এথনোমিউজিকোলজিঃ পরিচয়, ইতিহাস ও পদ্ধতি

[এই প্রবন্ধটিতে এথনোমিউজিকোলজি কী সে সম্বন্ধে জ্যঁ কাঁস্ট, অ্যালেন মিরিয়ামসহ  সংগীত নৃবিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও সূত্র বিশ্লেষণপূর্বক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ৷ এ ছাড়াও এথনোমিউজিকোলজির ইতিহাস, হিস্টোরিকাল মিউজিকোলজি ও কম্পারেটিভ মিউজিকোলজি থেকে ধারনা ও কর্মকান্ডগত উপায়ে কেমন করে এথনোমিউজিকোলজি নতুন একটি ডিসিপ্লিন আকারে আলাদা স্বকীয়তা অর্জন করেছে সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে ৷ সংগীত যে কোনো পণ্য নয়, বরং কেন এটি প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে এথনোমিউজিকোলজি ৷ কেন এথনোমিউজিকোলজি এই উত্তর খুঁজতে চায় প্রবন্ধটি তারই নির্দেশনা দেয় ৷ লেখাটি লিখেছেন রায়হান রহমান]

ভূমিকা 

নির্দিষ্ট ভাষাসূত্রে আবদ্ধ কোন নির্দিষ্ট নৃগোষ্ঠীর সংগীত ও সাংগীতিক পরিসরকে অধ্যয়নের মাধ্যমে সেই জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক অবস্থান, সাংগীতিক পরিচয় সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারনা লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি ‘এথনোমিউজিকোলজি’ নামক ডিসিপ্লিনটি ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে সারা পৃথিবীর সংগীত গবেষকদের কাছে নতুন করে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ৷ এথনোমিউজিকোলজির ধারনা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথে সমস্ত বিশ্বেই সংগীত বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় ৷ এই প্রবন্ধটিতে আমি মূলত এথনোমিউজিকোলজি কী, এর পটভূমি এবং পরিসর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করছি ৷

এথনোমিউজিকোলজি কী?

যে শাস্ত্র মানব সম্প্রদায় কেন এবং কিভাবে সাংগীতিক হয়ে উঠেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত পাঠদান করে তাকে এথনোমিউজিকোলজি বলে ৷ এটি সামাজিক বিজ্ঞান (Social Science), মানববিদ্যা (Humanities) এবং জীববিদ্যার (Biological Sciences) মতই আমাদেরকে মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে জৈবিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক এবং নান্দনিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে সাহায্য করে ৷

তবে, উপরে উল্লেখিত ‘সাংগীতিক’ শব্দটি এথনোমিউজিকোলজির ভাষায় সাধারণত কোন গান গাওয়ার মত গুণ বা ক্ষমতাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় না ৷ বরং এখানে ‘সাংগীতিক’ শব্দটি দ্বারা মানুষ কিভাবে সুর তৈরি করে, তার সাথে কেমন করে একক বা দলগত প্রচেষ্টায় গান তৈরি হয় এবং সেই তৈরিকৃত সুর কিভাবে তার ভেতর শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে নির্দিষ্ট অর্থ সামনে আনে এবং কেমন করে সেসব অর্থের আবহ সুস্থিত উপায়ে নতুন নতুন ভাবে আবার আলাদা আলাদা সুর তৈরি করে— সেসব কিছুর সম্বন্ধে অল্প বিস্তর ধারনা দেয় ৷

সাংগীতিক চিন্তা ও কর্ম কথা বলার মতই গুরুত্বপূর্ণ ৷ এজন্যই এথনোমিউজিকোলজিস্টরা দাবি করেন, পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠার জন্য সংগীত একটি অপরিহার্য ব্যাপার ৷ তারা বিশ্বাস করেন, যদি আমরা আমাদের মানবতাকে(Humanity) আমাদের সংগীত(Musicality) দিয়ে জানার চেষ্টা করি তবেই বোঝা যাবে কেন মানবিক হতে গেলে সংগীতকে প্রয়োজন ৷ মূলত এ জন্যই সব ধরনের সংগীতের প্রতিই সমানভাবে গুরুত্ব আরোপ করে এনথোমিউজিকোলজি তাদের সম্বন্ধে সম্যক ধারনা নেয়ার কথা বলে ৷ কারণ মানব সম্প্রদায় কেন এবং কিভাবে সাংগীতিক হয়ে উঠেছে তা খুব সহজেই এক দু’পাতা সংগীতের ইতিহাস বা কয়েকটা গান শুনেই বুঝে ফেলা সম্ভব নয় ৷ এর জন্যই পৃথিবীর সাংগীতিক যে সবকিছুর সাথে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক সম্পৃক্ততার বিষয় জড়িয়ে আছে এথনোমিউজিকোলজিতে তা গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করা হয় ৷ এথনোমিউজিকোলজিস্টরা কখনোই নিজেদের রুচির উপর ভাল-মন্দ নির্ধারক পূর্বক গবেষণা শুরু করেন না ৷ বরং পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানুষ সৎ আগ্রহ নিয়ে কোন সুর বা গান শোনে বা চর্চা করে সেই সুর বা গানকেই পাঠের জন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে থাকেন ৷

তাই অন্য ভাবে বলা যায়, এথনোমিউজিকোলজি মূলত বিশ্ব সংগীতের পাঠবিষয়ক শাস্ত্র ৷ তবে এই কথাটি এথনোমিউজিকোলজিতে কী পড়ানো হয় সে সম্বন্ধে বলতে পারলেও এর পরিসর এত বেশি বিস্তৃত কেন, সে সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ কোন ধারনা দিতে পারেনা ৷ এথনোমিউজিকোলজির পরিসর বিস্তৃত কারণ এটি মানুষের প্রকৃতি কেমন ও সংগীতের প্রকৃতি কেমন এই ধরনের বড় বড় ব্যাপারে উত্তর হাজির করতে চায় ৷ ব্রিটিশ এথনোমিউজিকোলজিস্ট জন ব্লেকিং (১৯২৮-৯০) তার ‘How Musical Is Man?’ বইয়ে বলেছেন —

“In  this  world  of  cruelty  and  exploitation…it  is  necessary  to  understand  why  a madrigal  by  Gesualdo  or  a  Bach  Passion,  a  sitar  melody  from  India  or  a  song  from Africa,  Berg’s  Wozzeck  or  Britten’s  War  Requiem,  a  Balinese  gamelan  or  a Cantonese  opera,  or  a  symphony  by  Mozart,  Beethoven,  or  Mahler  may  be profoundly  necessary  for  human  survival,  quite  apart  from  any  merit  they  may have  as  examples  of  creativity  and  technical  progress.  It  is  also  necessary  to explain  why,  under  certain  circumstances,  a  “simple”  “folk”  song  may  have  more human  value  than  a  “complex”  symphony.”

সব ধরনের সংগীতে জ্ঞানার্জনের ফলে কেমন করে মানুষের ইতিহাস সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যাবে ব্লেকিং এর উক্তিটিতে সেই ইশারা লুকিয়ে আছে ৷

‘How Musical Is Man’ এর প্রচ্ছদ

তো এথনোমিউজিকোলজি মূলত তিনটি গ্রীক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি শব্দ ৷ শব্দ তিনটি যথাক্রমে: Ethnos, Mousikē, and Logos.

তিনটি শব্দ ধরে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পুরো ব্যাপারটিকেই আরো সহজে ব্যাখ্যা করা যাবে ৷

প্রথমেই ‘Ethnos’ শব্দটি নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ প্রাচীন গ্রীসে Ethnos শব্দটি দ্বারা কোন নির্দিষ্ট জাতি, বর্ণ (Race) বা মানবগোষ্ঠীকে (Tribe) বোঝানো হত ৷ এথনিক গ্রুপ,এথনিক মাইনরিটি বা এথনিক মিউজিক এই শব্দগুলোতে যে ‘Ethnic’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে এটিও ‘Ethno’ শব্দটি থেকেই তৈরি হয়েছে ৷ এ থেকে বোঝা যায় যে এথনোমিউজিকোলজি বলতে কোন নির্দিষ্ট জাতি বা জনগোষ্ঠীর (Ethnos) সংগীত (Mousikē) সম্পর্কে জ্ঞান (logos) আহরণকে নির্দেশ করা হয়, বিশেষ করে যারা একই ধরনের ভাষা ও সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছে ৷ 

এই ধারনার উপরেই আমরা দেখি জ্যঁ কাঁস্ট (১৮৯১-১৯৬০) ১৯৫০ সালে তার বই “Musicologia:  A  Study  of  the  Nature  of Ethno-musicology,  Its  Problems,  Methods,  and  Representative  Personalities” এ এথনোমিউজিকোলজি শব্দটির অবতারণা ঘটিয়েছেন ৷ বইটিতে এথনোমিউজিকোলজির ব্যাখ্যায় কাঁস্ট দেখিয়েছেন মিউজিকোলজি ও এথনোলজির সমন্বয় কিভাবে এথনোমিউজিকোলজিকে একটি ডিসিপ্লিন হিসেবে তৈরি করেছে ৷ যদিও মিউজিকোলজি ও এথনোলজি দুটি স্বতন্ত্র ডিসিপ্লিন হিসেবেই ১৮৮৫ ও ১৭৮৩ থেকে সর্বজন স্বীকৃত ৷ মিউজিকোলজি বলতে সংগীতের অধ্যয়নকে এবং এথনোলজি বলতে  মানুষের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক  বৈচিত্র্যতা বিষয় তুলনামূলক অধ্যয়নকে বোঝানো হয় ৷ সে আলোকেই কাঁস্ট বলেছেন এথনোমিউজিকোলজি মূলত, ভিন্ন ভিন্ন মিউজিক্যাল এথনোগ্রাফিতে, ভিন্ন ভিন্ন সাংগীতিক আবহের বৈচিত্র্যতা বিষয়ক তুলনামূলক আলোচনা ৷

কাঁস্টের এই আলাপ তৎকালীন এথনোমিউজিকোলজিস্ট যারা মরিয়া হয়ে মানব সম্প্রদায় কেন এবং কিভাবে সাংগীতিক সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন তাদেরকে মাঠপর্যায়ে, এথনোগ্রাফিক ফিল্ডওয়ার্ক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খানিকটা আশার আলো দেখিয়েছিল ৷ মাঠ পর্যায়ে এই প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির উপর গবেষণা চালিয়ে কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে সংগীতের অবস্থান খোঁজা হয়েছে, খোঁজা হয়েছে কোন কোন জনগোষ্ঠীর সংগীত সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য । ১৯৬০ সালে এই ডিসিপ্লিনেরই আরেকজন বড় মুখ অ্যালান মিরিয়াম এথনোমিউজিকোলজি সম্বন্ধে বলেন — “[T]he  study  of  music  in culture.” কিন্তু এই কথা লিখতে গিয়ে দু তিন লাইন পরেই তিনি আবার এই প্রবন্ধের শুরুর আলাপটির কাছে ফেরত আসেন যে এথনোমিউজিকোলজি হলো,  “[T]he  study  of  music  as a  universal  aspect  of  man’s  activities.”

এখানেই সমস্যাটি তৈরি হয় ৷ সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে মানুষ আলাদা হলেও (culturally particular),  বৈশ্বিক সার্বজনীনতাও (Humanly Universal) আছে তার৷ এই যে দুইরকম দুটি অবস্থান- এটি সবসময়ই এথনোমিউজিকোলজিস্টদের একধরনের টানাপোড়নে রাখে৷ 

এ বিষয়ে আরেকটি জায়গায় একটু আলোকপাত করা জরুরি ৷ এথনোমিউজিকোলজি মূলত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সংগীত বিষয়ক অধ্যয়ন ৷ তবে জনগোষ্ঠীর যে ধারনা সেটি কিন্তু আর আগের মত নেই ৷ জনগোষ্ঠী বলতে সাধারণত কী বোঝায়? বোঝায় একটি সমাজে কিছু মানুষের বসবাস, দলবদ্ধভাবে এক ধরনের কাজ করে এমন একটা ছবি ৷ কিন্তু আধুনিক সময়ে সমাজের ধারনা দ্রুতই পাল্টে যাবার সাথে সাথে মানুষ নিজের সুবিধার জন্য তার শেকড় ছেড়ে কেবলই শহরমুখীতার দিকে ঝুঁকছে ৷ শহর হয়ে উঠেছে মাল্টি কালচারাল স্পেইস এক্সচেঞ্জের কেন্দ্রবিন্দু ৷ শহরে গ্রাম ফেরত মানুষেরাই নিজেদের প্রয়োজনে গড়ে তুলছে আলাদা আলাদা সমাজ ও সংস্কৃতি ৷ তাদের নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতিকে মূল ধরেই এই নতুন সাবকালচারাল বা মাইক্রোকালচারাল অবস্থায় মানুষ অবস্থান করে ৷ এই নতুন অবস্থানে মানুষের একত্রিত হওয়াটাও যে সংগীত সংস্কৃতিরই একটা বিরাট অংশ তার প্রতি এথনোমিউজিকোলজি সবসময়ই শক্ত অবস্থানে ৷

গ্রীক ‘Mousikē’ শব্দটি থেকে ইংরেজি ‘Music’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে যার দ্বারা সুস্থিত সুর প্রক্রিয়ার শ্রুতিমধুর শিল্পকে বোঝানো হয় ৷ এথনোমিউজিকোলজিস্টরা যেহেতু পুরো পৃথিবীর সংগীত বৈচিত্র্যতার উপর কাজ করেন সংগীতের উপরিউক্ত সংজ্ঞাটা তাদের চিন্তাপ্রক্রিয়ায় সমস্যার সৃষ্টি করে ৷

বর্তমানে ‘সংগীত’ শব্দটিকে এত সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়- যেহেতু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এর বোঝাপড়ার পরিসর ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে ৷ একসময় শুধুমাত্র যেমন মেলডি,হারমনি,রিদমের উপর প্রতিষ্ঠিত সুস্থিত শব্দ প্রক্রিয়াকে সংগীত বলা হত, কিন্তু আধুনিক সংগীত পরিক্রমায় সংগীতের পরিসর শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয় ৷ র্যাপ সংগীতের কথাই ধরা যাক ৷ সুস্থিত রিদমিক আবহকে ভিত্তি করে স্পষ্ট ভাষায় ভাবের আবহকে প্রকাশ করবার পুরনো যে সাংগীতিক রীতি আমরা দেখতে পাই, র্যাপ সংগীত একদমই তার মত নয় ৷ কিন্তু সারা বিশ্বের অসংখ্য র্যাপ মিউজিকের শ্রোতা আছে যারা গান বলতে শুধু র্যাপ মিউজিককেই বুঝে থাকে ৷ বিখ্যাত আমেরিকান কম্পোজার জন কেইজ (১৯১২-৯২) এর একটি কম্পোজিশন আছে 4′ 33″  (১৯৫২) নামে যেখানে পিয়ানিস্ট একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোন কর্ড না বাজিয়ে পিয়ানোর সামনে শুধু বসে থাকেন ৷ আবার জন ব্লেকিং এর মতে, সংগীত শুধু মাত্র মানব উদ্ভূত ব্যাপার- এ কথাটিও পুরোপুরি সঠিক নয় ৷ পাখির গান বা নীল তিমির গান বলতে যেসব উপমার কথা শোনা যায়, সেইসব পশুপাখি উদ্ভূত সুস্থিত শব্দমালা তবে কি সংগীত নয়? তাই ইউরো-আমেরিকান সংস্কৃতির আয়না দিয়ে সংগীত কি এ সম্বন্ধে পুরোপুরি ধারনা পাওয়া যায় না ৷

এথনোমিউজিকোলজিস্টরা জানতে পেরেছেন কৃষিজীবি সমাজ ব্যবস্থার মানুষেরা, যারা কাজের প্রয়োজনে দিনের অধিকাংশ সময় বাইরে কাটাতেন, তারা পশুপাখির ডাকের সাথে ও প্রকৃতি উদ্ভূত বিভিন্ন শব্দের সাথে এমনভাবে গলা মেলাতেন যেন বা মানুষ প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গাইছে এমনটি মনে হত ৷ এথনোমিউজিকোলজিস্টরা এটুকু বলেই থেমে যান না, তারা সেই যে শব্দ যা থেকে মানুষ সুর শিখল সেই শব্দের উপর জোড় দিতে পরামর্শ দেন ৷ 

এ থেকে পরোক্ষভাবে বোঝা যায় সংগীত ও অন্যান্য পারফর্মিং আর্টস অর্থাৎ নৃত্য,কবিতা বা থিয়েটার — এগুলো সার্বজনীন (Universal) নয় ৷ সংগীত পৃথিবীর একেক অঞ্চলে একেক রকম ৷ আফ্রিকান বান্টু ভাষীরা যেমন সংগীত বলতে নাচ, তালি, উলু বাজানোকে মনে করে থাকেন ৷ কোন কোন জায়গায় পশ্চিমে সংগীতকে যেমন দেখানো হয়েছে তেমন করে না দেখে বরং বেশ নিচু চোখে করে দেখবার প্রবণতা দেখা যায় ৷ ইসলাম ধর্মের কথাই বলা যাক ৷ বাদ্যসহ গানকে নিষিদ্ধ চর্চা বলা হলেও বাদ্যবিহীন সুর বা জিকির(Chanting)কে ইতিবাচক ধর্ম সংস্কৃতি হিসেবে প্রমোট করা হয়েছে ৷ আবার বুলগেরিয়ায় সংগীত বলতে শুধু বলা হয়েছে যন্ত্রসংগীতের কথা বা বাংলাদেশের বাউলেরা গানকে দেখেছেন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক সাধনার অন্যতম উপাদান হিসেবে ৷

‘সংগীত’ শব্দটির আরো একটি বড় সমস্যা হল সংগীত দ্বারা কোন প্রসেস বা প্রক্রিয়াকে না বুঝিয়ে সবসময় একে প্রোডাক্ট বা পন্য হিসেবে বোঝানো হয় ৷ এই কারনে এথনোমিউজিকোলজি টার্মটি শুরু হওয়ার প্রাথমিক দিনগুলোতে শুধুমাত্র পুরোপুরি নোটেশনভিত্তিক সাংগীতিক উপাদান ও কাঠামোর দিকে নজর দেয়া হত ৷ এই ধরনের গবেষণায় যদিও শুধুমাত্র গানটা বাদে কোনো সাংগীতিক পরিবেশে উপস্থিত শ্রোতাদের উপস্থিতির কারণ বা উপস্থিতির পেছনের উদ্দীপনা তাদের উপর কি প্রভাব ফেলেছে সে নিয়ে খুব বেশি কোন ধারনা দিতে পারেনা ৷

একটা সাংগীতিক উপাদান (Musical Product) কিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক, শারীরিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক গতিময়তার ভেতর তৈরি হয় তা বোঝার জন্য শুধুমাত্র বিশেষ্য অর্থে একটি গানকে ব্যাখ্যা করা বাদ দিয়ে ‘To Music’ বা তা তৈরি করবার পুরো প্রক্রিয়াটিকে যাকে  ‘Musicing’ বলা হয়েছে তার উপর জোর দেয় এথনোমিউজিকোলজি ৷ এ কারনে জেফ টড টাইটন একে (Ethnomusicology) ” The study of people making music” নামে অভিহিত করেছেন ৷

এতে করে একটি গানকে শুধুমাত্র তার গাওয়ার ঘটনা দিয়ে বিবেচনা না করে দৃষ্টিভঙ্গিগত, ধারনাগত, আবেগ সংক্রান্ত, যৌক্তিক অবস্থান দিয়ে ভাবনার অবকাশ উন্মুক্ত হয় ৷

ক্রিস্টোফার স্মলের ‘Musicking’ বইটিতে সর্বপ্রথম সংগীতকে বস্তুবাচক ধারনার বাইরে নিয়ে গিয়ে কর্মকান্ডবাচক ধারনায় স্থান দেয়া হয়েছে ৷ তিনি ‘Musicking’ নামক নতুন শব্দটি দ্বারা সংগীত বিষয়ক এমন চিন্তা বা ধারনাকে বোঝাতে চেয়েছেন যে চিন্তা বা ধারনা মানুষ শুধু যখন কোন সুর বাজায় বা তৈরি করে সে বাজানো বা তৈরিকৃত সুরের প্রতিই সীমাবদ্ধ না থেকে বরং অন্য কারো সুর মানুষের মনে কেমন প্রভাব ফেলে, সে প্রভাবের বিষয়েও আলাপ হাজির করবে ৷সে আলাপ ধরে এগিয়ে মানুষ কতটা সাংগীতিক এই উত্তর যদি পেতে হয় তবে তা পেতে সহজ হবে যদি মানুষ কেমন করে সংগীতকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবে উপলব্ধি করে, তৈরি করে, ব্যাখ্যা করে, সাড়া প্রদান করে তা খুঁজে বের করা যায় ৷

সংগীত কী, এটি পণ্য না প্রক্রিয়া এ নিয়ে যেমন অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, তেমনি এথনোমিউজিকোলজিস্টরা কোন ধরনের সংগীতের উপর পড়াশোনা বা গবেষণা করেন এটি নিয়েও নানারকম প্রশ্ন শোনা যায় ৷ যদি এই ফিল্ডের লক্ষ্য হয় মানুষের সংগীতময়তাকে অনুধাবন করা এবং কিভাবে ও কেন মানুষ সাংগীতিক-  তবে এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হওয়া উচিত এথনোমিউজিকোলজিস্টরা পৃথিবীর সবধরনের সংগীতকেই নিজেদের গবেষনার অন্তর্ভুক্ত মনে করেন ৷ যদিও জ্যঁ কাঁস্ট এর পরিসীমার লাগাম টেনে দিয়ে বলেছিলেন—

” The  study-object  of  ethnomusicology,  or  as  it  was  originally  called:  comparative musicology,  is  the  traditional  music  and  musical  instruments  of  all  cultural  strata  of mankind,  from  the  so-called  primitive  peoples  to  the  civilized  nations.  Our  science, therefore,  investigates  all  tribal  and  folk  music  and  every  kind  non-European  art music.…  European  art-  and  popular  (entertainment-) 

music  does not  belong  to  its field.”

যদিও এই লাগাম টানা উচিত নয় কারণ অধিকাংশ এথনোমিউজিকোলজিস্টরা যখন সংগীতকে সার্বজনীন প্রেক্ষাপট থেকে দেখবার চেষ্টা করছে তখন কাঁস্টের ফিল্ড থেকে কিছু কিছু উপাদান আলাদা করে বাদ দেয়া এর সার্বজনীনতাকে অস্বীকার করারই নামান্তর ৷ 

এই সার্বজনীনতা ধরে রেখে প্রিমিটিভ রুরাল মিউজিকের পাশাপাশি আজকের পপুলার মিউজিককে ভিত্তি করে গড়ে উঠা আধুনিক সংগীত প্রজন্মকে নিয়েও এথনোমিউজিকোলজি পাঠ করতে চায় ৷ 

গ্রীক শব্দ Logos দ্বারা কোন কারণ,যুক্তি বা ডিসকোর্সকে বোঝানো হয় ৷ -Ology প্রত্যয়টি ইংরেজি ভাষার অনেক স্বনামধন্য ডিসকোর্সের নামের সাথেই জড়িয়ে আছে ৷ সুতরাং শাব্দিক অর্থে এথনোমিউজিকোলজি সংগীতেরই একটি ডিসকোর্স ৷ যদিও এই আলাপ মিউজিকোলজি (Study of european art music) থেকে এথনোমিউজিকোলজিকে আলাদা করতে পারেনা ৷ তবে এটি এথনোমিউজিকোলজির চর্চার উপর কোন দ্বিবিভাজন সৃষ্টি করে না ৷ কারণ এথনোমিউজিকোলজির পরিসরে এখন স্কলারদের যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়, তেমনি পারফর্মাদের উপরও আলাদা গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ৷ তাই বলা যায়,

“Ethnomusicology  is  the  comparative  study of human  musical  diversity  based  on  fieldwork  and musical  ethnography. “

বা 

“Ethnomusicology  is  an  academic  discipline  based  on  reasoned  discourse  in  words  about  the  full range, in  all  places  and  time  periods, of human  music  and music  making.”

ইতিহাস

নাম আকারে এই (এথনোমিউজিকোলজি) ফিল্ডটি ১৯৫০ সালের দিকে বিকাশ লাভ করলেও, কম্পারেটিভ মিউজিকোলজি নামে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই এর অস্তিত্ব ছিল ৷ উনিশ শতকের ইউরোপিয়ান ন্যাশনালিজমের সাথে কম্পারেটিভ মিউজিকোলজির সংযুক্তি সাধারণত ইউরোপের বাইরে পৃথিবীর অন্য নানান অঞ্চলের সাংগীতিক আবহকে বোঝাপড়ার জন্য দেখা যেত ৷ ১৮৮৫ সালে অস্ট্রিয়ান স্কলার গুইডো এডলার(১৮৫৫-১৯৪১) কর্তৃক মিউজিকোলজির ফিল্ড প্রতিষ্ঠা হয় ৷ তিনিই সর্বপ্রথম হিস্টোরিকাল মিউজিকোলজি ও কম্পারেটিভ মিউজিকোলজিকে দুটি আলাদা আলাদা শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে হিস্টোরিকাল মিউজিকোলজিতে শুধুমাত্র পশ্চিমা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের উপরেই গুরুত্ব দেয়া হত ৷

কার্ল স্টাম্ফ (১৮৪৮-১৯৩৬) ছিলেন গোড়ার দিককার একজন কম্পারেটিভ মিউজিকোলজিস্ট যিনি ১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার আদিবাসীদের উপর প্রথম মিউজিক্যাল এথনোগ্রাফি রচনা করেন ৷ কম্পারেটিভ মিউজিকোলজিস্টরা প্রাথমিক ভাবে যেকোন সাংগীতিক উপাদানের উৎপত্তি ও চর্চা সংক্রান্ত বিবর্তন নিয়ে সচেতন থাকতেন ৷ ডারউইনের সমাজবাদী ধারনার প্রতি পক্ষপাতিত্ব রেখে তারা মনে করতেন অপশ্চিমা সমাজের সংগীত, পশ্চিম ইউরোপের সংগীতের তুলনায় কম জটিল এবং গাঠনিক দিক থেকে ইউরোপীয় সংগীত জটিলতার তুঙ্গে অবস্থান করে ৷ সংগীতের ছড়িয়ে পড়া বা চলাচলের প্রতিও তাদের আকর্ষণ ছিল ৷ সেসিল শার্প(কিংবদন্তী ব্রিটিশ ফোক ব্যালাড সংগ্রহকারী), ফ্রান্সিস ডেসমোর (কিংবদন্তী আদিবাসী সংগীত সংগ্রাহক) এর মত প্রথিতযশা ফোকলোরিস্টদের এই শাখার প্রবাদপুরুষ গণ্য করা হয় ৷

কম্পারেটিভ মিউজিকোলজি বাদ্যযন্ত্রের ধরন  বাজানোর প্রক্রিয়ার উপরও তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ৷ ১৯১৪ সালে জার্মান স্কলার কুর্ট সাকস এবং এরিখ ভন হর্নবস্টেল বাদ্যযন্ত্রের প্রকার নিয়ে যে বিভক্তিকরণ দেখিয়েছিলেন, এখনো সে নিয়মেই বাদ্যযন্ত্রের প্রকারভেদকে চিহ্নিত করা হয় ৷ অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র ৪ প্রকার ৷ তৎ বাদ্য যা তার দিয়ে নির্মিত হয় ; যথা: গীটার,দোতারা ইত্যাদি ৷ শুষির বাদ্য, যা বাতাসের সাহায্যে ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয় ; যথা : বাঁশি ৷ আনদ্ধ বাদ্য, যা পশুর চামড়ায় তৈরি হয় ; যথা : ঢোল,ড্রামস ইত্যাদি এবং ঘনবাদ্য বা ঘর্ষণবাদ্য , যা ধাতব ঘর্ষনে বাজাতে হয় যথা মন্দিরা বা ঝুনঝুনি ৷

১৯৫০ সালের দিকে ডাচ মিউজিকোলজিস্ট জ্যঁ কাঁস্ট মিউজিকোলজি ও এথনোলজির সমন্বয়ে এথনোমিউজিকোলজি নামক নতুন একটি টার্মের দিকে অগ্রসর হন ৷ টার্মটিকে চার্লস সীগার, অ্যালান মিরিয়ামের মত মিউজিকোলজিস্ট ও এন্থ্রোপলজিস্টরা সামনে এগিয়ে নিয়ে ১৯৫৫ সালে “Society for Ethnomusicology” ও ১৯৫৮ সালে “Ethnomusicology” জার্নালের প্রতিষ্ঠা করেন ৷ ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এথনোমিউজিকোলজির উপর ১৯৬০ সালে প্রথম স্নাতক প্রোগ্রাম শুরু হয় ৷

নামের পরিবর্তন এই ফিল্ডে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে ৷ এথনোমিউজিকোলজি কোনো সাংগীতিক উপাদানের উৎপত্তি ও বিবর্তন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে সংগীতকে তুলনামূলক চর্চাগত স্থান থেকে ভাবতে শুরু করে ৷ সংগীত যে ধর্ম,ভাষা ও খাদ্যের মতই দৈনন্দিন মানবিক কর্মকান্ডের একটা অংশ এই নতুন ফিল্ড তার উপরেই গুরুত্বারোপ করে ৷ সোজা কথায় ফিল্ডটি দিনকে দিন নৃতাত্ত্বিক হয়ে উঠতে থাকে ৷ অন্তত ১৯৬৪ সালে অ্যালেন মিরিয়াম রচিত “Anthropology of Music” বইটি পাঠ করলে এ সংক্রান্ত নির্দেশনাই পাওয়া যাবে ৷ তখন থেকেই সংগীতকে শুধুমাত্র গাওয়া(সুর) বা লেখা(স্টাফ)র জায়গা থেকে না ভেবে বৃহত্তর সমাজব্যবস্থায় এর তৈরি প্রক্রিয়ার ভেতর ভাবতে পারার অবকাশ চালু হয় ৷ এই কারনে এথনোমিউজিকোলজিতে ফিল্ডওয়ার্ককে প্রচন্ড গুরুত্বের চোখে দেখা শুরু হয় যাকে কম্পারেটিভ মিউজিকোলজিস্টরা তুলনামূলক কম গুরুত্বই দিতেন ৷

বিশ শতাব্দীর শেষের দিকে এথনোমিউজিকোলজি শুধুমাত্র ট্রেডিশনাল নন ওয়েস্টার্ন মিউজিককে নিজেদের পরিসর না বানিয়ে পপ আবহের সমস্ত জনপ্রিয় সাংগীতিক ধরনকেও নিজেদের গবেষণার আওতাভুক্ত করেছে ৷ এখন জাভাদেশীয় গ্যামলান,হিন্দুস্থানী ক্ল্যাসিক্যাল,আফ্রিকান ড্রামিং সহ র্যাপ,সালসা,রক,আফ্রো পপ,ইডিএম নিয়েও এথনোমিউজিকোলজি পাঠ করে ৷ সাম্প্রতিক নানা ঘটনা যেমন বিশ্বায়ন, অভিবাসন, মিডিয়া,টেকনোজি,সামাজিক বিরুদ্ধতা কেমন করে সাম্প্রতিক সংগীত তৈরি প্রক্রিয়ায় প্রভাব রাখছে তা নিয়েও এথনোমিউজিকোলজি গবেষনা করে ৷ এখন বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই সংক্রান্ত গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম আয়োজন করছে ।

এথনোমিউজিকোলজি যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চায়

এথনোমিউজিকোলজিস্টরা মোটামুটি বড় একটি পরিসর নিয়ে কাজ করে থাকেন ৷ পুরো পৃথিবীর সংগীত তথা মিউজিক্যাল প্র্যাকটিস তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ৷ মাঝে মাঝে মিউজিকোলজিকে অপশ্চিমা দেশসমূহের সংগীত অধ্যয়নের শাস্ত্র বলা হয়, যাকে World Music নামে অভিহিত করা হয়েছে ৷ এথনোমিউজিকোলজি এখানেই মিউজিকোলজি থেকে আলাদা, কারন মিউজিকোলজি হচ্ছে পশ্চিমা ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত বিস্তারিত অধ্যয়নের শাস্ত্র ৷ বিষয়বস্তুর চেয়ে কখনো কখনো এই শাস্ত্রে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় ৷ এই কারনে ফোক থেকে পপ, সমস্ত শ্রেণী(class)র মানুষের সংগীত চর্চার বিষয়বস্তু,পরিবেশ,মনস্তত্ত্ব নিয়েই এথনোমিউজিকোলজি কাজ করে থাকে ৷

গবেষণার জন্য এথনোমিউজিকোলজিস্টরা সাধারণত যে ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন তা নিম্নরূপ : 

※ কোনো একটি সংগীত যেই ভৌগোলিক পরিমন্ডলে তৈরি হয়েছে সেটি সেই অঞ্চলের সংস্কৃতিতে কেমন প্রভাব তৈরি করেছে?

※ কোনো একটি সংগীতকে , কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী কোন চোখে দেখছে ? এই সামাজিক না রাজনৈতিক নাকি ধর্মীয় অবস্থানগত? বা এই সংগীতটি ঐ নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করছে কি না ?

※ কোন একটি সমাজে সেখানকার সংগীত তৈরির সাথে সম্পর্কিত মানুষেরা কেমন ভূমিকা পালন করেন?

※ কিভাবে সংগীত পরিবেশনের ধরন আলাদা আলাদা শ্রেণী, জাতিগোষ্ঠী, সমাজব্যবস্থা, লৈঙ্গিক পরিচয়কে প্রতিনিধিত্ব করে ?

এথনোমিউজিকোলজি যেভাবে উত্তর খুঁজে

এথনোমিউজিকোলজি দেখায় কোনো বৃহত্তর কম্যুউনিটি বা সংস্কৃতির উপর সংগীত কেমন করে সূক্ষ্ণ নানান অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করে ৷ এথনোমিউজিকোলজির আরো একটি বড় কনসেপ্ট হল কালচারাল রিলেটিভিজম এবং কোন সংস্কৃতিই যে কোন সংস্কৃতি থেকে কম বা বেশি ভাল নয় এই সংক্রান্ত শক্ত অবস্থানে থাকা ৷ এইক্ষেত্রে এটি গুরত্ব দেয় প্রত্যেকটি সংস্কৃতিকে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই পাঠ করার চেষ্টা করে।  এথনোমিউজিকোলজি ‘ভাল’ বা ‘মন্দ’ এই রকম ভ্যালু জাজমেন্টগুলোকে অস্বীকার করতে চায় ৷

সূত্রানুসারে, এই ফিল্ডটি (এথনোমিউজিকোলজি) নৃবিজ্ঞান(Anthropology) দ্বারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে,  নৃবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড গির্টজের (১৯২৬-২০০৬) “থিক ডেসক্রিপশন” অর্থাৎ ফিল্ডওয়ার্কে গিয়ে ফিল্ডের সবকিছু বিস্তারিত এমনভাবে লিখে নিয়ে আসা যেন পড়তে গিয়ে পাঠক-গবেষক একাত্মা হয়ে যায় — এথনোমিউজিকোলজিতেও তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ৷ আশি ও নব্বই দশকের পর পর নৃবিজ্ঞানের “সেল্ফ রিফ্লেক্সিভ” ধারাটি দ্বারাও এথনোমিউজিকোলজিস্টরা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেখানে গবেষক নিজে ফিল্ডে যেভাবে কাজ করছেন এবং যে জ্ঞান উৎপাদন করছেন, সেটি নিয়ে সচেতন থাকার চেষ্টা করেন।  সামাজিক বিজ্ঞানের বেশ কিছু ডিসিপ্লিন যেমন ভাষাবিজ্ঞান(Linguistics), সমাজবিদ্যা (Sociology), কালচারাল জিওগ্রাফি (Cultural geography) থেকেও এথনোমিউজিকোলজি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে ৷ পোস্ট স্ট্রাকচারালিস্ট থিওরি বিশেষ করে মিশেল ফুকো(১৯২৬-১৯৮৪)র] কাজ দ্বারাও এথনোমিউজিকোলজি দারুনভাবে প্রভাবিত ৷

মেথড

মূলত এথনোগ্রাফি মেথডটির কারনেই এথনোমিউজিকোলজির সাথে হিস্টোরিকাল মিউজিকোলজির পার্থক্য তৈরি হয় এবং এটি ঘটে মূলত আর্কাইভাল রিসার্চ (Examining Text) এর কারনে ৷ এথনোগ্রাফির মাধ্যমে সরাসরি মানুষের কাছে গিয়ে, আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে মিউজিশিয়ানদের কাছে গিয়ে তাদের কম্যুনিটিতে তাদের ভূমিকা সমন্ধে, তারা কিভাবে গান তৈরি করে এবং গান তৈরির সময় কি কি বিশেষ অর্থ এরা কেন এবং কিভাবে গানের সাথে সংযোজিত করে এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় ৷ এথনোমিউজিকাল রিসার্চে এই কারনেই গবেষক যে অঞ্চল নিয়ে কাজ করছেন তাকে সে অঞ্চলের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আবহে পুরোপুরি মগ্ন থাকবার ঘটনাতে উৎসাহিত করা হয় ৷ 

সাক্ষাৎকার নেয়া এবং বিশেষ ভাবে সাক্ষাৎকার দানকারীকে পর্যবেক্ষণ করাও এথনোগ্রাফিক রিসার্চের মতই গুরুত্বপূর্ণ মেথড যেগুলো ফিল্ডওয়ার্কে একজন এথনোমিউজিকোলজিস্ট বাধ্যতামূলকভাবে করে থাকেন । 

অনেক এথনোমিউজিকোলজিস্টই তারা যে ধরনের সুর বা সাংগীতিক আবহ নিয়ে গবেষণা করেন সেটির মিউজিক্যাল প্র্যাকটিস কেমন তা বোঝার জন্য সেই ধরনের সুর বা গানকে পুরোপুরি বাজাতে ,গাইতে বা তার সাথে যদি নৃত্য থেকে থাকে তা শেখার চেষ্টা করেন ৷ 

এথনোমিউজিকোলজিস্টরা কোন সংগীত নির্মানের ঘটনাকে নানাভাবে সংগ্রহে রাখতে চান ৷ ফিল্ডনোট , অডিও ভিডিও রেকর্ডিং সহ নানা প্রক্রিয়ায় ৷ তারপর সেগুলোর একটি সাংগীতিক বিশ্লেষণ এবং ট্রান্সক্রিপশন পাওয়া যায় ৷ মিউজিক্যাল অ্যানালাইসিসে সুর বিষয়ক বর্ণনা-আলোচনা যা এথনোমিউজিকোলজিস্ট ও হিস্টোরিক্যাল মিউজিকোলজিস্ট দুই পক্ষকেই করতে দেখা যায় ৷ ট্রান্সক্রিপশন হল ফিল্ড থেকে সংগৃহীত মিউজিক্যাল সাউন্ডগুলোর নোটেশন আকারে লেখ্যরূপ ৷ এথনোমিউজিকোলজিস্টরা গবেষণা অবস্থান সুদৃঢ় করার নিমিত্তে সবসময়ই তাদের পাবলিকেশনের সাথে ট্রান্সক্রিপশন সংযুক্ত রাখেন ৷

পরিশেষে এই বিষয়টি বলে শেষ করছি যে, এথনোমিউজিকোলজিস্টদেরও গবেষণার সময় বেশ কিছু নৈতিক ব্যাপার বিবেচনায় নিতে হয় যখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা যে সাংগীতিক আবহটি নিয়ে গবেষণা করেছেন সেটি তাদের নিজস্ব নয় ৷ তারা এমন একটি জাতিগোষ্ঠীর সংগীতকে গবেষণার নিমিত্তে সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন যাদের নিজেদের হয়তো এই সক্ষমতাটুকু নেই ৷ কিন্তু যে কারো পক্ষেই কোন জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত না হয়ে কোন একটি বিষয়ে সে জাতিগোষ্ঠীর মুখপাত্র হয়ে উঠাটা সমস্যাজনক ৷ 

তাছাড়া পশ্চিমা এথনোমিউজিকোলজিস্টদের সাথে অপশ্চিমা রিসার্চ পার্টিসিপেন্টসদের ভেতর শ্রেণী প্রভেদসূচক পার্থক্যের ব্যাপারটি তো আছেই ৷ এই অসাম্যের ব্যাপারটি প্রায়শই অর্থনৈতিক, যেমন দেখা যায় রিসার্চ এলিমেন্ট খুঁজতে গিয়ে এইসব গবেষকরা প্রায়ই তথ্যের বিনিময়ে তাদের রিসার্চ পার্টিসিপেন্টসদের উপঢৌকন স্বরূপ অর্থসাহায্য করে থাকেন ৷

ঐতিহ্যবাহী গান বা লোক সংগীতের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইট নিয়ে সচেতনতার এই সময়ে অনেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায় কোন কোন সাংগীতিক উপাদানের ব্যক্তিগত মালিকানা নেই ৷ এসব লোক সংগীত পুরো জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত মালিকানার আওতাধীন থাকে ৷ এজন্যই যখন কোনো এথমিউজিকোলজিস্ট কোনো এলাকার  সংগীত রেকর্ড করে আনেন তখন তার উচিত সেই এলাকার সংগীতজ্ঞদের কাছে তার কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত বলে তাদেরকে অনুরোধ করা, তারা অনুমতি দিলেই তার রেকর্ড করা উচিত ৷ এই রেকর্ডকৃত সংগীত, যদি বানিজ্যিক কোন কাজে ব্যবহৃত হয় অবশ্যই সেখানে স্থানীয় সংগীত উৎপাদকদের  ক্রেডিট ব্যবহার করতে হবে, রাখতে হবে সম্মানীর ব্যবস্থা ৷ 

তথ্যসূত্র

※ Barz, Gregory F., and Timothy J. Cooley, editors. Shadows in the Field: New Perspectives for Fieldwork in Ethnomusicology. Oxford University Press, 1997.

※ Bodenheimer, Rebecca. “What Is Ethnomusicology? Definition, History, and Methods.” ThoughtCo, Feb. 17, 2021, thoughtco.com/what-is-ethnomusicology-4588480.

※ Myers, Helen. Ethnomusicology: An Introduction. W.W. Norton & Company, 1992.

※ Nettl, Bruno, and Philip V. Bohlman, editors. Comparative Musicology and Anthropology of Music: Essays on the History of Ethnomusicology. University of Chicago Press, 1991.

※ Nettl, Bruno. The Study of Ethnomusicology: Thirty-three Discussions. 3rd ed., University of Illinois Press, 2015.

※ Rice, Timothy. Ethnomusicology: A Very Short Introduction. Oxford University Press, 2014.