নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রে ক্ষমতার ধারনা
[নৃবিজ্ঞানে ক্ষমতা নামক ধারনাটিকে অনেক তাত্ত্বিকই অনেকভাবে দেখেছেন। ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন রিফাত হাসান আদর ও আফরিনা অর্পা]
উনবিংশ শতাব্দীতে নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রে ক্ষমতা প্রসঙ্গে বিভিন্ন তাত্ত্বিক মতবাদের সূচনা করেন সামাজিক বিবর্তনবাদী স্যার হেনরি মেইন। ১৮৬১ সালে তিনি আইনের আওতায় গঠিত সমাজ এবং মর্যাদার ভিত্তিতে নির্মিত সমাজের মধ্যে ভিন্নতা তুলে ধরার মাধ্যমে ক্ষমতার ব্যবহারের প্রসঙ্গে তাত্ত্বিক অবস্থান নেন। অন্যদিকে ১৯৭৭ সালে লুস হেনরি মর্গান জ্ঞাতিত্ব এবং টেরিটোরি’র (kinship and territory) পৃথকীকরণের প্রেক্ষিতে শাসনব্যস্থা গঠনের ভিত্তি পর্যালোচনা করেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান যখন নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রের একটি শাখা হিসেবে রূপ নেয়, তখন বিভিন্ন নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ম্যাক্স ওয়েবার ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়ন করেন এমন এক ধরণের সম্ভাবনা হিসেবে যেটার মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ একজন ব্যক্তি সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের ইচ্ছার উর্ধ্বে গিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিল করেন। এরপর সময়ের সাথে সাথে ফ্রেডরিক নিটশে, কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস, মিশেল ফুকোসহ আরো অনেকেই ক্ষমতা নিয়ে তাদের চিন্তার জায়গা থেকে বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেন। এই লেখায় চার জন অন্যতম তাত্ত্বিক, যারা ক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছেন তাদের তাত্ত্বিক অবস্থান সংক্ষিপ্ত রূপে তুলে ধরার মাধ্যমে ক্ষমতা প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হবে।
লা পিয়ের
ক্ষমতা প্রসঙ্গে শুরুর দিকে বয়ান দিয়েছিলেন লা পিয়ের। তিনিই প্রথম রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনো জৈবিক ভিত্তি আছে কিনা, এই প্রসঙ্গে মাথা ঘামান। তিনি মূলত জানার চেষ্টা করেছিলেন যে ক্ষমতার মূল ভিত্তি কি প্রকৃতিতে নাকি সংস্কৃতিতে অবস্থান করে। এরপর তিনি প্রাণিবিজ্ঞানের উপর কিছু গবেষণার ভিত্তিতে গবেষকরা উপসংহার টানেন যে এমন কোনো সামাজিক প্রপঞ্চ নাই যা নিয়ে প্রাণিকুলের প্রাপ্ত জ্ঞানে কোনোরূপ রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামো দেখা যায়। অর্থাৎ ক্ষমতা বা ক্ষমতার প্রয়োগ জৈবিকভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোনো মানব-বৈশিষ্ট্য না। ‘Essai sur le fondement du pouvoir politique’ নামক বইয়ে লা পিয়ের প্রাচীন সমাজের মানুষদের মাঝে রাজনৈতিক ক্ষমতার খোঁজ করেন। প্রাচীন সমাজের রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস খুঁজতে গিয়ে লা পিয়ের মূলত ঐসকল সমাজের সাবসিসটেন্স ইকোনমি এবং লেখার (writing) উপর বিশেষ নজর দেন। তিনি ক্ষমতাকে পরিমাপ করার জন্য অ্যাংলো-স্যাক্সন নৃবৈজ্ঞানিক স্তরবিন্যাসের সাহায্য নেন যেখানে ক্ষমতাকে ৫টি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এই স্তরবিন্যাসের ভিত্তিতে তিনি পূর্বের সমাজগুলোতে ক্ষমতা অনুপস্থিত ছিল বলে দাবি করেন। লা পিয়ের সেসকল ক্ষমতাহীন সমাজকে “প্রি-পলিটিকাল (pre-political) সমাজ” বলে আখ্যায়িত করেন।
পিয়েরে ক্লস্ত্রে
পিয়েরে ক্লস্ত্রে একজন ফ্রেঞ্চ নৃবিজ্ঞানী। রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানে তার অবদান অনন্য। একজন এনার্কিস্ট হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি ঐসকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাঝে অ-জবরদস্তি (non-coercive) ক্ষমতার খোঁজ করার চেষ্টা করেন যেখানে তাদের সমাজ প্রধানের (Chief) হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। ১৯৬৯ সালে তার রচিত আর্টিকেল ‘Copernicus and the savages’-এ তিনি লা পিয়েরের কাজের সমালোচনা করে তার যুক্তি পেশ করেন। লা পিয়েরের pre-political সমাজের ধারণাকে তিনি খারিজ করেন কিছু এথনোগ্রাফিক উদাহরণের মাধ্যমে। তিনি ট্রবিয়ান্ড দ্বীপের জনগোষ্ঠীদের উদাহরণ দিয়ে তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে উন্নতর বলে দাবি করেন। তিনি লা পিয়েরের বয়ানে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বুঝাতে সাবসিসটেন্স ইকোনমি’র ধারণাকে খারিজ করেন। তার মতে সাবসিসটেন্স ইকোনমির ধারণা পশ্চিমের সৃষ্টি। তিনি আরো বলেন যে পশ্চিমা গবেষকেরা প্রাচীন সমাজকে অধ্যয়ন করার সময় সাবসিসটেন্স ইকোনমি খুঁজতে গিয়ে ঐসকল সমাজের বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারে না। বিভিন্ন সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো বিনিময় প্রথার উপর দাঁড়িয়ে আছে (যেমনঃ কুলা রিং), আবার অনেক সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্বন্টন প্রথার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে (যেমনঃ পোটলাচ)। তিনি এরপর উপসংহার টানেন এই বলে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা একটা সার্বজনীন ব্যাপার এবং এটা সামাজিক বাস্তবতার মাঝেই অন্তর্নিহিত। প্রাচীন সমাজের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যাখা করার সময় লা পিয়ের যেটাকে ‘Pre-political’ বলছেন, পিয়েরে ক্লস্ত্রে সেটার বিপরীতে বলছেন প্রাচীন সমাজেও ক্ষমতার রাজনৈতিক রূপ দেখা যায় তবে সেটা অ-জবরদস্তি (non-coercive) অবস্থায় থাকে। পিয়েরে ক্লস্ত্রে এক ধরনের ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ‘আদেশ-আনুগত্য’ সম্পর্কের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার অস্তিত্ব নির্ধারণ করা যায়। তিনি যুক্তি দেন যে যেসব সমাজে ‘আদেশ-আনুগত্য’ (command-obedience) সম্পর্ক অনুপস্থিত, সেসব সমাজেও ক্ষমতা বিদ্যমান কিন্তু অ-জবরদস্তি (non-coercive) অবস্থায়।
অ্যান্তনীয় গ্রামসি
গ্রামসি তাঁর কারাগারের নোটবই বইতে প্রাক্সিসের দর্শন শব্দটি ব্যবহার করেন; যেখানে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বোঝানোর হেজিমনি টার্মটি নিয়ে আসেন। এই হেজিমনি শব্দটি বুঝতে গেলে আমাদের সাবলর্টান এবং বুর্জোয়া শ্রেণীকে বুঝতে হবে। সাবলর্টান শ্রেণী হলো মার্ক্সের ভাষায় পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার শ্রমিক শ্রেণী বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণী। আর বুর্জোয়া শ্রেণী হলো পুঁজির মালিক শ্রেণী। এই শ্রেণীকেই তিনি বলছেন হেজিমনিক শ্রেণী। এই বুর্জোয়া শ্রেণী সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। শুধু রাষ্ট্রীয় শক্তিকে কাজে লাগায় না, বরং তারা সংস্কৃতি এবং ভাবাদর্শের জগতে পরিবর্তন ঘটায়, শাসন করার ভিত্তি হিসেবে তারা শ্রমিক শ্রেণীর কাছ থেকে সামাজিক সম্মতি আদায় করে নেয়। আধুনিক জগতে শ্রেণীক্ষমতার সবচেয়ে কার্যকর প্রয়োগ মোটেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বা তার আইন, পুলিশ, সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল নয়। সবচেয়ে কার্যকর ক্ষমতা সেটাই যা সামাজিক, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন খুঁটিনাটির মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারে, যা পরিবার, স্কুল, কলেজ, ডাক্তার, হাসপাতাল, সংবাদপত্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান- এইসবের ভেতর দিয়ে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। আর বুর্জোয়া শ্রেণী তার শ্রেণীকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সেখানেই সবচেয়ে সফল যেখানে তাকে সবসময় রাষ্ট্রক্ষমতা জাহির করতে হয় না, বরং দৈনন্দিন সমাজজীবনই এমন নিয়মে চলে যা বুর্জোয়া শাসনের অনুকূল।
গ্রামসির মতে হেজিমনি একটা প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় শ্রমিকশ্রেণীর সম্মতির সাপেক্ষে তাদের উপর বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা প্রয়োগ করে। গ্রামসি মনে করেন যে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যখন শ্রমিকশ্রেণীর মানুষেরা নিজেদের সাধারণ জীবন যাপন করতে থাকেন, তখনই তারা বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্যে একভাবে সম্মতি জানিয়ে শোষিত হতে থাকেন।
গ্রামসির মতে, শ্রমিকশ্রেণীকে তার বিকল্প সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ঠিক এমনই এক সামাজিক অনুশাসন ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে, শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কথা ভাবলে চলবে না। গ্রামসির কাজে কার্ল মার্ক্সের দর্শনের ছাপ লক্ষণীয়। মার্ক্স যেভাবে শ্রেণী বৈষম্য দেখিয়েছেন, গ্রামসিও তার সূত্র ধরেই একটু ভিন্ন ধাঁচে তা তুলে ধরেছেন। মার্ক্স শ্রেণী শোষণের ইতি টেনেছেন তার সমাজতান্ত্রিক মডেল দিয়ে যেখানে তিনি সমাজতন্ত্রকে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেন যেখানে কোনো ধরনের শ্রেণী বৈষম্য থাকবে না। গ্রামসিও এমন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেন যেখানে ‘কাউন্টার-হেজিমনি’ থাকবে।
গ্রামসি মনে করেন যে বুদ্ধিজীবী ধারণাও আসলে বুর্জোয়া শাসনের অনুকূলে। এজন্য তিনি দুই ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কথা বলেন। ঐতিহাসিক বুদ্ধিজীবী (Traditional intellectual),যারা সমাজের চোখে বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃত যেমনঃ শিক্ষক, সাংবাদিক, দার্শনিক, লেখক ইত্যাদি। আরেকটি শ্রেণী হলো জৈব বুদ্ধিজীবী (Organic intellectual), যারা আসলে যে কোনো শ্রেণীর বা যেকোনো পেশার মানুষ। তার মতে একজন মুচি কিংবা একজন রিক্সাচালকও একজন বুদ্ধিজীবী, কারণ তারা তাদের কাজের ব্যাপারে যতোটা জ্ঞান রাখেন, অন্য কেউ তা রাখেন না। তার মতে, সমাজে শ্রেণী বৈষম্য দূর করতে এই জৈব বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মানুষদেরকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কাউন্টার হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম।
মিশেল ফুকো
মিশেল ফুকো ক্ষমতা নিয়ে তার বয়ান শুরু করেন নিকোলা ম্যাকিয়াভেলি’র ‘The Prince’ বইয়ের সমালোচনা করে। ম্যাকিয়াভেলি তার বইয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধাণ উৎস হিসেবে সার্বভৌমত্বকে তুলে ধরেন। ফুকো তার সমালোচনা করে বলেন যে সার্বভৌমত্ব অবশ্যই একটি রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চা করার উৎস তবে এটি মুখ্য উৎস না। তার মতে রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চার মূখ্য উৎস হচ্ছে জনসংখ্যা, আর গৌণ উৎস হচ্ছে সার্বভৌমত্ব।
ফুকো রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রশাসনিকতা (গভর্মেন্টালিটি) শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি এটা দ্বারা বোঝাতে চাচ্ছেন জনগণ আসলে কীভাবে পরিচালিত হয়, কীভাবে জনগণকে পরিচালনা করা হয়। এটা হচ্ছে এক ধরণের কৌশল যা দ্বারা systematic way তে চিন্তা করা হয়। গ্রামসি যেটাকে বলছেন হেজিমনি। রাষ্ট্র এই প্রক্রিয়ায় জনগণকে দুইভাবে শাসন করে- ১. ব্যক্তি হিসেবে, ২. জনসংখ্যা হিসেবে।
ফুকোর মতে, আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র সার্বভৌমত্বর ছক অবলম্বন করে চলে না, তা চলে অনুশাসন বা ডিসিপ্লিনের ছকে। তিনি তাঁর Discipline and punish বইয়ে অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের এক মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে আছে আসামীর দেহকে ক্ষতবিক্ষত, খণ্ডবিখণ্ড করে শাস্তি দেওয়ার বীভৎস বর্ণনা। সেখানে দণ্ডের অর্থ আইনবিরুদ্ধ হিংসার জবাব হিসেবে দৃষ্টান্তমূলক প্রতিহিংসা, যা ঘটবে লোকচক্ষুর সামনে, বিশাল জনসমাবেশে, যাতে সকলে দেখতে পায় যে রাজার কত ক্ষমতা। এরকম শাস্তিকে বলা হতে লাগলো অমানবিক, নিষ্ঠুর। শাস্তির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা নয়, দোষীকে সংশোধন করা।
সেজন্য দন্ডও হওয়া উচিত শারীরিক নির্যাতন নয়, দোষীকে নজরবন্দী করে তাকে সামাজিক অনুশাসনে শিক্ষিত করে তোলা। ফুকো এটাকে বলছেন জৈবক্ষমতার চর্চা করা। এই জৈবক্ষমতা চর্চা করা হয় দুইভাবে –
১. ডিসিপ্লিনারি মেকানিজম, ২. রেগুলেটরি মেকানিজম।
ডিসিপ্লিনারি মেকানিজম বলতে ফুকো আধুনিক সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত করেছেন হাসপাতাল, কারাগার, স্কুল, কারখানা- এইসব প্রতিষ্ঠানকে, যেখানে মানুষকে রাখা হয় নজরবন্দী অবস্থায়। অসুস্থ মানুষের শারীরিক ক্রিয়াকর্ম কেমন চলছে তা পরীক্ষার জন্য তাকে নজরবন্দী রাখা হয় হাসপাতালে, আইনভঙ্গকারীকে নজরাধীন রাখা হয় কারাগারে, ছাত্রকে স্কুলে, শ্রমিককে কারখানায়। এই শাসন শারীরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে না, তা কাজ করে মানুষের চেতনায়। এই অনুশাসনের উদ্দেশ্য সার্বভৌম শক্তির ভয় দেখানো নয়, তার উদ্দেশ্য হলো স্বশাসন। আধুনিক সমাজের নাগরিক নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেই বুঝে নেবে যে অসুস্থ হলে তার ডাক্তারের নজরাধীন হওয়া উচিত, নিজের মঙ্গলের জন্যই। আবার কারখানায়ও যাবে একই যুক্তিতে, ছেলেমেয়েদের স্কুলেও পাঠাবে। এই হলো আধুনিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে সকলেই স্বাধীন, অথচ স্বাধীনভাবেই তারা অনুশাসনের শৃঙ্খল পরতে রাজি। আর রেগুলেটরি মেকানিজম বলতে ফুকো বুঝিয়েছেন ক্ষমতার প্রয়োগ করা হবে জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য। কোনো সাধারণ অর্থে কল্যাণ নয়, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর বিশেষ বিশেষ কল্যাণের জন্য। যেমন, জনগোষ্ঠীর কোনো বিশেষ অংশের রোজগার বাড়ানো প্রয়োজন, অন্য কোনো অংশের কর্মসংস্থান দরকার, কোনো কোনো গোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। যেমন- জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিংবা কোনো জনগোষ্ঠীকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বাসস্থান সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গায়ের জোর না খাটিয়ে আর্থিক উৎসাহ দেওয়া বা আর্থিক অন্তরায় সৃষ্টি করা। এভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের পরধান অবলম্বন হলো জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে প্রশাসনিক জ্ঞান। রাষ্ট্রকে তাই স্ট্যাটিসটিকের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। আধুনিক আদমশুমারী এর একটা প্রধান উদাহরণ।
এছাড়াও ফুকো পেনপটিকনের (Panopticon) ধারণা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যাখা করেছেন। পেনপটিকন মূলত ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমি বেনথাম থেকে নেওয়া একটি ধারণা। তিনি একটা কাঠামোগত প্রতিষ্ঠানকে বুঝাতে এই প্রত্যয় ব্যবহার করেন যেখানে কয়েদিদেরকে একটি গোলাকার বিল্ডিং-এ রাখা হয় এবং বিল্ডিং এর মাঝ বরাবর একটি ওয়াচ টাওয়ার থাকে যেখান থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের উপর নজরদারি করেন। ফুকো এই ধারণাকে সংযুক্ত করেন রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন যে রাষ্ট্র অনেকটা এমন ভাবেই নাগরিকদের উপর নজরদারি করেন যেখানে নাগরিকরা প্রায় কয়েদিদের মতো তাদের ক্ষমতার প্রায়োগিক কারাগারে বন্দি থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োগ করে নাগরিকদের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারির উদাহরণ ফুকোর এই মতবাদকে সমর্থন করে।
Reference:
Clastre, Pierre 1974, ‘Copernicus and the Savages’, chapter 1 in his Society against the State: Essays in Political Anthropology, Zone Books, New York. (Chapter 1 & 11)
Layton, Robert 1997, An Introduction to Theories in Anthropology, Cambridge University Press Ltd., Cambridge.
পার্থ চট্টোপাধ্যয়, ২০০০, ‘ক্ষমতা প্রসঙ্গে দুই প্রেক্ষিতঃ গ্রামশি ও মিশেল ফুকো, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড