থিওরিঃ ম্যালিনস্কি
[এনথ্রোসার্কেলের থিওরি সিরিজে ম্যালিনস্কিকে নিয়ে লিখেছেন খান মাহমুদ]
বিংশ শতকের নৃবিজ্ঞানে অন্যতম শক্তিশালী ধারা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো “ক্রিয়াবাদী” ধারা। মূলত বিবর্তনবাদীদের দেয়া সংস্কৃতির ঐতিহাসিক বিবর্তনের ব্যাখ্যার বাহিরে এসে সংস্কৃতিকে পাঠ করেছিল তারা। তারা সংস্কৃতির প্রতিটি উপাদানকে দেখেছেন আন্তঃসম্পরকিত জালের মতো করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি তারা নিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইমের কাছ থেকে। প্রতিটি উপাদানকে তারা পর্যবেক্ষন করেছেন এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ক পাঠ করার চেষ্টা করেছেন। তবে, তারা সংস্কৃতির টিকে থাকার দিকে নজর দিয়েছিলেন বেশি। অর্থাৎ, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়া কীভাবে সমগ্র সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখে তা পাঠ করতেন ক্রিয়াবাদীরা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজগুলো অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই ধারা অনেকাংশেই সফল হয়েছিলো। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই ধারা তার গুরুত্ব হারাতে থাকে।
ক্রিয়াবাদের সাথে উদ্দেশ্যবাদের সম্পর্ক লক্ষ্যণীয়। উদ্দেশ্যবাদ মনে করে পৃথিবীর সব কিছুই কোন না কোন উদ্দেশ্যে চালিত হয়। ক্রিয়াবাদের কাজেও এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ক্রিয়াবাদী ধারা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো। একটি ম্যালিনোস্কির মনোদৈহিক ক্রিয়াবাদ এবং অপর ধারা র্যাডক্লিফ ব্রাউনের কাঠামোবাদী ক্রিয়াবাদী ধারা। দুটি ধারাই সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত। একদল মনে করে সমাজ বা সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্রিয়া করে ব্যক্তির চাহিদা পূরণ করতে আর আরেকদল মনে করে সমাজ বা সংস্কৃতিকে সমগ্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে। এই লেখায় ম্যালিনোস্কির মনোদৈহিক ক্রিয়াবাদ নিয়েই আলোচনা করা হবে।
ব্রনিস্ল ক্যাস্পার ম্যালিনোস্কি ১৮৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা ছিলেন স্লাভিক ভাষার একজন অধ্যাপক। ম্যালিনোস্কি ক্রাকহফে পদার্থবিদ্যা এবং গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯১০ সালে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকসে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন। সেখানে তার সুপারভাইজার ছিলেন সেলিম্যান। এখান থেকেই তিনি নিবিড়ভাবে এথনোগ্রাফি করার প্রেরণা পান। ম্যালিনোস্কিই নৃবিজ্ঞানে ফিল্ডওয়ার্ক বা মাঠকর্ম প্রবর্তন করেন।
ম্যালিনোস্কি ট্রবিয়ান্ডদের উপর করা গবেষণায় নিবিড়ভাবে তাদের জীবন যাত্রা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেখানে তিনি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলো কিভাবে আন্তঃসম্পর্কিত তা দেখার চেষ্টা করেছেন। তারপর তাদের ধর্ম, অর্থনীতি, যাদু প্রভৃতির কার্যক্রম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। আবার এসব বিষয়ে তিনি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতামত নিয়ে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখার চেষ্টা করেছেন।
‘জাদু’ ম্যালিনস্কি তার ক্রিয়াবাদী ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখান ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপের মানুষজন তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য মাছ শিকারের সময়, অসুস্থতা নিরাময়ের ক্ষেত্রে, কৃষি প্রভৃতিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জাদুর আশ্রয় নিয়ে থাকে। তিনি দেখান সাধারণত যেসব ঘটনা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, কেবল সেসব কাজের ক্ষেত্রে তারা জাদুর সাহায্য নিয়ে থাকে। ম্যালিনস্কির মতে এটি তাদের মানসিক শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। দেখা গেছে যখন তারা সমুদ্রের কাছে কোন খাড়িতে মাছ ধরতে যায় তখন তারা কোন আচার বা জাদু পালন করে না। কিন্তু যখন তারা গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করতে যায় তখন তারা জাদু কেন্দ্রিক বিভিন্ন আচার পালন করে থাকে। এর কারণ সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে যে বিপদের আশঙ্কা থাকে, জাদুচর্চা সেক্ষেত্রে একটি মানসিক নিশ্চয়তা প্রদান করে।
ম্যালিনস্কির ক্রিয়াবাদ কে মনোদৈহিক ক্রিয়াবাদ বলা হয়। অর্থাৎ, তার মতে সমাজ বা সংস্কৃতি ব্যক্তির জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক চাহিদা পূরণে কাজ করে। তিনি মনে করতেন সমাজের প্রতিটি উপাদান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং প্রত্যেকে সামষ্টিকভাবে ব্যক্তির চাহিদা পূরণে কাজ করে। ম্যালিনস্কি মানুষের সাতটি মৌলিক চাহিদার কথা বলেছেন। তার মতে মানুষের জীবন ধারণের জন্য এই সাতটি মৌলিক চাহিদা পূরণ অনিবার্য। এই চাহিদাগুলো পূরণের জন্যই সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়।
মৌলিক চাহিদা — সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া
বিপাক — খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা
প্রজনন — জ্ঞাতিসম্পর্ক
শারীরিক আরাম — আশ্রয়
নিরাপত্তা — সুরক্ষা
চলাফেরা — ক্রিয়াকলাপ
বিকাশ — প্রশিক্ষণ
স্বাস্থ্য — স্বাস্থ্যবিধি
মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য কীভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া হাজির হয় তা ম্যালিনস্কি দেখিয়েছেন। যেমন মানুষের বিপাক বলতে তার খাদ্য গ্রহণ ও বর্জ্য ত্যাগ করাকে বুঝায়। খাদ্য গ্রহনের জন্য খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। উৎপাদিত খাদ্য বণ্টনের জন্য গড়ে উঠে সামাজিক সংঠন। আবার মানুষের যৌন চাহিদা পূরণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য জ্ঞাতিসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মানুষ তার নিরাপত্তার জন্য বাড়ি তৈরী করে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তৈরী করে অস্ত্র ও সেনাবাহীনি। আবার মানুষের বিকাশের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষনের প্রয়োজন পড়ে। যেমন ভাষা শিক্ষা, নৈতিকতা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে এবং পরিবার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তি এসব শিক্ষা লাভ করে।
ম্যালিনস্কির মতে এই চাহিদাগুলো পূরণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ারূপে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়। এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরী হয়। এসব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে নতুন নতুন পরিবেশ এবং নতুন নতুন চাহিদা তৈরী হয়। তার এই চাহিদা পূরণের উপযোগবাদী তত্ত্ব পরবর্তীতে সমালোচনার স্বীকার হয়। কারণ, সংস্কৃতির কেবল চাহিদা পূরণ করে না, এর সাথে ব্যক্তির বিরোধার্থক সম্পর্ক থাকতে পারে। আবার কখনো কখনো কোন সাংস্কৃতিক আচরণ ব্যক্তির উপর নিপীড়নমূলকও হতে পারে। র্যাডক্লিফ ব্রাউনের কাঠামোবাদি ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব আসার পর থেকে ম্যালিনস্কির ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব গুরুত্ব হারাতে থাকে। বর্তমানে মূলত নৃবিজ্ঞানে বিশেষ ধরনের মাঠকর্মের প্রবক্তা হিসেবেই তাকে গুরত্ব দেওয়া হয়।