নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতিঃ প্রাথমিক পাঠ
[এনথ্রোসার্কেলে আমরা নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিছু লেখা প্রকাশ করবো। প্রথম পর্বে আমাদের জন্য লিখেছেন তাসনিম রিফাত]
আমি এমন একটি বিষয় নিয়ে এবার লেখতে বসেছি যেটি নৃবিজ্ঞানের সবচেয়ে কাঠখোট্টা একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। এর কারণ- নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতিগুলো এমন, যেগুলো বইয়ের পাতার শব্দের চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে আরো বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ব্যাপারে কবুল করে নেই যে, নৃবিজ্ঞানে গবেষণায় আমার খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে রাজশাহীতে ৩ দিনের একটা ছোট ফিল্ডওয়ার্কই সম্বল। সুতরাং, আবার পদ্ধতি বিষয়ক লেখালেখিগুলো অনেকটা চোখ বন্ধ করে পাথরের টুকরো ঢিল ছুড়ে আটলান্টিকের গভীরতা মাপার মতো ব্যাপার হবে। তবুও, নাচতে এসে যেহেতু ঘোমটা দেওয়াটা রীতিবিরুদ্ধ, সেই হেতু আর কোনো পথও খোলা নেই।
নৃবিজ্ঞানের তত্ত্ব যতটুকু গুরত্বপূর্ণ, পদ্ধতি ঠিক ততোটাই। প্রসঙ্গত বলে রাখি, নৃবিজ্ঞানে যেকোনো তত্ত্বের সাথে একটি সাধারণ ইস্যু সবসময়ই জড়িত থাকে, সেটা হলো ‘আমি ফিল্ডে গিয়ে কী খুঁজবো’? (কিংবা আদৌ কিছু খুঁজবো কিনা?) একজন ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক ফিল্ডে গিয়ে যেসব ব্যাপারে গুরত্ব দিবেন, যেসব নকশা অনুসরণ করে তার প্রাপ্ত উপাত্ত সাজাবেন, একজন কাঠামোবাদী তাত্ত্বিক নিশ্চয়ই সে ধারা অনুসরণ করবেন না। অর্থাৎ এখানে তত্ত্বই অনেকসময় ঠিক করে দিচ্ছে তথ্য সংগ্রহ করার পথকে। তবে, যেহেতু ‘যত মত তত পথ’ আর মানুষমাত্রই মত, সেহেতু নৃবিজ্ঞানের এই গবেষণা পদ্ধতিগুলো ব্যক্তিভেদেও আলাদা হয়। একজন নৃবিজ্ঞানী ফিল্ডে গিয়ে যেসব বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হয়, তিনি সেখান থেকেই আরো কার্যকরীভাবে তথ্য সংগ্রহের এক বা একাধিক পথ বের করার চেষ্টা করেন। সব নৃবিজ্ঞানী সেটি না করলেও, অন্তত দক্ষ নৃবিজ্ঞানীরা করেন।
অনেকক্ষণ ধরে অন্ধের হাতি দেখার মতো পদ্ধতি নিয়ে বকবক করলাম, কিন্তু গবেষণা পদ্ধতিটা আসলে কী সেটাই বললাম না। আমার ধারণা আপনারা সেটা ইতোমধ্যেই বুঝে গেছেন। নৃবিজ্ঞানে গবেষণা করার জন্য যেসব কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর সমষ্টি এবং বিন্যাসই হলো গবেষণা পদ্ধতি। গবেষণা পদ্ধতি বেশ বিস্তৃত একটি ধারণা। এটি একজন গবেষক মাঠে গিয়ে কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করবেন, কী করবেন আর কী করবেন না এবং গবেষণাকালীন নৈতিকতার মত বিষয়গুলোকেও নির্দেশ করে।
নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতি বললে অন্তত দুইটি ব্যাপার আলোচনায় চলে আসে। পয়লা ব্যাপারটি হলো এপিস্টোমলজি, দুসরা ব্যাপারটি হলো গবেষণা কৌশল। এপিস্টোপলজির বাংলা কেউ কেউ ‘জ্ঞানতত্ত্ব’ করেন। জ্ঞানতত্ত্ব হলো জ্ঞান আহরণ করার প্রকৃতি ও পদ্ধতি নিয়ে দার্শনিক বিতর্কের শাখা। অন্যদিকে নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতির কৌশলগত জায়গাটি হল যেসব পদ্ধতিসমূহ ( যেমন সাক্ষাতকার গ্রহণ, নমুনায়ন) ব্যবহার করে একজন গবেষক মাঠে গবেষণা চালাবেন, সেসকল বিষয়। আমি এই লেখাটিতে মূলত জ্ঞানতত্ত্বীয় ব্যাপারগুলো নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।
প্রাচীন গ্রিসের সময়কাল থেকেই একটি খুব বিখ্যাত বিতর্ক চলমান ছিল জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে। সেই সময় একদল তাত্ত্বিক মনে করতেন- রেখা, বৃত্ত বা ত্রিভুজের মতো আকৃতিগুলির যে ধারণা, সেগুলো এসেছে মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে। মানুষ তার চারপাশে যে বস্তুসমূহ পর্যবেক্ষণ করে, তা থেকেই তারা এই আকৃতিগুলোর একটি ধারণা লাভ করে। অন্যদিকে প্লেটো মনে করতেন, রেখা, বৃত্ত বা ত্রিভুজের ধারণাগুলো আসলে মানুষের মস্তিষ্কে সহজাতভাবেই থাকে। মানুষ তার মাথায় পূর্বে থেকে অবস্থান করা আকৃতিগুলিকেই প্রকৃতির নানা বস্তুর দিকে প্রজেক্ট করে। এই তর্কটি আমরা কমবেশি অভিজ্ঞতাবাদ আর বুদ্ধিবাদের তর্ক হিসেবেই চিনি। অভিজ্ঞতাবাদ মনে করে মানুষের জ্ঞানের মূল উৎস আসলে অভিজ্ঞতা। যেকোনো অভিজ্ঞতা লাভের আগে তার মস্তিষ্ক একটি ফাকা ব্ল্যাকবোর্ডের মতোই থাকে। যখন ব্যক্তিটি কোন অভিজ্ঞতা লাভ করে, সেই ফাঁকা ব্ল্যাকবোর্ডে একটির পর একটি অক্ষরও রচিত হতে থাকে। অন্যদিকে বুদ্ধিবাদীরা মনে করেন, মানুষের মনের মধ্যে সহজাতভাবেই যৌক্তিক কিছু কাঠামো থাকে, যার সাহায্যে সে জ্ঞানার্জন করতে পারে। অভিজ্ঞতা অর্জনের আগেই মস্তিষ্কে সেই যৌক্তিক সত্ত্বাটি জাগ্রত থাকে। তারা মনে করে, মানুষের জ্ঞানের মূল উৎস কেবলমাত্র তার ইন্দ্রিয়লদ্ধ (যেমনঃ চোখ, কান, নাক) উপাত্ত নয়, বরং তার মস্তিষ্কের সহজাত যৌক্তিক সত্ত্বা। দর্শনশাস্ত্রে এই তর্ক আরো বিস্তৃত ও জটিল। আমি আলোচনার সুবিধার্থে কেবলমাত্র মূল বিষয়য়টি বললাম।
অভিজ্ঞতাবাদ আর বুদ্ধিবাদের সুবাদে নৃবিজ্ঞানেরও দুটি বিষয় সামনে আসে। মানুষের বিভিন্ন আচার-আচরণ ও চর্চাগুলো কি কেবলমাত্র সে যে সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠে, সে সংস্কৃতির অভিজ্ঞতার ফসল, নাকি কিছু মানব বৈশিষ্ট্য অন্তনির্হিতভাবেই মানুষের মধ্যে থাকে? এই তর্ক এখনো নৃবিজ্ঞানে চলমান। যদি ধরে নেই, মানুষের অর্জিত সকল বৈশিষ্ট্যই সে একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠার কারণেই অর্জন করে, তাহলে ধরে নিতে হয় মানুষের যেকোনো আচরণই সংস্কৃতিসাপেক্ষ। কিন্তু, এইক্ষেত্রে নৈতিকতার মতো বিভিন্ন ব্যাপারগুলোকে কিভাবে বিবেচনা করা যায়, সেটি একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, অনেক দেশের সংস্কৃতিতে এমন কোন বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, যেটা একটা বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য নিপীড়ক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমন অনেকগুলো কেসের ক্ষেত্রে মানুষ কি কেবলমাত্র অভিজ্ঞতার ফসল, নাকি মানব আচরণের ও মূল্যবোধের কোন বৈশ্বিক মানদন্ড আছে, সেটি একটি বড় তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই তর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপারও এসে পড়ে। সেটা হলো নৃবিজ্ঞান কি একটি বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র হবে, অর্থাৎ নৃবিজ্ঞান কি মানবসমাজের কোন বৈশ্বিক ও সাধারণ নীতির অনুসন্ধান করবে, নাকি একটি মানবিক শাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞান গুরত্ব দিবে কেবলমাত্র ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতা ও পয়েন্ট অফ ভিউকে। বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে এই তর্কের সমাধা করার চেষ্টা করেছেন। কেউ আবার এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যবর্তী একটি অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এবার আমি এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলবো যেটাকে ঠিক তত্ত্ব কিংবা পদ্ধতি দিয়ে সরাসরি বুঝা যাবে না, সেটি হচ্ছে গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকের নিজের সেন্স বা বিবেচনাবোধ। একজন নৃবিজ্ঞানী গবেষণা পদ্ধতিগুলো খুব ভালো জানলেও, সবচেয়ে ভালো কাজ করার জন্য প্রয়োজন একটা মোক্ষম সেন্স। সেন্স বিষয়টা আসলে কী, সেটাকে নির্দিষ্ট ভাবে বলা সম্ভব না। সেন্ট অগাস্টিন যেমন ‘সময়’ নিয়ে বলেছেনঃ ‘আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস না করে, তাহলে আমি সময় মানে কী তা বলতে পারবো। কিন্তু কেউ যদি বলে সময় কী তা ব্যাখ্যা করে বুঝাতে, আমি বলবো আমি আসলে জানি না সময় মানে কী।” সেন্স নিয়েও আমার একই মত। এটা ব্যাখ্যা করে বুঝানো কঠিন, তবে বোধহয় আমাদের প্রায় সবার মাথায় এর একটা নির্দিষ্ট রূপ আছে। নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতিতে সেন্স কিভাবে ভূমিকা রাখে, সেটা আমার নিজের একটি ছোট ফিল্ডওয়ার্কের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করি।
আমাদের ফিল্ডওয়ার্কটি ছিল রাজশাহীর তানোরে, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীদের সাথে। সেখানে আমরা তাদের জীবনব্যবস্থা, পরিবারব্যবস্থা, সামাজিক সংগঠন নিয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন। সাঁওতালদের নিজস্ব কিছু বিচারব্যবস্থা ও সামাজিক সংগঠন রয়েছে। কালের পরিক্রমায় এগুলো হয়তো আগের মতো আর অতো মজবুত নয়, তবে এখনো এদের নানা কার্যকারীতা দেখা যায় সাঁওতালদের সমাজে। আমরা যেই সময় ফিল্ডওয়ার্ক করেছিলাম সেই সময় সাঁওতালদের কাছে তাদের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আর সামাজিক সংগঠনগুলো নিয়ে কিছু তথ্য পেয়েছিলেন। সাঁওতাল সমাজের কয়েকজনের তথ্যমতে, তারা এখনো ছোটখাটো ঝামেলাগুলো প্রায় সবই নিজস্ব বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলে এবং এইক্ষেত্রে তারা খুব একটা সরকারি প্রশাসনের দ্বারস্থ হয় না। অন্যদিকে আমার কিছু সহপাঠী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভিন্ন একটি তথ্য পায়। তাদের মতে, সাঁওতালদের স্থানীয় বিচারব্যবস্থা এখন আর কার্যকরী না, তাদের মধ্যকার সব ঝামেলা তারা স্থানীয় সরকারি প্রশাসনের সাহায্য নিয়েই মিটমাট করেন। আমার কোন কোন সহপাঠী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রাপ্ত তথ্যকেই বেছে নেয় উপস্থাপনের জন্য। তবে আবার এতে কিছু আপত্তি ছিল। প্রধান কারণটা হলো, বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনের মধ্যে ‘সাঁওতালদের সবকিছুই এখন আমাদের আয়ত্ত্বে’- এমন ইগো থাকাটা খুব একটা অসম্ভব ছিল না। তাদের সরকারি প্রশাসনের কার্যক্রম কতদূর অবধি পৌছেছে সেটা নিয়ে আগ বাড়িয়ে বলার জোর সম্ভাবনা আছে। এই চিন্তা থেকে আমি এই তথ্যটা উল্লেখ করা থেকেই বিরত ছিলাম। (যেহেতু ফিল্ডওয়ার্কটি খুব স্বল্পকালীন ছিল, সেখানে থেকে উভয় তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না)।
অর্থাৎ, এখানে আমার এই কথাটি বলার মূল কারণটি হচ্ছে গবেষণার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি গবেষকের বিবেচনাবোধও খুব গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বিবেচনাবোধ গবেষকের সামগ্রিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বোঝাপড়ার মাধ্যমেই তৈরি হয়।
আজকে এখানেই ইতি। এরপরের পর্বগুলোতে আমরা চলে যাবো নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতির কৌশল ও আরো কিছু ধারণা নিয়ে আলাপে। সাথেই থাকুন।
দোহাই
Research methods in anthropology, H. Russel Bernard
Myth and Meaning, Claude Levi-Strauss