদ্ধতি কী হবে তা আদতে সংস্কৃতির মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়ে থাকে।

সমগ্রতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Holistic approach)

 নৃবিজ্ঞানে সমগ্রতাবাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয় একটি ঘটনা কীভাবে অনান্য ঘটনা ও সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সম্পর্কিত তা বুঝাতে। কোন একক ঘটনা কিভাবে অনান্য ঘটনার সাথে সংযুক্ত এবং কিভাবে বিভিন্ন সত্ত্বার সাথে জড়িত হয় ও প্রভাবিত করে তা পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গিই হলিস্টিক এপ্রোচ বা সমগ্রতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। লেখার শুরুর দিকেই বলেছিলাম গবেষকের অবজেক্টিভ নির্ধারণের উপর তার উপাত্ত প্রাপ্তির একটি যোগ রয়েছে। সমাজ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ধরে কাজ করলে একধরনের উপাত্ত ও সমস্যা পাওয়া যাবে। আবার জ্ঞাতিসম্পর্ক ধরে অধ্যয়ন করলে আরেক ধরণের উপাত্ত ও সমস্যা সামনে আসবে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নৃবিজ্ঞানীরা সমগ্রতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন এবং সমাজকে সামগ্রিকভাবে অধ্যয়নের চেষ্টা করে থাকেন। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানের বৈচিত্র্য এবং গবেষণার পদ্ধতিগত স্বকীয়তা নৃবিজ্ঞাকে অনান্য জ্ঞানকান্ড থেকে আলাদা করেছে। সময়ের সাথে নৃবিজ্ঞান নিজেদের পুরনো ভুল পদক্ষেপ থেকে সরে এসেছে। আগের তুলনায় গবেষণার ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানীরা এখন নৈতিকতা নিয়েও অনেক বেশি  সচেতন। 

বর্তমান আলোচনাকে দীর্ঘায়ু করার নিয়ত নেই আর। ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি ও সমগ্রতাবাদ- এই চারটি প্রত্যয় নৃবৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে চতুর্স্তম্ভ স্বরূপ। নৃবিজ্ঞানের ভূমিকারূপী বিবিধ আলোচনা ইতোমধ্যেই হয়েছে, কাজেই নৃবৈজ্ঞানিক বোঝাপড়াকে আরেকটু পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে এবারের মত কেবল এই চারটি স্তম্ভ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপই জরুরী হয়ে ওঠে।

রেফারেন্স

What is Anthropology, Thomas Hylland Eriksen

Cultural Anthropology, Serena Nanda.

Investigating Culture: An Experimental Introduction to Anthropology, Carol Delaney

নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়- মাহফুজ সরকার, শাহারিয়ার জিম

One thought on “নৃবিজ্ঞান ও কতিপয় কেন্দ্রীয় প্রত্যয়

Comments are closed.