আলোকায়নের বৌদ্ধিক ভিত্তি

[ এনথ্রোসার্কেলে আলোকায়ন (Enlightenment) নিয়ে লিখেছেন আবদুল্লাহ হেল বুবুন]

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে যখন বুর্জোয়ারা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে এবং একটি উদীয়মান আর্থসামাজিক শ্রেণী হিসেবে রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করছে, তখন তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হচ্ছিল ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তিক জগতেও। ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রগতি, সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাংবিধানিক সরকার, রাষ্ট্র ও চার্চের পৃথকীকরণ প্রভৃতি আদর্শ এই সময়েই জন্মলাভ করে। এই সময়টা ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে আলোকায়ন নামে পরিচিত। আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্টের ভিত্তি ছিল এই বিশ্বাস যে, যুক্তিই কর্তৃত্ব ও বৈধতার প্রধান উৎস। এখানে যুক্তি হলো কর্তৃত্বপরায়ণ বিশ্বাসের বন্ধনমুক্ত মানব বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার; প্রগতি হলো ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইতিবাচক অগ্রগতি, যা স্থবির মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান দর্শনের একেবারে বিপরীতে অবস্থান নেয়; আর এই যুক্তি ও প্রগতির চূড়ান্ত ফলাফল হবে পৃথিবীতে মানব অবস্থার ধীর ও ধারাবাহিক উন্নয়ন। সাধারণত নিউটনের ‘প্রিন্সিপলস অব ম্যাথেমেটিক্স’ প্রকাশকাল থেকে শুরু করে ফরাসী বিপ্লব পর্যন্ত সময়কালকে আলোকায়ন বলা হয়। ইউরোপীয় ইতিহাসের এই সময়টা যুক্তির যুগ নামেও পরিচিত।

আলোকায়নের একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য ছিল জ্ঞানের ক্রমবর্ধমান সেকুলারাইজেশন অর্থ্যাৎ শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার পরিবর্তে দুনিয়াকে পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টা। এক দিক থেকে আলোকায়নকে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সম্প্রসারণও বলা যেতে পারে। আলোকায়ন বুদ্ধিজীবীরা নিউটনের যান্ত্রিক দর্শন দ্বারা এতোটাই প্রভাবিত ছিল যে তারা এই দর্শনকে প্রাকৃতিক জগত থেকে সামাজিক জীবনে সম্প্রসারিত করেছিল; নিউটন যেমন প্রকৃতির নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, সেটার অনুকরণে তারাও বিশ্বজনীন সামাজিক বিধান অন্বেষণে নিয়োজিত হন। এই সময়েই সামাজিক বিজ্ঞানের প্রধান প্রধান প্রত্যয়গুলোর তৈরি হয় এবং নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় ছিল সংস্কৃতি। 

সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের দিক থেকে দেখলে এই সময়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো জন লকের ‘অ্যান এসে কন্সার্নিং দি হিউম্যান কন্ডিশন’। এই প্রবন্ধে লক সর্বপ্রথম বিদ্যমান পরিবেশ ও মানব আচরণের মাঝে সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছেন, যা নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের মতো আচরণগত বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। লকের মতে, প্রত্যেক মানুষ জন্মের সময় ফাঁকা ক্যাবিনেটের মতো, যা কোন প্রাক-চিন্তা বা মূল্যবোধ ধারণ করে না। এই ফাঁকা ক্যাবিনেট পূর্ণ হয় মানুষের জীবদ্দশায়, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। আর এই জ্ঞানের ভিত্তি অভিজ্ঞতা। অর্থ্যাৎ, মানুষ তার জ্ঞান, মূল্যবোধ ও সংস্কার লাভ করে ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে, যাদের সংস্পর্শে সে আসে তার জীবনকালে। লকের এই দর্শন অভিজ্ঞতাবাদ নামে পরিচিত, যা জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার উপর জোরারোপ করে। এই দর্শন অনেক দিক থেকেই ছিল বৈপ্লবিক। প্রথমত, লকের পূর্বে এমন ধারণা শক্তিশালী ছিল যে, ঈশ্বর বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীকে কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে তৈরি করেছে এবং বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর এসকল মৌলিক বৈশিষ্ট্য সাধারণত অপরিবর্তনীয়। এই ধারণাকে দেখা যেতে পারে মধ্যযুগের স্থবির সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এক ধরণের ভাবাদর্শিক প্রতিচ্ছায়া হিসেবে। মানব আচরণ, মূল্যবোধ ও চিন্তাভাবনার বিভিন্নতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পরিবেশকে নির্ধারক ভাবার মাধ্যমে লক মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান বিশ্বদর্শনের একটি প্রধান উপাদান ‘অন্তর্নিহিতবাদ (Innatism)’-কে প্রত্যাখ্যান করেছে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু লকের তাত্ত্বিক প্রতিচিত্রে মানব আচরণ জৈবিকতা নয়, বরং সামাজিক পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত, তাই সামাজিক পরিবেশ পরিবর্তন করার মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের অবস্থার উন্নত করা সম্ভব। এই র‍্যাডিকাল ধারণা ছিল তৎকালের রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের প্রতি বিশাল বড় এক চ্যালেঞ্জ। বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করার দিক থেকে অষ্টাদশ শতকের সবথেকে বড় দুটি বিপ্লবে (আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লব) আমরা লকীয় চিন্তার উপস্থিতি দেখতে পাই।

John Locke

আলোকায়নের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ছিল গিয়ামবাতিস্তা ভিকো। এই ইতালীয় দার্শনিক সপ্তদশ শতকে বিশ্বজনীন ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টায় বিবর্তনবাদী সামাজিক প্রগতির ধারণা ব্যক্ত করেন৷ ভিকো বিশ্বের ইতিহাসকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করেছিলেন এবং সামাজিক অগ্রগতি বিষয়ক এই প্রস্তাবনা দেন যে, প্রতিটি সমাজ নির্দিষ্ট ও সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যের তিনটি স্তরের মাধ্যমে এগোয়৷ ভিকোর মতে, প্রথম স্তর ছিল ঈশ্বরের যুগ, যখন মানুষ প্রকৃতি পূজা করতো। তারপর আসে বীরের যুগে, যখন সামাজিক অসাম্যের কারণে সমাজে অশান্তি বিরাজমান ছিলো৷ ভিকোর কাছে সামাজিক অগ্রগতির চূড়ান্ত যুগ হলো সেই ভবিষ্যৎ কাল যখন সমাজকে পরিচালনাকারী শক্তি হবে যুক্তি এবং এই যুগকে ভিকো আখ্যায়িত করেছেন যুক্তির যুগ হিসেবে৷ ভিকোর মতে, এই যুগগুলো ইহজাগতিক ও মানবিক কর্মপ্রচেষ্টার ফসল৷ আলোকায়নের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো বিশ্বজনীন ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টা। বিশ্বজনীন ইতিহাস রচনায় যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে অ্যান রবার্ট জ্যাক টারগো, অ্যাডাম ফারগুসন, জন মিলার ও উইলিয়াম রবার্টসন প্রমুখের লেখনীতে প্রাক-নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়৷ টারগো মানব ইতিহাসকে শিকার, পশুপালন ও চাষাবাদ, এই তিন ধাপে বিভক্ত করেছিলেন। উইলিয়াম রবার্টসন এমনকি অসভ্যতা, বর্বরতা ও সভ্যতার সুপরিচিত ছাঁচটাও ব্যবহার করেছিলেন, যা উনবিংশ শতকে মূলধারার নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হয়ে দাঁড়ায়। ফার্গুসন ও রবার্টসনের মতো স্কটিশ তাত্ত্বিকরা বিশ্বজনীন ইতিহাসের ধাপ নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও অর্থনীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যা উনবিংশ শতকের অন্যতম প্রধান নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গানের বিবর্তনবাদী তত্ত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বাদে ধ্রুপদী সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদকে একদিক থেকে আলোকায়ন ইতিহাসবাদের ধারাবাহিকতা বা সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি হলো, অষ্টাদশ শতকের বিশ্বজনীন ইতিহাসবিদরা যেখানে আধুনিক পাশ্চাত্যের ইতিহাস লিখেছেন, সেখানে উনবিংশ শতকের সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিলো প্রাগৈতিহাসিক কালের অ-পশ্চিমা জনগোষ্ঠী।

Giambattista Vico

তবে নৃবিজ্ঞানকে একটি জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সর্বপ্রথম নেয়া হয় ফ্রান্সে। আর এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চার্লস ডি মন্টেস্কু। ১৭৪৮ সালে মন্টেস্কু তার ম্যাগনাম অপাস ‘দি স্পিরিট অব লস’ প্রকাশ করেন৷ যার বিষয়বস্তু ছিল বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির আইন ব্যবস্থার একটি ক্রস-কালচারাল অধ্যয়ন, যে বিষয়ে মন্টেস্কুর প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল (ইংল্যান্ডের বিচারব্যবস্থাকে বোঝার জন্য মন্টেস্কু কিছুকাল ইংল্যান্ডে থাকেন)। মন্টেস্কু বিচারব্যবস্থাকে সমাজের অন্যান্য উপাদান যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞাতিত্ব, ধর্ম প্রভৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একটি প্রপঞ্চ হিসেবে দেখেছে, যা কোন সামাজিক ব্যবস্থার একটি অংশ। একারণে অনেকেই মন্টেস্কুকে প্রোটো-ফাংশনালিস্ট বলে থাকে। একইসাথে, মন্টেস্কু বিভিন্ন সংস্কৃতির আইন ও বিচারব্যবস্থাকে আপেক্ষিকভাবে দেখেছেন। তার মতে, কোন আইনের সঠিকতা বা বেঠিকতাকে ওই আইনিব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রথা ও উপাদানের আলোকেই বিবেচনা করা উচিত। এক্ষেত্রে সে অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের বিচারব্যবস্থার মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া সংক্রান্ত আইনকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ওই সময় ফ্রান্সে মিথ্যা সাক্ষ্য বা অভিযোগ করার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড বা দীর্ঘকালীন কারাদণ্ড। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে এই অপরাধের কোন শাস্তি ছিল না বললেই চলে। দুই দেশের এই আইনকে বিচারব্যবস্থার অন্যান্য উপাদানের থেকে আলাদাভাবে দেখলে ফ্রান্সের আইনকে ইংল্যান্ডের থেকে অনেক বেশী নিষ্ঠুর বলে মনে হবে। তবে মন্টেস্কু যুক্তি দিয়েছেন যে, যদি আমরা আপাতদৃষ্টিতে একটি নিষ্ঠুর আইনকে ওই দেশের বিচারব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রথা এবং সামাজিক ব্যবস্থার অন্যান্য উপাদানের আলোকে বিশ্লেষণ করি, তবে ওই আইনও সঠিক বলে প্রতিভাত হতে পারে। যেমনঃ ফ্রান্সে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে, সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনশৃঙখলাবাহিনী তুলে নিয়ে যায় এবং সে তীব্র নির্যাতনের শিকার হয়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি অভিযোগ কোন ব্যক্তির জন্য প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। একারণে ফ্রান্সে মিথ্যা সাক্ষ্যের পরিণতি মৃত্যুদণ্ড বা এরকম কাছাকাছি কোন শাস্তি৷ অন্যদিকে, ইংল্যান্ডে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তি কোন রূপ টর্চারের সম্মুখীন হয়না এবং সে নিজের পক্ষে সাক্ষী ডাকতে পারে। একারণে ইংল্যান্ডে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের শাস্তি খুবই সামান্য৷ এভাবে দেখলে উভয় ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া সংক্রান্ত আইন যথার্থ বলে মনে হবে। আধুনিক নৃবিজ্ঞানীদের কাছে একটি কেন্দ্রীয় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নিজ সংস্কৃতিকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখার অক্ষমতা। যা সাধারণত হোম ব্লাইন্ডেডনেম নামে পরিচিত। এই সমস্যাকে মোকাবেলা করার জন্য মন্টেস্কু তার পারসিয়ান লেটারসে দুইজন ইরানী পর্যটকের মাধ্যমে তৎকালীন ফরাসি সামাজিক ব্যবস্থা ও রাজতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। 

ফ্রান্সের আরেকদল বুদ্ধিজীবী, যারা এন্সাইক্লোপিডিয়াইস্ট নামে পরিচিত, নৃবিজ্ঞানকে একটি জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যতো বেশী সম্ভব বিদ্যমান জ্ঞান সংকলিত করার মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। চার্চ ও রাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করার কারণে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ এই এন্সাইক্লোপিডিয়ায় স্থান পেয়েছিল ক্ষুদ্র কারিগরদের তৈরি বিভিন্ন ক্ষুদ্র কৃষি ও শিল্প যন্ত্র। অষ্টাদশ শতকে এন্সাইক্লোপিডিয়ায় কারিগরদের আবিষ্কারের অন্তর্ভুক্তি ইঙ্গিত করে যে, খুব শীঘ্রই সাধারণ মানুষের জীবন সামাজিক বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে। রুশো, ভলতেয়ার ও মন্টেস্কু থেকে শুরু করে ওই সময়ের সকল প্রধান বুদ্ধিজীবীই এন্সাইক্লোপিডিয়াতে অবদান রেখেছিলেন। 

Jean-Jacques Rousseau

তবে নিঃসন্দেহে আলোকায়নের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী ছিলেন জা জ্যাক রুশো। অন্যান্য আলোকায়ন তাত্ত্বিকদের মতো রুশো মানব ইতিহাসকে প্রগতির দিকে একরৈখিক যাত্রা হিসেবে দেখেননি। বরং তার মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় (স্টেট অব ন্যাচার) মানুষ ছিল আরো বেশী স্বাধীন এবং মানবিক সম্পর্কের মাঝে সাম্য অবস্থা বিরাজমান ছিল। এরপর মানুষ পরিবার, জ্ঞাতিত্ব, পুরোহিততন্ত্র, ধর্ম, রাজতন্ত্র প্রভৃতির মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে যা আসলে সামাজিক অসমতার ভিত তৈরি করে। রুশোর মতে, এই সামাজিক অসাম্যই মানুষের সম্মুখীন হওয়া সকল সমস্যার মূলে। তবে রুশো এমন কোন প্রতিক্রিয়াশীল ছিল না, যে পূর্বের কোন যুগে ফিরে যেতে চেয়েছে। সে যুক্তি দিয়েছে যে, বর্তমান সময়েই এমন একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যা গড়ে উঠবে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সবার জন্য সমান সুযোগের উপর ভিত্তি করে। রুশোর এই আদর্শ সমাজের অনুপ্রেরণা ছিল তৎকালীন অ-পশ্চিমা স্বাধীন রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী, যারা কোন কোন ইউরোপীয় তাত্ত্বিকদের কাছে নোবেল স্যাভেজ নামে পরিচিত ছিল। অ-পশ্চিমা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে রুশোর এই পুনর্মূল্যায়ন ছিল প্রকৃত সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে রুশোর আগ্রহের বিষয় অ-পশ্চিমা জনগোষ্ঠী ছিলো না, বরং সে অ-পশ্চিমা জনগোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থাকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন তৎকালীন ইউরোপীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনা করার ক্ষেত্রে; অ-পশ্চিমা জনগোষ্ঠী রুশোর কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল তার নিজ সময়ের বিপরীত হিসেবে, তিনি ঐ সব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে এথনোগ্রাফিক অধ্যয়নের কোন আগ্রহ দেখায়নি৷ কিছু ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মার্ক্স থেকে শুরু করে লেভি স্ত্রস পর্যন্ত পরবর্তীকালের অনেক সামাজিক বিজ্ঞানীদের কাছে অনুপ্রেরণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল রুশো এবং তাকে অনেক সময় আখ্যায়িত করা হয় ফরাসি আলোকায়ন ও জার্মান রোমান্টিসিজমের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনকারী হিসেবে।

পরিবর্তীকালে নৃবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা অনেক উপাদান ও প্রশ্নের জন্মকাল ছিল যেমন আলোকায়ন, তেমনি নৃবিজ্ঞানের মতো অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মৌলিক অ্যাজাম্পশন গুলোও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সময়ে। একারণেই আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী মারভিন হ্যারিস বলেছেন, আলোকায়নের পূর্বে নৃবিজ্ঞান বলতে কিছু ছিল না।

রেফারেন্স:

বার্নার্ড, অ্যালেন (২০০০) থিওরি অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন অ্যান্থ্রোপলজি, ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড

এরিকসেন, থমাস হাইল্যান্ড (১৯৮৩), অ্যা হিস্ট্রি অব অ্যান্থ্রোপলজি, প্লুটো প্রেস

মারফি ডি, লিয়াম ও এরিকসন, পল (১৯৯৮), অ্যা হিস্ট্রি অব অ্যান্থ্রোপলজিকাল থিওরিস, ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো প্রেস

মোবার্গ, মার্ক (২০১৭), এনগেজিং এন্থ্রোপলজিকাল থিওরি, আলটামিরা