রেডক্লিফ-ব্রাউন ও তার তত্ত্ব

[এনথ্রোসার্কেলে রেডক্লিফ-ব্রাউনের তত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন তাসনিম রিফাত]

বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে যদি ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় নামটি উচ্চারণ করতে হয়, তিনি হলেন রেডক্লিফ-ব্রাউন। তাত্ত্বিক দিক দিয়ে তিনি ম্যালিনস্কিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের যেকোনো পাঠে সামাজিক কাঠামো আর জ্ঞাতিসম্পর্ক নিয়ে যে অতি আগ্রহ, তার অনেকটাই আসলে রেডক্লিফ-ব্রাউনের প্রভাবে।  ব্রাউন ম্যালিনস্কির ক্রিয়াবাদী ধারণার সমালোচক ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ম্যালিনস্কি সংস্কৃতির ব্যাখ্যাটি উপযোগবাদী, অর্থাৎ ব্যক্তির জন্যই সমাজের সংস্কৃতি বা কাঠামো গড়ে উঠছে। অন্যদিকে ব্রাউন মনে করতেন, ব্যক্তি নয়; সমাজ পাঠের মূল ব্যাপার হলো কাঠামো। ম্যালিনস্কি আর রেডক্লিফ-ব্রাউন, এই দুই তাত্ত্বিকের বিরোধ ব্রিটেনের একাডেমিক পরিসরেও প্রভাব ফেলেছিল। 

রেডক্লিফ-ব্রাউনের জন্ম ১৮৮১ সালে, ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। সেখানেই তিনি নৃবিজ্ঞানী ডব্লিউ এইচ রিভার্সের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। ব্রাউন ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত আন্দামান অঞ্চলে ফিল্ডওয়ার্ক করেন। রেডক্লিফ-ব্রাউনের ফিল্ডওয়ার্কের ধরন ছিল ম্যালিনস্কির সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, তিনি খুব একটা নিবিড়ভাবে মাঠকর্ম করেন নাই। সেই সময় তিনি ডুর্খেইমের কাজের সাথে পরিচিত হন এবং এর পরবর্তী জীবনে ডুর্খেইমের পজিটিভিস্ট চিন্তাধারার প্রতিই বিশ্বস্ত ছিলেন। ডুর্খেইমের মতো ব্রাউনও মনে করতেন, যেকোনো সমাজকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পাঠ করা যায় আর এই পাঠের মাধ্যমে সামাজিক সত্ত্বার সাধারণ কোন নীতিও বের করা যায়। 

রেডক্লিফ-ব্রাউনের কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদ সম্পর্কিত ধারণা

রেডক্লিফ ব্রাউনের প্রধান তাত্ত্বিক জায়গা ছিল কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদ। রেডক্লিফ-ব্রাউন নৃবিজ্ঞানকে একটি অভিজ্ঞতাবাদী জায়গা থেকে দেখতে চেয়েছেন। ব্রাউন মনে করতেন, অতীত সমাজগুলোকে কখনো অভিজ্ঞতালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পাঠ করা সম্ভব না, তা সম্ভব একমাত্র বর্তমান সমাজগুলোর ক্ষেত্রে। তাই বিবর্তনবাদীদের কর্তৃক অতীত সমাজের ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজকে তিনি ছদ্ম-ইতিহাস নামে অভিহিত করেছিলেন। ব্রাউন আরো মনে করতেন, নৃবিজ্ঞানের জন্য অবশ্যই তুলনামূলক পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজগুলোকে তুলনা করে কোন সাধারণ নীতি বের করা যেতে পারে। 

ব্রাউন কিভাবে তুলনামূলক পদ্ধতিকে কাঠামো অনুসন্ধান করার কাজে ব্যবহারর করতে চেয়েছেন সেটি একটা উদাহরণের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার করা যাক। একজন গবেষক গিয়ে যখন কোন সমাজে বাবা আর সন্তানের সম্পর্ক দেখেন, তখন তিনি আসলে একটি সামাজিক কাঠামো দেখছেন। এরপর যখন তিনি একটি সমাজে বাবা হিসেবে ব্যক্তির কী নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে, আর সন্তান হিসেবে কী নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে, সেটা বের করার চেষ্টা করেন, তখন সেটাকে বলা যায় সামাজিক গঠন। রেডক্লিফ-ব্রাউনের মতে, সমাজকে বুঝতে ব্যক্তি হিসেবে বাবা কিংবা সন্তানের সম্পর্কে আটকে না থেকে, বাবা আর সন্তান- এই দুইটি সামাজিক সম্পর্কের ভূমিকার ধরনকে বুঝতে হবে। একজন নৃবিজ্ঞানী যখন একটি সমাজের কোন নির্দিষ্ট সম্পর্কের গঠন বের করবেন, এরপর তার কাজ হবে অন্যান্য সমাজের গঠনের সাথে তার তুলনা করা। এই তুলনার মাধ্যমেই হয়তো একটা সাধারণ নীতি বা সূত্র বের করা সম্ভব হতে পারে। যেমন আগের উদাহরণটার ক্ষেত্রে, বিশ্বব্যাপী বাবা আর সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কে কোন সাধারণ নীতি খুঁজে পাওয়ার কথা বলা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে রেডক্লিফ ব্রাউনের ‘রোল’ আর ‘স্ট্যাটাস- এই দুইটি ধারণার কথাও বলা দরকার। ব্রাউনের ক্রিয়াবাদী ধারার অন্যতম মূল দুইটি বিষয় হলো রোল আর স্ট্যাটাস, যা তিনি পেয়েছিলেন ডুর্খেমীয় চিন্তার ঐতিহ্য  থেকে। কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদী ধারায় স্ট্যাটাস বলতে বুঝায় একটি সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিদের অবস্থান। যেমন, একটা সমাজে ‘বাবা’ একটা অবস্থান, ‘পুলিশ’ একটা অবস্থান- এগুলো হল স্ট্যাটাস। আবার প্রতেকটি স্ট্যাটাসের সাথে কিছু বাধ্যবাধকতা আর দায়-দায়িত্ব জড়িয়ে থাকে, এগুলো হল রোল। যেমন বাবার কিছু নির্দিষ্ট দায়-দায়িত্ব থাকে সন্তান আর পরিবারের প্রতি। এই সম্পর্কগুলো আবার পারষ্পরিক। একটি সমাজে প্রত্যেকটি ব্যক্তির একাধিক স্ট্যাটাস আর রোল থাকে। সে একইসাথে কারো বাবা, কারো স্বামী, কোনো অফিসের কর্মচারী। রেডক্লিফ-ব্রাউনের মতে, সমাজকে পাঠ করার জন্য এই রোল আর স্ট্যাটাসকেই গুরুত্ব দিতে হবে, ব্যক্তিকে নয়। এর কারণ হিসেবে তিনি কিছু যুক্তিও দাড় করিয়েছেন। তিনি এইক্ষেত্রে স্পেন্সারের দোহাই দিয়ে একটি আঙ্গিক সাদৃশ্য ব্যবহার করেন। আমরা একটা মানব শরীরের কথা বিবেচনা করতে পারি। একটা মানব শরীর অনেকগুলো অঙ্গ-প্রতঙ্গ, কোষ আর রক্ত প্রভৃতি নিয়ে গঠিত। এই অঙ্গগুলোর সমষ্টিমাত্রই মানব শরীরে কাঠামো নয়। বরং মানব শরীরের নানা অঙ্গ-প্রতঙ্গ আর তাদের আন্তঃসম্পর্কের মাধ্যমেই মানব শরীরের কাঠামো খাড়া হয়। এই শরীরে বহু কোষ মরে যায় , আবার পুনরায় জন্ম নেয়। তবে এতে কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয় না। এই কোষগুলোকে আমরা সমাজে বসবাস করা ব্যক্তিমানুষের সাথে তুলনা করতে পারি। একটা সমাজে ব্যক্তি জন্ম নেয়, আবার মরে যায়। কিন্তু ‘বাবা’ কিংবা ‘পুলিশ’ – এর মতো পদগুলো আর তাদের সাথে জড়িত দায়-দায়িত্ব আর ভূমিকাগুলো টিকে থাকে। এইজন্যই সমাজকে বুঝতে হলে এসব বিষয়কে কেন্দ্রে রেখেই পাঠ করতে হবে। রেডক্লিফ-ব্রাউন তাই সমাজকে বুঝার জন্য ব্যক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে জ্ঞাতিসম্পর্কের মতো পাঠগুলোতে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। 

রেডক্লিফ-ব্রাউন সামাজিক কাঠামো পাঠ করতে গিয়ে গুরুত্ব দেন কর্পোরেট গ্রুপের ধারণাতে। তার মতে, কর্পোরেট গ্রুপ হল এমন এক গোষ্ঠী যেটা সদস্যদের পরিবর্তন সত্ত্বেও একই থাকে। একটা সমাজে জ্ঞাতিগোষ্ঠী, ট্রাইব, ক্ল্যান কিংবা কোন সামাজিক সংগঠনগুলো কর্পোরেট গ্রুপের আওতার মধ্যে পড়ে। তিনি কর্পোরেটকে গ্রুপকেই তার গবেষণার কেন্দ্রে রেখেছিলেন, কারণ যেকোনো সমাজে একজন মানুষ কোন গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবেই নির্দিষ্ট রোল আর স্ট্যাটাস লাভ করে। এগুলোর সাপেক্ষেই তার অধিকার, দায়-দায়িত্ব কিংবা বাধ্য-বাধকতার প্রশ্ন আসে। এই গোষ্ঠীগুলোতে অবস্থান করা ব্যক্তিদের পারষ্পরিকতা যে সম্পর্কগুলোর ভিত্তিতে গড়ে উঠে সেটাও সামাজিক কাঠামোর অংশ। রেডক্লিফ ব্রাউন মনে করতেন, একটা সমাজে গোষ্ঠীর মধ্যকার এসব সম্পর্ককে বৈজ্ঞানিক ভাবে পাঠ করা সম্ভব। বহিঃগোত্র বিবাহব্যবস্থা, মইতি, বিবাহ পরবর্তী বাসস্থান  এবং ধর্মের মতো বিষয়গুলো পাঠ করে, এদের কাঠামোগুলোকে বিভিন্ন সংস্কৃতি সাথে তুলনা করে উক্ত কাঠামোগুলোর অন্তর্নিহিত কারণগুলো খুঁজে বের করার জন্য ব্রাউন বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন শ্রেণীকরণে। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞাতিসম্পর্ক আর বংশধারা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোষ্ঠী-সম্পর্কিত উপাত্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাজিয়ে শ্রেণীকরণ করাকেই তুলনামূলক পদ্ধতির প্রাথমিক ধাপ মনে করতেন। 

রেডক্লিফ-ব্রাউনের কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদ সম্পর্কিত ধারণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘ক্রিয়া’ ও তার উদ্দেশ্যের ধারণা। উদ্দেশ্যের কথা বললাম এই কারণে যে ব্রাউনের মতে সমাজে যেকোনো ক্রিয়ার উদ্দেশ্য হলো সেই সমাজটিকেই টিকিয়ে রাখা। অর্থাৎ, তিনি বলতে চেয়েছিলেন, সমাজের যেকোনো প্রতিষ্ঠান আন্তঃসম্পর্কিত হয়ে ক্রিয়া করে সেই সমাজটির ধারাবাহিকতা ও সাম্যব্যস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য। ব্রাউনের তার নিজের কাজের মধ্যে দিয়েও এই ব্যাপারটিই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তার মাঠকর্ম আর নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণেও দেখা যায় তিনি জ্ঞাতিসম্পর্ক, টোটেম বিশ্বাস এমনকি কৌতুকের ভূমিকাও দেখাচ্ছেন একটি সমাজের টিকে থাকার ক্ষেত্রে। 

রেডক্লিফ-ব্রাউন বিশ্ব শতাব্দীর প্রথমভাগে নৃবিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রভাবশালী তাত্ত্বিকদের একজন ছিলেন। আমেরিকায় গড়ে উঠা বোয়াসিয়ান ধারা যেখানে সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্ন কতগুলো ফেনোমেনা আকারে দেখতেন এবং তুলনামূলক পদ্ধতির বিরোধিতা করতেন; সেখানে ব্রাউন সংস্কৃতি কিংবা সমাজকে একটি অবিচ্ছিন্ন ও সমন্বিত গঠন হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি তুলনামূলক পদ্ধতির উপরও জোর দিয়েছিলেন, তবে তার তুলনামূলক পদ্ধতি ছিল বিবর্তনবাদীদের অনুমানমূলক পদ্ধতি থেকে আলাদা। বলা যায়,তত্ত্ব আর পদ্ধতি- দুইদিক থেকেই রেডক্লিফ-ব্রাউন নৃবিজ্ঞানে বেশকিছু ধারনা যুক্ত করেছিলেন। 

রেফারেন্স:

Visions of Culture, Jerry D. Moore

Anthropology and anthropologists, Adam Kuper

An Introduction to Theory in Anthropology,Robert Layton