মূলধারার অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান
[মূলধারার অর্থনীতি কী এবং এই শাস্ত্র সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানের সমালোচনার মাধ্যমে কিভাবে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, সেটি নিয়ে লিখেছেন আবদুল্লাহ হেল বুবুন]
মূলধারার অর্থনীতির সাথে নৃবিজ্ঞানের, বিশেষ করে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের, সম্পর্ক সবসময়ই জটিল৷ এই সম্পর্ক কখনো দ্বাতর্থক, আবার কখনো শত্রুতাপূর্ণ। অনেক নৃবিজ্ঞানীর কাছে অর্থনীতিই তাদের ডিসিপ্লিনের মূল শত্রু। এই দুই শাস্ত্রের মধ্যকার ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জিং সম্পর্কের কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে।
প্রথমত, অনেক নৃবিজ্ঞানীর অভিযোগ এই যে, অর্থনীতি নামক জ্ঞানশাস্ত্র বিশেষভাবে বৈচিত্র্যময় মানুষ ও তাদের আচরণকে সর্বজনীন সাধারণ নীতির (ইউনিভার্সাল ল) মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চায়। সাংস্কৃতিক পার্থক্য তাদের তাত্ত্বিক প্রতিচিত্রে একেবারে ভিত্তিহীন। ক্লিফোর্ড গিয়ার্জের মতো করে বলা যায়, মানুষ সম্পর্কে মূলধারার ইকোনোমিক্সের মৌলিক অ্যাজাম্পশান হলো, “নিড ড্রাইভেন ইউটিলিটি সিকার ম্যানিউভারিং ফর এডভান্টেজ।”
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা সমাজ অর্থনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞানের শিখরে স্থান দিয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাস্ত্রের মধ্যে একমাত্র অর্থনীতিই নিজেকে ফিজিক্সের মতো একটি ‘বিজ্ঞান’ হিসেবে দাবি করে। অর্থনীতিবিদরা বড় বড় সরকারী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে; তাদের ভবিষ্যদ্বাণীর উপর নির্ভর করে পলিসি নির্ধারণ করা হয়; সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনীতিবিদ ও আমলারা তাদের দিকেই প্রথম তাকায় এবং তাদের উপদেশ প্রভাবিত করে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানীরা (আসলে সকল নৃবিজ্ঞানীই) অর্থনীতিবিদদের এই রাজকীয় মর্যাদাকে ভালো চোখে দেখে না৷ অনেকের মতেই, অর্থনীতি একটি এথনোসেন্ট্রিক জ্ঞানশাস্ত্র, যা জটিল ও বৈচিত্র্যময় মানবীয় আচরণকে একরৈখিকভাবে উপস্থাপন করে, যা ইউরোপীয় বিশ্বদর্শনকে অন্যান্যদের উপর চাপানোরই নামান্তর।
তবে মানব পকৃতি সম্পর্কে এই দুই ডিসিপ্লিনের মৌলিক পূর্বানুমান ও ধ্যানধারণার র্যাডিকেল পার্থক্যকে বলা যেতে পারে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের মধ্যকার পারস্পরিক বিরোধীতার প্রধান কারণ। এই মৌলিক পার্থক্যের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জ্ঞানজাগতিক কৌশল, উপকরণ ও ভাষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
নিড ড্রাইভেন ইউটিলিটি সিকার ম্যানিউভারিং ফর অ্যাডভান্টেজ
পশ্চিমা দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও রাজনীতিতে ব্যক্তিসত্ত্বার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। আলোকায়নের সময় থেকেই পশ্চিমা সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে ব্যক্তি এবং তার অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্ন। প্রথা ও অযৌক্তিক কুসংস্কারের বন্ধনের বিপরীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হয়ে ওঠে একটি সামাজিক আদর্শ। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মতো অর্থনীতিরও জন্ম যেহেতু আলোকায়নের সময়, স্বভাবতই পশ্চিমা অর্থনৈতিক চিন্তা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং ব্যক্তির আচরণ বা ‘সহজাত প্রবৃত্তি’ সম্পর্কে কিছু মৌলিক পূর্বধারনা থেকে শুরু করেই বৃহত্তর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করেছে।
অর্থনীতির দুই আদি প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম স্মিথ ও তার উত্তরসূরী ডেভিড রিকার্ডোর মতে মানুষ যুক্তিগতভাবেই স্বার্থপর এবং সকল অর্থনৈতিক কার্যাবলী মানুষ নিজের স্বার্থেই (উদ্দেশ্য নিজস্ব প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশান) পরিচালনা করে। উৎপাদক চাইবে সবথেকে বেশী দামে পণ্য বিক্রয় করতে, অন্যদিকে ক্রেতার উদ্দেশ্য থাকে সবথেকে কম মূল্যে পণ্য ক্রয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করে, এই “র্যাশনাল ইকোনোমিক ম্যান” একটি সর্বজনীন প্রপঞ্চ, যা জাতীয়তা ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সর্বত্র বিদ্যমান। সরকার-গিল্ড-কর্পোরেশন থেকে শুরু করে যেকোন ধরণের সংগঠনের হস্তক্ষেপহীন মুক্ত বাজারের অদৃশ্য হাতই সকল মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা তথা শ্রম ও মূলধনের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করতে সক্ষম।
মধ্যযুগের ইউরোপকে বলা হয় খ্রিস্টেনডম বা খ্রিস্টের রাজ্য। মানব জীবনের সর্বস্তরেই ছিল ক্যাথোলিক চার্চের প্রভাব। অন্যান্য বিষয়ের মতোই অর্থনীতির ‘ভ্যালু’ সম্পর্কিত আলোচনা ক্যাথোলিক ধর্মতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বাস্তবে হোক বা না হোক, ন্যায্য মূল্য ও ন্যায্য মজুরী, সুদের সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতা প্রভৃতি ছিল সামাজিক আদর্শ। তবে আধুনিক যুগে, যখন বহুরাষ্ট্রিক ব্যাবসা-বাণিজ্য ও উপনিবেশবাদ শক্তিশালী হচ্ছিল, তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে ভ্যালুর একটি নতুন সেকুলার সংজ্ঞায়নের। আলোকায়ন ও শিল্প বিপ্লবের সময়ে বিকশিত একটি অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানশাস্ত্র হিসেবে অর্থনীতিরও ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদানের কোন সুযোগ ছিল না। ইকোনোমিক্সের জনক হিসেবে পরিচিত অ্যাডাম স্মিথ তার বিখ্যাত বই ‘ওয়েলথ অব ন্যাশন’ শুরু করেছেন ভ্যালুর সেকুলার সংজ্ঞায়নের মাধ্যমেই। স্মিথের মতে, কোন পণ্যের ভ্যালু অর্থ দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। কারণ, অর্থ প্রায়শই দূর্লভ; স্মিথের সময়ে কয়েনের সংকট একটি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। আবার, উপযোগিতাও ভ্যালুর নির্ধারক নয়। এক্ষেত্রে স্মিথ পানির উদাহরণ দিয়েছেন (অধিক উপযোগিতা তবে মূল্য কম)। যেহেতু শ্রমিকের কাছে সকল শ্রমই সমমূল্যের, তাই শ্রমই ভ্যালুর সর্বোত্তম নির্ধারক। অর্থ্যাৎ একটি পণ্য তৈরিতে যে পরিমাণ শ্রম দরকার হয় সেটা হওয়া পণ্যের প্রকৃত মূল্য। অনেক আলোকায়ন বুদ্ধিজীবীদের মতো স্মিথও ‘মর্ডান’ ও ‘প্রিমিটিভ’ -এর একটি ডাইকোটমি এনেছেন। স্মিথ যুক্তি দিয়েছেন যে, ‘প্রিমিটিভ’ সমাজে শ্রমই উৎপাদনের একমাত্র নির্ধারক এবং সকল শ্রমের মূল্য সমান। স্মিথ উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, নর্থ আমেরিকান আদিবাসীরা শিকার করা প্রাণী বিনিময়ে বা মূল্য নির্ধারণে নির্ভর করে ওই প্রাণী দুটি শিকার করতে যে পরিমাণ সময় দরকার হয় তার উপর। অন্যদিকে, ‘মর্ডান’ সোসাইটিতে ভ্যালু নির্ধারিত হয় যোগান (কিন্তু চাহিদা নয়) ও ডিস-ইউটিলিটি দ্বারা। এখানে ডিস-ইউটিলিটির অর্থ হলো একটি পণ্য তৈরির বদলে তা ক্রয় করলে যে পরিমাণ সময় একজন ব্যক্তি বাঁচাতে পারে৷
ভ্যালুর সেকুলার সংজ্ঞায়নের পর স্মিথ মনোযোগ সরান অন্যদিকে; তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন অর্থনীতি কিভাবে কাজ করলে পণ্যের দাম তার প্রকৃত মূল্যকে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে তার উত্তর ছিল মুক্ত বাজার। স্মিথের মতে, মুক্ত বাজারে মানুষ অংশগ্রহণ করে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সবথেকে বেশী লাভবান হওয়ার জন্য এবং এই ‘সবথেকে বেশী লাভবান’ হতে চাওয়ার ও প্রয়োজনের থেকেও বেশি সম্পদ আহরণ করতে চাওয়ার কারণ মানুষের র্যাশনাল সেল্ফ-ইন্টারেস্টেডনেস। মুক্ত বাজার অর্থনীতির একজন অনুসারী স্মিথের সামনে অন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল এটা দেখানো যে, মানব প্রকৃতির স্বার্থপর দিকটি আসলে সমাজের স্বার্থের পরিপন্থী না। এক্ষেত্রে তার যুক্তি ছিল, প্রত্যেকেরই লাভবান হতে চাওয়ার কারণে প্রতিযোগীতা বাড়বে এবং প্রতিযোগীতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি দামও কমবে। অর্থ্যাৎ সমাজ উপকৃত হবে।
একটু বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে, উদীয়মান শিল্পভিত্তিক সমাজ ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নৈতিক বৈধতা প্রদানকারী স্মিথ ছিলেন একজন ফিজিওক্রাট (মার্কেন্টালিস্টদের সাথে বিতর্কে যারা মনে করতেন বাণিজ্য নয়, কৃষিই জাতীয় আয় ও উৎপাদনের প্রধান উৎস), এবং তার ম্যাগনাম অপাস ‘ওয়েলথ অব ন্যাশনস’-এ স্মিথ কখনোই শিল্প উৎপাদনের ব্যাপারে আলোচনা করেননি। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদরা মনে করেন, স্মিথের তীক্ষ্ণ মনোপলি-বিরোধীতাই এই বইয়ে শিল্প উৎপাদনের অনুপস্থিতির প্রধান কারণ; কারণ স্মিথ মনে করতেন, শিল্প কার্যে (বা গিল্ড) স্বভাবতই মনোপলি তৈরি হয় (কিন্তু কৃষিতে নয়) যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের পরিপন্থী।
একজন ফ্রি-মার্কেট লিবারেল হিসেবে স্মিথের আলোচনা শুরু হয়েছে ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ থেকে। অর্থ্যাৎ ব্যক্তির লেনদেন থেকে তিনি বৃহত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌছেছেন। রিচার্ড উইক অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান সম্পর্কিত নিজ বই ‘ইকোনোমিস অ্যান্ড কালচারস’-এ অ্যাডাম স্মিথের এই চিন্তাকে স্বার্থকেন্দ্রিক বলেছেন একারণে নয় যে তিনি মানব প্রকৃতিকে ‘স্বার্থপর’ হিসেবে দেখেছেন, বরং এই কারণে যে অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনায় তার প্রাথমিক ইউনিট অব অ্যানালাইসিস ছিল ইন্ডিভিজুয়াল। উল্লেখযোগ্য যে, স্মিথের তাত্ত্বিক প্রতিচিত্রে ক্ষমতার প্রশ্নটি একেবারেই অনুপস্থিত। তার তাত্ত্বিক প্রতিচিত্র অনুযায়ী, একজন বস্তিতে জন্মগ্রহণ করা শ্রমিক ও একজন কোটিপতি শিল্পপতির অর্থনৈতিক কার্যাবলীতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও বেছে নেওয়ার সমান সুযোগ রয়েছে।
মর্ডান নিও-ক্লাসিকাল ইকোনোমিক্সের ভিত্তি স্থাপনে আরেকজন কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন ডেভিড রিকার্ডো। রিকার্ডোর মতে ভ্যালুর ধারণা ছিল অর্থনীতির ভিত্তি৷ নিওটনিয়ান মেকানিক্সের অ্যাটমের মতোই রিকার্ডোর তত্ত্বে ভ্যালু ছিল একটি অপরিহার্য উপাদান। রিকার্ডোর তত্ত্ব দাঁড়িয়ে ছিল কতোগুলো মৌলিক ধারণা উপর৷
১) অধিকাংশ সম্পত্তি ব্যক্তিমালিকানাধীন।
২) শ্রম প্রদানে যে সময় লাগে সেটাই কোন পণ্যের প্রকৃত মূল্যের পরিমাপক।
৩) অর্থনৈতিক কার্যাবলীতে ব্যক্তির নির্বাচন করার সুযোগ ও স্বাধীনতা (ফ্রিডম অব চয়েস) রয়েছে।
৪) অর্থনৈতিক কার্যাবলীতে ব্যক্তি যৌক্তিকভাবেই সর্বোচ্চ লাভবান হতে চায়।
৫) ইকুইলিব্রিয়াম অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা।
এই ধারণাগুলো আমাদের কাছে সামাজিক দর্শন মনে হলেও রিকার্ডোর কাছে ছিল ‘ফ্যাক্ট’ বা ‘মেকানিকাল ল অব ইকোনোমিক্স’। এই ধারনাগুলোকে ফ্যাক্ট হিসেবে উপাস্থপনের মাধ্যমে রিকার্ডো অর্থনৈতিক আলোচনাকে নৈতিক দর্শন (মরাল ফিলোসোফি) থেকে আলাদা করেন। তখন আর প্রশ্ন এটা ছিল না যে ‘মানব প্রকৃতি কি?’, তখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, মানব প্রকৃতি সম্পর্কে এসব পূর্বধারনা গ্রহণ করে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ দশা সম্পর্কে যথাযথভাবে আন্দাজ করা এবং পলিসি নির্ধারণ করা সম্ভব কিনা। অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো–– এই দুই তাত্ত্বিকের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আধুনিক নিওক্লাসিকাল ইকোনোমিক্স।
ইকোনোমিক অ্যান্থ্রোপলজি
ইকোনোমিক অ্যান্থ্রোপলজি কি বা এর পরিসর কতোটুকু, এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞানে কোন ঐকমত্য নেই। সহজ ভাষায় অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান বলতে উৎপাদন, ভোগ ও বিনিময়ের আন্তঃসম্পর্কিত ব্যাবস্থাকে বোঝায়। তবে, এখানে ‘উৎপাদন’ ‘ভোগ’ প্রভৃতি বলতে কি বোঝায় এবং এর পরিসর কতোটুকু, এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞানীরা কোন সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পৌছায়নি। যেমনঃ অনেক ইকোলজিকাল অ্যান্থ্রোপলজিস্ট শুধু পণ্যদ্রব্য বিনিময়কেই অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত মনে করেন; জীবীকার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের প্রক্রিয়া তাদের কাছে সাবসিস্টেন্স প্যাটার্ন ও প্রসেসের অংশ। আসলে নৃবিজ্ঞানের এই উপশাখা নিজেকে সংজ্ঞায়িত করেছে ইকোনোমিক্সের বিপরীতে। একারণে এই প্রবন্ধে প্রথমে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান নয়, বরং মূলধারার অর্থনীতি তথা নিওক্লাসিকাল অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান জন্মলাভ করে ৪০ ও ৫০- এর দশকের সাবস্টান্টিভ-ফরমালিস্ট বিতর্কের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে নৃবিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা লাভ ও স্নাতক সংখ্যা বৃদ্ধি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের মতো বিশেষায়িত উপশাখাগুলোর জন্মলাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তবে সাবস্টান্টিভ-ফরমালিস্ট বিতর্কের দুই দশক পূর্বে ট্রব্রিয়ান্ড আইল্যান্ডে ম্যালিনোস্কির কাজ অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল এবং এই সময়েই সূত্রপাত হয় অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের মধ্যকার বিপরীতমুখী সম্পর্কের৷
১৯১৫ সালে ম্যালিনোস্কি যখন ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপূঞ্জে মাঠকর্ম শুরু করেন, তখন তার একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এমন জনগোষ্ঠী খুঁজে বের করা যারা সমকালীন ইউরোপীয়ানদের থেকে একেবারে ভিন্ন। ইউরোপীয় সংস্কৃতির সম্পর্কে নিজের ক্রিটিকে ম্যালিনোস্কির মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল আধুনিক বস্তুবাদ (অর্থ ও সম্পদ আচ্ছন্নতা) ও স্বার্থপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা মেইনস্ট্রিম ইকোনোমিক্সের ‘র্যাশনাল সেল্ফ-ইন্টারেস্টেড ইন্ডিভিজুয়াল’ (এই ‘ইকোনোমিক ম্যান’ অর্থনীতিবিদদের কাছে স্থান-কাল-নির্বিশেষে একটি সর্বজনীন প্রপঞ্চ হিসেবে বিবেচিত) থেকে একেবারেই ভিন্ন, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে যাদের মূল প্রণোদনা কর্তব্য ও বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা, জাদু বিশ্বাস ও সামাজিক আকাঙ্ক্ষা সহ বিবিধ প্রথাগত প্রপঞ্চ। ম্যালিনোস্কি যুক্তি দিয়েছেন যেহেতু ট্রব্রিয়ান্ডরা পশ্চিমাদের থেকে একেবারেই আলাদা, তাই প্রথাগত এথনোসেন্ট্রিক পশ্চিমা অর্থনীতিত ধ্যানধারণা ট্রব্রিয়ান্ড অর্থনীতি বুঝতে অকেজো; প্রথাগত ইকোনোমিক্সের মাধ্যমে পশ্চিমারা নিজেদের বুঝতে সক্ষম হলেও অন্যান্য সমাজ-সংস্কৃতি উপলব্ধি করতে অক্ষম। সম্ভবত ম্যালিনোস্কির আরো প্রশাংসাযোগ্য কাজ এটা যে, তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন মানুষ স্বভাবত স্বার্থপর নয়, বরং বস্তুবাদী পশ্চিমা সংস্কৃতিই মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। অন্যদিমে মূলধারার অর্থনীতিবিদরা দাবী করতো একেবারে উল্টোটা। তাদের মতে, ‘প্রিমিটিভ ইকোনোমিক ম্যান’ স্বভাবতই স্বার্থপর ও ‘স্যাভেজ’ যারা ভাগাভাগি করতে অক্ষম। এই বিষয়টি ম্যালিনোস্কিকে বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল।
আসলে পশ্চিমা ইকোনোমিক্সের সর্বজনীনতার ক্রিটিকের মাধ্যমে ম্যালিনোস্কি বিংশ শতকের নৃবিজ্ঞানের মূলধারায় তথা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের স্রোতে গা ভাসাচ্ছিলেন। অর্থাৎ কোন সর্বজনীন মাপকাঠির পরিবর্তে প্রত্যেক সংস্কৃতিকে তাদের নিজস্ব মানদণ্ডে বিচার করার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের শুরু।