ইভান্স-প্রিচার্ড ও তার চিন্তা

[এনথ্রোসার্কেলের থিওরি সিরিজে ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক ইভান্স-প্রিচার্ড নিয়ে লিখেছেন তাসনিম রিফাত।]

আজকে আমি এমন একজনকে নিয়ে লিখতে বসেছি, যার প্রতি আমার নিজেরও কিছুটা ব্যক্তিগত মুগ্ধতা আছে। তিনিও  ছিলেন ম্যালিনস্কি আর রেডক্লিফ-ব্রাউনের মতো ক্রিয়াবাদী ধারার তাত্ত্বিক। ইভান্স-প্রিচার্ড তার কাজের মধ্য দিয়ে ম্যালিনস্কির মাঠকর্ম আর রেডক্লিফ-ব্রাউনের কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদ- এই দুইয়েরই সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। নুয়ের আর আজান্দে সমাজের উপর তিনি যেসব নিবিড় মাঠকর্ম করেছিলেন সেগুলো ছিল ক্লাসিক্যাল নৃবৈজ্ঞানিক এথনোগ্রাফির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আবার, তত্ত্বের দিক দিয়েও তিনি আজীবন ক্রিয়াবাদের প্রতি একরৈখিক বিশ্বস্ততা দেখাননি। এজন্যই বোধহয় আর্নস্ট গেলনার প্রিচার্ডকে বলেছিলেন ‘সন্দেহবাতিক হ্যামলেট’। আসলে হ্যামলেটই ছিলেন তিনি। সারাজীবন কোন একটা নির্দিষ্ট তত্ত্বে নিজেকে ধরে না রেখে, বিভিন্ন সময়ই যৌক্তিক পরিবর্তন এনেছিলেন নিজের মধ্যে। এইজন্য তার তত্ত্বীয় চিন্তাকে কোন একটি নির্দিষ্ট ঘরে বন্দী করা যায় না।

ইভান্স-প্রিচার্ডকে বলা যায় বৃটিশ ক্রিয়াবাদের এক পরিবর্তনকামী তাত্ত্বিক।  প্রথম জীবনে রেডক্লিফ-ব্রাউন প্রবর্তিত কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদের ধারণাগুলো কঠোরভাবে মেনে চললেও, পরবর্তীকালে তিনি সামাজিক ইতিহাসের উপর অধিক গুরুত্ব দেন। একইভাবে তার কাজের মধ্য দিয়ে সমাজগুলোতে বিভিন্নপক্ষীয় দ্বন্দ্বের দিকটিও উঠে এসেছে। তিনি রেডক্লিফ-ব্রাউনের কাঠামোগত ক্রিয়াবাদের বাঁধা-ধরা কাঠামোর ধারণাকে ত্যাগ করে,কাঠামোতে অবস্থান করা ব্যক্তির উপরও জোর দিয়েছিলেন। শেষদিকে তিনি রক্ত-মাংসের ব্যক্তিমানুষকে বাদ দিয়ে ক্রিয়াবাদ যে কেবলমাত্র কাঠামো নিয়েই আলোচনা করে, সেটির একবারেই বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। এইজন্য ইভান্স-প্রিচার্ডের কাজে ক্রিয়াবাদের অনৈতিহাসিক পাঠ-পদ্ধতি থেকে ধারাবাহিকভাবে সামাজিক ইতিহাসের দিকে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

ইভান্স-প্রিচার্ড জাতিতে ছিলেন বৃটিশ। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০২ সালে । প্রিচার্ড প্রথমে অক্সফোর্ডে ইতিহাস নিয়ে পড়লেও পরবর্তীতে তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে নৃবিজ্ঞানের অধীনে পড়তে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল মাঠকর্মের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। সেখানে তিনি নৃবৈজ্ঞানিক মাঠকর্মের দুই পুরোধা ব্যক্তিত্ব সেলিম্যান আর ম্যালিনস্কির সাহচর্য পান। ১৯২৬ সালে সেলিম্যান সুদানের কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর গবেষণা করার কাজ পান। কিন্তু সেলিম্যান সেই সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই দায়িত্ব তিনি ইভান্স-প্রিচার্ডকে দিয়ে দেন। এই প্রকল্পটি অবশ্য ছিল মিশরের বৃটিশ উপনিবেশিক প্রশাসনের অর্থায়নে। সেইসময় বৃটিশরাজের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের শাসনব্যবস্থাকে মজবুত করে তোলা। এইজন্য স্থানীয় প্রশাসনের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আরো প্রত্যক্ষভাবে শাসন করার জন্য আজান্দে আর নুয়েরের মতো গোষ্ঠীগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করার লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী নিয়োগ দিতে থাকে। প্রিচার্ডের মাঠকর্মও ছিল এমন একটি প্রকল্পের অংশ। তিনি সুদানে যাওয়ার আগেই বৃটিশরা নুয়েরদের উপর আক্রমণ করে। নুয়েরদের প্রতিরোধের কারণে তা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় ওই অঞ্চলে গবেষণা করা নিয়ে ইভান্স-প্রিচার্ডের মনেও বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল।  তিনি তার ‘African Political System’ (1940) বইতে উল্লেখ করেন, তিনি যখন নুয়েরদের বসতভূমিতে গিয়ে হাজির হন, অনেকেই তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করতে থাকেন, তার সাথে কুশল বিনিময় করতেও অস্বীকৃতি জানান।

পরবর্তীতে ইভান্স-প্রিচার্ড কাজ করেন আজান্দে সমাজের উপর। আজান্দেদের উপর তার বিখ্যাত বই ‘উইচক্রাফট, ওরাকল এন্ড ম্যাজিক এমং দ্যা আজান্দে’-তে তিনি জাদুবিশ্বাস আর মানুষের যুক্তিবোধের সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করেন। এখানে তিনি আরেকটা দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটান যেটা পূর্ববর্তী ক্রিয়াবাদী ধারা থেকে বেশ আলাদা। রেডক্লিফ-ব্রাউনের ক্রিয়াবাদী ধারা সমাজকে পাঠের ক্ষেত্রে মূলত সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের (যেমন, জ্ঞাতিসম্পর্ক, বিয়ে, রাজনৈতিক সংগঠন) উপর গুরুত্ব দিত। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি অনেকটা ডুর্খেইমের ‘সামাজিক সংহতি’- ধারণাটি দ্বারা প্রভাবিত যেখানে মনে করা হতো মানুষ সামাজিক কাঠামোর মধ্যে সংহত থাকে এবং এই সামাজিক কাঠামোই ব্যক্তিবর্গের আচরণকে নির্ধারণ করে দেয়। এর ফলে ক্রিয়াবাদে এমন একটা ব্যাখ্যার জায়গা তৈরি হলো যে, মানুষ স্বভাবতই সমাজের নিয়ম-কানুন এবং রীতি-নীতি মেনে চলে। একইসাথে অভিন্নভাবে তার চর্চাও করে। এই সূত্র ধরেই ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিকরা ব্যক্তিবর্গের আচরণ এবং অভিজ্ঞতাকে তাদের আলোচনা থেকে দূরে রেখেছিলেন। তাদের কাছে ‘মানুষ কিভাবে চিন্তা করে’ সেই ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে মানুষের আচরণের পেছনে কার্যশীল থাকে। তবে, পরবর্তীতে চল্লিশের দশকের পর অনেক তাত্ত্বিকই বুঝতে শুরু করেছিলে যে, মানুষ সবসময় সামাজিক কাঠামো অনুযায়ী আচরণ করে না, এরমধ্যে ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। একইসাথে মানুষের আচরণকে পুরোপুরি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেও বুঝা সম্ভব না। এই নতুন বোঝাপড়া যখন নৃবিজ্ঞানের পালে হাওয়া দিতে থাকে, তখন নৃবৈজ্ঞানিক চর্চায়ও নতুন ঢেউ জোয়ার আসতে শুরু করে। প্রিচার্ড ছিলেন তারই অংশ।

Witchcraft, Oracles And Magic Among The Azande

ইভান্স-প্রিচার্ড যখন আজান্দেদের নিয়ে কাজ করতে যান, তখনো তিনি তাদের এক বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গবেষণা করেছিলেন, সেটি হলো আজান্দেদের জাদুবিশ্বাস। আজান্দেদের কাছে জাদুবিশ্বাস সম্পর্কিত চর্চাগুলো ‘ওরাকল’ নামে পরিচিত।

আজান্দেদের জাদুবিশ্বাস নিয়ে ইভান্স-প্রিচার্ড

ইভান্স-প্রিচার্ড যখন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন, সেই সময়টায় মানুষের যুক্তিবোধের প্রকৃতি নিয়ে অনেক শাস্ত্রেই নানা তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। অনেকেই মনে করতেন, প্রাচীন সমাজের মানুষের যুক্তিবোধ বর্তমান সময়ের চেয়ে কম। দার্শনিক লেভি-ব্রুহল প্রাচীন সমাজের মানুষদের যুক্তিবোধকে ‘প্রাক-যৌক্তিক’ নামে অভিহিত করেছিলেন। আবার নৃবিজ্ঞানের ধারায় টাইলর আর ফ্রেজারের কথাও এখানে উল্লেখযোগ্য। তারা দুইজন মানুষের ধর্মবিশ্বাস আর জাদুবিশ্বাসকে একটা প্রাচীন ঘরানার যুক্তিবোধ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন, যার আওতায় প্রাচীন মানুষরা প্রকৃতি ও তার আশেপাশের ঘটনাকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করার ফলে জাদুবিশ্বাস কিংবা ধর্মবিশ্বাসের উদ্ভব ঘটেছে। কেউ কেউ মনে করতেন প্রাচীন সমাজের মানুষরা প্রতীকি ধারণা আর আক্ষরিক ধারণাগুলোর মধ্যে বিভেদ করতেন জানতেন না। কিন্তু, মানুষের যুক্তিবোধ নিয়ে ইভান্স-প্রিচার্ডের অবস্থান ছিল সমন্বয়বাদী। এক্ষেত্রে তিনি দুই ধরণের চিন্তার ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে তার কাজে এগিয়ে যান। একটি ধারা ছিল যারা মানুষের বুদ্ধিগত জায়গায় জোর দিয়ে মানবসমাজের নানা ফেনোমেনা বুঝার চেষ্টা করতেন, তারা ব্যক্তিমানুষের যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করার ক্ষমতার উপরই জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ফ্রান্সে ডুর্খেইমীয় ধারার তাত্ত্বিকরা সামষ্টিকভাবে মানবসমাজে কিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর ধারণার উদ্ভব ঘটেছে, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। এই ক্ষেত্রে তাদের মূল আগ্রহের জায়গা ছিল সমাজ, ব্যক্তিমানুষ নয়। ইভান্স-প্রিচার্ড এই দুই ধারাকেই কাজে লাগান।

আজান্দেদের প্রতিদিনকার জীবনে বেশিরভাগ ঘটনার সাথেই জাদুবিদ্যার সম্পর্ক দেখা যায়। কারো যদি ফসল ভালো না হয়, কেউ যদি কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হয় বা  কেউ যদি নদীতে গিয়ে মাছ না পায়- তবে তারা ধরেই নেয় যে এটা জাদুবিদ্যার কারণেই হয়েছে। অর্থাৎ যেকোনো ছোটখাটো ঘটনার সাথেই তারা জাদুবিদ্যার সম্পর্ক খুঁজে পায়। তাদের মতে, মানুষের শরীরের মধ্যে জাদুবিদ্যার অবস্থান, যা একটি অঙ্গের মতো শরীরে অবস্থান করে। কেউ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করতে পারে, আমার কেউ মনের অজান্তেই তার জাদুবিদ্যার জোরে অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

আজান্দেদের জাদুবিশ্বাসের একটি বিশেষ দিক দেখতে পেয়েছিলেন ইভান্স-প্রিচার্ড। আজান্দেরা বিভিন্ন দুর্ঘটনার পিছনে জাদুবিদ্যার প্রভাব দেখতে পান। কিন্তু তার মানে এই না যে কোন দুর্ঘটনা ঘটার কার্যকারণ সম্পর্ককে তারা অস্বীকার করে। অর্থাৎ, কোন ঘটনা ঘটার স্বাভাবিক যে কারণগুলো, এগুলো তারা স্বীকার করে নেয়। জাদুবিদ্যাকে ব্যবহার করা হয় কেবলমাত্র ঘটনাসমূহের পরম্পরাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। তার একটি বিখ্যাত উদাহরণ আছে আজান্দেদের শস্যগোলা নিয়ে। আজান্দে সমাজে যেসব জায়গায় শস্য মজুদ রাখা হয় সেগুলোকে শস্যগোলা বলা হয় । এগুলো সাধারণত কাঠের তৈরি। কাঠের তৈরি থামের মাধ্যমে শস্যগোলাকে দাড় করিয়ে রাখা হয়। যেকোনো সময় শস্যগোলার নিচে দাড়িয়ে থাকা মানুষের উপর ধ্বসে পড়তে পারে এটি, অনেক মানুষ আহতও হতে পারে। আজান্দেরা খুব ভালো করে জানে যে, উইপোকা শস্যগোলারে কাঠগুলোকে খেয়ে ফেলায় এগুলো ক্ষয়ে যেতে পারে, এরফলে যেকোনো সময় ধসে পড়া অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু তারা মনে করে একটা নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির উপরই কেন শস্যগোলাটি ধসে পড়লো, তার পিছনে নিশ্চয়ই জাদু হাত আছে।  নিশ্চয়ই কেউ তাদের উপর কালোজাদুর প্রয়োগ করেছে, যার কারণে তারা এই দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়েছেন। রোদ থেকে বাঁচার জন্য কেন ঐ সময়ই নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি গোলার নিচে আশ্রয় নিয়েছে, আর কেন ওইসময়ই তা ধ্বসে পড়েছে- এই ঘটনাসমূহকে বুঝার জন্যই আজান্দেরা জাদুবিদ্যাকে একটা ব্যাখ্যাকারী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। এদিক দিয়ে ইভান্স-প্রিচার্ড দেখান, আজান্দেরা জাদুবিদ্যাকেও প্রকৃতপক্ষে একটা যুক্তিবোধের আওতায় ব্যবহার করে। যুক্তিবোধ সকল সমাজেই বিদ্যমান, এটি কোন ‘উন্নত’ জনগোষ্ঠীর বিশেষ সম্পদ নয়।

আজান্দেদের ওরাকল নিয়ে করা কাজে ইভান্স-প্রিচার্ডের একটি কেন্দ্রীয় জায়গা ছিল সামাজিক কাঠামো আর ব্যক্তির আন্তঃসম্পর্ক দেখানো। আজান্দেদের জাদুবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি কিভাবে যৌক্তিক আচরণ করে, আবার একইসাথে এরমধ্যে কাঠামোও ক্রিয়াশীল থাকে, তা দেখিয়েছেন ইভান্স-প্রিচার্ড। এরফলে, পূর্ববর্তী ক্রিয়াবাদীদের চেয়ে তার কাজ একটা নতুন বাক এনে দিয়েছিল। বিভিন্ন  সমাজগুলোর বিভিন্ন বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠানের পেছনে জারি থাকা যুক্তিবোধ তালাশের ক্ষেত্রে প্রিচার্ডের প্রচেষ্টাও পরবর্তীতে অনেক তাত্ত্বিককে প্রভাবিত করেছিল।

রেফারেন্স:

Vision of Culture, Jerry D. Moore

Theory in Social and Cultural Anthropology: An Encyclopedia,  R. Jon Mcgee, Richard L. Warms

An Introduction to Theory in Anthropology,Robert Layton

Anthropology and anthropologists, Adam Kuper