বই রিভিউঃ ইমাজিন্ড কম্যুনিটিজ

[বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘ইমাজিন্ড কম্যুনিটিজ’ জাতীয়বাদ নিয়ে একটি যুগান্তকরী  বই। প্রকাশের পরপরই এটি বহুল আলোচিত হয়েছে। এই বইটির রিভিউ লিখেছেন সাদিয়া শান্তা। ]

কেউ যখন আমাদের প্রশ্ন করে, আমাদের জাতীয় পরিচয় কি, নির্দ্বিধায় উত্তর দিই – আমরা বাংলাদেশি। কোন প্রাতিষ্ঠানিক আবেদনপত্রে স্বীকার করি – আমরা বাংলাদেশি। আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কেন্দ্র করে বাজারে পাওয়া যায় অনেক রকম বই। আবার এই জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে হয়েছে যুদ্ধ। কিন্তু কি এই জাতীয়তাবাদ যা আমাদের কেবল পরিচয়ই নয়, আবেগ অনুভূতির সাথেও মিশে রয়েছে? কেমন লাগবে যদি কেউ হঠাৎ বলে বসে – বাঙালি জাতিস্বত্বা একটা কাল্পনিক ধারণা? ঠিক এভাবেই জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন

বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (১৯৩৬-২০১৫) একজন ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। চীন দেশে জন্মে বেড়ে উঠেছেন আমেরিকায় এবং জীবনের অন্তিম পর্যায়ে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ায়। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের স্বাদ পেয়ে জাতীয়তাবাদ নিয়ে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের মনে তৈরী হয় মজার মজার ধারণা (Idea of Nationalism)। তার মতে, জাতীয়তাবাদ একটি কাল্পনিক ধারণা। কল্পনাপ্রসূত জাতিসত্ত্বার এই ধারণা নিয়ে ১৯৮৩ সালে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন রচনা করেন তার বিখ্যাত বই ‘Imagined Communities : Reflections on the Origin and Spread of Nationalism

১৯৭০ সালে চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার ত্রি-দেশীয় যুদ্ধ এই বইটি লেখার উৎসাহ জাগায়। ১৯৭৮ সালে চীন যখন ভিয়েতনামকে আক্রমণ করে এবং ভিয়েতনাম আক্রমণ করে কম্বোডিয়াকে, তখন এই তিনটি রাষ্ট্রই ছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এই তিন দেশের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা বিলুপ্ত হয়ে সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং তিনটি দেশে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগত পরিচয় গড়ে উঠার প্রবণতা দেখা যায়। অ্যান্ডারসনের আলাপের ভিত্তি ছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের মধ্যেও কিভাবে জাতিগত পরিচয়ের ধারণা বড় হয়ে উঠে। এই আলাপের ভিত্তি রচিত হয় মূলত অ-পাশ্চাত্য দেশগুলোর জাতীয়তাবাদী ধারণাকে কেন্দ্র করে। ‘Imagine Community’ এর ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অ্যান্ডারসন কৃতজ্ঞতা জানান ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ও ভিক্টর টার্নারের প্রতি।

অ্যান্ডারসন ‘Anomaly of nationalism’ এর কথা বলেন। তার মতে, মার্ক্সবাদসহ অপরাপর অনেক চিন্তাধারাই জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত আলোচনায় অনেকটা কম গুরত্ব দিয়েছে। অথচ জাতীয়তবাদ বর্তমানে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি ফেনোমেনা আকারে হাজির হয়েছে। দুনিয়ার সব মানুষই নিজেকে কোন না কোন জাতিস্বত্বার অংশ মনে করে। অ্যান্ডারসনের মতে, জাতীয়তাবাদের আলাপে মার্ক্সবাদসহ অন্যান্য চিন্তাধারার এটি একটি দূর্বলতা। তিনি বলেন, “nationalism has proved an uncomfortable anomaly for Marxist theory..”

বইটি এগারোটি অধ্যায় দিয়ে সাজানো। প্রথম অধ্যায়টি শুরু হয় Introduction দিয়ে। এরপর ধারাবাহিকভাবে দশটি অধ্যায় হলো Cultural Roots / The Origins of National Consciousness / Creole Pioneers / Old Languages, New Models / Official Nationalism and Imperialism / The Last Wave / Patriotism and Racism / The Angel of History / Census, Map, Museum / Memory and Forgetting । (এই লেখায় আমি প্রথম তিনটি অধ্যায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি ও বাকি অধ্যায়গুলোর সারকথা আলোচনা করেছি।)

বইয়ের সূচনাপর্বেই অ্যান্ডারসন বলেছেন, “Nationality,  Nation-ness, as well as Nationalism, are cultural artefacts of a particular kind” –  জাতীয়তাবাদ এক বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক নির্মাণ। কিন্তু ইতিহাসে কিভাবে এই নির্মাণের সূচনা হলো, এর অর্থই বা কিভাবে বদলে গেল, সতেরো শতকের শেষদিকে কোন মোড়ে গিয়ে জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রকট হয়ে উঠলো এবং কিভাবে আমাদের অনুভূতির সাথে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক জড়িয়ে পড়লো এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অ্যান্ডারসন তার বইয়ে। জাতীয়তাবাদের কোন সুনির্দিষ্ট ও “বৈজ্ঞানিক” সংজ্ঞার অভাব অনুভব করে অ্যান্ডারসন নৃবৈজ্ঞানিক চিন্তার আলোকে সংজ্ঞা দিয়েছেন, “it is an imagined political community and imagined as both inherently limited and sovereign” – এটি একটি কাল্পনিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যা একইসাথে সীমিত ও সার্বভৌম। (এখানে ‘Community’ শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে ‘গোষ্ঠী’)। 

অ্যান্ডারসন তার সংজ্ঞায় তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদের ধারণা কাল্পনিক, সীমিত ও সার্বভৌম। কাল্পনিক একারণে যে একটা জাতির প্রতিটা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ নেই; একটা জাতির প্রতিটা সদস্য প্রত্যক্ষভাবে একে অপরকে চেনে না, জানে না। কিন্তু তবুও তাদের সকলের মনেই কিছু পারস্পরিক সাদৃশ্য আছে বলে ধারণা করা হয়। এই কাল্পনিকতা শুধু জাতীয়তাবাদেই সীমাবদ্ধ নয়। এমন সকল গোষ্ঠী যেখানে সকলের সাথে সকলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই সেসকল গোষ্ঠীকেও অ্যান্ডারসন বলেছেন ‘Imagine Community’। যেমন- The United States of America, LGBTQ community, The European Union, Online social media networks ইত্যাদি। সীমিত এই অর্থে যে, প্রতিটা কাল্পনিক গোষ্ঠীই একটা সীমানার ধারণায় আবদ্ধ এবং সেই সীমানার বাইরে থাকে অন্য কোন কাল্পনিক গোষ্ঠী। আর সার্বভৌম একারণে যে, ধারণাটির যখন বিকাশ ঘটে (মূলত আঠারো শতকে) তখন এনলাইটেনমেন্ট আর রেভ্যুলেশনের ফলে রাজতন্ত্রের পতন ঘটতে শুরু করে এবং মানুষ একইসাথে “স্বাধীন জাতি” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, কীসের তাড়নায় একটা কাল্পনিক জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে এই ভ্রাতৃত্ববোধ জন্মায় যার কারণে তারা জাতিরক্ষার নামে জীবন উৎসর্গ করতে পারে? অ্যান্ডারসনের মতে, এর উত্তর লুকিয়ে আছে সংস্কৃতির শিকড়ে।

অ্যান্ডারসন ধারণা করেন, সতের শতকের শেষে যখন রাজতন্ত্র ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর পতন ঘটতে থাকে, সেই সুযোগে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। তার আগে মানুষ ধর্মীয় বিধানমতে নিজেদের দুর্ভাগ্যকে ব্যাখ্যা করতো। একটা মানুষ কেন পঙ্গু হয়ে জন্ম নিলো, কেন একজনের সন্তান অন্ধ হয়ে জন্মালো, সেসব প্রশ্নের উত্তর পেতে মানুষ ধর্মীয় বিধানের আশ্রয় নিতো। ইহকালের ও পরকালের ধারণা মেনে নিয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দিতো। কিন্তু আলোকায়নের যুগে যখন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর পতন ঘটে, মানুষ তখন সার্বভৌমত্ব পায়। ধর্মের বাঁধা থেকে সরে আসার ফলে এই সার্বভৌমত্বের ধারণা মানুষকে মুক্তির আশ্বাস দেয়। তারা জাতি হিসেবে মুক্তি চায়। সার্বভৌমত্বের ফলে কালেক্টিভলি মানুষের মধ্যে যে মুক্তির ধারণা জন্মে সেখান থেকে জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের এই ধারণা মানুষের মাঝে এতোটা প্রকট হিসেবে দেখা দেয় যে সবাই যার যার উপর আরোপিত জাতিগত পরিচয়কেই নিয়তি হিসেবে ধারণ করে। অ্যান্ডারসন বলেন, “It is the magic of nationalism to turn chance into destiny”। অর্থাৎ, জন্মেছি বাংলাদেশে তাই আমি বাংলাদেশি – এখানে আমার জন্মস্থান ঘটনাচক্রে নির্বাচিত হলেও আমি যে বাংলাদেশি হবো তাই যেন আমার নিয়তি।

রাজতন্ত্র ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর পতনের পাশাপাশি অ্যান্ডারসন তৃতীয় আরেকটি ফ্যাক্টরকে গুরুত্ব দেন। তিনি মনে করেন গোষ্ঠীকে (community) কল্পনা করার জন্য মধ্যযুগের সমান্তরাল সময়ের ধারণা (simultaneity-along-time) ও অভিন্ন সময়ের ধারণা (homogenic time) সমানভানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ধারণাটির ব্যাখ্যা দিয়ে অ্যান্ডারসন চার্চের কাঠামোগত বর্ণনা এবং যিশুখ্রিষ্টের চিত্রকর্মের উল্লেখ করে। তিনি ব্যাখ্যা করেন মধ্যযুগে চার্চের জানলা কিংবা যিশুর পাশে মা ম্যারির ছবি এক ধরনের কল্পনা তৈরী করে। সেসময় মানুষ বিশ্বাস করতো সময় স্থির; অতীত, বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই; সময় সমান্তরাল ও একরৈখিকভাবে বয়ে চলে এবং এর সমাপ্তিও যেকোন সময় ঘটতে পারে। এই ধারণা থেকে পরবর্তীতে ‘homogenate time’ এর ধারণা আসে। সময়ের এই দুই ভিন্ন ধারণা জগৎকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ধারণ করতে মানুষকে সাহায্য করে। এই ধারণাকে কেন্দ্র করে অ্যান্ডারসন কল্পনার দুটি জনপ্রিয় উৎসকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন। একটি উপন্যাস ও অন্যটি পত্রিকা।

বইয়ে অ্যান্ডারসন একটি উপন্যাসের প্লট তুলে ধরেছেন। ‘ক’ ব্যক্তির স্ত্রী ‘খ’ ও প্রেমিকা ‘গ’। ‘গ’ এর আবার অন্য একজন প্রেমিক আছে ‘ঘ’, যে ‘ক’ এর ব্যাপারে জানে না। এখানে ‘গ’ চরিত্র ‘ক’ ও ‘ঘ’ উভয়ের সাথেই সম্পর্কিত হলেও তাদের মধ্যে কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেনি। কিন্তু তবুও কেন পাঠক তাদের একসূত্রে কল্পনা করেন? প্রথমত, এর কারণ হলো, তারা উভয়েই একই সমাজে বাস করে; একই সমাজে বাস করে বিধায় কল্পনা করে নেওয়া হয় হয়তোবা রাস্তায় হাঁটা চলাতে কখনো তারা একে অপরকে পাশ কাটিয়ে যায়। ফলে তারা একইসূত্রে আবদ্ধ। দ্বিতীয়তো, উপন্যাসের লেখক তাদের উভয়কেই একইসাথে উপস্থাপিত করছে ফলে পাঠকের মনে উভয়েই একইসময়ে কল্পিত হচ্ছে। এখানে এই সবটাই পাঠকের মনের কল্পনা যা এই দুই চরিত্রকে একই গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করে। অ্যান্ডারসন বলেন, জাতীয়তাবাদের ধারণাও অনেকটা সেরকম; এখানেও একটা গোষ্ঠীর প্রতিটা সদস্য একে অপরের সাথে নিজেদের সংযুক্ত হিসেবে কল্পনা করে।

এর আরেকটি উদাহরণ হতে পারে হুমায়ুন আহমেদের বই। একদল মানুষ যারা সবাই হুমায়ুন আহমেদের বই পড়েছেন এবং ‘হিমু’কে চেনেন তারা সবাই হিমুকে চেনার সূত্র ধরে একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ হিমুকে যারা চেনে, তারা একে অপরের সাথে কল্পনার যোগসাজশে পরিচিত। উপন্যাসের ধারণা অথবা আমরা বলতে পারি ‘Rise of books’ এভাবেই জাতীয়তাবাদী ধারণা তৈরীতে অবদান রেখেছে।

অন্যদিকে পত্রিকা নিয়ে অ্যান্ডারসন কল্পনার আরেকটি উদাহরণ দিয়েছেন। একটা দৈনিক পত্রিকা পড়ার সময় আমরা অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা একসাথে পড়ি। প্রথম পাতাতেই থাকে বিভিন্ন ধরনের খবর যেমন- কোন ব্যক্তির দুর্ঘটনা, কারো জমির ফসল নষ্ট হওয়া, কারো স্বর্ণপদক প্রাপ্তি, কারো নির্বাচন জেতা ইত্যাদি। প্রথম পাতা উলটিয়ে যখন আমরা পরের পাতায় আরো বিভিন্ন রকম খবর পড়ি, তখনো কিন্তু আমাদের কল্পনায় আগের খবরগুলোও রয়ে যায়, সেগুলো অতীত হয়না। একইসাথে কল্পনা করতে পারার একটা যৌক্তিক কারণ হলো তারিখ; অর্থাৎ ঘটনাগুলো নির্দেশ করে একই সময়। সবগুলো ঘটনা একইদিনে ঘটেছে যা আমাদের মনে সমান্তরাল কল্পনা তৈরী করে। আরেকটি কারণ হলো পত্রিকা ও বাজারের সংযোগ। বাজারে প্রতিদিন যে পরিমাণ পত্রিকার বেচাকেনা চলে তাতে করে পত্রিকাকে ‘One-day bestseller’ ও হয়তো বলা যায়। একজন ব্যক্তি একটা পত্রিকা কিনে পড়ার সময় কল্পনা করে পত্রিকার বাকি কপিগুলোও তার মতোই আরো কিছু মানুষ পড়ছে। সেই ব্যক্তি যখন দোকানে, অফিসে কিংবা অন্য কোন বাসায় পত্রিকার আরো কপি দেখে তখনো তার মনে কাজ করে যে তারা সবাই একসাথে এই পত্রিকাটা পড়েছে। এই সদৃশ্যতার ধারণাও মানুষকে একই গোষ্ঠীভুক্ত হিসেবে কল্পনা করার সুযোগ করে দেয়।

অ্যান্ডারসনের মতে জাতীয়তাবাদকে “লিবারালিজম” কিংবা “ফ্যাসিজম” এর মতো কোন আদর্শগত চেতনার সাথে তুলনা না করে বরং সংস্কৃতির অংশ অর্থাৎ ‘জ্ঞাতিত্ব’, ‘ধর্ম’ ইত্যাদি ধারণাগুলোর সাথে তুলনা করে বুঝতে হবে। কারণ জ্ঞাতিগোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো জাতীয়তাবাদও একদল মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠা একটা কাল্পনিক গোষ্ঠী। অ্যান্ডারসন আরো একটি বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, কল্পনা করা মানেই কোন কিছু মিথ্যা প্রতিপন্ন করা না। কোন একটা (কাল্পনিক) গোষ্ঠীকে সত্য কিংবা মিথ্যার মান দিয়ে বিচার না করে বরং গোষ্ঠীগুলো কোন ধরনের কল্পনার মাধ্যমে গড়ে উঠছে তাতেই অ্যান্ডারসন বেশি মনোযোগ দিতে চান।

তৃতীয় অধ্যায়ে অ্যান্ডারসন ‘Print capitalism’ ও ‘Sacred language’ এর ধারণা দেন। অ্যান্ডারসনের মতে, জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে তো কেবল আধুনিক যুগে। কিন্তু তার আগে ক্লাসিক্যাল কমিউনিটিগুলোও টিকে ছিল কাল্পনিক যুথবদ্ধতার ভিত্তিতে। যেমন- বাঙালি মুসলমানের কাছে স্যাক্রেড ল্যাঙ্গুয়েজ অর্থাৎ শুদ্ধ ভাষা হলো কুরানের আরবি ভাষা। এখন বাঙালি মুসলমান এই ভাষা জানুক কিংবা না জানুক, আরবি ভাষাভাষী কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হলে তার কথা বুঝুক কিংবা না বুঝুক, শুদ্ধ ভষার ধারণাগত জায়গায় উভয় ব্যক্তির মিল থাকায় তাদের মাঝে একটা কাল্পনিক যোগসূত্রতা তৈরী হয়ে যায়। যা তাদের কাল্পনিকভাবে একই গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু আধুনিক যুগে শুদ্ধ ভাষা কেন্দ্রিক কাল্পনিক গোষ্ঠীর ধারণা বেশিদিন টিকলো না।

সতের শতকের পূর্বে যত বই লিখিত হয়েছে তার ৭৭% লিখিত হয়েছে ল্যাটিন ভাষায়। বিদ্যায়তনে শিক্ষাদান হতো ল্যাটিন ভাষায় এবং শিখানোও হতো একমাত্র ল্যাটিন ভাষা। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সেসময় ল্যাটিন ভাষার সুপ্রিমেসি কতোটা ছিল! কিন্তু আধুনিকতার যুগে এসে ইউরোপবাসী যখন ভৌগোলিক ভাষা বৈচিত্র্যতা সম্বন্ধে জ্ঞাত হলো তখন ল্যাটিন ভাষার আধিপত্য ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগলো। পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে ছাপাকানার মালিকেরা চায়তো এমন কোন ভাষায় বই লেখা যাতে করে তা সকলের বোধগম্য হয় ও বই বিক্রির সংখ্যাও বেড়ে যায়। ফলে ছাপাখানাগুলো আর কেবল ল্যাটিন ভাষায় আবদ্ধ হয়ে রইলো না। সকলের জন্য বোধগম্য ও যা সকলের কথ্য ভাষার সাথে সামঞ্জস্য এমন একটি স্ট্যান্ডার্ড ভাষায় তারা বই ছাপানো শুরু করলো। ফলে ল্যাটিন ভাষাকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের যে কাল্পনিক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল তাতে বিভক্তি দেখা গেল। অন্যদিকে, প্রিন্ট ক্যাপিটালিজমের বিস্তারের ফলে কিছু মানুষের মাঝে যোগাযোগ বাড়লো ও ভাষা কেন্দ্রিক ক্ষমতা গঠন হলো যা তাদের নতুন করে জাতি গঠনের ধারণা দিল।

তারপরের অধ্যায়ে অ্যান্ডারসন উপনিবেশকালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোর কথা বলেছেন। তিনি যুক্তি দেন, আমেরিকায় যেসব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে সেগুলোর নেতৃত্বে ছিল একটা বিশেষ শ্রেনীর জনগোষ্ঠী (অ্যান্ডারসনের ভাষায় Creole class) যারা মূলত ইউরোপিয়ান আমেরিকান, অর্থাৎ আমেরিকা নিবাসী ইউরোপীয় মানুষ। ইউরোপের উপনিবেশিক ভাষার সাথে যারা পরিচিত ছিল তারাই পরবর্তীতে ভিন্ন জাতি গঠনের দাবী তুলে আন্দোলন করে। অন্যদিকে অ্যান্ডারসন দেখান, উপনিবেশিকদের মধ্যে ব্রিটিশরা তাদের স্বতন্ত্র অর্থনীতি ও পত্রিকার বাজার নিয়ে ভৌগোলিকভাবে সংঘবদ্ধ জাতি হিসেবে রয়ে গেলেও স্প্যানিশরা উপনিবেশ ধরে রাখতে পারেনি; বরং স্পেনের উপনিবেশিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে বিপ্লব ঘটে ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠে। এছাড়া ‘প্রাইভেসি’র ধারণা দিয়েও অ্যান্ডারসন বলেন, আমেরিকায় যেহেতু জাতীয়তাবাদের আন্দোলন আগে শুরু হয়েছিল, তার অনুকরণ করে পরবর্তীতে ইউরোপেও জাতীয়বাদের ধারণা প্রকট হয়। তিনি বলেন, সতের শতকে রাজতন্ত্রের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষ যখন জাতীয়তাবাদের চেতনায় সংঘবদ্ধ হতে শুরু করলো, তখন তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার কাছে রাজতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলো। রাজতন্ত্র নিজেই তখন সুর পালটে জাতীয়তাবাদের গান ধরলো যাতে করে জাতীয়তাবাদের মুখোশের আড়ালে থেকে তারা সাধারণ মানুষকে দেশপ্রেমের নামে অনুগত করে রাখতে পারে। অর্থাৎ এখানেও জাতীয়তাবাদ এমন একটা কাল্পনিক ধারণা যা সকলে এক করে; যা সকলকে একই গোষ্ঠীর সদস্য ভাবতে সাহায্য করে। রাজতন্ত্রের মাধ্যমে এই জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাকে অ্যান্ডারসন বলেছেন ‘Official nationalism’।

জাতীয়তাবাদের শেষ ঢেউ আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। তখন আফ্রিকা ও এশিয়ার উপনিবেশিত অঞ্চলগুলো পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তিগুলোকে প্রতিহত করে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের দাবীতে আন্দোলন করে। তারা মূলত পার্শ্ববর্তী স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়বাদী চেতনা থেকে অনুপ্রাণিত হয় যেগুলো আরো আগেই পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত হয়েছে। অ্যান্ডারসন দেখান, কোন সেই শক্তি যা মানুষকে জাতীয়তাবাদের নামে জীবন বাজি রাখতেও প্ররোচিত করে?

অ্যান্ডারসন ‘Inter socialist war’ এর ব্যাখ্যা দেন চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধের উদাহরণ দিয়ে। তিনি বলেন এই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ‘Official nationalism’ এর নেতিনাচক মডেলটির অনুকরণ করছে এবং মার্ক্সিস্ট তত্ত্বকেও ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। এভাবে তিনি আবারো ‘Piracy’ ও ‘Imitation’ এর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জাতীয়তাবাদ বিকাশের ধারণা দেন।

শেষ দুটি অধ্যায় বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে যুক্ত করা হয়। এখানে অ্যান্ডারসন তিনটা ভিত্তির কথা বলেন (census, map, museum) যেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করতে সাহায্য করে। এই তিনটা ভিত্তি – জনগণনা পদ্ধতি, ভৌগোলিক মানচিত্র ও জাদুঘরের নিদর্শন – একদল মানুষকে কাল্পনিকভাবে একই গোষ্ঠীতে অন্তভুর্ক্ত করে। জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রাচীন নিদর্শনগুলো শুধুই নিদর্শন না, বরং সেগুলো একটা পরিচয়ের ভিত্তি নির্দেশ করে, একটা জাতির অতীত ও ইতিহাস নির্দেশ করে। জাতীয়তাবাদ যখন প্রকট হয়ে উঠতে থাকে, তখন জাদুঘরের গুরুত্বও বেড়ে যায়। জাদুঘরে সংরক্ষিত সামগ্রীগুলো রাষ্ট্রের মানুষকে তাদের জাতিগত অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। 

বইয়ের সর্বশেষ সংস্কারে ইতি টানতে গিয়ে অ্যান্ডারসন আরেকটি অধ্যায় যুক্ত করেছেন। শেষ অধ্যায়টির নাম ‘Travel and Traffic: On the Geo-biography of Imagined Communities‘। এখানে লেখক বইটির সমালোচনামূলক কিছু উদ্দেশ্যের কথা জানিয়েছেন। এর একটি হচ্ছে জাতীয়বাদের ধারণা সম্পর্কে টম নাইরনের অবস্থানকে সমর্থন জানানো এবং একইসাথে মার্ক্সিজম ও জাতীয়তাবাদী ধারণার বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরা। আরেকটি মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে পাশ্চাত্যের বাইরে জাতীয়তাবাদী ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা। এছাড়া তিনি অনুবাদজনিত সমস্যার কথাও আলোচনা করেছেন। বইটি ত্রিশেরও অধিক দেশে ও ঊনত্রিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যদিও কেবল ফরাসি ভাষার অনুবাদেই লেখক তৃপ্ত হয়েছেন। বাকি ভাষাগুলোর অনুবাদে বইয়ের কিছু কিছু আলাপের ভাবার্থই বদলে গেছে বলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন।

জাতীয়বাদ ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে আগে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অনেক ধারণা দিয়েছেন। তবে অ্যান্ডারসনের ‘Imagine community’ এর ধারণার মতো বাকি ধারণাগুলো পাঠককে এতোটা আকৃষ্ট করতে পারেনি। সমাজ, রাষ্ট্র ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখিতে অ্যান্ডারসনের বইয়ের তুমুল জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। ২০০৫ সালে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে অ্যান্ডারসন বলেন, এই বইয়ের সাথে তার সম্পর্ক অনেকটা বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মতন। মূল বইয়ে অ্যান্ডারসন নিজেই বলেন, হয়তো এটিই একমাত্র বই যেখানে জাতীয়বাদকে কটাক্ষ করে উপস্থাপন করা হয়নি। বরং তার মতে, জাতীয়তাবাদ একটি চিত্তাকর্ষক মতদর্শেও পরিণত হতে পারে।

ReplyForward