পরিবেশ প্রশ্নে নৃবৈজ্ঞানিক ভাবনা

[এনথ্রোসার্কেলে পরিবেশ নৃবিজ্ঞানের কিছু বিষয় নিয়ে লিখেছেন এসভি আনোয়ার আহমেদ।]

১ 

শুরুর আলাপ

চলুন, প্রথমেই দুইটা বিষয়ের ফয়সালা করা যাক। তারপর ধীরেধীরে ভেতরের আলাপে যাই। এক, আমরা ”পরিবেশ” বলতে যা বুঝাতে চাচ্ছি এবং দুই, জ্ঞানের একটি শাখা  হিসেবে “পরিবেশগত নৃবিজ্ঞান” যে ধরনের তৎপরতা দেখাতে চায় তার মুখাবয়বটি। 

সাধারণ ভাষায় আমাদের চারপাশে যে বায়ু, মাটি, জল, আগুন, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, প্রাণী ইত্যাদি রয়েছে এসব পারিপার্শ্বিক সবকিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। অন্যকথায় বললে পরিবেশ হচ্ছে একটি জটিল প্রাকৃতিক উপাদানের যৌগ যার উপর আমরা নির্ভর করি এবং অভিযোজন করে বেঁচে থাকি। তবে এখানে আবার মোটাদাগে দুটি ভাগ রয়েছে। এক, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও দুই, মানুষের তৈরি পরিবেশ। আমাদের চারপাশে প্রকৃতির সব উপাদান নিয়েই প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি।  যেমন: গাছপালা, পশুপাখি, সূর্যের আলো, মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদি। আর মানুষের তৈরি সকল উপাদান নিয়ে “মানুষের তৈরি পরিবেশ” সৃষ্টি হয়। যেমন: ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, রাস্তা-ঘাট, বাস, ট্রেন, নৌকা ইত্যাদি হতে পারে। 

এবার আসা যাক দ্বিতীয় বিষয়ে। নৃবিজ্ঞান মানুষের উৎপত্তি, বিকাশ এবং বর্তমানকে পূর্ণাঙ্গভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করে, তার সংস্কৃতি ও পরিবেশকে সামগ্রিকভাবে দেখতে চায়। আমরা জানি যে নৃবিজ্ঞান কেবল ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ,  উপস্থাপন ও বিশ্লেষণই করে না, বরং সে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা ও বিশ্ববীক্ষাসমূহ গভীরভাবে অনুসন্ধানের কাজটি করে। আর যেহেতু পরিবেশ সম্পর্কিত নানা ধরনের সমস্যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষ জড়িত কিংবা এক্ষেত্রে যেহেতু মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডগুলোও অত্যন্ত শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে তাই নৃবিজ্ঞানের আলোচনার ময়দানে পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পরিবেশ একটি প্রয়োজনীয় গবেষণাযোগ্য জায়গা। পরিবেশগত নৃবিজ্ঞান মানুষ এবং পরিবেশের মধ্যে জটিল সম্পর্কের উপর কাজ করছে। পরিবেশ নৃবিজ্ঞানীরা বর্তমানে বন নিধন, প্রতিবেশ, জলবায়ু সমস্যা, উদ্ভিদ ও প্রাণী, পরিবেশ সমস্যা, বিভিন্ন দূষণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া, বন্যপ্রাণী নিধন, বর্জ্য পদার্থ, বৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়া, শিল্পজাত কৃষি, পানি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। পরিবেশ অধ্যয়নের সিরিয়াসনেস প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানী কে মিলটনের একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করা এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। “নৃবিজ্ঞানী মিল্টন (১৯৭৯) গ্রীষ্মের দুপুরে আফ্রিকার Rukanaga এর Kasigau গ্রামে নৃবিজ্ঞানের মাঠ গবেষণায় প্রথাগত পদ্ধতিতে “অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ” করছিলেন। গ্রামের একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করছিল, “আমরা শুনেছি কয়েক বছর আগে কয়েকজন আমেরিকান চাঁদে গিয়েছিল, ঘটনাটি কি সত্যি, তাঁরা কি সত্যিই গিয়েছিল?” সংবাদপত্র, টেলিভিশনের তথ্য অনুযায়ী কে মিলটন তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, ঘটনাটি সত্য। তখন আশেপাশের অনেকেই প্রশ্নকারীর সঙ্গে হেসে উঠল। তখন প্রশ্নকারী গবেষককে জিজ্ঞেস করছিল, “কি ব্যাপার, তাঁদের কি এই পৃথিবীতে করার কিছু নাই?” যদিও আমেরিকাবাসীদের কাছে চাঁদে যাওয়া ছিল একটি ঐতিহাসিক অর্জন। কিন্তু গ্রামবাসীর কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে, কারণ প্রযুক্তি যেখানে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ টিকে থাকাকে হুমকির মুখে এনেছে, সেখানে মানুষের পরিবেশ রক্ষার জন্য এই পৃথিবীতে অনেক কিছু করার আছে।” (হায়দার, ১৯৯৯) 

২ 

পরিবেশ ও নৃবৈজ্ঞানিক চিন্তা 

পরিবেশ যে কেবল পরিবেশ বিজ্ঞান কিংবা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় নয়, পরিবেশ যে সামাজিক বিজ্ঞানেরও অধ্যয়ন ক্ষেত্র হতে পারে এইটা মোটামুটি গিয়ার্টজের ইকো সিস্টেমকে এককভাবে বিশ্লেষণ করার প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় হতে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে নৃবিজ্ঞানীরা সেভাবে কখনো সমাজ ও সংস্কৃতির অধ্যয়নে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান ছাড়া তেমন কিছুই বিশ্লেষণ করেনি এবং কেন সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তন হয় তা বোঝার জন্য ভৌত পরিবেশকে বোঝার চেষ্টা করা হয়নি। সংস্কৃতির নৃবিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো শুধু সংস্কৃতি অধ্যয়নের জন্য, বায়ু, গাছ, মাটি, পশুদের জন্য নয়। তবে পরবর্তীতে গিয়ার্টজ এই জায়গাটা নিয়ে জোরালোভাবে প্রশ্ন তোলেন এবং তিনি পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণের বিরোধীতা করে এইটা প্রস্তাব করেন যে ইকো-সিস্টেমকে একটি একক বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে একটি নির্দিষ্ট সমাজের জৈবিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌত উপাদানের আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ করা যায়, যা পরবর্তীতে সংস্কৃতি ও পরিবেশ অধ্যয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ধারণা হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং একইসাথে এটি নৃবিজ্ঞানে পরিবেশ অধ্যয়ন জ্ঞানকাণ্ডের সমসাময়িক প্রয়োজনীয়তাকেও স্বীকার করে। নৃবিজ্ঞান বিভিন্ন সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে পরিবেশগত সমস্যার ধরন পর্যালোচনা করে থাকেন যেটির মধ্য দিয়ে তাঁরা “সংস্কৃতির বৈশ্বিকীকরণ” ধারণাকে নানাভাবে প্রশ্ন করেন, তাকে ‘সমস্যাযুক্ত’ চিহ্নিত করেন। পরিবেশকে সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে  নৃবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রস্তাবে বা আলাপের  প্রেক্ষিতে যে চিন্তাগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে কিংবা নানাভাবে সামনে উঠে আসছে। এক, প্রযুক্তি নির্ভরতা কমিয়ে আনা। দুই, লৌকিক সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা। তিন, প্রথাগত সম্পদ ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া। চার, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র‍্য এবং মানবতাবোধ জাগিয়ে রাখা। পাঁচ, পৃথিবীতে জীবের বৈচিত্র‍্য রক্ষা করা ইত্যাদি। আসলে নৃবিজ্ঞান পরিবেশ অধ্যয়নে মানুষকে কেবল জৈবিক পৃথিবীর অংশ হিসেবে দেখে না, এর বাইরে নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিবেচনা করে আলোচনা করে থাকে এবং পৃথিবীর সকল সংস্কৃতির মানুষকে ও তাঁদের পরিবেশের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি যে এক অর্থে কিংবা নির্দিষ্ট একক কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায় না, সেখানে যে ভাষা, জাতীয়তা, জাতিসত্ত্বা, স্থানীয় মূল্যবোধ, বিশ্বাস ব্যবস্থা, লিঙ্গীয় সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, উৎপাদন সম্পর্ক, শ্রেণী চরিত্রের মতো ইত্যাদি নানা বিষয়ের ভূমিকা রয়েছে এই বাস্তবতাকে নৃবিজ্ঞানীরা বুঝতে চেষ্টা করেন। 

৩ 

পরিবেশ নৃবিজ্ঞানীরা যেখানে গুরুত্বারোপ করেন অথবা/এবং করতে পারেন। 

নৃবিজ্ঞান কথিত আধুনিক ও প্রযুক্তি ব্যবহারকারী এবং সরল প্রযুক্তির সমাজ প্রত্যেকের সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে কিভাবে পরিবেশের সুস্থতা রাখা যায় সেই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পরিবেশের সমস্যা সাধারণত প্রতিবেশ (ecology) সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা রয়েছে; যেখানে নৃবিজ্ঞানীরা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণ-প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে মানবিক প্রতিবেশের আলাপ আনছেন। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ সমস্যা নির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতির একার সমস্যা নয়। এটি একটি ট্রান্সকালচারাল ব্যাপার। তাই পরিবেশ সমস্যা বোঝা ও সমাধানের প্রশ্নটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। এখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে পরিবেশ নৃবিজ্ঞানীরা সমস্যার বিশ্লেষণে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিতে পারেন। এই প্রসঙ্গে সাপির বলেন “এই পৃথিবীতে বিভিন্ন সমাজের লোক বাস করেন এবং প্রতিটি সমাজই এক একটি নির্দিষ্ট পৃথিবী। কিন্তু বিভিন্ন ছাঁচে আঁটা এক পৃথিবী নয়।” (Sapir, 1961) তাছাড়া গিয়ার্টজ ও লিচ বলেন, “সংস্কৃতির অধ্যয়ন হল সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাকে বোঝা। বিতর্ক রয়েছে যেমন সত্যি তেমনি পরিবেশের সমস্যার মূল অন্বেষণে এবং তার সমস্যার সমাধানে পরিবেশের সাথে মানবের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ অধ্যয়নে নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা এখানেই কারণ সংস্কৃতির মাধ্যমেই এই আন্তঃসম্পর্কটি টিকে আছে যেহেতু ভিন্ন প্রকৃতি ও তাতে টিকে থাকার সমস্যা সম্পর্কে মানুষের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন হয়, ফলে একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক সীমানার মধ্যে পরিবেশের অর্থ ও সমস্যাকে নির্দিষ্ট রূপে বিশ্লেষণ করতে হয়।” (Geertz, 1973 & Leach, 1973) 

৪ 

পরিবেশ, বিশ্ববাস্তবতা ও নৃবিজ্ঞান 

নৃবিজ্ঞান কেবল পরিবেশ সমস্যা প্রশ্নে “বিজ্ঞানসম্মত” সমাধানের আলাপে সীমাবদ্ধ থাকে না; নৃবিজ্ঞানীরা পরিবেশ সমস্যার বিষয়ে বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, “কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্ক” বিভিন্ন নীতি, মুক্ত বাজার ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্যেও পরিবেশ সমস্যার কারণ খোঁজার চেষ্টা করে থাকেন। কেন্দ্র-প্রান্তের অসম ক্ষমতা সম্পর্ক বিদ্যমান, উচ্চ ফলনশীল প্রযুক্তি ও অধিক উৎপাদন ও মুনাফার চর্চা যেখানে রয়েছে যেখানে ‘উন্নত’ দেশগুলোর পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচিগুলো দ্বৈত অবস্থাকেই প্রকাশ করে বলা যায়। এখানে নৃবিজ্ঞানীরা গুরুত্বের সাথে যে বিষয়টাকে সামনে আনেন সেটা হচ্ছে যেখানে উন্নয়ন মানেই বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রকৃতিকে সর্বোচ্চ নিংড়ে নেবার কৌশল রয়েছে সেখানে পরিবেশ সমস্যা বিষয়কে শুধুমাত্র জৈবিক কিংবা ভৌত প্রেক্ষিতে দেখতে যাওয়া সমস্যাজনক; যেটি কিনা নৃবিজ্ঞান অধ্যয়নে অন্যতম প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা। আসলে পরিবেশগত সমস্যাগুলো যে কেবলই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণাক্ষেত্র নয়, এর সাথে যে মানুষ ও তার কর্মকান্ডগুলোও সম্পর্কিত এবং মানুষ যে শুধু জৈবিক মানব নয় সে একইসাথে সামাজিক সাংস্কৃতিক মানুষও বটে এই আলাপগুলো পরিবেশ নৃবিজ্ঞানীরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে অত্যন্ত জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসেন। 

পাঠ নির্দেশ 

Alam. S. M. Nurul and Rasheda Akhtar. Anthropology in Bangladesh: past present and future Keynote paper presented at the seminar on Anthropology in Bangladesh held at British Council Auditorium Dhaka April 13, 1994.

Andrew. p. Vayda. Anthropologists and Ecological problems 

Baker P. T. (62) Application of Ecological theory to anthropology

Kay Milton (ed) Environmentalism. The view from Anthropology, published 93 by Routledge.

Kay Milton. Environmentalism and Cultural theory. Published 96 by Routledge:

Robin Grove. “White Environmentalism a new moral discourse for technological society,” in Kay Milton (ed) Environmentalism. The view from Anthropology, published 93 by Routledge.

Steven Yearley. A sociology of environmental issues, arguments and policies published 92 by Routledge.

নুরুল আলম, আইনুন নাহার, মানস চৌধুরী, ২০০০, সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা। 

Kopnina, Helen, 2015, Environmental Anthropology: Future Directions,  Routledge, UK