নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস জানা কেন জরুরি?

[Anthrodendum-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রবার্ট লোউনের ‘Being History’ লেখাটি এনথ্রোসার্কেলের জন্য অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ হেল বুবুন। লেখাটির মূল থিমঃ নৃবিজ্ঞানের শাস্ত্রীয় ইতিহাস পড়ার যৌক্তিকতা।]

আমি ১৯৭৮ সাল থেকে নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস পড়াচ্ছি (হিসাবটা দু একবছর এদিক ওদিক হতে পারে যদিও) । ক্যারিয়ারের শুরুতে ও শেষে উভয় ক্ষেত্রেই আমাকে একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছেঃ কেন শিক্ষার্থীদের নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস পড়তে হবে? তবে এই প্রশ্নের পেছনে পূর্বে যে যুক্তি দাঁড় করানো হতো, সেখানে এখন র‍্যাডিকাল পরিবর্তন এসেছে। আশির দশক ছিলো পজিটিভিজমের স্বর্ণযুগ এবং তখন এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল যে নৃবিজ্ঞানের মতো ‘সামাজিক বিজ্ঞান’-এর শাস্ত্রসমূহেরও উচিত প্রকৃত অর্থে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করা, সহজ অর্থে যতোটা সম্ভব পদার্থবিজ্ঞানের মতো হওয়ার চেষ্টা করা। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের তাদের শাস্ত্রের ইতিহাস পড়তে হয় না, তবে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা কেন পড়বে? অবশ্য পরবর্তীতে গবেষণার দৃষ্টিকোণ ও পাঠ পদ্ধতি হিসেবে ‘রিফ্লেক্সিভিটি’ পজিটিভিজমের স্থান গ্রহণ করলে নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ শিক্ষার্থীদের কাছে অধিক অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ‘ডিকলোনাইজিং এন্থ্রোপলজি’ একটি জনপ্রিয় প্রবণতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর এই অবস্থানে আবারো পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার্থীরা জানতে চাচ্ছে কেনো তাদের এখনো মরে ভূত হয়ে যাওয়া শ্বেতাঙ্গ হেটেরোসেক্সুয়াল পুরুষ ইউরোপিয়ান নৃবিজ্ঞানীদের লেখা পড়তে হবে (তাও আবার সেগুলো পড়াচ্ছেন একই পরিচয়ের একজন ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গ পুরুষ?) সব থেকে খারাপ দিক হলো, এই নৃবিজ্ঞানীদের প্রায়ই অভিযুক্ত করা হয় ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও এজেন্ডার সাথে সংযুক্ততার জন্য। 

বোধগম্যভাবেই অনেক প্রবীন নৃবিজ্ঞানী (এর মধ্যে আমাদের সংগঠন আমেরিকান এন্থ্রোপলজিকাল এসোসিয়েশনও রয়েছে) এই নতুন অবস্থানের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন; তাদের মতে, এই অবস্থান নৃবিজ্ঞান নামক জ্ঞানশাস্ত্র ও এর ইতিহাসের একটি অতিরঞ্জিত ও সরলীকৃত উপাস্থপনা। যদিও তাদের বক্তব্য একেবারে ভিত্তিহীন নয়, কিন্তু এই ধরণের অপরাধশূন্যতার উচ্চকিত ঘোষণা খুব কমই প্রভাব রাখবে। তবে আমার পরামর্শ থাকবে যে, রক্ষণশীল অবস্থান গ্রহণ না করে, আমার প্রজন্মের নৃবিজ্ঞানীদের বরং এই শাস্ত্রের সাথে সুদীর্ঘ সম্পৃক্ততার সুযোগ নিয়ে আমাদের সময়ে যে শাস্ত্রীয় রুপান্তরগুলো ঘটেছে, তা একটি ক্রিটিকাল ও বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। 

পশ্চিম আফ্রিকায় সরেজমিন অধ্যয়ন অভিজ্ঞতার ফলে তৈরি হওয়া দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা আমার এই অঞ্চলের ইসলাম সম্পর্কিত বোঝাপড়াকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলের তরুণরা যুক্ত হচ্ছে (তাদের মতে) ইসলামের কঠোর অনুশীলনে, এক নতুন ধরণের ইসলামি ধর্মানুরাগে। এই রূপান্তর স্বভাবতই এই অঞ্চলে কাজ করা তরুণ প্রজন্মের নৃবিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে৷ কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সকল তাত্ত্বিকরা যেটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে সেটা হলো ইসলামি ধর্মানুরাগ ও ধর্মচর্চার পুরোনো রূপ, যার স্থান নতুন প্যারাডাইমটি দখল করতে চাচ্ছে। যেহেতু নতুন প্যারাডাইমটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে আমি এই অঞ্চলের একটি মুসলিম সম্প্রদায়ে থেকেছি এবং কাজ করেছি, এই অভিজ্ঞতা আমাকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে, যাকে আমি আখ্যায়িত করি ”দি রিভেঞ্জ অব দি গিজার্স” নামে। ৭০ ও ৮০ -এর দশকে যখন আমি ফিল্ডে ছিলাম, তখন এই অঞ্চলের ধর্মানুরাগ সম্পর্কিত ভাবনা ও প্রত্যাশা সামাজিক স্তরবিন্যাসকেই প্রতিফলিত করতো৷ তরুনদের থেকে বয়স্কদের বেশী ধার্মিক ধরে নেয়া হতো; পুরুষদেরকে নারীদের থেকে; মুক্ত বংশের উত্তরাধিকারদেরকে দাস বংশোদ্ভুত ব্যক্তিদের থেকে; হাজিদেরকে অ-হাজিদের থেকে। এটা ধর্মানুরাগ বিষয়ক ‘সাংস্কৃতিক’ প্রত্যাশার একটি নির্ধারণী সূচক। বলাই বাহুল্য যে, স্বতন্ত্র ব্যক্তির আচরণ এই সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা মেনে চলতো না। আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক হলো, এই প্রত্যাশা অনেকটা অনিশ্চয়তাময় এবং প্রেক্ষিত নির্ভর। দাস মর্যাদার একজন বয়স্ক নারী যে হজ্বব্রত পালন করেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে ধর্মীয় যথাযথতার আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়, কিন্তু কখনো কখনো একই ব্যক্তি দাস বংশদ্ভুত অন্যান্য নারীদের সাথে অশ্লীলভাবে গান ও নাচে যোগদান করে, যে আচরণ একইসাথে একটি সামাজিক ট্যাবু ও দাসদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত।  ধর্মানুরাগের নতুন একীভূত ও অভিন্ন রীতিনীতি এই ধরণের দ্বার্থকতা দূর করে। একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আমার কাজ ধর্মানুরাগের পুরোনো রূপগুলোকে নস্টালজিকভাবে স্মরণ করা নয়, আবার নব রূপগুলোর আগমনকে উদযাপন (অথবা নিন্দা) করাও নয়। বরং আমার কাজ হলো, উভয় রূপের সুবিধা-অসুবিধা, লাভ-ক্ষতিকে সহানুভূতিশীলভাবে দেখা এবং নব রূপের আগমনের ফলে কি অর্জিত হয়েছে এবং কি হারিয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা। 

এই জ্ঞানশাস্ত্রের মৌলিক রূপান্তরগুলোর সাক্ষী হওয়ার কারণে আমি নিজেকে নৃবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক (এবং খুব সাম্প্রতিকও নয়) রূপান্তরগুলো ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে একইভাবে সক্ষম মনে করি৷ আমি নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বিভিন্ন মুখ্য বিষয়বস্তুকে (যা একসময় ছিল এই শাস্ত্রের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়) মূলধারা থেকে হারিয়ে যেতে দেখেছি। এক্ষেত্রে জ্ঞাতি তত্ত্ব সবথেকে সহজ উদাহরণ। জ্ঞাতি তত্ত্ব একসময় ছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের পরিচয় সূচক উপাদান। একজন নৃবিজ্ঞানীকে একজন সমাজবিজ্ঞানী থেকে আলাদা করার সবথেকে সহজ উপায় ছিল মাতৃপক্ষীয় ক্রস কাজিন বিয়ের কথা বলা এবং চোখে-মুখে বিহ্বলতার চিহ্ন খোঁজা। বর্তমানে আমি একই ধরণের বিহ্বল চেহারা দেখতে পাই সরেজমিন অধ্যয়নে নিযুক্ত স্নাতকদের মধ্যে। মর্গান ও লাউনসবারী থেকে শুরু করে ক্রোয়েবার, র‍্যাডক্লিফ-ব্রাউন, মারডক ও লেভি-স্ত্রসের  মতো প্রধান প্রধান নৃবিজ্ঞানীরা জ্ঞাতি তত্ত্বের সাথে জড়িত ছিল এবং জ্ঞাতি পদাবলীর বিশ্লেষণ ছিল অনেক নৃবিজ্ঞানীর কাজের একটি মৌলিক (এবং খানিকটা রহস্যময়) বিষয়বস্তু। একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আপনি মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব(alliance) না বংশধারা(descent) তত্ত্বের পক্ষাবলম্বী, এটা তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল। তারপর, একেবারে হঠাৎ করে, এই আলাপগুলো গুরুত্বহীন হয়ে যায়, হারিয়ে যায় নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মূলধারা থেকে। 

যে সময়ে জ্ঞাতি তত্ত্ব নৃবৈজ্ঞানিক মানচিত্রে স্থান হারায়, তখন ধর্মের নৃবিজ্ঞানেও (এন্থ্রোপলজি অব রিলিজিয়ন) র‍্যাডিকেল পরিবর্তন আসে। সত্তর-আশির দশকে আমি যখন আফ্রিকার ইসলাম নিয়ে গবেষণা ও লিখতে শুরু করি, তখন আমি এ ব্যাপারে আত্মসচেতন ছিলাম যে এই ফিল্ডে আমার কাজের তাৎপর্য সীমিত। তখনকার দিনে ধর্মের নৃবিজ্ঞান বলতে সৃষ্টিতত্ত্ব, জাদুবিদ্যা, পূর্ব পুরুষ পূজা ও শামানবাদের মতো বিষয়বস্তুকে বোঝাতো। ঐ সময়ে ইসলাম সম্পর্কে নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান (বিশেষ করে, ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের হাত ধরে মরোক্কো ও ইন্দোনেশিয়ায়) মাত্র উদিত হচ্ছিল অধ্যয়নের একটি গ্রহণযোগ্য উপ-বিশেষত্ব হিসেবে। বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছে। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম এখন এন্থ্রোপলজি অব রিলিজিয়নের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এবং জাদুবিদ্যা ও শামানবাদ এখন এই অনুসন্ধানের গৌণ বিষয়।

নৃবিজ্ঞানের পরিবর্তনশীল কেন্দ্র শুধুমাত্র নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের রূপান্তর নয়, বরং বিশদভাবে পৃথিবীর র‍্যাডিকেল পরিবর্তনকেও প্রতিফলিত করে। সাম্প্রতিক সমালোচকরা যুক্তি দেয় যে, অপ্রচলিত ধর্ম ও জ্ঞাতিত্ব ব্যাবস্থার উপর জোরারোপের একমুখী প্রবণতা ঔপনিবেশিক আধিপত্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। উপনিবেশায়িত জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করা হয়েছিল পৃথক পৃথক দেশজ সংস্কৃতি ও সমাজে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে ভিন্ন ধরণের জ্ঞাতি ব্যবস্থা, চিন্তা ধর্ম, রাজনীতি ও অর্থনীতি। আদতে এই ‘অনুমিত’ পৃথক সমাজগুলো গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন উৎস থেকে আসা অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক একদল জনগোষ্ঠী নিয়ে, যারা প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি সাড়া দিচ্ছিল। কিন্তু এই বিষয়টি চাপা পড়ে গিয়েছিল সমাজ-সংস্কৃতিকে শ্রেণিকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি দ্বারা। নৃবিজ্ঞানীরা (বিশেষ করে এদের মধ্যে যারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ) যে এই অগোছালো ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন এমন না। কিন্তু সাংস্কৃতিক সঙ্গতি অর্জনের প্রচেষ্টায় তারা তথ্যের এই অসমাঞ্জস্যপূর্ণতাকে পদ্ধতিগতভাবে আড়ালে রাখেন। এই ধরণের বোঝাপড়া আসলে একটি উপনিবেশায়িত দুনিয়ার উপনিবেশায়িত দর্শনকেই প্রতিফলিত করে৷ এর থেকেও খারাপ দিক হলো, চিন্তাধারা-জ্ঞাতিত্ব-অর্থনীতি-রাজনীতি-ধর্ম এর একেবারে অপরিচিত রূপের প্রতি জোরারোপ উপনিবেশায়িত জনগোষ্ঠীকে ”এক্সোটিসাইজ’ করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। এর মানে এই নয় যে, সকল নৃবিজ্ঞানী সচেতনভাবেই তাদের কাজে ঔপনিবেশিক দর্শন চাপিয়ে দিতে চেয়েছে অথবা তারা ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষে কৈফিয়ত দিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কিছু নৃবিজ্ঞানী ধীরভাবে (খুব বেশীই গোপনে) এবং অন্যরা সরাসরি ঔপনিবেশিক কতৃত্বের বিরোধীতা করেছে। এরপরও ক্ষুদ্র আকারের স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্কৃতির ঔপনিবেশিক ফ্রেমওয়ার্ক আমার পূর্বসুরী নৃবিজ্ঞানীদের কাছে সম্পূর্ণভাবে সত্য ও সহজাত বলে প্রতীয়মান হয়েছিল; এটা দুনিয়া সম্পর্কে চিন্তা করার একটি উপায়, যা ছিল ওই সময়ে (কিন্তু এখন আর না) তাত্ত্বিকদের কাছে স্বজ্ঞাতভাবে অর্থপূর্ণ।

বর্তমানে নৃবিজ্ঞানীদের কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন আর অর্থপূর্ণ নয়। কারণ, শুধু নৃবিজ্ঞান নামক জ্ঞানশাস্ত্রই নয়, পৃথিবীরও রূপান্তর ঘটেছে। পুরোনো ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন, বৃহদায়তন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যর্থতা এবং নব্য-উদারবাদী অর্থনৈতিক ভাবাদর্শের সাফল্য সম্পূর্ণরূপে স্থানচ্যুত ও রূপান্তরিত করেছে ওইসব গ্রামীন সম্প্রদায়কে যাদেরকে ঔপনিবেশিক প্যারাডাইমের নৃবিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছিল আলাদা আলাদা সংস্কৃতির উদাহরণ হিসেবে। গ্রাম থেকে শহরে ক্রমবর্ধমান মাইগ্রেশনের ফলে গ্রামীন সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন আত্মীয় গোষ্ঠী (যা একসময় ছিল গ্রামীন সম্প্রদায়ের বন্ধনের ভিত্তি) দিন দিন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বংশধারা গোষ্ঠীর পরিবর্তে জ্ঞাতিত্ব ক্রমশ নেটওয়ার্কের রূপ ধারণ করছে। এই পরিবর্তনগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে ইসলাম ও খ্রিস্টানিটির মতো বৈশ্বিক ধর্মের দ্রুত প্রসার, যা বিভিন্ন উপায়ে অধিকাংশ সময় সক্রিয়ভাবে ও আত্মসচেতনভাবে ”ট্রেডিশন’-কে প্রত্যাখান করছে।

জ্ঞানশাস্ত্রের এই ধরণের র‍্যাডিকাল রূপান্তরের পরবর্তী কালে যেসব নৃবিজ্ঞানী বেড়ে উঠেছে তারা তাদের পূর্বসুরীদের ঔপনিবেশিক পূর্বানুমান সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন হলেও কেনো তাদের পূর্বসূরীরা এসব পূর্বানুমানকে সত্য ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিল এটা উপলব্ধি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। একইসাথে তাদের নিজস্ব পূর্বসংস্কার তাদেরকে পূর্বসূরীদের ভালো কাজ ও খারাপ কাজ উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করতে প্রবর্তিত করেছে। কেউ প্রকৃত অর্থে উপনিবেশায়িত জনগোষ্ঠীর অতীতকে বুঝতে পারবেনা যদি না সে আত্মীয় দল, ধর্মীয় ভাবাদর্শ ও রাজনৈতিক অর্থনীতির গুরুত্ব উপলব্ধি না করে, যা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। সত্তর-আশির দশকে যখন আমি আফ্রিকায় গবেষণা করছি, তখন জ্ঞাতি উপনিবেশিত নৃবৈজ্ঞানিক ভাবনার অলীক কল্পনা নয়, বরং অসাধারণভাবে বাস্তব একটি প্রপঞ্চ ছিল। এর মানে এটা বলা নয় যে, নৃবৈজ্ঞানিক লেখনীতে জ্ঞাতি সম্পর্ক যথার্থভাবে বর্ণিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। ফলাফল ভালো হোক বা খারাপ হোক, আমাদের বোঝাপড়া পরিবর্তিত হতে বাধ্য। সমসাময়িক  কালের কিছু পন্ডিতেরা যেভাবে এই স্মৃতিবিলোপের ব্যাপারটিকে অস্বীকার করে থাকে, তাতে আদতে নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রের ইতিহাস তো বটেই, উপনিবেশিত গণমানুষের ইতিহাসও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, উপরন্তু এটি তারা আবার উপনিবেশায়িত গণমানুষের নাম করেই ঘটিয়ে থাকে।এন্থ্রোপলজিকাল ট্রেডিশনের কিছু সমালোচক ও একই সাথে, কিছু সমর্থকের আত্মনৈতিক দম্ভ আমাকে ক্রমবর্ধমানভাবে অসহিষ্ণু করে তুলেছে। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে আমি নিজের কিছু ভুল ত্রুটি (নিশ্চিতভাবে সব নয়) সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ পেয়েছি এবং সেগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করেছি। আমাদের কাছে যা একেবারে স্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে, তা  আমার পূর্বসুরীরা বুঝতে পারেনি, এই উপলব্ধি আমাকে ক্রমশ বিনয়ী করে তোলে। ভবিষ্যত প্রজন্ম কি খুঁজে পাবে যা আমরা লক্ষ্য করিনি, যদিও তা তাদের কাছে স্পষ্ট ও স্বাভাবিক বলে আবির্ভুত হবে? যদি বার্ধক্য আমাকে প্রগাঢ় দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি বিনয়ও দিয়ে থাকে, তবে এই বিনয় ছিল একটি আশীর্বাদ।

মূল লেখার লিংক