লেভিস্ত্রসের চিন্তা ও পুরাণের কাঠামোগঠন

[আজকে ২৮ নভেম্বর, ক্লদ লেভিস্ট্রসের জন্মদিন। এই উপলক্ষ্যে লেভিস্ত্রসের পুরাণ ও কাঠামোবাদ সম্পর্কে সাদিয়া শান্তার লেখাটি প্রকাশিত হল]

ক্লদ লেভিস্ত্রস নৃবিজ্ঞান মহলে এক অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। নৃবিজ্ঞানে ভাষাতত্ত্ব ও কাঠামোবাদ তত্ত্বের সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৮ সালের ২৮শে নভেম্বর, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। শখের বসে লেভিস্ত্রস সংগীত চর্চা করতেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি আইন ও দর্শন শাখায় দীক্ষা নেন। শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের তাড়নায় ফ্রান্স, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে অবশেষে তিনি প্যারিসে গিয়ে থিতু হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। লেভিস্ত্রস ‘ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস’ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ফরাসি বুদ্ধিজীবি মহলে নিজের জায়গা সুপ্রতিষ্ঠিত করে নেন। তার আলোচিত কিছু বইয়ের নাম ‘Tristes Tropiques’, ‘The Savage Mind’, ‘Myth and Meaning’, ‘The Elementary Structures of Kinship’, ‘The Raw and The Cooked’ ইত্যাদি। লেভিস্ত্রস জ্ঞাতিসম্পর্ক ও পুরাণকে আশ্রয় করে নৃবিজ্ঞানে সফলভাবে কাঠামোবাদ (Structuralism) তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। শতবর্ষ জীবন অতিবাহিত করার পর ২০০৯ সালের ৩০শে অক্টোবর এই মহীয়ান নৃতাত্ত্বিক প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।

নৃবিজ্ঞানে লেভিস্ত্রসের সবচেয়ে বড় অবদান তার কাঠামোবাদ তত্ত্ব। ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুর ছিলেন কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্বের প্রবক্তা। পরবর্তীতে লেভিস্ত্রস এই কাঠামোবাদকে জ্ঞাতিসম্পর্ক (Kinship) ও পুরাণ (Mythology) বিশ্লেষণে সফলভাবে প্রয়োগ করে দেখান। পুরাণে কাঠামোবাদ প্রয়োগ করতে গিয়ে লেভিস্ত্রস কাহিনীর বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ করেননি, বরং কাহিনীর উপাদানগুলোর মধ্যকার সম্পর্ককে ভিত্তি করে পুরাণের কাঠামোগত বিশ্লেষণ করেছেন। লেভিস্ত্রস তার ‘Mythologiques’ বইয়ে ৮১৩টি আমেরিকান ইন্ডিয়ান পুরাণের কাঠামোগত বর্ণনা করেছেন। সেসব বর্ণনার ভাবগত বিশ্লেষণ করেছেন তার ‘Myth and Meaning’ বইয়ে। অনুবাদজনিত সমস্যার কারণে লেভিস্ত্রস ফরাসি ভাষায় যেসব বই লিখেছেন সেগুলোর ইংরেজী অনুবাদ অনেকটা দুর্বোধ্য ঠেকলেও, ১৯৭৮ সালে ইংরেজী ভাষায় তার রেডিও বক্তৃতার সংকলনে ‘Myth and Meaning’ বইটি সাধারণ পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যার ফলে পুরাণের কাঠামোগত বিশ্লেষণে এই বইটির দ্বারস্থ হওয়া সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক।

কাঠামোবাদের মূল আলাপ হলো মানুষের সংস্কৃতি মানুষের মনের গড়ন বা নির্দিষ্ট এক রীতি দিয়ে বিন্যস্ত। কাঠামোবাদীরা মানুষের কাজ, আদর্শ, বা মূল্যবোধের চেয়ে বরং মনের অবচেতন অংশের ভাবনার উপর বেশি জোর দেন। কাঠামোবাদীরা বলেন, মানুষ তার অবচেতন মনে যেকোন চিন্তার দ্বৈত-বিপরীত (Binary opposition) বিন্যাস করে থাকে। লেভিস্ত্রসের মতে, সকল মানুষের মনের গড়নে রয়েছে একই ধরনের ‘সাইকিক ইউনিটি’ (Psychic unity), অর্থাৎ ‘মানসিক সামঞ্জস্যতা’। তিনি বলেন, ”আদিম মানব সমাজ” বলে যারা চিহ্নিত, তাদের মানসিক গঠন আধুনিক “সভ্য” সমাজের মানুষের তুলনায় অধিক শৃঙখল কিংবা বিশৃঙখল নয়। বরং সকল মানুষের চিন্তার আদলেই রয়েছে একই ধরনের বিন্যাস রীতি। যেমন- মানুষের ভাবনার এক সার্বজনীন রীতি হলো দ্বৈত বিপরীত বিন্যাসে কোন কিছু ভাববার ক্ষমতা ও প্রবণতা। অর্থাৎ মানুষের মন যেকোন বিষয়কে তার বিপরীত বিষয়টির মানদন্ডে রেখে ভেবে থাকে। যেমন- নারী-পুরুষ, ভালো-মন্দ, সাদা-কালো, বাম-ডান, রাত-দিন, প্রকৃতি-সংস্কৃতি ইত্যাদি। টোটেমিজমের (গাছ, প্রাণী, মূর্তি পূজার চর্চা) ক্ষেত্রে এই বাইনারি অপোজিশনকে লেভিস্ত্রস ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে টোটেমিক চর্চার মাধ্যমে মানুষ সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। এছাড়াও বিভিন্ন সংস্কৃতির পুরাণ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, কোন পুরাণ সেই নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মানুষের চিন্তার আদলে তৈরী। তাহলে কি পুরাণের বিশ্লেষণেই সংস্কৃতিতে মানুষের চিন্তার গড়ন বোঝা সম্ভব? বিজ্ঞানের এই যুগে এসে কি আবার আমাদের পুরাণের আশ্রয় নিতে হবে?

এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ১৯৭৮ সালে ক্লদ লেভিস্ত্রস বিজ্ঞান নির্ভর মানুষের চিন্তা ও পুরাণ আশ্রিত মানুষের চিন্তাকে সমান্তরালে রেখে একটি বই প্রকাশ করেন, যার নাম ‘Myth and Meaning’। এই বইয়ে তিনি দেখান আধুনিক মানুষের বিজ্ঞান ও প্রাচীন মানুষের পুরাণ মূলত চিন্তার একই কাঠামোতে বিন্যস্ত।

‘Myth and Meaning’ বইটির আলাপে ঢোকার আগে আমরা জেনে নিই মিথোলজি বা পুরাণ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি। ছোটকাল থেকে আমরা দাদী-নানীর মুখে রূপকথার গল্প শুনে এসেছি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এভাবে মুখে মুখে গল্প আওড়ানোর ধারাবাহিকতায় ও নানান সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে ঠাকুমাদের ঝুলি বোঝাই করা হচ্ছে। এসবই আমাদের সংস্কৃতির পুরাণ। আবার, কমিক সিরিজ বা বিদেশী সিনেমার মাধ্যমে আমাদের পরিচয় ঘটে বিদেশি মিথোলজির সাথে। যেমন- গ্রীক মিথোলজিতে পরিচয় হয় দেবরাজ জিউস, যুদ্ধের দেবতা এরিস কিংবা প্রেম ও কামনার দেবী আফ্রোদিতির সাথে; নর্ডিক মিথোলজিতে পরিচয় হয় আদিপিতা ওডিন, উর্বরতার দেবী ফ্রেয়া এবং ওডিনের দুই ছেলে থর ও লোকির সাথে; মিশরীয় মিথোলজিতে পরিচয় হয় সৌন্দর্যের দেবী আইরিসের সাথে; ভারতীয় মিথোলজিতে পরিচয় হয় নীলগাত্র শ্রীকৃষ্ণ, দ্রৌপদী ও পঞ্চ পান্ডব, উপদেবতা কর্ণ, রাম-সীতা-লক্ষ্মণ-রাবণ, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর এবং আরো অনেক পৌরাণিক চরিত্রের সাথে। বিজ্ঞানের এই সময়ে এসে আমরা যদিও বলে থাকি এসবই প্রাচীন মানব সমাজের কল্পনা আশ্রিত অতিরিঞ্জিত রপকথা কেবল, লেভিস্ত্রস কিন্তু বলেন অন্য কথা। তার মতে এই সকল পুরাণের কাঠামোতে রয়েছে এক অন্তর্নিহিত যোগসাজশ, বিজ্ঞানভিত্তিক কাঠামোবাদ দিয়ে যার বিশ্লেষণ সম্ভব।

‘মিথ এন্ড মিনিং’ বইটির প্রচ্ছদ

সতেরো এবং আঠারো শতকের আগে মানুষের কল্পনা ও চিন্তা ভাবনা ছিল পুরাণ আশ্রিত। তবে রেঁনেসা পরবর্তীকালে মানুষ পুরাণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিজ্ঞান নির্ভর হয়ে পড়ে। বেকন, দেকার্তে ও নিউটনের সময়ে মনে করা হতো, পৌরাণিক ঘটনা বা প্রাচীনকালের চিন্তাধারা (Primitive Thought) থেকে ঘুরে তাকালেই কেবল বিজ্ঞানকে দাঁড় করানো সম্ভব। মনে করা হতো, প্রাচীনকালের রহস্যঘেরা “অতিরঞ্জিত” পৌরাণিক ঘটনাগুলি বর্জন করেই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্ত লেভিস্ত্রস মনে করেন চিন্তার যে বিন্যাসে মানুষ সেসব পুরাণ সাজাতো, বর্তমানেও সেই একই কাঠামোতে, একই বিন্যাসে বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থাৎ, বিজ্ঞান পুরাণ থেকে খুব বেশি দূর সরে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লেভি-স্ট্রসের মতে, বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রাচীনকালের সেসব “অতিরঞ্জিত” পুরাণের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।

পুরাণের বিশ্লেষণে আমরা অনেক অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক, এলোপাথাড়ি ও খামখেয়ালি বিষয় দেখতে পাই। এগুলোকে একটা বড় ঘটনার আওতায় বিশৃঙ্খল কিছু ছোট ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু লেভিস্ত্রস মনে করেন, প্রতিটি ডিজঅর্ডারের পেছনে অর্ডার রয়েছে। অর্ডার এবং ডিজঅর্ডার চক্রাকারে চলতে থাকে। সহজ করে বললে, পুরাণ কিংবা পুরাণের বিভিন্ন ঘটনাকে আপাতদৃষ্টিতে যতোটা এলোপাথাড়ি ও অদ্ভূত মনে হয় আসলে তা নয়; পুরাণটি যে সংস্কৃতিতে গড়ে উঠেছে, সামকগ্রিকভাবে দেখলে বোঝা যাবে এটি সেই সংস্কৃতির সামগ্রিক চিন্তারই এক বিন্যাস রীতি। পুরাণের কোন ঘটনা যদি অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক, এলোপাথাড়ি হতো তাহলে নির্দিষ্ট বিন্যাস মেনে তার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। কিন্তু কাঠামোবাদের ছকে ফেলে নিরীক্ষণ করলে আমরা তার পুনরাবৃত্তি ও আন্তঃসম্পর্ক দেখতে পাই। যেমন- পুরাণ মূলত নানান মানুষের চিন্তার নানান রকম কল্পনাপ্রসূত সৃষ্টি, যাকে লেভিস্ত্রস বলেছেন ‘Fanciful Creation’। আপাতদৃষ্টিতে এই কল্পনাপ্রসূত সৃষ্টিগুলোকে নিছক খেয়ালী (Arbitrary) বলে মনে হয়। কিন্তু এই ডিজঅর্ডার মেনে খেয়ালি প্রক্রিয়ায় যখন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পুরাণ কিংবা পৌরাণিক চরিত্র গড়ে উঠে, সেগুলোর মাঝে কোন অর্ডার আছে কিনা তাই খুঁজে দেখতে চেয়েছেন লেভিস্ত্রস।

পৌরাণিক সময়ের যেসব ইতিহাস রচিত হয়েছে সেগুলো আজ পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হয়ে এসেছে। সেসবের কোন লিখিত দলিল ছিল না। লেভিস্ত্রসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী পুরাণকে (Mythology) বলা হয়েছে ‘Close System’ আর ইতিহাসকে (History) বলা হয়েছে ‘Open System’। তিনি মনে করেন, ইতিহাস পর্যালোচনা মূলত অনুক্রমিক (Diachronic) এবং পুরাণের পর্যালোচনা সমক্রমিক (Synchronic)। এখানে পুরাণের উপাদান অপরিবর্তিত থাকে; কেবল ইতিহাস রচনায় ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে তার পরিবর্তন ঘটে। ঐতিহাসিকরা কোন নির্দিষ্ট ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পুরাণকে সেই একই উপাদান দিয়ে বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে নেয়। যার কারণে প্রশ্ন থেকেই যায়, বৈজ্ঞানিকভাবে ইতিহাসের কোন অধ্যায় নিয়ে কাজ করার সময় আমরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে ইতিহাস রচনা করি নাকি পুরাণ আশ্রিত ইতিহাস রচনা করি। 

লেভিস্ত্রস তার কাঠামোবাদ তত্ত্বের সাহায্যে কিছু পুরাণ নিরীক্ষণ করেছেন যার উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ‘Myth and Meaning’ বইটিতে। সেখানে তিনি কানাডার একটি পুরাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রাচীন চিন্তাভাবনা ও সামাজিক মনস্তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করেন। এটি এমন এক সময়ের পুরাণ যখন মানুষ ও অন্য প্রাণীর স্বতন্ত্রতা ছিল না। তারা সবাই ছিল ‘Half Human’ অথবা ‘Half Animal’। অর্থাৎ, অর্ধেক নরদেহ, অর্ধেক পশুদেহ। তখন প্রকৃতিতে অনবরত এক দখিনা হাওয়া বইতো। হাফ হিউম্যান/হাফ অ্যানিমেলদের জীবন যাপনে এই হাওয়ার প্রভাব ছিল খুব ক্ষতিকর। তাদের মাছ শিকারে এই হাওয়া বিরূপ প্রভাব ফেলতো। তখন স্কেটফিশ সহ কিছু সংখ্যক প্রাণী সেই দূষিত হাওয়াকে শান্ত রাখার অভিযানে নামলো। অবশেষে ঠিক হলো এই হাওয়া বইবে, তবে অনবরত না বয়ে বরং দিনে এক বেলা বা কিছুদিন পর একবার করে বইবে। তো এখন আসি মূল কথায়। কানাডায় প্রচলিত এই পুরাণটি কতোটা যৌক্তিক বা কতোটা ভিত্তিহীন তা নিয়ে লেভিস্ত্রস ভাবেন নি। তিনি বরং প্রশ্ন তুলেন কেন স্কেটফিশ আর কেন দখিনা হাওয়ার কথাই বলা আছে এই পুরাণে। এর উত্তর খুঁজতে তিনি স্কেট ফিশ ও দখিনা হাওয়ার উপস্থিতিকে (সাইন্টিফিক্যালি ও মিথিক্যালি) দুইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি স্কেটফিশের দ্বৈত বৈশিষ্ট্যকে কম্পিউটারের বাইনারি অপোজিশনের সাথে তুলনা করেন। ফলে এতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এবং একইসাথে পুরাণের ভিত্তিও তৈরী হয়। অর্থাৎ লেভিস্ত্রসের মক্তে, প্রাচীন চিন্তাধারা (Primitive Thought) ও আধুনিক চিন্তাধারা (Modern Thought) আলাদা হলেও কোনটাই সুপেরিয়র কিংবা ইনফেরিয়র নয়। এই জায়গায় এসে লেভিস্ত্রসের মতের সাথে ফরাসি দার্শনিক লুসিয়েন লেভি-ব্রুলের মতের বিরোধ তৈরী হয়। লেভি-ব্রুল মনে করতেন, আধুনিক মানুষের চিন্তার সাথে প্রাচীন কালের মানুষের চিন্তার গুণগত পার্থক্য রয়েছে। তিনি ‘সাইকিক ইউনিটি’র ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। লেভি-ব্রুলের মতে, প্রাচীন মানুষের চিন্তা আধুনিক মানুষের চিন্তার মতো যৌক্তিক ছিল না, তবে অযৌক্তিকও ছিল না; তাদের চিন্তায় কেবল কার্যকারণ (cause and effect) সম্পর্ক তৈরীর প্রচেষ্টা ছিল না। অন্যদিকে লেভিস্ত্রসের দাবি করেন, আধুনিক মানসিক গঠের তুলনায় ‘Primitive mind’ বা প্রাচীন মানসিক গঠন ‘Inferior kind of thought’ নয়, তবে অবশ্যই ‘Different kind of thought’।

লেভিস্ত্রস কাঠামোবাদের আলোকে ইডিপাস পুরাণের কাহিনীকে (Oedipus Myth) আরো সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আমরা জেনে নিই ইডিপাসের কাহিনীতে কি আছে।

রাজা ফোয়েনিশিয়ার ছেলে ক্যাডমোস। গ্রীক দেবতাদের রাজা জিউস ক্যাডমোসের বোন ইউরোপাকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে ক্যাডমোস তার বোনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। ক্যাডমোস ডেলফিতে পৌছুলে সেখানে সে এক দৈববাণী পায় যে একটি গরুকে অনুসরণ করে সে যেন এগিয়ে যায় এবং গরুটা যেখানে থেমে যায়, ক্যাডমোস যেন সেখানে একটি শহর গড়ে তোলে। ক্যাডমোস গরুকে অনুসরণ করে থিবিসে পৌছায় এবং সেখানে একটি ড্রাগন হত্যা করে। সেই ড্রাগনের দাঁত থেকে অনেক স্পার্তোই জন্ম নেয় এবং তারা একে অপরকে হত্যা করে। সর্বশেষ টিকে থাকা পাঁচজন স্পার্তোই ক্যাডমোসকে শহর নির্মাণে সাহায্য করে। ক্যাডমোসের পাঁচ সন্তানের একজন হলো পলিডোরাস এবং পলিডোরাসের ছেলে ল্যাবডাকোস (ল্যাবডাকোস অর্থ খোঁড়া)। ল্যাবডাকোসের ছেলে লায়োস (লায়োস অর্থ বামহাতি) দৈববাণী পায় যে তার ছেলে তাকে হত্যা করবে এবং তার স্ত্রী জোকাস্তাকে বিয়ে করবে। লায়োসের ছেলে হয়ে জন্ম নেয় ইডিপাস (ইডিপাস অর্থ পা ফোলা, Swollen foot), যাকে লায়োস পাহাড় থেকে ফেলে দেয়। কিন্তু ইডিপাসকে কুড়িয়ে পেয়ে লালন পালন করেন এক মেষ পালক। ঘটনাক্রমে লায়োসের সাথে ইডিপাসের দেখা হয় এবং ইডিপাস নিজের অজান্তেই তার বাবাকে হত্যা করে। ইডিপাস তখন থিবিসে গিয়ে স্ফিংক্সের দেখা পায় এবং স্ফিংক্স তাকে একটি ধাঁধা দেয়। ধাঁধাটি হলো – কোন সে জিনিস যা এক স্বরে কথা বলে, প্রথমে চার-পায়ী হয়, পরে দু-পায়ী হয় এবং অবশেষে তিন-পায়ী হয়? ইডিপাস ধাঁধার সমাধান দেয় – মানুষ। মানুষ জন্মের পর হাত পা মিলিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে চলে, বড় হয়ে দুই পায়ে ভর করে হাঁটে এবং বৃদ্ধ বয়সে দুই পা ও এক লাঠির উপর ভর করে। ধাঁধার সমাধান করার পর ইডিপাস স্ফিংক্সকে হত্যা করে এবং থিবিসের রাণী জোকাস্তাকে (যে কিনা ইডিপাসের মা ও লায়োসের বিধবা স্ত্রী) বিয়ে করে। এক সময় ইডিপাসও বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয় এবং পরবর্তীতে থিবিস এক নতুন রাজা ক্রেওনের (ক্রেওন জোকাস্তার ভাই) দখলে যায়। ইডিপাস ও জোকাস্তার ছিল চার সন্তান; ইটিওক্লিস, পলিনাইসিস, আন্তিগন ও ইজমিনি। যার মধ্যে ইটিওক্লিস ও পলিনাইসিস উভয়ই রাজ্য দখল নিয়ে সংঘাতে জড়ায় এবং এক পর্যায়ে ইটিওক্লিস পলিনাইসিসকে হত্যা করে। রাজা ক্রেওন পলিনাইসিসের বোন আন্তিগনকে তার ভাইয়ের মৃতদেহ সৎকার নিষেধ করে। কিন্তু আন্তিগন সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পলিনাইসিসের সৎকার করে।

লেভিস্ত্রস কাঠামোবাদী বিশ্লেষণের জন্য প্রথমে এই পুরাণ বা কাহিনী (Myth) থেকে মিথিম (Mytheme) বা একক ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন করে নেন। (সলিমুল্লাহ খান বাংলায় এই মিথিমকে বলতে চান ‘মহলা’)। ইডিপাস মিথের মিথিমগুলো হলোঃ

১. ক্যাডমোস কর্তৃক তার অপহৃত বোন ইউরোপাকে খোঁজা;

২. ক্যাডমোস কর্তৃক ড্রাগন হত্যা;

৩. একই উৎস থেকে জন্ম নিয়ে স্পার্তোইদের একে অপরকে হত্যা;

৪. খোঁড়া রূপে ক্যাডমোসের নাতি ল্যাবডাকোসের জন্ম;

৫. খোঁড়া ল্যাবডাকোসের ছেলে বামহাতি লায়োসের জন্ম;

৬. লায়োসসের ছেলে পা-ফোলা ইডিপাসের জন্ম;

৭. ইডিপাস কর্তৃক পিতা লায়োসের হত্যা;

৮. ইডিপাস কর্তৃক স্ফিংস হত্যা;

৯. ইডিপাস ও তার মা জোকাস্তার বিয়ে;

১০. ইটিওক্লিস কর্তৃক পলিনাইসিসের হত্যা;

১১. রাজা ক্রেওনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আন্তিগন কর্তৃক পলিনাইসিসের সৎকার;

এই মিথিমগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইডিপাসের কাহিনীতে একদিকে যেমন পারিবারিক বা রক্তের সম্পর্কের অতিমাত্রিক মূল্যায়ন লক্ষ্মণীয় (ইউরোপাকে খুঁজতে যাওয়া কিংবা ইডিপাস ও জোকাস্তার বিয়ে যা অজাচার ইঙ্গিত করে), অন্যদিকে পারিবারিক বা রক্তের সম্পর্কের অতিমাত্রিক অবমূল্যায়ন লক্ষ্মণীয় (ইডিপাস কর্তৃক লায়োসের হত্যা কিংবা ইটিওক্লিস কর্তৃক পলিনাইসিসের হত্যা)। আবার, মিথিমগুলোতে ভূ-উদ্ভূত অস্তিত্বকে স্বীকার ও ভূ-উদ্ভূত অস্তিত্বকে অস্বীকারের বিষয়টিও লক্ষণীয়। যেমন- ড্রাগন ও স্ফিংসের অস্তিত্ব বিরাজমান এবং সর্বশেষ পরিণতিতে এদের বিনাশ। লেভিস্ত্রস এই কাহিনীটিকে ছক আকারে উল্লম্ব ও আনুভূনিকভাবে সাজিয়ে দেখান, মিথিমগুলোর অন্তর্হীন কাঠামো তৎকালীন সমাজকাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। লেভিস্ত্রস বলেন, কোন পুরাণ বা কাহিনী পাতার পর পাতা (অর্থাৎ আনুভূমিকভাবে) পড়ে গেলে এর মিথিম বা মহলাগুলো আলাদা করা যায়। কিন্তু মহলাগুলো যখন খাড়া ভাবে (উল্লম্বভাবে) পড়বো কেবল তখনই এক কাহিনীর মহল থেকে অন্য কাহিনীর মহলে যাতায়াত করা যায়। ইডিপাসের কাহিনীকে এভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পরস্পর বিরোধী (Binary opposite) মহলাগুলোও কাহিনীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আদিম মানব সমাজে মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে কিছু পরস্পর-বিরোধী ধারণা সুপ্তভাবে বিরাজ করতো। মানুষের উদ্ভব যৌনমিলন তথা রক্ত সম্পর্ক থেকে নাকি ভূ-উদ্ভূত অস্তিত্ব থেকে তা নিয়ে ছিল সংশয়। লেভিস্ত্রসের মতে, ইডিপাস কাহিনীর কাঠামোগত বিশ্লেষণ থেকে আদিম মানব সমাজের সেই সংশয়ই প্রকাশ পায়।

পরবর্তীতে লেভিস্ত্রস পুরাণ বা লোক-কাহিনীর যোগসাজস দেখান তার ‘The Structural Study of Myth’ বইটিতে। এই বইয়ে তিনি দেখান, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠা পুরাণের মাঝেও যোগসাজস রয়েছে। লেভিস্ত্রস বলেন, পুরাণের কাহিনীতে নয়, বরং এর গঠনগত কাঠামোতে সাদৃশ্য বিদ্যমান। যেমন- গ্রীক পুরাণ ও ভারতীয় পুরাণে সূর্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন দেবতা রয়েছে। গ্রীক পুরাণে হয়তো সেই দেবতার নাম অ্যাপোলো এবং ভারতীয় পুরাণে সেই দেবতার নাম সূর্যনারায়ণ। কিন্তু সূর্যের প্রতি বিশ্বব্যাপী মানুষের ভরসা ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ (যেহেতু ধরণীতে সকল শক্তির উৎসই সূর্য) দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষই সূর্যের মাহাত্ম্যের জন্য একজন করে দেবতার স্মরণ করছেন। আবার, গ্রীক পুরাণে যেমন ঝড় ও বজ্রপাতের অর্থ দেবতা জিউসের ক্রোধ, ভারতীয় পুরাণেও ঝড় ও বজ্রপাতের অর্থ দেবতা ইন্দ্রের ক্রোধ। এই দুই সংস্কৃতিতেই বৈরী আবহাওয়াকে দেবতাদের ক্রোধ হিসেবে ব্যাখ্যা করে হচ্ছে, কেননা বৈরী আবহাওয়া তাদের চাষাবাদ ও জনজীবনে ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনে। যদিও পৌরাণিক কাহিনীগুলি বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মনের খামখেয়ালিপনায় সৃষ্টি, কিন্তু সংস্কৃতিভেদে সেই খামখেয়ালিপনাও একই বিন্যাসে সজ্জিত। অর্থাৎ লেভিস্ত্রস মানুষের চিন্তার খামখেয়ালিপনার বিন্যাস রীতির সন্ধান করেন। একে তিনি বলছেন ‘System of system’। হতে পারে সেসব বিশৃঙখল সিস্টেম, তবে এই বিশৃঙখলাও একটা সুগঠিত, কাঠামোগত ও শৃঙখলাবদ্ধ সিস্টেম মেনে চালিত হয়। এই সাদৃশ্যকেই লেভিস্ত্রস বলেন, পৃথিবীর সকল মানুষের ‘সাইকিক ইউনিটি’ অর্থাৎ সার্বজনীন মানসিক সামঞ্জস্যতা (ফরাসিতে লেভিস্ত্রস বলেন, l’esprit humain)।

অন্যসব তত্ত্বের মতো কাঠামোবাদেরও সমালোচনা হয়েছে। লেভিস্ত্রস পরবর্তী চিন্তকরা কাঠামোবাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। লেভিস্ত্রসের কাঠামোবাদ তত্ত্বের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো এর প্রয়োগিক অক্ষমতা। কাঠামোবাদ প্রায়োগিক/পরীক্ষামূলক (Empirical) নয়, বরং যৌক্তিক (Rational)। একে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কাঠামোবাদ মানুষের চিন্তার আদল নিয়ে আলাপ করে যা পরখ করে দেখা প্রায় অসম্ভব। কাঠামোবাদীরা যখন কোন সংস্কৃতির একক অংশ (যেমন-পুরাণ) বেছে নিয়ে তাকে কাঠামোবাদের সাহায্যে ব্যাখ্যা করে দেখান, তখন সেই ব্যাখ্যারও রয়েছে সীমাবদ্ধতা।

কাঠামোবাদ নিয়ে বহু মতবিবাদ ও সমালোচনা থাকলেও নৃবিজ্ঞান মহলে ক্লদ লেভিস্ত্রস এক সমাদৃত নাম। কেননা তিনি মানুষের চিন্তার আদলের রহস্য আবিষ্কার করতে না পারলেও চিন্তার আদল নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। মানুষের মন কিভাবে কাজ করে, সকল মানুষের মনের গড়নে কি সামঞ্জস্যতা আছে এসকল প্রশ্নের উত্তর লেভিস্ত্রসই প্রথম খুঁজতে চেয়েছেন। লেভিস্ত্রসের একটি উক্তি দিয়েই এই আলাপ শেষ করা যাক।

“A wise man doesn’t give the right answers,

He poses the right questions.”

লেভিস্ত্রস Culture ও Cognition-এর সম্পর্ক তথা সংস্কৃতির সাথে মানুষের ইন্দ্রিয়গত চিন্তার সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছেন। নৃবিজ্ঞান শাখায় লেভিস্ত্রসের এই কাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী নৃবিজ্ঞানীদের কাছে মানুষ অধ্যয়নের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়, যা দিয়ে মানুষকে ভিন্ন আঙ্গিকে অধ্যয়ন করা সম্ভব হয়।

Reference:

1. Levi-Strauss, 1978, ‘Myth and Meaning’

2. Barnard, 2004, ‘History and Theory in Anthropology’

3. Layton, 1997, ‘An Introduction to Theory in Anthropology’

4. সলিমুল্লাহ খান, ২০১১, ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’

One thought on “লেভিস্ত্রসের চিন্তা ও পুরাণের কাঠামোগঠন

  • December 3, 2021 at 7:09 am
    Permalink

    বাদ,বিশ্বাসী,যুক্তিতর্ক মানব অবয়ব, মনের চলাচল,যৌনভাবনা,রূপায়ণ কাটা ছেঁড়ায় লেখাটি প্রতিষ্ঠা পায়। যায় হোক পড়লে হৃয়ঙ্গম করলে মনের উত্তরণ হবে। ধন্যবাদ।

Comments are closed.