নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতিঃ নমুনায়ন (Sampling)
[এনথ্রোসার্কেলে আমরা নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিছু লেখা প্রকাশ করবো। এই পর্বে আমাদের জন্য লিখেছেন খান মাহমুদ]
ধরা যাক “হ্যালো” বিস্কিটে ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণ জানা দরকার। বাজারে যেকোন একটি “হ্যালো” বিস্কিট থেকে পরীক্ষা করলেই তা জানা সম্ভব। এক্ষেত্রে Sampling বা নমুনায়নের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যখন কোন একটি এলাকায় কতজন লোক এই বিস্কিট পছন্দ করে, কিভাবে খেতে পছন্দ করে এসব জানার জন্য নমুনায়ন করার প্রয়োজন হয়। কারণ, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সময় কোন জনগোষ্ঠীর পুরো জনসংখ্যা নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয় না। পুরো জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করা একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ অপরদিকে ব্যয়বহুল। ফলে, গবেষণার সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য গবেষিত জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট অংশ নির্বাচন করা হয়। গবেষণার জন্য একটি মোট জনগোষ্ঠী থেকে জনসংখ্যার একটি উপসেট নির্বাচন করাই নমুনায়ন।
প্রধানত সাত ধরণের নমুনায়ন দেখা যায়। এর মধ্যে Simple random, Stratified random এবং Cluster sample সম্ভাব্যতা (Probability) তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে করা হয়। সম্ভাব্য নমুনায়ন মূলত বড় জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। আর বাকি ৪ টি নমুনায়ন হলো Qouta, Purposive, Snowball এবং Haphazard নমুনা।
Simple Random: Simple Random নমুনায়ন প্রক্রিয়ায় গবেষক গবেষিত জনগোষ্ঠী থেকে এলোপাথাড়ি/ যথেচ্ছভাবে একটি উপসেট নির্বাচন করেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকের নির্বাচিত হবার সমান সম্ভাবনা থাকে।
ধরা যাক কোন একটি গ্রামের বয়ঃসন্ধিকালীন বয়সের ছেলে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করা হবে। এখন ঐ গ্রামে ৬০০ জন কিশোর-কিশোরি রয়েছে। এদের প্রত্যেক কে ১-৬০০ নাম্বারে চিহ্নিত করা হবে। এবার এদের থেকে নির্দিষ্ট বিরতিতে যেকোন ১০০ জন কে গবেষণার জন্য ইচ্ছামতো নির্বাচন করে গবেষণা করা যেতে পারে। এইক্ষেত্রে কখনো লটারি পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ ৬০০ জন থেকে লটারির মাধ্যমে ১০০ জন বাছাই করে নেওয়া। আবার কখনো কখনো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার পার্থ্যক্যকে ভিত্তি করে বাছাই করা হয়। যেমন প্রত্যেককে ১-৬০০ পর্যন্ত সংখ্যার মাধ্যমে চিহ্নিত করে প্রতি দুই সংখ্যা পরপর (২,৪,৬,৮…) নমুনা নেওয়া হয়। এই ধরনের নমুনার আকার বাড়ালে অধিক যথাযথ উপাত্ত পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
Stratified Random: যখন কোন গবেষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ছোট ছোট উপদল করার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন Stratified Random Sampling ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে একই রকম বৈশিষ্ট্য বা বিশ্বাস ধারণ করে এমন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে উপদল গঠন করা হয়। এই নমুনায়নের মাধ্যমে গবেষিত জনসংখ্যার থেকে সর্বাধিক যথাযথ নমুনা পাওয়া সম্ভব।
ধরা যাক, গবেষক কোমল পানীয় উপভোগ সম্পর্কে জানতে চান। এক্ষেত্রে তিনি লিঙ্গ, বয়স, সামাজিক শ্রেণীর উপর ভিত্তি করে কয়েকটি স্তর বা Stratum গঠন করতে পারতে পারেন। ধরা যাক তিনি ১৮-২৪, ২৫-৩১, ৩২-৩৯ এবং ৪০-৪৬ বয়স শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এবার গবেষক তার নমুনার আকার অনুসারে প্রতিটি স্তর থেকে নমুনা সংগ্রহ করবেন। তারপর তিনি দৈব ভাবে নমুনা সংগ্রহ শুরু করবেন। তাকে অবশ্যই প্রতিটি স্তর থেকে নমুনা নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরে স্বতন্ত্র নাম্বার দিয়ে চিহ্নিত করতে পারেন।
এই নমুনায়ন পদ্ধতির অন্যতম সুবিধার দিক হলো, এর মাধ্যমে বিভিন্ন মাত্রার উপাত্ত পাওয়া সম্ভব হয়। যেমন, কোন উপাত্ত বয়স, লিঙ্গ কিংবা আর্থসামাজিক অবস্থানের দিক দিয়ে ভিন্ন হতে পারে। এসব ভিন্নতা উক্ত নমুনায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে জানা সম্ভব।
Cluster Sampling: Cluster বা গুচ্ছ নমুনায়ন প্রক্রিয়ায় গবেষক গবেষণার পুরো জনগোষ্ঠীকে কয়েকটি দল বা গুচ্ছে ভাগ করেন। তারপর এই গুচ্ছ থেকেই Simple বা Systematic নমুনায়নের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করেন। নমুনা দল কে গুচ্ছ গুচ্ছ করে নেয়ার কারণে একে গুচ্ছ নমুনায়ন বলা হয়।
ধরা যাক কোন একটি জেলার সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের গড় পড়াশোনার মান যাচাই করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সাধারণ দৈব চয়নে প্রতিটি স্কুল থেকে একজন নির্বাচন করা অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে গুচ্ছ নমুনায়ন ব্যবহৃত হয়। ঐ জেলাকে প্রতিটি উপজেলায় ভাগ করে কয়েকটি এলাকা তৈরী করা যায়। এবার প্রতিটি ভাগের স্কুল গুলো থেকে সহজেই গবেষক এক বা একাধিক নমুনা সংগ্রহ করতে পারেন।
এখন সাধারণভাবে দেখলে Stratified Random এবং Cluster নমুনায়ন দুটিকে একইরকম মনে হয়। এই দুটি নমুনায়ন প্রক্রিয়ায় তফাৎ কিছুটা সূক্ষ্ম হওয়ায় এই সমস্যা দেখা দেয়। Stratified Random নমুনায়নে যেসব উপদল গঠন করা হয় সেগুলো মূলত গবেষকের উপর নির্ভর করে। এবং গবেষক উপদলগুলো সাদৃশ্যের ভিত্তিতে করে থাকেন। যেমন ধর্মীয় বিশ্বাস, পছন্দ ইত্যাদির ভিত্তিতে উপদল গঠন করা যায় Stratified Random নমুনায়নে। ফলে, উপদলগুলোর নিজেদের মধ্যে সাদৃশ্য এবং একটির তুলনায় অপরটির মধ্যে বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। অপরদিকে Cluster বা গুচ্ছ নমুনায়ন পদ্ধতিতে গঠিত উপদল প্রাকৃতিক ভাবেই বিভক্ত থাকে। প্রতিটি ভাগের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। যেমন কোন জেলায় উপজেলাগুলো হবে গুচ্ছ নমুনায়নের একেকটি Cluster বা গুচ্ছ যা পূর্ব থেকেই নির্ধারিত।
আলোচিত তিনটি নমুনায়নই সম্ভাব্যতা তত্ত্ব (Probability) এর উপর ভিত্তি করে করা হয়। এর মধ্যে গুচ্ছ নমুনায়ন পদ্ধতি বাজার গবেষণা ও বিশ্লেষণের জন্য বেশী ব্যবহৃত হয়। এবার Non probability নমুনায়ন তত্ত্বগুলো নিয়ে আলাপ করা যাকঃ
Quota Sampling: এই নমুনায়ন প্রক্রিয়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশী ব্যবহার করে থাকে। Quota Sampling এ গবেষক নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা গুণের ভিত্তিতে নমুনার জন্য বিশেষ ব্যক্তি নির্বাচন করেন। সাধারণত তাৎক্ষণিক ভাবে এই নমুনায়ন করা হয়ে থাকে।
যেমন কোন “কলম” কোম্পানি যদি জানতে চায় কোন কোন বয়সের ভোক্তারা কোন ব্র্যান্ডের কলম ব্যবহার করতে পছন্দ করে সেক্ষেত্রে তারা Qouta sampling ব্যবহার করবে। এক্ষেত্রে গবেষক লিঙ্গ ও বয়সকে বিবেচনায় নিয়ে নমুনা দলকে ভাগ করে গবেষণা করবেন।
Purposive Sampling: উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন বা Purposive Sampling বিচারমূলক, বিষয়মূলক হিসেবেও পরিচিত। এই নমুনায়ন প্রক্রিয়ায় গবেষক তার উদ্দেশ্য অনুসারে তথ্যদাতা নির্বাচন করেন। Purposive Sampling প্রয়োগের জন্য গবেষকের তার অধ্যনের বিষয়বস্তু নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরী যাতে সে সহজেই তার কাঙ্ক্ষিত তথ্যদাতা নির্বাচন করতে পারেন। যেসব তথ্যদাতা কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলবে না তাদের নমুনা থেকে বাদ দিয়ে দেয়াই গবেষকের কাজ। এজন্যই উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন প্রক্রিয়াকে জাজমেন্টাল বা বিচারমূলক বলা হয়।
Haphazard Sampling: দৈব নমুনায়ন বা Haphazard Sampling অন্য নমুনায়ন প্রক্রিয়ার মতো করে তথ্যদাতা বাছাই করে না। এই প্রক্রিয়ায় গবেষক দৈবভাবে তথ্যদাতা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি Random Sampling করার প্রয়াস চালায়। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত নমুনায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর থেকে তথ্যদাতা প্রাপ্তির সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। স্বল্প খরচে কোন গবেষণা করার জন্য এই নমুনায়ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ফলে উপাত্তের যথার্থতাও কম থাকে Haphazard Sampling এর ক্ষেত্রে। আবার অনেক সময় গবেষক তাৎক্ষণিক কিছু উপাত্ত সংগ্রহ করতে চান তখনও এই নমুনায়ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কিছু উপাত্ত পাওয়া যায় যা হয়তো নিয়মতান্ত্রিক গবেষণায় পাওয়া যেতো না। তবে এই পদ্ধতিতে ভুল উপাত্ত পাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
Snowball sampling: সামাজিক সম্পর্কের অধ্যনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর নমুনায়ন প্রক্রিয়া হচ্ছে স্নো বল স্যামপ্লিং। এই নমুনায়ন প্রক্রিয়ায় গবেষক এক বা একাধিক মূল তথ্যদাতা নির্বাচন করেন যারা পরবর্তীতে গবেষণার জন্য উপযুক্ত আরো তথ্যদাতার সন্ধান দিবে। সাধারণত কোন ছোট সমাজ যেখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সাথে পরিচিত সেখানে এই নমুনায়ন পদ্ধতি খুবই কার্যকর। আবার শহরের কোন বিশেষ জায়গায় গবেষণার ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি কার্যকর। যেমন শহরের কোন অভিজাত ক্লাবের পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে গবেষক সহজেই সেখানে হয়তো প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। সেক্ষেত্রে ক্লাবের কোন সদস্য পেলে তার মাধ্যমে ক্লাবে প্রবেশ করা সম্ভবপর হয়ে উঠে। আবার ধরা যাক কোন গবেষক কিডনি ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করতে চান, সেইক্ষেত্রে তিনি এই ধরণের কাজে জড়িত খুব বেশি মানুষকে সরাসরি নাও খুঁজে পেতে পারেন। এইক্ষেত্রে তিনি স্নোবল স্যামপ্লিংয়ের মাধ্যমে একজন মূল তথ্যদাতা নির্বাচন করে অন্যান্য তথ্যদাতাদের সন্ধান পেতে পারেন। যেসব গবেষণায় তথ্যদাতাদের নাগাল পাওয়া কঠিন, সেখানে স্নোবল স্যামপ্লিং খুব কার্যকরী পদ্ধতি।
Research methods in anthropology, H. Russel Bernard