জেমস ফ্রেজার ও তার তত্ত্ব

[জেমস ফ্রেজার ও তার তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিয়ে লেখেছেন খান মাহমুদ]

জেমস ফ্রেজার ১৮৫৪ সালের ১ লা জানুয়ারি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি এবং লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজে অধ্যয়ন করেছিলেন। ফ্রেজার মূলত তার মিথ, যাদুবিদ্যা এবং ধর্ম সংক্রান্ত কাজের জন্য পরিচিত। ১৯১৪ সালের ৭ মে স্যার জেমস ফ্রেজার মৃত্যুবরণ করেন। 

ই বি টাইলরের “Primitive Culture” পড়ার পর ফ্রেজার সামাজিক নৃবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তার কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল মিথ, যাদুবিদ্যা ও ধর্ম। তিনি নিজে কখনো মাঠকর্ম করেন নাই, তার বেশিরভাগ কাজ তিনি করেছিলেন মূলত প্রাচীন ইতিহাসের বই ঘেটে ও মিশনারির সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের উপর ভিত্তি করে। এসবের উপর ভিত্তি করেই তিনি “দ্য গোল্ডেন বাউ” বইটি লিখেন, যেটি ছিল সেই সময়ের নৃবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযুক্তি। ১২ খণ্ডে প্রকাশিত হলেও পরে ১ খণ্ডের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। 

‘গোল্ডেন বাউ’ বইটির প্রথম খন্ডের প্রচ্ছদ।

টাইলর দ্বারা প্রভাবিত ফ্রেজারও ছিলেন তার মতই বিবর্তনবাদী। তিনি তুলনামূলক পদ্ধতি ও বিবর্তনের ফ্রেমওয়ার্ক অনুসরন করে ধর্মের বিবর্তন নিয়ে কাজ করেছেন। ফ্রেজার মনে করতেন ক্রমবিবর্তনের ধারায় মানুষ যাদু থেকে ধর্ম ও ধর্ম থেকে বিজ্ঞানে পদার্পণ করেছে। অর্থাৎ, তিনি একপ্রকার মানসিক প্রগতির দিক নির্দেশ করছেন যা সেই সময়কার বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।  বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিক টাইলর অতীত সংস্কৃতির পুনর্নিমাণে আগ্রহী ছিলেন। তার বিখ্যাত প্রিমিটিভ কালচার বইতে ধর্মের উদ্ভব বিষয়ক আলাপ ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও একরৈখিক। যার ছাপ ফ্রেজারের কাজেও দেখা যায়। 

ফ্রেজার যাদুকে দেখেছেন ভ্রান্ত বিজ্ঞান হিসেবে, যার মাধ্যমে প্রাচীন মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতো। যেহেতু তারা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতো না, সেহেতু আদিম মানুষ যেসব জিনিস ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হত বা বুঝতে পারতো না সেসব বিষয় তারা যাদুর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করত। তারা এর মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনা, চিকিৎসা ও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাতো। ফ্রেজার দুই ধরণের যাদুবিদ্যার কথা বলেছেন। একটি হলো অনুকরণমূলক বা মিমেটিক এবং অপরটি সংক্রামক বা কন্টেজিয়াস। 

অনুকরণমূলক যাদু অনেকটা সাদৃশ্যের নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হতো। এক্ষেত্রে মনে করা হতো যে কাজটি বা যে ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোন প্রতিকৃতি বানিয়ে এর উপর জাদু প্রয়োগ করা যায়। আবার কখনো কখনো কোন প্রতীকি আচরণেরও আয়োজন করা হতো।  এইসব জাদুর ক্ষেত্রে দেখা যেত কোন শত্রুর ক্ষতি করার জন্য তার কোন প্রতিকৃতি বানিয়ে তাঁকে আঘাত করা হচ্ছে। অর্থাৎ, কেউ শত্রুর ক্ষতি সাধণ করতে চাইলে তার একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে তার ক্ষতি করলে শত্রুর ক্ষতিসাধণ হবে বলে বিশ্বাস করা হতো। যেমন, অনেক সমাজে এমন বিশ্বাস ছিল যে কেউ শত্রুর পুতুল তৈরি করে তার চোখ গেলে দিলে শত্রুর চোখ কানা হয়ে যাবে।

অন্যদিকে ফ্রেজারের মতে কন্টেজিয়াস বা সংক্রামক যাদুর ভিত্তি ছিল যোগাযোগের নীতি। প্রাচীন মানুষেরা মনে করতো যে জিনিসের সাথে একবার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে পরবর্তীতে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক থাকে। আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এরা আসলে সংযুক্ত। এই নীতির মাধ্যমে কারো চুল, নখ বা ব্যবহৃত কোন বস্ত্র বা বস্তু দিয়ে তার উপর যাদু করা সম্ভব। যদি ক্ষতি করতে চায় তাহলে এইসব জিনিস পোড়ালে বা ধ্বংস করলে তার ফল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভোগ করবে। সংযোগের নীতির জন্য ফ্রেজার এটিকে কন্টেজিয়াস বা সংক্রামক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 

 ফ্রেজার দেখিয়েছিলেন যাদু কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা না, পাশাপাশি পুরো গোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে ভূমিকা রাখতো। ফলে, যাদুকররা সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে উঠতেন। সমাজেও তাদের বিশেষ প্রভাব ছিল। 

যাদু থেকে ক্রমবিবর্তনের ধারায় ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে বলে মনে করতেন ফ্রেজার। তার কাছে ধর্ম হচ্ছে মানুষের ক্ষমতার বাহিরে এমন সর্বাত্মক শক্তি যা প্রকৃতি ও মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যাদুর ক্ষেত্রে যেখানে মনে করা হয় প্রকৃতির ঘটনাগুলো অনমনীয় এবং ঘটনা সমূহের মাঝে পরম্পরা রয়েছে; সেখানে ধর্মের ক্ষেত্রে মনে করা হয় বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে একটি পরাক্রমশালী শক্তি এবং পূজা অর্চনা করার মাধ্যমে এই শক্তিকে নমনীয় করা যায়। ফ্রেজার যাদু ও ধর্মের ব্যখ্যা দিলেও যাদু বিশ্বাস থেকে ধর্মের উদ্ভব সম্পর্কে অনুমানের উপর ভিত্তি করে কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন যখন মানুষ বুঝতে পারল প্রকৃতির সবকিছু মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন সংশয় থেকে মানুষ ভাবতো সার্বভৌম  কোন স্বত্তার কথা যে সব নিয়ন্ত্রণ করে। সময়ের সাথে সাথে অতিপ্রাকৃত শক্তির এই ধারণা ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর আসে বিজ্ঞানের যুগ। ফ্রেজারের কাছে বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যা করার যোগ্য পদ্ধতি। 

নৃবিজ্ঞানী টাইলর তার ধর্মের উদ্ভব সংক্রান্ত আলাপ দিয়েছিলেন অনেকটা বুদ্ধিগত (কগ্নিটিভ) জায়গা থেকে। ফ্রেজারও একই কোণ থেকে তার আলাপ দিয়েছেন। তারা উভয়েই মনে করতেন যাদু কিংবা ধর্মের উদ্ভব হয়েছে প্রকৃতিকে বুঝার চেষ্টা থেকে। প্রারম্ভিক মানুষরা প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জাদুবিশ্বাসাসের উদ্ভব হয়েছে। তাছাড়া, টাইলর ও ফ্রেজারের মতানুযায়ী বিজ্ঞান প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর সফল ব্যাখ্যাদান করতে পারার ফলে যাদু ও ধর্মের প্রভাব ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখি ধর্ম এখনো সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রতীকিভাবে টিকে আছে। উক্ত দুই তাত্ত্বিকই ধর্মের সামাজিক ও অন্যান্য দিকগুলো ব্যাখ্যা করতে পারেন নাই।