নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’

[শওকত আলীর  ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসটিকে নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন সাদিয়া শান্তা।] 

“প্রদোষে প্রাকৃতজন” উপন্যাসটি নৃবিজ্ঞানের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হলেও উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ ও লেখকের উপস্থাপন ভঙ্গিমার সাথে নৃবিজ্ঞানের যোগসাজশ রয়েছে। নৃবিজ্ঞানে মানুষকে পূর্ণাঙ্গভাবে অধ্যয়ন করা হয় যার ফলে মানুষের ইতিহাস, সমাজ, অতীত ইত্যাদিও এই শাখার আওতায় পড়ে। যেমন- বর্তমান বাংলার মানুষের জীবন পূর্ণাঙ্গভাবে অধ্যয়ন করতে হলে শত বছর পূর্বে এই বাংলার মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকেও জানতে হবে। আর “প্রদোষে প্রাকৃতজন” আমাদের সেই সমাজ-জীবনকে জানতেই সাহায্য করে। আবার, “প্রদোষে প্রাকৃতজন” নামটিকে যদি ব্যবচ্ছেদ করি তবে এই যোগসাজশ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। ‘প্রদোষ’ অর্থ সন্ধ্যা যা দিনের শেষ বেলা বোঝায়; আর ‘প্রাকৃজন’ মানে সাধারণ মানুষ। উপন্যাসের নামটি দিয়ে বোঝায় – দিনের শেষে কিংবা ইতিহাসের কোন এক মোড়ে সাধারণ মানুষের নিয়তি। অর্থাৎ উপন্যাসের নামটিও নৃবিজ্ঞানের সাথে এর সম্পর্ক ইঙ্গিত করে।

বাংলার ভূখণ্ড ও তার মানুষের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে। এর মাঝে “প্রদোষে প্রাকৃতজন” ব্যতিক্রমধর্মী ও অন্যতম। এখানে লেখক উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আটশো বছর পূর্বের বাংলার মানুষের জীবন, তাদের পেশা, চিন্তা, বিশ্বাস, দুঃখ-দুর্দশা, ও প্রতিবাদের রূপকে তুলে ধরেছেন তার অন্তর্দৃষ্টি ও অনুপম ভাষার মাধ্যমে। বারো শতকের দিকে বাংলার ভূখন্ডে জনসাধারণের উপর সামন্ত শ্রেণীর অত্যাচার ও নিপীড়ন, সেন রাজার পতন, ও তুর্কি যবনদের আগমণ নিয়ে এই উপন্যাসের ধারা এগিয়ে গেছে। সেই বাংলার জনমানসের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রণয় ও বেদনার ধারণা দিতে লেখক লীলাবতী-শ্যামাঙ্গ, মায়াবতী-বসন্তদাসের মতো চরিত্রকে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তুলে নিয়েছেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশা, সংগ্রাম, ও বিশ্বাসের রূপান্তরের মাঝে সেই সময়ের বাংলার সাধারণ মানুষের নিয়তি প্রতিফলিত হয়েছে।

ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস “প্রদোষে প্রাকৃতজন” এর লেখক শওকত আলী। ১৯৩৬ সালে পশ্চিম বাংলার দিনাজপুরে তিনি জন্ম নেন। তার শিক্ষাজীবন কাটে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শওকত আলীর অনুরাগ ছিল ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের মতো শাখাগুলোতে। ১৯৮৪ সালে শওকত আলীর উপন্যাস “প্রদোষে প্রাকৃতজন” প্রকাশিত হয় দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে।

শওকত আলী

(এই লেখায় উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনার চেয়ে আমি নির্দিষ্ট কিছু সংলাপ ও ঘটনার উপর জোর দিয়েছি। যার কারণে প্রথমে কোন একটি ঘটনার প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে দিয়ে তারপর সেই ঘটনা ও নির্দিষ্ট সংলাপকে নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছি।)

ঘটনা ও সংলাপের নৃবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ-

উপন্যাস শুরু হয় মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের নদীতীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার দৃশ্য দিয়ে। শ্যামাঙ্গ বারো শতকের বাংলার সমাজস্বীকৃত শিল্পের রীতি ভেঙে নারীর মনন বাসনার প্রতিফলনে পুত্তলিকা (মূর্তি) গড়তে চায় যাতে তার গুরুদেব বাধা দিলে সে অভিমানে-অপমানে জর্জরিত হয়ে শিল্পকর্ম ত্যাগ করে মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এই ঘটনাটিতে বারো শতকের বাংলায় সমাজের চোখে নারীর ভাবমূর্তির স্বরূপ প্রকাশ পায়। নারীর বাসনা তখন ছিল সুপ্ত, যার প্রকাশ সমাজ গর্হিত বলে গণ্য হতো। অন্যদিকে, সেই সময়ে সামন্তরাজাদের কাছে শিল্পের পরাধীনতাও এই ঘটনায় প্রতিফলিত হয়। শিল্পের কদর তখনই যথার্থ হয়, যখন তার সৃষ্টি হয় স্বাধীন। কিন্তু সেই সময়ে কেমন শিল্প তৈরী হবে আর কোনটা বর্জিত হবে তা নির্ধারিত হতো সামন্তশ্রেণীর অধিপতিদের ইচ্ছানুসারে। এতে করে বারো শতকের বাংলায় শিল্প হয়ে উঠেছিল পরাধীন।

মন্দির ছেড়ে এসে ঘটনাক্রমে শ্যামাঙ্গ আশ্রয় নেয় শুকদেবের বাড়িতে। সেখানে তার পরিচয় হয় দুই সখী মায়াবতী ও লীলাবতীর সঙ্গে। শুকদেবের বাড়িতে অবস্থানকালে এক রাতে মায়াবতী ও লীলাবতী শ্যামাঙ্গের গৃহের বাইরে এসে তাকে ডাকলো কোন এক বার্তা দেওয়ার জন্য। শ্যামাঙ্গ তখন ভাবলো, “তবে কি পুনর্ভবা তীরের রমণীরা সত্যিই শিথিলশাসনা? এবং স্বাধীন ভর্ত্তৃকা?” শ্যামাঙ্গের এই ভাবনায় সেই সময়ের সমাজে নারী-পুরুষের কথা বলা ও মেলামেশার অধিকারের সীমানা প্রতিফলিত হয়। আবার, স্থানভেদে নারীর চলাফেরায় স্বাধীনতার ভিন্নতাও প্রকাশ পায়। কেননা, পুনর্ভবা তীরের রমণীরা শিথিলশাসনা কিনা এই প্রশ্ন মনে জাগার মধ্য দিয়ে এই ধারণাও তৈরী হয় যে বাংলার এক অঞ্চলের নারীর চেয়ে অন্য অঞ্চলের নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা ও সীমানা ভিন্ন প্রকৃতির ছিল বৈকি।

শ্যামাঙ্গ যখন নবগ্রাম হাটে এসে উপস্থিত হলো তখন রাজপাদোজীবীর দল এসে জড়ো হলো। শ্যামাঙ্গ এক বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলো – এরা দস্যু দমনে বের হয়েছে কিনা। বিদ্রূপাত্মক সুরে বিক্রেতা জবাব দেয়, “কাক কি স্বজাতির মাংস ভক্ষণ করে?” – এই সংলাপ থেকে বোঝা যায় সামন্ত রাজার লোকেরাই মূলত দস্যূ হয়ে সাধারণ মানুষের উপর আক্রমন করতো, তাদের শোষণ করতো। ফলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও ভরসায় সেন আমলের রাজশক্তি আর স্থান পেলো না। বরং তারা ভরসা করলো বিদেশী যবন জাতির উপর। সামন্তরাজার নিপীড়ন সম্পর্কে সেন রাজার উদাসীনতা বাংলায় সেন শাসন পতনের একটি অন্যতম কারণ।

উপন্যাসে তুর্কি থেকে আসা মুলসমান বণিকদের “যবন জাতি” বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ সনাতন ধর্মাবলম্বী শুকদেবের শ্যালক দীনদাস একবার যবন জাতির উপাসনার ক্রিয়াকর্ম দেখেছিল। ভিন্ন ধর্মের উপাসনা তার কাছে বড়ই বিচিত্র ঠেকলো। যবন জাতির মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য উপেক্ষা করে চাকর-মালিকের একসাথে খেতে বসা ও কোলাকুলি করার দৃশ্য দেখে দীনদাস তাদের “মধুর-স্বভাব” ও “প্রীতিপ্রার্থী” গুণে আখ্যায়িত করলো। “সুরেলা কণ্ঠে”, “দুর্বোধ্য ভাষায়” আযান দেওয়া ও মূর্তিবিহীন শূন্য দিগন্ত সামনে রেখে নামাজ পড়াতেও দীনদাস এক নির্মলতা খুঁজে পেল৷ এখানে ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ে দীনদাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠে। এটাকে আমরা বলতে পারি “সাংস্কৃতিক অভিঘাত” কিংবা Cultural Shock। আবার, যবনদের অর্থাৎ তুর্কি মুসলিমদের বিবাহপ্রথা নিয়েও তারা কৌতুহল প্রকাশ করে। কারণ হিন্দু সমাজে এক নারী ও এক পুরুষে বিয়ে হয় এবং তা জন্ম-জন্মান্তরের বলে মেনে নেওয়া হয়। সেই বিয়ের বন্ধন ছিন্ন করার অধিকার ও ক্ষমতা সমাজের কারো নেই। অন্যদিকে, মুসলিমদের পুনরায় বিয়ে করার রীতিনীতি রয়েছে। সংস্কৃতিভেদে বিয়ের রীতির এই ভিন্নতা নিয়েও বারো শতকের সনাতন বঙ্গবাসী Cultural Shock-এর মুখোমুখি হয়। উল্লেখ্য, যবন জাতির ধর্মাচরণে দীনদাসের যে মুগ্ধতা দেখা যায় তার বিপরীতে আমরা শুকদেবকেও বলতে শুনি, “ওদের মধুর ব্যবহার যেমন সত্য, তেমনি সত্য হত্যা এবং লুণ্ঠনও।” কারণ শুকদেবের সন্ধান মতে, মগধ দেশে হাজার হাজার লোকের প্রাণ গেছে এই যবনদের তরবারির আঘাতে। অর্থাৎ বারো শতকের বাংলায় সাধারণ মানুষের একটা অংশ যেমন সামন্ত রাজার শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তুর্কি মুসলমানের উপর নির্ভর করেছিল, আরেকটা অংশ তেমনি ভিনদেশীদের আগমনে শংকিতও ছিল।

মায়াবতীর চরিত্রকে উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে চপলা নারীর চরিত্র হিসেবে। কিন্তু সেই চপল নারী চঞ্চল হয়ে উঠে কেবল স্বামীসঙ্গ পেলে। মায়াবতীর পরিবার ও মাতুল লক্ষ্য করে, মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাস উপস্থিত থাকলেই মায়াবতীর আনন্দ বিচ্ছুরিত হয়। অন্যথায়, মায়াবতী স্বামীর আগমণের অপেক্ষায় দুঃখিনী হয়ে দিন কাটায়। এখানে সেন আমলের বাঙলায় নারী জীবনের হাসি-আনন্দ ও দুঃখ-বেদনাকে পুরুষ কেন্দ্রিক করে দেখানো হয়েছে। বস্তুত, সেই সময়ে নারীর চলাফেরায় স্বাধীনতা ছিল না। স্বামী কিংবা বাবার কাছেই নারী শখ-আহ্লাদ প্রকাশ করতে পারতো। অন্যদিকে, পুরুষেরাও তখন গৃহে সময় কাটাতো না। হাটে, বাণিজ্য কিংবা রাজদরবারে ছিল তাদের কাজ। তাই যেটুকু সময় নারী তার প্রিয় পুরুষকে কাছে পেতো, সেই সময়টুকুতে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেতো। তবে মায়াবতীর আনন্দ প্রকাশ পেতো আরো একটি সঙ্গীর উপস্থিতিতে – মায়াবতীর সখী লীলাবতী। এই দুই নারীতে মনের সুপ্ত বাসনা, ইচ্ছা, অনুরাগ, অভিমান প্রকাশ করতো একে অপরের কাছে। অর্থাৎ, এই উপন্যাসে নারীর আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বামীকেন্দ্রিক নয় – স্বাধীনতা কেন্দ্রিক।

উপন্যাসের এক পর্যায়ে মায়াবতীর স্বামী বণিক বসন্তদাসের দেখা হয় এক বৃদ্ধ যবনের। তার সাথে বসন্তদাসের আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বৃদ্ধ তাকে একদিন এক সুগন্ধির কৌটা উপহার দেয় যার নাম বলে ‘ইতর’ (‘আতর’ এর সমার্থক, যা পারস্য শব্দ ইতির থেকে এসেছে)। কিন্তু বাংলায় ‘ইতর’ বলতে নীচ, অধম, অভদ্র বোঝানো হয়। তাই সুগন্ধির এই নাম শুনে বসন্তদাস মন্তব্য করে, “এক দেশের বুলি অন্য দেশের গালি।” এখানে সংস্কৃতিভেদে ভাষার অর্থ বদলের প্রতি লেখক ইঙ্গিত করেছেন। ভাষার সঠিক ‘Interpretation’ ছাড়া কোন সংস্কৃতির মানুষের উপহারকেও অপমান ভাবার সুযোগ থেকে যায়। অর্থাৎ ব্যক্তি ও তার সংস্কৃতিকে বুঝতে হলে, সেই সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ভাষাকে বোঝা অতীব জরুরী।

উপন্যাসের ঘটনাক্রমে বসন্তদাস তার সর্বস্ব হারিয়ে একটা বটগাছের নিচে বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে বসন্তদাস “পরিচয় সংকট” অর্থাৎ Identity Crisis-এ ভোগে। ব্যক্তির পরিচয় গড়ে উঠে তার অবস্থান ও অন্যের সাথে সম্পর্কের নিমিত্তে। বসন্তদাস নিজ পিতামাতা, স্ত্রী, সহায়-সম্পত্তি সবই হারিয়েছে। তাই সে ভাবে, তবে আর কিসের নিমিত্তে পরিচয় তৈরী হবে? বসন্তদাস আপনমনে প্রশ্ন করে, “তুমি এখন তবে কার? পিতামাতার? প্রিয়তমা পত্নীর? নাকি বালগ্রামের কৃষ্ণা নাম্নী সেই মন্দিরদাসীটির?…ব্যক্তির অস্তিত্ব তো সম্পর্কে – তা সে যেমনই হোন – বস্তুসম্পর্ক অথবা ব্যক্তিসম্পর্ক। আমি আমি বলে চিৎকার করলেই কি তাতে কিছু প্রমাণিত হয়? আমার এখন মানবসম্পর্ক নেই – পিতামাতা, আত্মীয়-পরিজন, স্ত্রী-বন্ধু, কোন সম্পর্কেই তো আমি এখন যুক্ত বোধ করি না। আর বস্তু সম্পর্ক? সেখানেও কি আমি যুক্ত? কোন পরিচয়টি আমার? আমি কি বণিক? বণিক হলে বিত্তহীন সম্বলহীন অবস্থায় আমি হট্টগৃহে একাকী শয়ান কেন? নাকি আমি ক্ষেত্রকর? তাহলে তো আমার গৃহবাসী হয়ে ক্ষেত্রকর্মে যুক্ত থাকার কথা।” এই সংলাপ বসন্তদাসের পরিচয়হীনতার হাহাকার প্রকাশ করে।

হাটে, ঘাটে, বাণিজ্যে প্রতারিত হয়ে বসন্তদাস পুনর্ভবা নদীর তীরে হডডিপল্লীর কাছে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। তখন পল্লীর কিছু মানুষ এসে তার চারপাশে জড়ো হয়। তৃষ্ণার্ত বসন্তদাস অস্ফুটস্বরে তাদের কাছে পানি চায়। পল্লীর এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করে, “মহাশয় কি আমাদের হাতে জলপান করবেন?” এখানে বসন্তদাসের জীবন বাঁচানোর চেয়েও তার জাত-পাতের পবিত্রতা রক্ষা অর্থাৎ Caste and Purity-এর ধারণাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে দেখানো হয়। সেসময়কার সনাতন ধর্মে জাত-পাত ভিত্তিক হায়ারার্কি অর্থাৎ উঁচু-নিচু শ্রেণী ভেদাভেদ ছিল তীব্র। উঁচু শ্রেণীর Caste বিশ্বাস করতো নিচু শ্রেণীর Caste-এর স্পর্শে এলে তারা জাত দূষিত হবে। নৃবিজ্ঞানের ভাষায় কোন সংস্কৃতিতে এই ধরনের চর্চাকে বলা হয় Untouchability Practice।

উপন্যাসের এক পর্যায়ে সদ্ধর্মী বৌদ্ধরা যবনদের সাথে যুক্ত হয়ে সামন্ত রাজাদের বিরূদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠে। কেননা এই বৌদ্ধরাও সামন্ত রাজাদের শোষণের স্বীকার ও তাদের অত্যাচারে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত। তখন সোমজিৎ তার রাজকর্মচারী বন্ধু হলায়ুধের সাথে দেখা করে। হলায়ুধকে সে অনুরোধ করে আসন্ন বিপদ এড়াতে হলায়ুধ যেন রাজার কাছে সদ্ধর্মী বৌদ্ধদের সাথে মৈত্রী স্থাপনের আবেদন জানায়। হলায়ুধ তখন বৌদ্ধদের ধর্মাচরণ ও সংস্কৃতিচর্চাকে খর্ব করে এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে। হলায়ুধ নিজ সনাতন ধর্মকে উচ্চ এবং শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে এবং বৌদ্ধদের ”তৃণভোজী শত্রু” বলে আখ্যায়িত করে। সোমজিতের সাথে বাক্যালাপে হলায়ুধ বলে, “সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা আর্য ধর্মের শত্রু…তাদের ধর্মে স্বর্গ নরক নেই, যাগযজ্ঞ নেই, বলিউপচার নেই, ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ নেই…যারা যথার্থই তৃণভোজী – এ হলো তাদের ধর্ম।…তুমি আমাদের আর্য ধর্মের কথা ভাবো, এ ধর্ম উচ্চশ্রেণীর। আর্যত্বের অর্থ হলো শ্রেষ্ঠত্ব।…এর স্বর্গ-নরক আছে, এ ধর্ম কর্মফলে বিশ্বাস করে এবং মনে করে না যে, সকল মানুষ সমান হতে পারে।” নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ও অন্য ধর্মাচরণকে খর্ব করে দেখার এই প্রবণতার মাধ্যমে হলায়ুধের আচরণে স্বজাতিকেন্দ্রিকতা অর্থাৎ Ethnocentrism প্রকাশ পায়।

সোমজিৎ তখন হলায়ুধকে পিপ্পলী হাটে সামন্তপ্রভু কর্তৃক ডোম নারীর যোনিদেশে উত্তপ্ত লোহার দন্ড ঢুকিয়ে দেওয়ার কথা জানায়। এই ঘটনা শুনে হলায়ুধ মন্তব্য করে “প্রভু যে শাসন করে, সে যেমন কর্মফল, দাস যে শাসিত হয়, সেও তেমনি কর্মফল।” অর্থাৎ বারো শতকের বাংলার সমাজে দাস-প্রভুর যে অধীনতা-ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরী হয়, হলায়ুধ একে নিয়তি বলে স্বীকৃতি দিতে চায়। দাস-প্রভুর এই দ্বৈত-বিপরীত সম্পর্ক যে সমাজের সৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক কোন প্রপঞ্চ, হলায়ুধ তা এড়িয়ে গিয়ে একে প্রাকৃতিক সম্পর্ক হিসেবে বৈধ ঘোষণা করতে চায়।

আলাপের এক পর্যায়ে সোমজিৎ যখন নাছোড়বান্দার মতো হলায়ুধকে চেপে ধরে রাজার কাছে মৈত্রী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য, হলায়ুধ তখন মন্তব্য করে – “ব্যক্তির ইচ্ছায় কিছুই হয়না – সমস্তই হয় রাষ্ট্রের প্রয়োজনে।” এখানে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্রের অধিক ক্ষমতা ও গুরুত্ব প্রকাশ পায়। যদিও রাষ্ট্র পরিচালিত হয় ব্যক্তির মঙ্গলার্থে, ব্যক্তির নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে, কিন্তু কখনো বা ব্যক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে রাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করে, যেখানে লাভবান হয় শুধু নীতি প্রণয়ননকারী একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষ, আর অবহেলিত হয় সাধারণ মানুষ অর্থাৎ প্রাকৃতজন।

বসন্তদাস উপন্যাসের এক পর্যায়ে মায়াবতীর মাতুল মিত্রানন্দের সাথে ভ্রমণে বের হয় ও বিশ্রামের জন্য একটি হাটে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে তখন সামন্ত রাজার দুই সৈনিক এসে এক মিষ্টির দোকান থেকে বিনা পয়সায় মিষ্টি খেয়ে চলে যায়। এতে দোকানের বিক্রেতা নারী ক্ষেপে যায় এবং সৈনিকদের গালিগালাজ শুরু করে। একটা সৈনিক তরবারি বের করলে দোকানী আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং তরবারির জবাবে এক হাড়ি মিষ্টির রস সৈনিকের মুখে ছুড়ে মারে। এই দৃশ্য দেখে বসন্তদাস কৌতুকস্বরে বলে – “দেখলে তো? বঙ্গদেশী রমণী কিরূপ ভয়শূন্য হতে পারে! তরবারির বিরূদ্ধে তার অস্ত্রখানি কি প্রকার কল্পনা করতে পারবে?” এই দৃশ্যপট থেকে সর্বহারা বঙ্গবাসীর প্রতিবাদের ধরণ ও লড়াইয়ের হাতিয়ার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তারা তরবারি, কামান, বন্দুকের যোগান না পেলেও যখনই রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়েছে, দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য সামগ্রী থেকে সংগ্রামের হাতিয়ার বেছে নিয়েছে। যে উৎপাদিত পণ্যের প্রাপ্য মজুরী থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে, সেই পণ্যকেই তারা সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এখানে শোষকের অস্ত্রের মুখে শোষিত, নিরস্ত্র ও সর্বহারা বাঙালীর প্রতিবাদের রূপটি ব্যক্ত হয়েছে।

বাঙলায় যখন সেন রাজার পলায়ন আসন্ন, সামন্ত রাজাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সর্বোচ্চ বিরাজমান, তখন জনসাধারণ সেই বিশৃঙখলা ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে যবনদের দলে যোগ দেয়, নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়। লীলাবতী তখন শ্যামাঙ্গের সন্তান গর্ভে ধারণ করে। কিন্তু সেসময়কার সনাতন সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী লীলাবতীর এই সন্তান স্বীকৃতি পাবে না। লীলাবতী চায় সন্তানকে স্বীকৃতি দিয়ে শ্যামাঙ্গের সাথে বৈধ জীবন কাটাতে। তাই সে শ্যামাঙ্গকে প্রস্তাব দেয় যবনদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে ও সেই ধর্মমতে লীলাবতীকে বিয়ে করতে। এখানে লীলাবতী ইসলাম ধর্মে অনুরাগী হয়ে ধর্ম গ্রহণ করে নি, বরং সমাজে স্বামী-সন্তানসহ নিজের পরিচয় নির্মাণ করতে ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে যবনদের ধর্মের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। এই ঘটনাটি শুধু লীলাবতীর একার ঘটনা নয়; বারো শতকের বাঙলার শত শত নারীর ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণ।

উপন্যাসের শেষে এসে পাঠক জানতে পারে মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের মৃত্যু হয় যবনদের হাতে। উপন্যাসের লেখকের মতে, এটিই অনিবার্য। কেননা শ্যামাঙ্গ যবনদের ধর্মে দীক্ষা নেয়নি। অন্যদিকে মৃৎশিল্পী হিসেবে শ্যামাঙ্গ শিল্প তৈরীতে সেসময়কার সনাতন সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ স্বীকৃত রীতিও মানে নি। শ্যামাঙ্গ সমাজ স্বীকৃত কাঠামোর বিপরীতে নিজ মননের বাসনায় নারী মূর্তি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। আর সমাজের বাইরে গিয়ে যে এজেন্ডা তৈরী হয়, তা সমাজের মূলধারার স্রোতে টিকে থাকে কদাচিৎ। গৌর অঞ্চলে গিয়ে শ্যামাঙ্গ যখন সমাজের প্রথিত নিয়মের বাইরে ভিন্ন রীতির মূর্তি দেখে, তখন শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে, “গৌরীয় রীতি কোন রীতি নয় – এ হলো রীতিভঙ্গের রীতি”। বিপরীতভাবে বললে, সুনির্দিষ্ট রীতির বাইরে যা রীতি নয়, তাও একধরনের রীতি। অর্থাৎ, অবিন্যস্ততার বিন্যাস – যা নৃবিজ্ঞানে কাঠামোবাদ (Structuralism)-এর আলাপকে ইঙ্গিত করে।

“প্রদোষে প্রাকৃতজন” উপন্যাসের এমন আরো কিছু অংশের ঘটনাকে তুলে এনে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে। আগ্রহী পাঠকরা চাইলে সেসব বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারেন। কিংবা কেউ উপন্যাসটি আরেকবার পড়ার আগ্রহ বোধ করতে পারেন। এতেই লেখাটির স্বার্থকতা।