গারোদের জমিতে বন বিভাগের ‘সংরক্ষিত বন’
(এই প্রতিবেদনটির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে মধুপুরের আদিবাসী সংগঠনকর্মী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সদস্যদের কাছ থেকে। তথ্য প্রকাশের পূর্বে তথ্যদাতাদের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।)
টাঙাইলের মধুপুর গারো আদিবাসীর নিবাসকেন্দ্র। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মধুপুরের বনাঞ্চলে তাদের বসবাস। মধুপুরের গারোদের জীবিকার প্রধান উৎসই কৃষি কাজ। মূলত বনাঞ্চলের আবাদি জমিতেই তারা চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গারোদের এই প্রাচীন নিবাস থেকে তাদের উচ্ছেদের কাহিনী আর নতুন কিছু নয়। তবে এর মধ্যেই নতুন করে শুরু হয় ‘সামাজিক বনায়ন’ এর ষড়যন্ত্র।
‘সামাজিক বনায়ন’ মূলত বনবিভাগের একটি প্রকল্প যা প্রায় দুই যুগ ধরে বাস্তবায়িত হয়ে আছে। এই প্রকল্পের ফলে বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী গাছ কেটে আগ্রাসী গাছ রোপণের পরিকল্পনা চলছে। আগ্রাসী গাছ বলতে সেই গাছগুলো বোঝায় যেগুলো রোপণ করলে দ্রুত সময়ে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। যেমন- মেহগণি, আকাশমণী, লণ্ঠন গাছ, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এই গাছগুলো প্রতিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকর।
‘সামাজিক বনায়ন’ কথাটি কোটেশনে ব্যবহার করার নৃবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। নামটি নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত। বন – প্রকৃতির অংশ, আর উদ্যান/বাগান – সংস্কৃতির অংশ। নৃবিজ্ঞানের শাখায় প্রকৃতি আর সংস্কৃতির মধ্যে তফাৎ টানতে গিয়ে শেখানো হয়, প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, যতক্ষণ কোন কিছু আপনা থেকেই সৃষ্টি হয়ে বিরাজ করে এবং সেখানে কোন মানুষের হস্তক্ষেপ থাকে না, ততক্ষণ তা প্রকৃতি। যেমন বন-জঙ্গল-পাহাড়-ঝর্ণা-সমুদ্র এসব প্রকৃতির অংশ। অন্যদিকে, বাগান-উদ্যান-হ্রদ-কৃষিজমি ইত্যাদি সংস্কৃতির অংশ। কারণ এগুলো মানবসৃষ্ট। নৃবিজ্ঞানের এই সংজ্ঞানুসারে বন – তথা প্রকৃতির কোন অংশ – মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষ যদি সৃষ্টি করে তবে তা হবে উদ্যান। অর্থাৎ, ‘সামাজিক বনায়ন’ কর্মসূচি কোনভাবেই মধুপুর শালবনের যে প্রাকৃতিক দশা তার পরিপূরক নয়। বড়জোর একে বলা যায় ‘বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি’।
তবে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যেসব গাছ নির্বাচন করা হয় তার অধিকাংশই আগ্রাসী। শালবনের প্রাচীন গাছগুলো তুলে ফেলে কাগজ ব্যবসা ও বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার কথা চিন্তা করে দ্রুত বর্ধণশীল এই বিদেশী গাছগুলো রোপণ করা হয়। কিন্তু এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শালবনের বাস্তুতন্ত্র, খাদ্যশৃঙ্খল আর প্রতিবেশ ব্যবস্থা। কারণ, সেসব প্রাচীন গাছের মূলে জন্ম নিতো আরো অনেক লতা-গুল্ম-ছত্রাক। সেগুলো আবার বন্যপ্রাণীদের খাদ্যের যোগান দিতো। এছাড়াও এসব প্রাচীন গাছের মূল থেকে আদিবাসীরা তৈরী করতো বিভিন্ন পথ্য যা ছিল তাদের ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যম। কিন্তু ‘সামাজিক বনায়ন’ কর্মসূচি গৃহীত হলে সেসব জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে বিদেশী আগ্রাসী গাছ রোপণ করা হয়। স্ব-মূলে উৎপাটন করে ফেলা হয় প্রাচীন গাছগুলো। ফলে নষ্ট হয় বনের বাস্তুতন্ত্র ও বাধাগ্রস্ত হয় প্রতিবেশ ব্যবস্থা।
মধুপুরে ‘সামাজিক বনায়ন’ কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। মধুপুরে বসবাসরত গারোরা এই কর্মসূচির বিরূদ্ধে অবস্থান করে আসছেন। তাদের অভিযোগ, বন বিভাগ ‘সামাজিক বনায়ন’ কর্মসূচির নামে বনের প্রাচীন গাছ সব উজাড় করে দিচ্ছে। তারা গাছ রোপণের নাম করে গারোদের আবাসস্থল থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে। সময়ে সময়ে গারো আদিবাসীরা আন্দোলন করে ‘সামাজিক বনায়ন’ কর্মসূচির নামে এই বন উজাড় ঠেকিয়ে রেখেছে। তবে বনবিভাগের সাথে তারা কখনো চূড়ান্তভাবে ক্ষমতায় পেরে উঠেনি। বরং যত দিন যাচ্ছে, বন বিভাগের সাথে স্থানীয় গারো আদিবাসীদের সংঘর্ষ ততো বাড়ছে। বর্তমানে সেই সম্পর্ক চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে ছেয়ে গেছে।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা
মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা ও চুনিয়া গ্রামের মাঝামাঝি আমতলী বাইদ নামে একটি জায়গা আছে। বাইদ বলতে আবাদি নিচু জমি বোঝনো হয় যেখানে খাদ্যশস্যের চাষ হয়। অন্যদিকে, উঁচু জমি যেখানে বৃক্ষ রোপণ করা হয় সেগুলোকে বলা হয় চালা৷ মধুপুরের আমতলী বাইদে ৪৫ বিঘা আবাদি জমি রয়েছে। এই জমিতে মধুপুরের গারো আদিবাসীরা কৃষিকাজ করেন। স্থানীয়দের মতে, ১৩টি কৃষক পরিবার বংশ পরম্পরায় এই স্থানে কৃষিকাজ করে আসছেন।
গত ২২শে এপ্রিল – শুক্রবার, রাতের আধারে সেই জমির উপর বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ একটি সাইনবোর্ড বসিয়ে দিয়ে যান। সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সর্ব-সাধারণের প্রবেশ নিষেধ, উন্নয়নমূলক কাজ চলমান”। পরদিন সকালে সাইনবোর্ড দেখার পর আদিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা বলেন, এগুলো সব আদিবাসীদের আবাদি জমি দখল করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সেই সাইনবোর্ড বসানো নিয়ে প্রতিরোধমূলক পোস্ট দেওয়া হয়। গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিৎছিল সাইনবোর্ডটির ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলে সেখানে একজনের মন্তব্যের উত্তরে তিনি বলেন, বন বিভাগের কর্মকর্তারাই আবার রাতের আধারে এই সাইনবোর্ড সরিয়ে নিবেন এবং আদিবাসীদের নামে মামলা ঠুকে দিবেন। মজার ব্যাপার হলো, ঘটনাটি ঘটলোও তাই। শনিবার রাতেই আবার সাইনবোর্ডটি উধাও হয়ে যায়। তারপরদিন বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলার অভিযোগে তিনজন আদিবাসী নেতার নামে মামলা করেন। আন্দোলনকর্মী হিসেবে তাদের মধ্যে লিয়াং রিৎছিল নিজেও অভিযুক্ত।
এই ঘটনার প্রতিবাদে গত ২৫শে এপ্রিল – সোমবার, সাধারণ গারো জনগোষ্ঠী ও তাদের স্থানীয় নেতারা সম্মিলিতভাবে একটি প্রতিরোধ সমাবেশের আয়োজন করেন। মধুপুরের দোখলা চৌরাস্তায় এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তৃতা দেন বাংলাদেশ গারো ছাত্রসংগঠন (বাগাছাস) এর কেন্দ্রীয় সভাপতি জন জেত্রা, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ, গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন (জিএসএফ) এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিৎছিলসহ আরো অনেকেই। তাদের দাবি ছিল আদিবাসীদের আবাদি জমিতে লেক খননের পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে এবং আদিবাসীদের নামে দায়ের করা মামলা তুলে ফেলতে হবে।
ফেসবুকের মাধ্যমে ঘটনাটি জানার পর ‘এন্থ্রোসার্কেল’ এর একজন সদস্য সবিস্তারে ঘটনাটি জানতে লিয়াং রিৎছিলকে ফোন করেন। তিনি বলেন, টাঙাইল মধুপুরের মন্ত্রী-মহোদয় একসময় প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন যে গারোদের বাসভূমি ও আবাদি জমি যেন কেউ দখল করতে না পারে সে ব্যাপারে তিনি সর্বদা তৎপর থাকবেন। কিন্তু তারপরই অন্যান্য সভা সমাবেশের বক্তৃতায় তিনি সুর পালটে ফেলেন। বিভিন্ন মাধ্যমে গারো আদিবাসীরা জানতে পারেন বন বিভাগ আমতলী বাইদের চার একর জমিতে ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে লেক খননের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে আদিবাসীদের আবাদি জমিও অন্তর্ভুক্ত। এই জমিতে যে ১৩টি কৃষক পরিবার আবাদ করেন, তাদের জীবনযাপনের একমাত্র মাধ্যমই এই কৃষিকাজ। কিন্তু তাদের জমিতে লেক খননের যে পরিকল্পনা চলছে সেই বিষয়ে বন বিভাগ তাদের সাথে কোন আলোচনা পর্যন্ত করে নি, কোন আর্থিক ক্ষতিপূরণের কথাও তুলে নি। হুট করেই রাতের আধারে সাইনবোর্ড বসিয়ে দেওয়া হয় আবার হুট করেই তা তুলে নিয়ে আদিবাসী নেতাদের নামে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়।
লিয়াং রিৎছিল জানান, ঘটনাটি যে এভাবে মোড় নিবে তা তিনি আগে থেকেই জানতেন। এগুলো বন বিভাগের পুরনো কৌশল। এধরনের ষড়যন্ত্রের সাথে তারা আগে থেকেই পরিচিত। লেক খননের প্রস্তাবের মাধ্যমে বন বিভাগ যে উন্নয়নের দাবি করছে সেই উন্নয়ন সম্পর্কে আদিবাসীরা কি ভাবছে সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “উন্নয়ন আমরাও চাই, তবে সেটা যেন হয় সকলের জন্যই। কিছু আদিবাসীর আবাদি জমি কেড়ে নিয়ে বিনোদনের জন্য যে উন্নয়ন, সেরকম উন্নয়ন আমরা চাই না।”
বনবিভাগের লেক খননের পরিকল্পনাটিও ‘সামাজিক বনায়ন’ প্রকল্পের একটি অংশ। এর ফলে বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিবর্তে স্থান দখল করে নিবে কৃত্রিম ‘বনায়ন’ ও ‘হ্রদ’। এছাড়াও এর ফলে আবাসভূমি আর আবাদিজমি হারাবে আরো অনেক আদিবাসী কৃষক পরিবার। কিন্তু বনবিভাগের কর্তৃপক্ষের সাথে আর কতোদিন লড়াই করে যেতে পারবে মধুপুরের আদিবাসীরা? গারোরা তাদের আজন্মভূমি মধুপুরের শালবনকে ‘সামাজিক বনায়ন’ এর খপ্পর থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।