মানব পরার্থবাদের আদি সন্ধান


[সাইন্স.অর্গে প্রকাশিত মাইকেল বলটারের লেখা ‘Human altruism traces back to the origins of humanity’ লেখাটি অনুবাদ করেছেন সাদিয়া শান্তা।]

কাউকে বিপদ থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণত অন্য প্রজাতির প্রাণীদের চেয়ে অধিক সহযোগী হয় এবং আন্তরিকভাবে অতিসত্বর পরোপকারী মনোভাব ধারণ করে। নতুন একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তান লালন-পালনে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা অর্থাৎ তথাকথিত “co-operative breeding” চর্চার ফলে মানবকূল এই বৈশিষ্ট্যটি লাভ করেছে; যেমন – শিশুর যত্ন কেবল মা-ই নেয় না, বরং পরিবারের অন্যান্য সদস্য, কখনো বা অনাত্মীয় প্রাপ্তবয়স্করাও শিশুর যত্ন নিয়ে থাকে। গবেষকের মতে, মানুষের পারস্পরিক সহযোগি হয়ে উঠার এই প্রবণতাটি পরবর্তীতে ভাষার বিকাশ এবং জটিল সভ্যতার বিকাশের সাথেও সম্পর্ক ইঙ্গিত করে।

সন্তান পালনের কাজে সহায়ক প্রতিপালনের মনোভাব এককভাবে কেবল মানুষ প্রজাতিরই বৈশিষ্ট্য নয়। পক্ষিকূলের ১০ শতাংশেরও বেশি পাখি সহায়ক প্রতিপালনের কাজ করে। যেমন – মিরক্যাট এবং নিউ ওয়ার্ল্ড মানংকিদের মধ্যে আছে ট্যামারিন আর মারমোসেট। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রাইমেট বর্গ, গ্রেট এইপ (Great Ape) যেমন- শিম্পাঞ্জি, এরা সহায়ক প্রতিপালক নয়। কারণ মানুষ আর শিম্পাঞ্জির বংশ রেখা আরো ৫-৭ মিলিয়ন বছর আগেই বিভক্ত হয়ে যায় এবং এইপ-দের মধ্যে কেবল মানুষই সহায়ক প্রতিপালনের কাজ করে। গবেষকরা এই ভেবে বারবার দ্বিধায় পড়েছেন যে, কীভাবে এই সাহায্যকারী মনোভাব মানুষ প্রজাতির মধ্যে পরবর্তীতে আরো বিকশিত হয়েছে।

১৯৯০ সালের শেষ দিকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদালয়ের ইমেরিটাস নৃবিজ্ঞানী সারাহ ব্লাফার হার্ডি সহায়ক প্রতিপালনের একটি অনুমান (co-operative breeding hypothesis) প্রস্তাব করেন। তার মডেল অনুযায়ী, বিবর্তনের শুরুতে উন্নত প্রজাতির এইপ হিসেবে মানুষের মধ্যে যে বোধশক্তি ইতিপূর্বে বিদ্যমান, তার সাথে এই সহায়ক প্রতিপালনের মনোভাবও যুক্ত হয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে বুদ্ধিশক্তি ও সামাজিক বোধের এক শক্তিশালী সমাহার ঘটে যা পরবর্তীতে আরো বড় মেধার এমনকি ভাষা এবং সহযোগি মনোভাবের এক অভূতপূর্ব স্তরের উদ্ভাস ঘটায়। হার্ডির প্রস্তাবনার পরপরই সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ক্যারেল ভ্যান শাইক এবং জুডিথ বুর্কার্ট এমন কিছু ধারণার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, সহায়ক প্রতিপালনকারী বর্গের প্রাণীরা সাধারণত কোন তাৎক্ষণিক পুরষ্কার লাভের আশা ছাড়াই অন্য প্রাণীদের সাহায্য করার মাধ্যমে পরোপকারী আচরণে নিযুক্ত হয়; যেমন- মারমোসেটরা কোন পুরষ্কার ছাড়াই অন্যান্য মারমোসেটদের খাদ্য জোগাড়ে সাহায্য করে।

কিন্তু তারপরও এধরনের গবেষণার ব্যাখ্যা নিয়ে এবং মানব বিবর্তনের সাথে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতবিবাদ দেখা যায়। এর একটি বড় দ্বন্দ্ব হলো – শিম্পাঞ্জির মত এইপরা যারা কিনা বিপদে একে অপরকে সাহায্য করে থাকে তারা কি প্রকৃতপক্ষে তা নিঃস্বার্থভাবে করে, নাকি প্ররোচণায় ফেলে তাদের থেকে সাহায্য নেওয়া হয়। কিছু গবেষকের মতে, শিম্পাঞ্জিরা যদি লালনপালনের কাজে সহায়ক না হয়ে কখনো কখনো কেবল পরোপকারী হিসেবে ভূমিকা রাখেও, তবুও তা সহায়ক প্রতিপালনের অনুমান (co-operative breeding hypothesis) এর প্রতি দূর্বল সমর্থন কেবল। কিন্তু শিম্পাঞ্জি ও অন্যান্য বর্গভুক্ত প্রাণীরা নিঃস্বার্থ আচরণে অংশগ্রহণ করে কিনা তার উপর যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে সেগুলো হয়তো গবেষণার পদ্ধতিগত সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত, নয়তো কিভাবে তার ব্যাখ্যা করা উচিত সেই মতবিবাদ দ্বারা আক্রান্ত।

‘অনলাইন টুডে’ এর নতুন গবেষণা ‘ন্যাচার কমিউনিকেশনস’ এ বুর্কার্ট, ভ্যান শাইক, এবং তাদের সহকর্মীরা একটি ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তাদের দল আগের পদ্ধতিটিকে সামান্য পরিবর্তন করে নতুন একটি আদর্শ মানের যন্ত্রের নকশা করেন যেটি কিনা প্রাইমেট বর্গের প্রায় সকল প্রজাতির প্রাণীর সহযোগিতামূলক আচরণ পরখ করতে ব্যবহারযোগ্য। কিছু সচল পাটাতন দিয়ে তৈরী সেই যন্ত্রটিকে কোন প্রাণীর খাঁচার বাইরে রাখা হতো। পাটাতনের এক মাথায় গবেষক তার সুবিধা অনুযায়ী কোন খাবার রাখতো এবং সেই প্রাণীটি যেন একটি হ্যান্ডেল দিয়ে খাবার টেনে অন্য প্রাণীদের নাগালের মধ্যে নিতে পারে গবেষক সেই প্রশিক্ষণ দিত । কিন্তু যে প্রাণীটি হ্যান্ডেল দিয়ে খাবার টেনে দিবে সে আবার তার নিজের আয়ত্ত্বে খাবার টেনে আনতে পারে না। এই পুরো পদ্ধতিটি এমনভাবে নকশা করা যাতে মনে হবে প্রাণীটি তার সাথী প্রাণীদের প্রতি পরোপকারী আচরণে নিযুক্ত হচ্ছে।

এই পরীক্ষাটির ফলাফলের উপর যখন পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করা হয়েছিল, তখন গবেষকরা লক্ষ্য করলো – যে পর্যায় পর্যন্ত একটা প্রজাতির প্রাণী সহযোগী প্রতিপালক হিসেবে কাজ করে এবং যে পর্যায়ে একটা প্রাণী অন্য প্রাণীকে খাবার জোগাড়ে সাহায্য করে – সেই দুই পর্যায়ের সহযোগী মনোভাবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ একরৈখিক সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া উচ্চতর বোধ (যা সাধারণত মস্তিষ্কের আকার অনুযায়ী পরিমেয়), দলবদ্ধ হয়ে শিকারের প্রবণতা, দলের সদস্যদের মধ্যে দৃঢ় সামাজিক বন্ধন, ইত্যাদি আচরণগুলো – যা প্রাণীর পরার্থপর আচরণের সম্ভাব্য সমর্থন ও ব্যাখ্যা দেয় – সেগুলোও প্রাণীর সহায়ক আচরণের সাথে হয়তো খুবই দূর্বল আন্তঃসম্পর্ক দেখিয়েছে নয়তো একেবারেই দেখায়নি।

গবেষকদের মতে, মানুষ হয়তো সহায়ক প্রতিপালক হয়ে উঠেছে আরো কয়েক মিলিয়ন বছর আগেই, যখন আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষরা প্রথমবার বৃক্ষবাসী জীবন ছেড়ে সাভানা আর অরণ্যের পরিবেশে নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন শুরু করে। অন্য প্রজাতির প্রাণী (যেমন- পাখি) থেকে আমরা জানি যে, এই সহায়ক মনোভাবটি প্রতিকূল পরিবেশের জন্য প্রযোজ্য যেখানে বেঁচে থাকাই কষ্টকর। বুর্কার্টের ভাষ্যমতে, “একবার যখন তারা সাভানার মতো আবাসস্থলে বসবাস শুরু করে, তখন স্বভাবতই সন্তানকে একা দেখাশোনা ও লালনপালন করা মায়েদের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠে।” বুর্কার্ট আরো বলেন যে, সন্তান লালনপালনে অন্যদের সাহায্য পাওয়ার সুবিধায় মায়েরা আরো সন্তান জন্ম দেওয়ার সুযোগ পায়। কেননা আগের সন্তানটি তখন অন্যান্য বয়ষ্ক সদস্যদের উপরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই বৈশিষ্ট্যটির বিকাশ মানুষের প্রজনন সাফল্যকেও বৃদ্ধি করে।

নেদারল্যান্ডে ম্যাক্স প্লাংক ইন্সটিটিউটের প্রাইমেট গবেষক ক্যাথেরিন ক্রোনিন বলেন, “গবেষকরা এই সকল ধারণাগুলি পরখ করার জন্য এমন একটি আদর্শ পন্থা অবলম্বন করেন যেটি তাদের অনুসন্ধানের বিস্ময়কর কাজ হিসেবে স্বীকৃত।” ক্রোনিন আরো বলেন যে, এই অনুসন্ধানের ফলাফল একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কেননা এই অনুসন্ধানে পূর্বের অনুসন্ধানগুলোর মতো প্রাণীদের খাঁচা থেকে বের করে এনে কৃত্রিম পরিবেশে রেখে পরীক্ষা করা হয়নি, বরং খাঁচার ভেতরেই সাধারণত প্রাণীদের যে দলীয় পরিবেশ সেখানেই পরীক্ষাগুলো চালানো হয়।

তবুও ক্রোনিন একটি ব্যাপারে সতর্ক করেন যে, মানুষের অতিশয় পরোপকারী হয়ে উঠার পেছনে সহায়ক প্রতিপালনের ব্যাখ্যাটি হয়তো অনেকগুলো ব্যাখ্যার মধ্যে একটি ব্যাখ্যা মাত্র।

ইংল্যান্ডের সেইন্ট এন্ড্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ এন্ড্রু হোয়াইটেন এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এটি একটি বিস্তৃত চিত্তাকর্ষক গবেষণা। গবেষকরা অনেকগুলো প্রাইমেট প্রজাতির মধ্যে একই ধরনের সহজ ও সুষ্ঠু পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বলেন, সহায়ক প্রতিপালনের মনোভাবই একমাত্র জাদুময় বিষয় নয় যা আজ আমাদের পরোপকার বানিয়েছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত নতুন ফলাফলটিকে হার্ডি বলেছেন “a thing of beauty“। কেননা এই ফলাফল অনুযায়ী মানুষের পরোপকারী আচরণের কারণ হিসেবে সহায়ক প্রতিপালনের অনুমানটিই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়। হার্ডি তার সহকর্মী এবং বুর্কার্টের সাথে একমত প্রকাশ করেন যে, সহায়ক প্রতিপালনের মনোভাবটিই সুদূরপ্রসারী বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেয়; যেমন- ‘হোমো’দের মধ্যে কেবল এইপদেরই কেন সেসব স্নায়ুর বিকাশ ঘটে যা সহযোগী আচরণ প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয়। হার্ডি বলেন, “কিন্তু তবুও মানুষ কেন অন্যের চিন্তা, আবেগ, উদ্দেশ্য, প্রয়োজন, এবং চাহিদার প্রতি এতো আগ্রহ দেখায় – যেসব গুণাবলি অদ্বিতীয়ভাবে মানুষকে অত্যন্ত সহযোগী করে তুলে – তা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের গবেষণার আরো গভীরে যেতে হবে।”

মূল লেখার লিংক