নৃবিজ্ঞানের অনাদৃত নেটিভ সহযোগীরা

[মাঠকর্মে স্থানীয় সহযোগীদের নিজস্ব লোকজ জ্ঞান এবং অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যতীত ফ্রাঞ্জ বোয়াস এবং মার্গারেট মিডের মতো প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানীরা কর্মক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখতেন না। তবে নৃবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানীদের সফলতার গল্পগুলোতে এই স্থানীয় সহযোগীদের কথা প্রায়শই অনুপস্থিত। সাপিয়েন্স ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আমরিনা রোজইয়াডার ‘Unsung Native Collaborators in Anthropology’ প্রবন্ধটি এনথ্রোসার্কেলের জন্য অনুবাদ করেছেন আশরাফুল আলম প্রান্ত।]

  

একজন ‘বাদামী’ ত্বকের নারী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী নৃবিজ্ঞানী হিসেবে, আমার কাছে  সফলতা ধারণায়  ছিল গ্যালারীপূর্ণ  ‘সাদা’ পশ্চিমা পন্ডিতদের ছবি। ভাবতাম সফলতা হলো প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সামোয়া দ্বীপপুঞ্জে আসা সাহসী নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিডের সদা কঠোর চেহারাটা। বা বালির পুলিশ যখন অবৈধ মোরগ লড়াইয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন সেখান থেকে পালানো সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড গির্টজের অদ্ভুত উড়ন্ত চুলগুলোকে আমার সফলতার প্রতিচ্ছবি বলে মনে হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস বইগুলোর পুরাতন পাতা ওলটানোর সময়, আমি কোথাও একজন অশ্বেতাঙ্গ এথনোগ্রাফারের উল্লেখ পাইনি। বইগুলোতে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রতি এমন মনোযোগ দেয়া হতো যেন তারা সম্পূর্ণ একাকীভাবেই নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, অধ্যবসায়, কলম ও নোটবুক দিয়ে গোটা নৃবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ।

তারকা হিসেবে সমাদৃত নৃবিজ্ঞানীদের কর্মজীবন খুব তথ্যসমৃদ্ধভাবে সংরক্ষিত আছে। অথচ অনেক নৃবিজ্ঞানীর জন্যই গবেষণার অংশ ছিলো অনুবাদকদের অতিসতর্ক শ্রম, সাংস্কৃতিক দোভাষী এবং গবেষণা সহযোগীদের সাহায্য- যা নৃবিজ্ঞানীদের পৃথিবীটাকে ভালো করে বুঝতে সাহায্য করেছিলো। কিন্তু এই অশ্বেতাঙ্গ সহযোগীদের প্রসঙ্গে খুব কমই জানা যায়, যেখানে তারাই নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলোকে সফল করতে মূল সাহায্যটা করেছিলেন।

খুব কম মানুষ আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী কোরা দ্যু বয়েসের জাভানিজ সহযোগী আলি বিন উসমাসকে চিনবেন, যাকে কোরা নিজের রক্ষক, পরামর্শদাতা এবং বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করেছেন। অনেকেই অপরিচিত স্কটিশ নৃবিজ্ঞানী ভিক্টর টার্নারের সহযোগী মুচোনা ‘দ্য হর্নেটের’ সাথে। যিনি (বর্তমান জাম্বিয়ার অন্তর্গত) সাবেক উত্তর রোডেসিয়ার দেমবু জনগোষ্ঠীর ঔষধ এবং আচার অনুষ্ঠান বিষয়ে অদ্বিতীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি টার্নারের সাথে কাজ করেছিলেন স্থানীয় ধর্মের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে। উসমাস এবং মুচোনার মতো ব্যক্তিদের এমন অবিস্মরণীয় অবদান সত্ত্বেও তাদের বর্তমানে গন্য করা হয় নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসে গৌণ চরিত্র হিসেবে। 

তাই প্রশিক্ষণরত একজন ইন্দোনেশিয়ান নৃবিজ্ঞানী হিসেবে ইতিহাসে নিজের অবস্থান খুঁজে পেতে আমি প্রশ্ন করি: পশ্চিমের এই বিখ্যাত সাদা নৃবিজ্ঞানীদের সফলতার পেছনে কারা ছিলেন? এবং এই ব্যক্তিরা কিভাবে গবেষকদের অর্জনে নিজেদের ভূমিকা রেখেছিলেন?

২০২১ সালে নিজের গবেষণা প্রজেক্টের জন্য সংগ্রহশালায় করা কাজের ভিত্তিতে, আমি আমেরিকার সবচেয়ে খ্যাতিমান নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিড এবং ফ্রাঞ্জ বোয়াসের স্থানীয় গবেষণা সহযোগীদের জীবনী ও অবদানের উপর অনুসন্ধান করেছি। মূল কাজের ফুটনোট এবং কাগজপত্রের স্তূপে হয়তো জর্জ হান্ট এবং আই মাদে কালেরের নাম তাদের নিয়োগদাতাদের মতো তারকাখচিত হবে না। কিন্তু বিশ্বের নৃবৈজ্ঞানিক জ্ঞানকান্ডে তাদের অসাধারণ অবদান অনস্বীকার্য। এই প্রবন্ধটি মূলত তাদেরকে ভুলে যাওয়ার প্রতি একটি প্রত্যাখ্যান।  

জর্জ হান্ট এবং ফ্রাঞ্জ বোয়াস

জর্জ হান্ট ছিলেন উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় আমেরিকার একজন আদিবাসী এবং বোয়াসের মাঠকর্ম প্রতিনিধি ও কথোপকথনকারী। বোয়াস অধিকাংশ সময় তাকে “Dear friend” বলে ডাকতেন। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের ফোর্ট রুপার্ট অঞ্চলে ১৮৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করা হান্টের বাবা ছিলেন একজন ইংরেজ এবং মা একজন আদিবাসী টিঙ্কিত (Tlingit) । দুটি পৃথক সংস্কৃতিতে বড় হওয়ার সুবাদে, হান্টকে নিয়মিত সেই অঞ্চলে আসা সাদা পন্ডিত এবং সংগ্রাহকদের দোভাষী হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। হান্ট বোয়াসের সাথে ১৮৮৬ সালে জেসুপ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অভিযানে কাজ শুরু করেন। যা ছিলো উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাথে সাইবেরিয়া, মাঞ্চুরিয়া এবং রাশিয়ার সাখালিন দ্বীপের সংস্কৃতির মেলবন্ধন বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান।

জর্জ হান্ট

হান্টের প্রধান কর্তব্য ছিলো উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় আদিবাসী কোয়াক.ওয়াকা.ওয়াক (Kwakwa̲ka̲’wakw) সম্প্রদায়ের শিল্পকর্ম এবং তথ্যাবলি জোগাড় করা। তিনি সম্প্রদায়টির আচার-অনুষ্ঠানের বিষয়ে লিখে পূর্ব উপকূলে বসবাসকারী বোয়াসকে ডাকযোগে পাঠাতেন। হান্ট কোয়াক.ওয়াকা.ওয়াকদের জীবনপ্রণালী , মৌখিক ইতিহাস এবং পবিত্র রীতিনীতি ওপর হাজার হাজার হাতে লেখা ডকুমেন্ট তৈরি করেছিলেন।

তবে হান্টের দায়িত্ব তথ্য সংগ্রহের চেয়েও অনেক বেশি ছিলো। যেমন নৃবিজ্ঞানী চার্লস ব্রিগস এবং রিচার্ড বাউম্যান লিখেছেন যে, হান্ট একই সাথে বোয়াসের কথাগুলো কোয়াক.ওয়াকা.ওয়াকদের বুঝিয়ে দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ কোয়াক.ওয়াকা.ওয়াকদের স্যালমন মাছ এবং মাছের তেল মাখানো বেরিফল খাওয়ার ভোজন উৎসবে, হান্ট স্থানীয়দের কথোপকথনগুলোকে অনুবাদ করে বোয়াসকে স্থানীয় রীতিনীতি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি জ্ঞানের ইতিহাসবিদ (Historian of Knowledge) ইশায়াহ উইলনার এই মর্মে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে, হান্ট শুধু বোয়াসকে তথ্যই দিতেন না বরং নৃবিজ্ঞানী বোয়াস এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর এবং বিশ্বস্ত সম্পর্কও তৈরি করেছিলেন।

যেমনি করে বোয়াস তার অনাদৃত দোভাষী হান্টের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, ঠিক তেমনি হান্ট অন্যদের, বিশেষ করে আদিবাসী নারীদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। আদিবাসী নারীদের অবদান এই কাজে সবসময়ই উপেক্ষিত ছিলো। নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট ব্রুচাচ উল্লেখ করেছেন যে, হান্টকে সবসময় আদিবাসী সম্ভ্রান্ত নারীরা ঘিরে রাখতেন। হান্টের মা একটি সম্ভ্রান্ত টিঙ্কিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এদিকে হান্টের দুই স্ত্রীও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কোয়াক.ওয়াকা.ওয়াক নারী ছিলেন।

যদিও হান্ট নিজেকে কোনোদিনই একজন কোয়াক.ওয়াকা.ওয়াক বলে পরিচয় দেয়নি,  স্থানীয় সম্প্রদায় বরং তাকে একজন ‘বিদেশী ইন্ডিয়ান’ হিসেবে পরিচয় দিতো। হান্টের স্ত্রীদের সামাজিক মর্যাদা তাকে অভিজাতদের জ্ঞান লাভের সুযোগ দিয়েছিলো। আদিবাসীদের রন্ধনশৈলী এবং বিবাহের পবিত্র রীতিনীতি সম্পর্কে সে অধিকাংশ জ্ঞান লাভ করেছিলো তার উচ্চবংশীয় স্ত্রীদের কাছ থেকে। যখন তার প্রথম স্ত্রী লুসি হোমিকানিস মারা যায়, তখন সে বোয়াসকে লেখে:  “আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানো আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার ছিলো। যে আপনার ও আমার এবং আপনার জন্য আমি যেসব কাজ করছি সেসবে একজন বিরাট সাহায্যকারী ছিল।”

বোয়াস ও হান্টের মধ্যে নিবিড় সহযোগিতার সম্পর্ক থাকলেও, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা প্রায়ই বোয়াস এবং হান্টের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করতো। উইলনারের মতে, বোয়াস কয়েকবার হান্টের আর্থিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলো প্রতি পেজ ফিল্ড নোটের জন্য পারিশ্রমিক  কমিয়ে ৫০ থেকে ২০ সেন্টস করে দিয়ে। বোয়াসের এমন আচরণে কষ্ট পেয়ে, হান্ট এর প্রতিবাদে আকারে ছোট কাগজে ফিল্ডনোট লেখা শুরু করেন, যাতে তিনি বেশি টাকা উপার্জন করতে পারেন।

বোয়াস কয়েকবার হান্টকে প্রতিনিয়ত এমনকিছু নতুন উপাদান সংগ্রহ করার অনুরোধ করে বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন, যা সংগ্রহ করা কঠিন ছিলো। একবার বোয়াস হান্টকে একটি আদিবাসী কবরস্থান থেকে কলোনিয়ান সময়ের আগে সমাহিত লাশের হাড় এবং শিল্প সামগ্রী আনতে উৎসাহিত করে যা “পশ্চিমা প্রভাব মুক্ত” ছিলো। এই উদাহরণগুলো এটিই ইঙ্গিত করে যে, যতই হান্ট বোয়াসের গবেষণায় অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করুক না কেনো, তাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে হান্টের অবস্থান ছিলো নিরাপত্তাহীন।

আই মাদে কালের এবং মার্গারেট মিড

বোয়াস ও হান্টের ঘটনার অনেক বছর পরে, বোয়াসের বিখ্যাত ছাত্রী নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিডের মাঠকর্ম সহযোগী হিসেবে আই মাদে কালের নামক একজন বালিনিজ তরুণ চাকরি করতে আসেন। মাদে কালের ১৯১০ এর দশকে উত্তর বালি পাহাড়ি অঞ্চলের একটি নিম্নবর্ণের (Lower-caste family) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মালায় এবং ডাচ স্কুলগুলোতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা এই যুবক ইংরেজি, ডাচ, বালিনিজ সহ মোট পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন।

স্কুল থেকে পাশ করার পরে তিনি তৎকালীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের রাজধানী বাতাভিয়ায় চলে আসেন, যা মূলত বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী ‘জাকার্তা’ হিসেবে পরিচিত। তিনি সেখানে উচ্চ বেতনের একটি সরকারি চাকরির প্রত্যাশা করছিলেন। তবে তার বদলে তিনি সাক্ষাৎ পেয়ে যান মিড এবং তার স্বামী গ্রেগরি বেটসনের সাথে, যারা বালিতে মাঠকর্ম সম্পাদন জন্য একজন রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টের সন্ধান করছিলেন। বালিতে মিড ও তার স্বামীর মাঠকর্মের বিষয় ছিলো মানুষের চরিত্র গঠনের সাথে স্কিজোফ্রেনিক আচরণের সম্পর্ক অনুসন্ধান করা। ১৯৩৬ সালে এই তিন ব্যক্তির ঘটনাবহুল সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার যাত্রা শুরু হয়।

মার্গারেট মিড (সর্বডানে), তার বালিনিজ সহযোগী আই মাদে কালের (মধ্যে)

হয়তো মাদে কালেরকে মিডের কাজের প্রেক্ষাপটে খুব সামান্যই স্মরণ করা হয়, কিন্তু তিনি মিডের ফিল্ডনোটের জন্য পাঁচশয়ের অধিক বালিনিজ টেক্সট নিজে লিখে প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি বালিনিজ সংস্কৃতির অনেক কিছু অনুসন্ধান করেছিলেন, যেখানে একজন শিশুর ত্রৈমাসিক জন্মদিন পালন থেকে গ্রামের পবিত্রকরণ রীতিনীতির বিবরণীও উল্লেখিত ছিলো। বালিনিজ ভাষায় দক্ষতা মাদে কালেরকে জনজীবনের স্বাভাবিক এবং অদৃশ্য ঘটনাগুলোর প্রতি সংবেদনশীল করে তুলেছিলো। তার পর্যবেক্ষণ থেকে সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দুঃখ দুর্দশা বা চলতি আড্ডায় শিশুদের ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র নিয়ে দেখা অলীক স্বপ্ন থেকে শুরু করে  প্রচলিত সামাজিক সংস্কারগুলোর মতো কোনো বিবরণই বাদ যায়নি। স্থানীয়দের ভাষা না জানায় মিড প্রায়শই মানবজীবনের এই গভীর অন্তর্দৃষ্টিগুলো ধরতে পারছিলেন না। মাদে কালের মিডের তথ্যদাতা হিসেবে তার পরিবারের সদস্য এবং নিজের শৈশবের স্মৃতিদেরও সৃজনশীল ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এই পন্থাটি মিডের কাজের জন্য খুবই সতেজ ও সমৃদ্ধকারী ভূমিকা পালন করে, যেহেতু বালিনিজ সংস্কৃতি নিয়ে করা আগের কাজগুলোতে তথ্যদাতার ভূমিকা পালন করেছিলো শুধু উচ্চবংশের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরাই।

তবে মিডের অধীনে কাজ করার সময়ে মাদে কালের মিডের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে দ্বিধা করেননি। উদাহরণ স্বরূপ তিনি এক জায়গায় লিখছেন যে,“আমি একটি কান্নার আওয়াজ শুনলাম। গতদিন আমাদের সাথে দেখা হওয়া আই রিতা নামের শিশুটি কাঁদছিলো। আই নোনয়া [মিড] বলছেন যে, শিশুটির মা শিশুটির মাথায় আঘাত করেছে। আমি জানি না তিনি সত্যি বলছেন কিনা। একজন শিশু হামাগুড়ি দিতে শিখলেই বায়ুং এলাকার মায়েদের এমনটি করার প্রচলন নেই।’    

মজার ব্যাপার হলো, মাদে কালেরও নৃবিজ্ঞানীদের কাছে কিছু তথ্য লুকিয়েছিলেন। বালিতে সেই বিখ্যাত মাঠকর্মের ৫০ বছর পরে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিভাবে সেসময় একটি ভুল রঙিন চশমা থেকে মিড ও বেটসন বালির সমাজকে দেখেছিলেন। ভাঙ্গা উপনিবেশিক আইনকানুনের ফলে গ্রামীণ বালিতে সৃষ্ট জাতপাতের রাজনীতি (Caste politics) ও দরিদ্রতা নিয়ে নাকি মিড ও বেটসন খুব অল্পই সচেতন ছিলেন। মাদে কালের নিজেকে ও নিজের নিয়োগকর্তাদের ডাচ উপনিবেশের রোষানল থেকে বাঁচাতে, এইসব ‘কুৎসিত সত্য’ বাকিদের অজানা রাখতে সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক ভাবে সন্দেহজনক বা বালির উপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কিছু প্রচার করা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে নিয়ে যেতে ডাচ গোয়েন্দারা একটুও ইতস্তত: করতো না।

একজন কঠোর পরিশ্রমী এবং মেধাবী ব্যক্তি হয়েও মাদে কালের মিডের সাথে বিদেশে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বালিতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একসময় একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের দায়িত্বও পেয়ে যান। শিক্ষকতায় অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাদে কালের সে দায়িত্ব আনন্দের সাথে পালন করেন। যদিও পশ্চিমা বিশ্ববীক্ষা দিয়ে মাদে কালেরকে একজন ‘পন্ডিত’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। তবে যেসব আমেরিকান একাডেমিয়ানরা এই দ্বীপে কাজ করতে এসেছেন, তারা সকলেই একজন স্থানীয় তথ্যদাতা (Native informant) হিসেবে তাকে সম্মান প্রদর্শন করতেন।

১৯৭৮ সালে মৃত্যুবরণের আগে মাদে কালেরকে লেখা মিডের শেষ চিঠিতে তিনি লিখেন:  ‘১৯৩৬ সালে তোমার মতো কাউকে নিজের সহকারী হিসেবে পেলে, সে আসলে অত্যন্ত ভাগ্যবান ব্যক্তি হত।’

বোয়াস এবং মিড নিঃসন্দেহে ইতিহাসের দুইজন প্রভাবশালী নৃবিজ্ঞানী, তবে তারা সম্পূর্ণ একা এই জ্ঞানকান্ডে কোনো জ্ঞান সৃষ্টি করেননি। অধিকাংশ সময় স্বীকৃতি না পাওয়া এই স্থানীয় গবেষণা সহযোগীদের শ্রম, দুই মহারথীর খ্যাতিমান কাজকে পরিপূর্ণতা দিতে এবং তার একাডেমিক সফলতা এনে দিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তাই এই সহযোগীদের কর্ম উদ্যোগ, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা এবং কঠোর পরিশ্রম তাদের নিজেদের বিশেষ পান্ডিত্যের প্রতিভাকে প্রমাণ করে।

হান্ট এবং মাদে কালেরের গল্প আমাদের শেখায় যে, নৃবিজ্ঞান সবসময়ই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং যৌথ প্রচেষ্টার ফলাফল ছিলো- এবং থাকবে। যখনই মানুষ তাক থেকে নৃবিজ্ঞানের একটি বই নেবে, আমি চাইবো তারা মুহূর্তের জন্য থামবে এবং প্রশ্ন করবে: এই কাজটির অদৃশ্য সহ-স্রষ্টারা কারা?

মূল লেখার লিংক।