ক্রিয়াবাদঃ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

[এনথ্রোসার্কেলের থিওরি সিরিজে এবার ক্রিয়াবাদ নিয়ে লিখেছেন তাসনুভা হিমি]

বিংশ শতকের নৃবিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী ধারার একটি হিসেবে ক্রিয়াবাদকে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানাদি, সম্পর্ক এবং আচরণ সামাজিক ব্যবস্থায় কী ক্রিয়া পালন করে ক্রিয়াবাদ মূলত সেটিরই অনুসন্ধান করে। বলা হয়ে থাকে, বৃটিশ নৃবিজ্ঞানীগণ ফরাসী সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ক্রিয়াবাদের মূল প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরেছিলেন।

১৮৮০ এবং ১৮৯০ এর দিকে আলফ্রেড হ্যাডনের নেতৃত্বে একদল নতুন চিন্তকের আবির্ভাব ঘটেছিল ব্রিটেনে। শরীরতত্ত্ব এবং জীববিদ্যায় প্রশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও হ্যাডন অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন টাইলর, স্পেন্সার এবং ফ্রেজার দ্বারা। ১৮৮০ সালে তিনি ডাবলিনের রয়েল কলেজ অফ সায়েন্সে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু আরো ভালো ক্যারিয়ারের আশায় হ্যাডন ১৮৮৮ সালে নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝামাঝি টরেস স্ট্রেইটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন । কোরাল রিফ নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে সেখানে গেলেও তিনি সেখানকার বয়স্ক অধিবাসীদের কাছে বিভিন্ন গল্প শুনে নৃবিজ্ঞানের প্রতি ব্যাপক আগ্রহী হয়ে পড়েন। 

হ্যাডন ইংল্যান্ডে ফিরে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানের প্রথম লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। হ্যাডন পরবর্তীতে আবারো একটি দল নিয়ে  সেখানে অভিযানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, যার সদস্য ছিলেন  শারীরতত্ত্ববিদ চার্লস সেলিম্যান, মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম রিভার্স, এবং তার শিক্ষার্থী উইলিয়াম ম্যাকডগার ও মেয়ার্স। হ্যাডন এবং তার সহকর্মীগণ মাঠকর্মকে ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও তারা নিজেরা সেসব অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে অনুবাদকের সাহায্যে যোগাযোগ করেছিলেন, তবে তাদের শিক্ষার্থীদের তারা উৎসাহিত করেছিলেন আঞ্চলিক ভাষা শিখতে। হ্যাডন এবং তার সহকর্মীরা টাইলর এবং উনবিংশ শতাব্দীর বিবর্তনবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হলেও, তারা মানব সামাজিক বিবর্তনের গতিপথ নির্ধারণের চেয়ে বিভিন্ন মানুষের বস্তুগত, সামাজিক, শারীরবৃত্তীয় এবং মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার প্রতি অধিক আগ্রহী ছিলেন। 

নৃবিজ্ঞানের ক্রিয়াবাদ সাধারণত দুটি চিন্তাধারায় বিভক্ত, দুইটি ধারাই দুইজন ভিন্ন তাত্ত্বিকের সাথে সংযুক্ত। মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াবাদের সাথে জুড়ে আছে নৃবিজ্ঞানী ব্রোনিস্লো ম্যালিনোস্কির নাম। মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াবাদীদের জন্য, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি একটি সমাজের ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটাতে কাজ করে। বোয়াসের মতো, মালিনোস্কির পদ্ধতিটি ছিল নিবিড় মাঠকর্মের উপর ভিত্তি করে, যেখানে তিনি তার তাত্ত্বিক অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সাতটি মৌলিক মানবিক চাহিদা মেটানোর জন্য সংস্কৃতির প্রাথমিক উদ্ভব ঘটেছে, এগুলো হল পুষ্টি, প্রজনন, শারীরিক আরাম, নিরাপত্তা, চলাচল, বিকাশ ও স্বাস্থ্য। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, কিভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং অনুশীলনগুলি পৃথক জৈবিক বা মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা প্রদান করার সময় সমাজের মসৃণ কার্যকারিতায় অবদান রাখে। উদাহরণ স্বরূপ, তার ১৯২৫ সালের প্রবন্ধ, “Magic, Science, and Religion,”-এ ম্যালিনস্কি আদিম সমাজে চিন্তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং জাদুর মত অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস কিভাবে সমাজকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখে তার সম্পর্কে বলেছিলেন। ৷ শারীরবৃত্তীয় এবং জৈব মনস্তাত্ত্বিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে, মালিনোস্কি তার সংস্কৃতির তত্ত্বকে একটি সার্বজনীন চরিত্র দিয়েছিলেন। কারণ এই চাহিদাগুলি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই পূরণ করা হয়, সেগুলি পূরণ করার জন্য ম্যালিনস্কি  নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক গঠন চিহ্নিত করেছিলেন। দ্বিতীয় স্কুল, কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ নৃবিজ্ঞানী রেডক্লিফ ব্রাউনের সাথে যুক্ত। কাঠামোগত ক্রিয়াবাদীরা ডুর্খেইমের কাজের দ্বারা ব্যাপভাবে প্রভাবিত ছিলেন, তারা বুঝতে চেয়েছিলেন কিভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি একটি সমাজের ভারসাম্য এবং সংহতি বজায় রাখে। কিভাবে সমাজের বিভিন্ন অংশ ক্রিয়া করে পুরো কাঠামোটিকে সচল ও সুস্থিত রাখে, এটি ব্যাখ্যা করা তাদের একটি মূল উদ্দেশ্য ছিল। রেডক্লিফ-ব্রাউন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং অস্ট্রেলিয়ায় মাঠকর্ম করেছিলেন, তবে রেডক্লিফ-ব্রাউন নিবিড় মাঠকর্মের উপর ভিত্তি করে সাংস্কৃতিক বর্ণনার চেয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির তুলনামূলক অধ্যয়ন করে সংস্কৃতির কোনো সাধারণ সূত্র অনুসন্ধানে অধিক আগ্রহী ছিলেন। সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে তা চিত্রিত করার জন্য রেডক্লিফ-ব্রাউনের প্রচেষ্টায় ডুর্খেইমের প্রভাব স্পষ্ট। 

যদিও তিনি তার প্রাথমিক কাজে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, রেডক্লিফ-ব্রাউন পরে অবশ্য ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার কর্মজীবনে তিনি বিশ্বাস করতেন যে সংস্কৃতি একটি বিমূর্ত ধারণা, এবং যেহেতু একটি সংস্কৃতির মূল্যবোধ এবং নিয়মগুলি সরাসরি দেখা যায় না, তাই সংস্কৃতির বিজ্ঞানায়ন করা অসম্ভব। রেডক্লিফ-ব্রাউন তার গবেষণাকে সামাজিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করেছিলেন- যে নীতিগুলি একটি সমাজে ব্যক্তিদের সংগঠিত করে (যেমন আত্মীয়ের সম্পর্ক), যা সরাসরি লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যাপারটিকে বুঝানোর জন্য, রেডক্লিফ-ব্রাউন স্পেনসারের অরগ্যানিক এনালজি ব্যবহার করেছেন (এবং স্পেন্সারের কাছে তার ঋণ স্বীকার করেছেন)। ১৯৩৫ সালে, তিনি লিখেছেন: একটি প্রাণী হলো কোষ এবং আন্তঃস্থায়ী তরলগুলির একটি সমষ্টি, যা কেবলমাত্র একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি সমষ্টি হিসাবে নয়, বরং একটি সমন্বিত জীবিত সমগ্র হিসাবে কাজ করে। এই অংশগুলি যে সম্পর্কগুলির দ্বারা সম্পর্কিত তা হল জৈব কাঠামো। পুরো কাঠামোটিকে এইভাবে সত্তার মধ্যে সম্পর্কের একটি সেট হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সময়ের সাথে সাথে এর উপাদান, অর্থাৎ কোষগুলি একই থাকে না। কিন্তু উপাদান ইউনিটগুলির কাঠামোগত বিন্যাস একই রকম থাকে। 

অর্থাৎ, আমরা যদি মানবদেহকে পুরো একটি শরীর ধরি, তবে এর কোষগুলো হলো ব্যক্তি। কোষের মতো ব্যক্তি মরে গেলেও, পুরো কাঠামোটি প্রকৃতপক্ষে একই থাকে। নৃতাত্ত্বিক তথ্যে এই সাদৃশ্য প্রয়োগ করে, রেডক্লিফ-ব্রাউন যুক্তি দিয়েছিলেন যে সমাজে ব্যক্তিদের অধ্যয়ন করার চেয়ে আত্মীয়তা ব্যবস্থা অধ্যয়ন করা বেশি কার্যকর। কারণ, যদিও মানুষ মারা যায়, আত্মীয়তার কাঠামো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই থাকে। রেডক্লিফ-ব্রাউন দৃষ্টিতে, ব্যক্তিমানুষদের প্রতি ম্যালিনোস্কির জোরপ্রদান আসলে সমাজ পাঠের জন্য যথার্থ নয়। রেডক্লিফ-ব্রাউন বলেছিলেন, যে, ‘মালিনোস্কি গাছ দেখতে গিয়ে বন দেখেননি।’ অর্থাৎ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে কাঠামোকে উপেক্ষা করেছেন। “অন জোকিং রিলেশনশিপস’ লেখাটিতে রেডক্লিফ-ব্রাউন যুক্তি দেন যে, আত্মীয়তা ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকা মানুষের মধ্যে কাঠামোগত সম্পর্ক মানুষকে স্বার্থের দ্বন্দ্বের দিকে নিয়ে যায়। এই ধরনের দ্বন্দ্ব সমাজের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তবে এই সমস্যাটি আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এই ধরনের অবস্থানে থাকা লোকেদের মধ্যে রসিকতা করা বা এড়ানোর মাধ্যমে অনেকসময়ই সমস্যার মোকাবেলা করা হয়। সুতরাং, যখন দ্বন্দ্ব স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে, তখন সমাজ বিরোধীদের মধ্যস্থতা করতে এবং সামাজিক সংহতি রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে।

ক্রিয়াবাদ সম্পর্কে একটি পর্যবেক্ষণ হলো, ক্রিয়াবাদীরা সাধারণত ইতিহাসের প্রতি খুব সামান্য আগ্রহী ছিল। যেখানে এই সময়ে আমেরিকান নৃতত্ত্ব মূলত তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার থেকে সংস্কৃতির পুনর্গঠনের উপর জোর দিয়েছিল, সেখানে ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানীরা সরাসরি নেটিভ সমাজগুলোকে বর্তমান সময়ের পাটাতনে রেখে পাঠ করতে চেয়েছে। এইজন্য তারা অনৈতিহাসিক পাঠপদ্ধতি অনুসরণ করতেন। অনেক ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক মনে করেছিলেন যে, যেহেতু তাদের অধ্যয়ন করা বেশিরভাগ সমাজ নিয়ে লেখিত তথ্যের অভাব ছিল, তাই ঐতিহাসিক পুনর্গঠন আসলে কল্পকাহিনীর চেয়ে বেশি কিছু না। ফলস্বরূপ, ইতিহাসকে বাদ দিয়ে তারা সমাজগুলিকে এমনভাবে পরীক্ষা করেছিল যেন তারা স্থির এবং এইভাবে সামাজিক পরিবর্তনে  অক্ষম ছিল।

ক্রিয়াবাদের সমস্যাগুলি

ক্রিয়াবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাত্ত্বিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। যুদ্ধের ফলে ব্যাপক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে, কিভাবে সমাজগুলি সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে সে বিষয়ে আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে। তা সত্ত্বেও, ম্যালিনোস্কি, রেডক্লিফ-ব্রাউন এবং তাদের ছাত্র ফোর্টেস, গ্লুকম্যানসহ অন্যান্যদের কাজ আধুনিক নৃতত্ত্ববিদদের অনুপ্রেরণা প্রদানের জন্য ব্যাপকভাবে পঠিত হচ্ছে। যদিও খুব কম মানুষই নিজেদেরকে আজ ক্রিয়াবাদী নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে উল্লেখ করবে, তবুও মূল ক্রিয়াবাদী ধারণাগুলি এখনও নৃবিজ্ঞানের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে। 

তথ্যসূত্র

Anthropological Theory: An Introductory History, R. Jon McGee & Richard L. Warms \