প্রসব সহিংসতা ও প্রসবের হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরূদ্ধে তুর্কি নারীদের কৌশলগত অবস্থান (প্রথম কিস্তি)

[সেলেন গোবেলেজের ‘Tactics of women up against obstetrical violence and the medicalization of childbirth in Turkey’ নামক একাডেমিক নিবন্ধটি নেওয়া হয়েছে ‘The Politics of Female Body in Contemporary Turkey’ নামে একটি সংকলন থেকে। সেলেন গোবেলেজের কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে কিভাবে সন্তান জন্মদান সম্পর্কিত প্রক্রিয়াগুলোকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আওতায় নিয়ে আসার নামে একধরনের সহিংসতার জন্ম হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে নারীরা কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে। নিবন্ধটি এনথ্রোসার্কেলের জন্য অনুবাদ করেছেন সাদিয়া শান্তা। নিবন্ধটি তিনটি কিস্তিতে প্রকাশিত হবে। আজকে প্রকাশিত হলো প্রথম কিস্তি। ]

অনুবাদকের নোটঃ পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে – এখানে মূল শব্দ ‘medicalization” কে ‘হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা’ হিসেবে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। কিছু কিছু টিকা শব্দের অনুবাদের পাশে ইংরেজি মূল শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব ইংরেজি শব্দের যথার্থ বাংলা পরিভাষা নেই সেগুলোকে কোন কোন ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় রাখা হয়েছে যেমন- সিজার, জেন্ডার পার্ফর্ম্যান্স ইত্যাদি; কোন শব্দের পাশে আবার প্রয়োজন অনুসারে থার্ড ব্রেকেটে বাংলায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু ইংরেজি বাক্য বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে ভেঙে একাধিক বাক্যে সাজিয়ে লেখা হয়েছে।

তুর্কি নারীদের সন্তান প্রসবে হাসপাতালকেন্দ্রিক অতি-চিকিৎসাকরণ সংযুক্তির মাধ্যমে প্রসব চিকিৎসার পরিবর্তন


‘হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা’ (medicalization) সেই প্রক্রিয়াকে বোঝায় যা স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের জ্ঞানের ভিত্তিতে ঔষধকে একটি বিশ্বস্ততার ভান্ডারে পরিণত করে। ফলে তা সমাজ নিয়ন্ত্রণের একটি বিধান হয়ে উঠে ও ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব বৃদ্ধি করে (Zola 1972:487)। এই শতাব্দীর শেষের দিকে প্রসবজনিত বিষয়ে পুরুষের নাকগলানো বৃদ্ধি পায়। এর পাশাপাশি ঐতিহাসিক নারী কেন্দ্রিক গৃহ-প্রসব চর্চা প্রতিস্থাপিত হয় প্রযুক্তি কেন্দ্রিক ও পুরুষ চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রিত হাসপাতাল-প্রসব ব্যবস্থা দ্বারা। হাসপাতাল মূলত অতিরিক্ত চিকিৎসা সরবরাহ করে আরো সহজ ও নিরাপদ প্রসবের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই পরিবর্তনটি লিয়েভিট এর ঐতিহাসিক বর্ণনায়ও দেখা যায় , যা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীদের ‘মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার (Negotiated process) কথা বলে। যদিও এই পরিবর্তনের ফলে মা ও শিশু মৃত্যুহারের তাৎক্ষণিক হ্রাস ঘটেনি। প্রসব ব্যবস্থার এই পরিবর্তনের ফলে নারীরা প্রসবের সময় সাহায্যকারী নারী বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়, গৃহ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয় এবং অচেনা মানুষদের মাঝে একাকী প্রসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় (Walzer Leavitt 1986:171)। আধুনিক প্রসববিদ্যা চর্চা, যা রথম্যানের ভাষায় ‘মেডিকেল মডেল’ (১৯৮২) ও ডেভিস ফ্লয়েডের ভাষায় ‘টেকনোক্রেটিক বার্থ মডেল’ (১৯৯২) হিসেবে সংজ্ঞায়িত, তার প্রাথমিক আদিকল্পের উদ্ভব হয়েছিল অসম্পূর্ণ নারী দেহের ধারণা থেকে। ধারণা করা হতো, ত্রুটিযুক্ত নারীদেহকে যদি কার্যকরী রোগ নির্ণায়ক সরঞ্জামের সাথে নিখুঁতভাবে সংযুক্ত করা হয় তবে তা থেকে অধিক ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

হাসপাতালকেন্দ্রিক প্রসব চিকিৎসার সমালোচকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ওয়কলি (১৯৮০) এবং কাৎজ রোথম্যান (১৯৮২)। তারা বৃহৎ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামো উদঘাটন করে দেখিয়েছেন কিভাবে হাসপাতালকেন্দ্রিক প্রসব চিকিৎসার প্রবণতা শিশুদের পণ্যে পরিণত করে এবং গর্ভবতী নারীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে (Fox and Worts 1999:328-9)। এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য হলো তুরস্কের সমকালীন প্রসব চর্চাকে পুঁজিবাদী সমাজের প্রযুক্তিনির্ভর প্রসবচিকিৎসার সাথে মিলিয়ে দেখা যা একটি রক্ষণশীল স্রোত দ্বারা প্রভাবিত।

তুরস্কে গর্ভাবস্থার চিকিৎসা ও প্রসবের হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শেষদিকে এবং তা চালু ছিল প্রজাতান্ত্রিক নিয়ম ও চর্চায়। এই ব্যবস্থা তুরস্কের আধুনিকীকরণ ও সেখানকার জনগণকে সন্তান-ধারণে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত নীতিগুলো (pronatalist policy) এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। তুরস্কের হাসপাতালকেন্দ্রিক প্রসব চিকিৎসার উপর সীমিত সংখ্যক কিছু কাজ হয়েছে। তার মধ্যে ব্যালসয় (২০১৩), বেয়িনলি (২০১৪), সিনদগলু ও সায়ান-সেংগিজ (২০১০)- এর কাজ সর্বাধিক সমাদৃত। তারা দেখিয়েছেন অটোম্যান সাম্রাজ্য – যেখানে নারীদের কেবল জনসংখ্যার উৎপাদক কিংবা জাতির বীজ প্রতিপালন ও পুনরুৎপাদনের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হতো – সেখানকার মতো নয়া তুর্কি প্রজাতন্ত্রেও জনসংখ্যার গুণগত ও পরিমাণগত মান দিনে দিনে কেমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে শুরু করে (Beyinli 2014:43)।

তুর্কি সাম্রাজ্যে (Ottoman empire) নারী-পুরুষ পরিমণ্ডল আংশিকভাবে পৃথক হওয়ার ফলে সেখানে ধাত্রীর বদলে পুরুষ চিকিৎসকের আবির্ভাব ঘটতে ইউরোপের চেয়ে কিছু বেশি সময় লেগেছে। জনসংখ্যার পরিমাণ যখন তুর্কি সাম্রাজ্যের অভিজাত শ্রেণীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল, তখন তারা শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার কমানোর দিকে আলোকপাত করল এবং গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী প্রসববিদ্যাকে আধুনিকায়ন করলো। তারা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষনহীন ধাত্রীদের অযোগ্য বলে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করার বদলে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের যোগ্য ধাত্রী হিসেবে নিবন্ধন করানোর নীতি বাস্তবায়ন করলো এবং এর ফলে সেসব অভিজ্ঞ ধাত্রীদের অবস্থান হলো হাসপাতালের চিকিৎসকদের অধীনে। ১৮৪৭ সালে তুরস্কে হাসেকি ওমেন’স হাসপাতাল চালু করার মাধ্যমে প্রসব বিষয়টিকে গৃহস্থালি পরিসর ছাড়িয়ে হাসপাতালমুখী করার প্রথম পদক্ষেপটি নেওয়া হয় (Balsoy 2013)।

ধাত্রীদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ক্রমশ পুরুষ-শাসিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধীন হয়ে উঠতে থাকে – যা কিনা পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত। এভাবে নয়া তুর্কি প্রজাতন্ত্রে গর্ভাবস্থার হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা চালু করে নারী দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। ফলে জনবহুল স্থানে (Public space) নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলেও তুরস্কে এমন একটি পিতৃতন্ত্রের জন্ম হলো যা নিজেকে আধুনিক, প্রগতিশীল, পশ্চিমা ও আলোকিত হিসেবে দাবি করে। আর সেই পিতৃতন্ত্র নারীর জীবনের এমন কিছু ক্ষেত্রে প্রবেশ বিস্তার করে যা ঐতিহ্যগতাবে নারীর নিজস্ব পরিমন্ডলের দখলে ছিল; যেমন – রোগ নিরাময় শিল্প, বিশেষ করে ‘প্রসববিদ্যা’ (Cindoglu and Sayan-Cengiz 2010:223)।

২০০০ সাল থেকে গর্ভাবস্থা ও প্রসবের মতো বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্তি-নির্ভর হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশগুলোর মধ্যে হস্তক্ষেপজনিত কিছু পদ্ধতিও অন্তর্ভুক্ত হয়; যেমন- Intravenous infusions, প্রসনবেদনায় অক্সিটোসিনের ব্যবহার, নিয়মিত যোনি পরীক্ষা, জোরপূর্বক পৃষ্ঠীয় অবস্থান, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব, এবং এর পাশাপাশি সিজার বিভাগ। এছাড়াও তুরস্কে এমন অনেক হস্তক্ষেপজনিত চিকিৎসা পদ্ধতির চর্চা হয় যেগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মূলনীতি দ্বারা আদৌ স্বীকৃত নয়; যেমন-Enema, Pubic shaving, Episiotomy। গর্ভাবস্থা ও প্রসবের হাসপাতালকেন্দ্রিক অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার আরেকটি দিক হলো, এতে গর্ভবতী নারীকে ‘অসুস্থ’ বলে গণ্য করা হয় এবং ফলসরূপ তাদের রোগী হিসেবে বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী আচরণ করা হয়। এর ফলে প্রায়ই গর্ভবতী নারীদের শারীরিকভাবে অক্ষম হিসেবে ধরে নিয়ে তাদেরকে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয় এবং মনে করা হয় নারীরা তাদের গর্ভাবস্থার সেবাবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ। এভাবে গর্ভবতী নারীদের গর্ভাবস্থার প্রতিমূর্তি, তাদের অভিজ্ঞতা নির্ভর জ্ঞান, প্রসববিদ্যা, এবং সন্তান জন্মদানের জ্ঞানকে অবজ্ঞা করে কেবল বিশেষজ্ঞের জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে বাধ্য করা হয়।

পাশ্চাত্যে প্রসব বিষয়ে যত ধরনের গবেষণা হয়েছে সেগুলো থেকে জানা যায়, হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালুর ফলে অনেক নারী যেমন গর্ভাবস্থার সহজাত রূপ থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটে বলে মনে করে, তেমনি আবার বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর অনেক নারী এই হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে সানন্দে আগ্রহও প্রকাশ করে (Sargent and Stark 1989; Davis-Floys 1992; Lazarus 1994)। ইতোমধ্যে হওয়া গবেষণাগুলির ফলাফল ঘাটলেও দেখা যায়, হাসকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে নারীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ায় নারীর সন্তুষ্টির মাত্রা প্রসব পদ্ধতি থেকে শুরু করে প্রসব পরবর্তী সহায়তা পাওয়ার মতো একাধিক প্রত্যাশিত বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তা সত্ত্বেও নারীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা ও সসম্মানে সেবা গ্রহণের নিশ্চয়তা পাওয়া যাতে নারীর নিজস্বতা (privacy) রক্ষা পায় এবং প্রসবকালীন, প্রসব-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নারী সহায়তা পায়। এই গবেষণাটিতে বৃহৎ সামজিক কাঠামো বিবেচনা করে প্রসব বিষয়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব ও অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করার জন্য আমি একটি দ্বি-স্তরের পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। এই গুণগত গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত নারীদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো এক ধরনের মিশ্র ব্যাখ্যা দেয় যা প্রসবের প্রচলিত দ্বৈত-বিপরীত ধারণাগুলো ভেঙে দেয়; যেমন- অস্ত্রোপচার পদ্ধতিতে প্রসব (ceasarean) বনাম যোনিপথে প্রসব, প্রাকৃতিক বনাম প্রযুক্তিনির্ভর প্রসব, গৃহ বনাম হাসপাতালে প্রসব, প্রসবে পুরুষ ডাক্তার বনাম নারী ধাত্রীর হস্তক্ষেপ।

তবে গর্ভধারণকে ঘিরে সন্তান জন্মদান ও মাতৃত্বের বিষয়ে আরো যেসব অব্যক্ত, অস্বাভাবিক ও অজানা অভিজ্ঞতা রয়েছে সেগুলো এই প্রচলিত দ্বৈত-বিপরীত ধারণাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেক্ষেত্রে কুইয়ের অধ্যয়ন (Queer studies) তাত্ত্বিকভাবে ও পদ্ধতিগতভাবে এই ধরনের অভিজ্ঞতাগুলো বুঝতে সাহায্য করে; এছাড়াও কুইয়ের অধ্যয়ন প্রসবকালের জেন্ডার পার্ফর্ম্যান্স (Gender performance) ও মাতৃত্বের স্বকীয়তার (Mothers’ subjectivities) বহুমুখী রূপও প্রকাশ করে। কুইয়ের বিদ্যা যখন লিঙ্গীয় সংখ্যালঘু (Sexual/Gender minorities) -দের অভিজ্ঞতা পরখ করতে অধিক ব্যস্ত হয়ে উঠে, তখন বিপরীত লিঙ্গকামী (Heterosexual) -দের সম্পর্ককেও কুইয়ের দৃষ্টিতে নিরিখ করে দেখার চেষ্টা চলে (Browne and Nash 2010:5)। ফলে আমার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বিপরীত লিঙ্গকামী (cisgender) নারী তথ্যদাতাদের বর্ণিত অভিজ্ঞতাকে আরো বড় ও জটিল পরিসরে ফেলতে গেলে সন্তান জন্মদানের প্রচলিত নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সম্ভাবনাও মুখ্য হয়ে উঠে। এই আলোচনার সাথে মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়নে মিকদাশির পরামর্শ মতো কুইয়ের (queer) দৃষ্টিতে সেখানকার প্রচলিত লিঙ্গীয় আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বিষয়টিও সম্পর্কিত। মিকদাশি মূলত কুইয়েরিং (queering) পদ্ধতিতে জাতি, শ্রেণী, রাষ্ট্র এবং দেহবিষয়ক প্রচলিত আদর্শ ও ধারণাকে যাচাই করে দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন (Mikdashi 2013:350)। মিকদাশির পরামর্শ মতে বিপরীত লিঙ্গকামী দম্পতিদের নিয়ে আলেশে সম্প্রতি একটি গবেষণা চালান। আলেশের কাজটি ভালবাসার সম্ভাব্য রাজনীতি শনাক্ত করার মাধ্যমে ‘পুরুষ ও স্ত্রী’- এর মধ্যকার প্রচলিত আধিপত্যের ধারণা ভাঙতে একটি কার্যকর পদ্ধতিগত কুয়েরিং (Queering) হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আলেশের গবেষণায় কুইয়ের তত্ত্ব (queer theory) লেবাননের নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট অনুসারে যৌনতারও ঊর্ধ্বে স্থান পায় (Allouche 2019)। কুইয়ের বিদ্যার (Queer scholarship) লক্ষ্য হলো প্রচলিত ও সর্বজনগৃহীত বিষয়গুলো নেড়েচেড়ে দেখে গঠনগত সমালোচনার মাধ্যমে সেগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাতে করে তা প্রতিদিনের প্রতিরোধ সাধনের মাধ্যমে প্রচলিত সামাজিক ধারণাগুলো ভেঙে দিতে পারে (Browne and Nash 2010)।  

এই অধ্যায়ে আমি তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত বিষয়গুলো হালকাভাবে মিশিয়ে প্রসবকালে তুরস্কের নারীদের সুললিত কৌশল প্রয়োগের আলাপটি বর্ণনা করেছি। নারীরা কিভাবে ব্যতিক্রমধর্মী, বহুমাত্রিক ও অনির্দিষ্ট পদ্ধতির প্রসব অভিজ্ঞতাকালীন তাদের নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে স্থানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সেসব বিষয়ও আলোচনা করেছি। এখানে কৌশল বলতে আমি বুঝাচ্ছি – প্রসবকাল থেকে প্রসব-পরবর্তী সময় পর্যন্ত নারীর সেসকল স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নেয়, কর্মকান্ডে অংশ্রগ্রহণ করে, ও নিষ্ক্রিয় অবস্থান নেয় যা কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠানের জৈবচিকিৎসার সাথে তাকে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে (De Certeau 1984)। অন্যদিকে, আবু লুঘদের বিখ্যাত কাজ ‘রোমান্স অব রেজিস্টেন্স’ (Romance of resistance)-  এর কথা ভাবা যাক। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন সব ধরনের প্রতিরোধই অকার্যকর ক্ষমতা ব্যবস্থাকে ইঙ্গিত করে ও অধীনতাকে অস্বীকার করার মাধ্যম হিসেবে প্রকাশ পায় (Abu-Lughod 1990:42)।

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে নয়া-উদারনীতিবাদী কৌশল


সিজারিয়ান প্রসবে সর্বাধিক এগিয়ে থাকা তুরস্কের আধুনিক প্রসব চর্চা চিহ্নিত করা যায় উদারনীতিবাদের ধ্যান-ধারণার আর ধর্মীয় ও প্রশাসনিক ‘ডিসকোর্স’ দ্বারা (Topcu 2019)। এই সকল ডিসকোর্স নারীর শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করে। ২০০৩ সালের ‘হেলথ ট্রান্সফরমেশন প্রোগ্রাম’ (Health Transformation Program) এক বিরাট আদিকল্পের পরিবর্তন (Paradigmatic shift) ঘটায়। সেই পরিবর্তিত আদিকল্পে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মানদণ্ড হয় ‘পার্ফর্ম্যান্স’ অর্থাৎ সেবা দেওয়ার ঢং । যদিও এতে উল্টো সেবা প্রদানের অনিয়ম, ঝুঁকি, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও স্তরায়ণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে বৃদ্ধি পায় স্বাস্থ্য সেবার বৈষম্য। ‘সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা’র জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের খরচাদি কমিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সক্ষমতার উপর পারিশ্রমিক যুক্ত করা হয়। কিন্তু এটি স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে অধিক গুণগত মানের সেবা প্রদানের বদলে অধিক সংখ্যক সেবাপ্রদানের প্রতিযোগিতাকে উস্কে দেয়; ফলে তা স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর মধ্যকার সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে (Dayi and Karakaya 2018)। সেবা প্রদানের ধরনকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের চাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে তীব্র মানসিক চাপে কর্মক্ষেত্রে যেমন স্বাস্থ্যকর্মীদের অসহিষ্ণু মনোভাব প্রকাশ পায়, তেমনি রোগীর সাথে তাদের যোগাযোগে ফারাক তৈরী হয় (Ocal 2017:85)। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে এধরনের নব্য-উদারনীতিবাদী পরিবর্তনগুলো ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে।  ‘বুলবুল’- এর একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞ (obstetric-gynaecologist) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মানেই ঝুঁকি না নেওয়া কিংবা ভুল না করা। দিনশেষে তা কেবল চাকরি-ই মনে হয়, যেন এতে রোগীর সাথে কোন কারবার নেই, আছে আছে খদ্দের আর মনিব যাদেরকে খু্শি রাখাই চাকরির একমাত্র কাজ” (Bulbul 2012:42-3)। ২০১২ সালে তুর্কিতে সীজার সংক্রান্ত আইন জারি হলে নব্য-উদারনীতিবাদী পরিবর্তনগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রসূতি বিশেষজ্ঞদের জন্য সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়ায়। এই খন্ডে [যে বইয়ে এই লেখাটি অধ্যায় হিসেবে ছাপানো হয়েছে সেই বইটির কথা বুঝানো হয়েছে] তপসু রচিত অধ্যায়টিতে একটি বিশ্লেষণ দেখানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সিজারের ‘অপব্যবহার’কে লক্ষ্য করে তুরস্কের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে নতুন নিয়ম জারি করে; কিন্তু তাতে সিজার প্রসবের হার যথেষ্ট মাত্রায় হ্রাস পায়নি। বাস্তবে বরং দেখা যায় – নতুন নিয়ম জারির ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে একদিকে যেমন সিজার প্রসবের সংখ্যা কমে আসে, অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আবার সিজার প্রসবের সংখ্যা বেড়ে যায়।

এভাবে ‘স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার’-এর নামে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বিস্মোফরণের মতো বৃদ্ধি পায় এবং সিজারিয়ান প্রসবের সংখ্যাও প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ফলে সিজারিয়ান প্রসব সংখ্যার বৃদ্ধি ও প্রসব ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ – এই দুইয়ের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ তুরস্কের মতো ব্রাজিলের অবস্থাও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। ব্রাজিলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সীজারের হার (৮০-৯০ শতাংশ), সরকারি প্রতিষ্ঠানের সীজারের হার (৩৫-৪৫ শতাংশ) থেকে তুলনামূলক বেশি (Nakamura-Pereira et al. 2016:246)।

এক নতুন আইনী পরিভাষাঃ প্রসব সহিংসতা


নারীবাদের দ্বিতীয়-ঢেউ আছড়ে পড়ে প্রায় অর্ধ-শত বছর পূর্বে। সেসময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত ‘নারী স্বাস্থ্য আন্দোলন’ (Women’s Health Movement) হাসপাতালকেন্দ্রিক প্রসব ব্যবস্থা এবং প্রসব সহিংসতার বিরূদ্ধে অভিযোগ তোলে। কিন্তু সম্প্রতি আবার ‘প্রসব সহিংসতা’র ধারণা নতুনকরে আবির্ভূত হলে এটি একটি আইনী পরিভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০০৭ সালে ভেনেজুয়েলায় আনুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রসব সহিংসতা’র ধারণা প্রণীত হয়। তাতে প্রসব সহিংসতা বলত বোঝানো হয় – প্রসূতিসেবার নামে অসম্মানজনক ও সম্মতিহীন পরিচর্যা, স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা নারীর প্র‍তি অবমাননাকর আচরণ, প্রমাণ-ভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক সেবা প্রদানে ব্যর্থতা, নারীর প্রতি যৌনবৈষম্যবাদী মনোভাব ও পেশাদারদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ।

চীন, স্পেন, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, এবং ফ্রান্সে যথাক্রমে  পাঁচটি প্রসব সহিংসতা পর্যবেক্ষণকেন্দ্র (Obstetric Violence Observatories) স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে এই পর্যবেক্ষণকেন্দ্রগুলো একটি অভিন্ন বিবৃতি প্রকাশ করে যাতে প্রসব সহিংসতাকে নারীর প্রতি সহিংসতার সবচেয়ে অদৃশ্য রূপ ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে ঘোষণা করা হয় (Sadler et al. 2016:50)। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ইউরোপীয় কাউন্সিলের সংসদীয় সমাবেশে ‘প্রসব এবং স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সহিংসতা’ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটির চূড়ান্ত রকম বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রাজনৈতিকভাবে প্রসব সহিংসতাকে স্বীকৃতি দানে এর বিরাট ভূমিকা ছিল।

নারীর প্র‍তি দুর্ব্যবহার ও অসস্মানের মতো কাঠামোগত বৈষম্যের বিষয়গুলোকে নারী সহিংসতার বৃহত্তর ছকে ফেলে আলোচনা করা জরুরী। এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য হলো প্রসবকালীন সময়ে নারীর প্রতি করা দুর্ব্যবহারকে নারী যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করুক না কেন – এক নিশ্চিতভাবে ‘প্রসব সহিংসতা’র অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা। আমি এই পদ্ধতিতেই প্রসব সহিংসতা চিহ্নিত করি। কেননা, প্রসব সহিংসতার একটি অন্যতম বিষয় হলো অসম্মতি। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সম্মতি দিতে হলেও নারী নীরব উপায়ে কৌশল প্রয়োগ করে এবং ‘সহিংসতার স্বীকার নয়’ বলে নিজের মধ্যে এক ধরনের মিথ্যা ধারণা তৈরী করে। এই বিষয়গুলোই পরবর্তী আলাপে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

তুরস্কের নারীবাদী আন্দোলনে গর্ভপাতের অধিকার ও নারী শিশু হত্যাকে অতিমাত্রায় অভিযুক্ত করা হয়৷ সেই আন্দোলনে কেবল পেশাদার কিছু স্বাস্থ্যকর্মী, মূলত ধাত্রী [প্রসব চর্চায় যাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই] এবং দৌলা (Doula) [যারা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত] প্রসব সহিংসতার বিরূদ্ধে সংবেদনশীল ছিল। কিন্তু এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে প্রসব সহিংসতা রোধের কোন জীবন্ত প্রতিফলন দেখা যায়নি। ফলে প্রসব সহিংসতার বিরূদ্ধে কাঠামোগত আন্দোলনের অভাব থাকায় আমার এই পরীক্ষামূলক গবেষণাটি প্রসব সহিংসতার নারীবাদী সমালোচনায় অবদান রাখে।

পদ্ধতিগত রূপরেখা 


ইস্তাম্বুলের বিলাসবহুল একটি বেসরকারি হাসপাতালে আমার সিজারের অভিজ্ঞতা হয়৷ তার দুই বছর পর, ২০১৩ সালে সীজারের হার বৃদ্ধির বিভিন্ন দিক বোঝার জন্য আমি একটি গবেষণা পরিচালনা করি। গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ের মাঠকর্মে একজন ধাত্রী, দুইজন প্রসব বিশেষজ্ঞ, আর একজন দৌলার সাক্ষাৎকার নিই। এই প্রাথমিক মাঠকর্মই আমাকে সিজারিয়ান খাত থেকে বের হয়ে আরো বৃহত্তর পরিসরে গবেষণাটি পরিচালনা করার ইঙ্গিত দেয়। ফলে প্রসবের হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসাকরণ, প্রসব ব্যবস্থায় অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তা ও নারীর মতামতের মতো বিষয়গুলোর দিকেও আমি আলোকপাত করি। এর জন্য আমার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী মায়েদের নির্বাচন করা হয়েছিল ‘কনভেনিয়েন্স স্যাম্পলিং’ [গবেষণার সুবিধার্থে যে নির্বাচন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়] আর ‘স্নোবল স্যাম্পলিং’ [একজন অংশগ্রহণকারী থেকে অন্য একজন অংশগ্রহণকারীর সন্ধান পাওয়ার পদ্ধতি]-  এই দুইয়ের মিশ্র পদ্ধতির মাধ্যমে। কনভেনিয়েন্স স্যাম্পলিং পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত যেসকল নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তারা সবাই ইস্তাম্বুলের কেন্দ্রে বসবাসরত মধ্য ও উচ্চ শ্রেণীর শিক্ষিত নারী এবং ত্রিশ বছরের মধ্যে সন্তান প্রসবের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। অন্যদিকে, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিসরের নারীদের মতামত জানার জন্য স্নোবল স্যাম্পলিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি নিম্ন-আয়ের ও কম শিক্ষাগত যোগ্যতার নারীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি যারা ২৫ বছর হওয়ার পূর্বেই সন্তান প্রসবের অভিজ্ঞতা লাভ করে। এছাড়াও, আরো সম্মানজনক প্রসব চর্চার সম্ভাবনার প্রতি আগ্রহ থেকে আমি একটি দৌলা প্রশিক্ষণ আয়োজনে অংশগ্রহণ করি। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমি প্রসব চর্চাকালীন অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাই এবং সেখানেই আমার গবেষণার লক্ষ্যে কিছু ধাত্রী ও দৌলার সাক্ষাৎকার নিই।

২০১৬২০১৭ সালের মধ্যে আমি ৩৭ জন নারীর মুখোমুখি ও নিবিড় সাক্ষাৎকার (In-depth interview) নেই যারা গত ২৫ বছরের মধ্যে তুরস্কে সন্তান প্রসবের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এই গবেষণায় বিচিত্র রকম অভিজ্ঞতার গল্প তুলে আনার উদ্দেশ্যে ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন জেলার মায়েদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল যারা সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বা নিজ গৃহে সহজাত উপায়ে কিংবা সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করেছে। ১৪-৪০ বছর বয়সের মধ্যে প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়া নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিরক্ষরতা থেকে পিএচডি স্নাতক পাশ পর্যন্ত পাওয়া যায় এবং তারা বিভিন্ন রকম সামাজিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। গবেষণায় নির্বাচিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এমন বিশজন নারী ছিল যারা পঁচিশ বছর বয়সের আগেই প্রথম সন্তান প্রসবের অভিজ্ঞতা লাভ করে৷ এই গবেষণায় অল্পবয়সী মা ও বয়ষ্ক মায়েদের মধ্যকার মূল পার্থক্য তুরস্কের জনসংখ্যা জরিপের সাথে সম্পর্কিত। তুরস্কের জনসংখ্যা জরিপের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, যে নারীর সন্তান প্রসবকালীন বয়স যতো কম, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও উপার্জনও ততো কম (Hacettepe Institution of Population Studies 2019:55)। এছাড়াও দেখা যায়, কম বয়সী মায়েদের অধিকাংশই সরকারি হাসপাতালে তাদের সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। সাক্ষাৎকারগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন দিক থেকে আসা উচ্চমাত্রার গ্রামীন অভিবাসন ইস্তাম্বুলের শহুর ও বৈশ্বিক পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থা ও আধুনিক বৈশ্বিক ব্যবস্থার মিলন ঘটায় যা প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসাকে যুক্ত করে প্রসবের এক মিশ্র পদ্ধতির চর্চা চালু করেছে।

এই অধ্যায়ের পরের ভাগে হাসপাতালকেন্দ্রিক অতিরিক্ত চিকিৎসাকরণের সাধারণ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে; যেমন – এপিসিওটোমি [প্রসবের সময় যোনিপথকে বড় করার জন্য অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি ছেদ তৈরী করণ], নিয়মিত যোনি পরীক্ষা, প্রসব চিকিৎসাকালে কথায় কিংবা শারীরিকভাবে সহিংস আচরণ করা, এবং ঘনিষ্ঠতার জন্য অপমান করা ইত্যাদি। এই আলাপের ভিত্তি হিসেবে আমার গবেষণার উদ্দেশ্যে  নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলোর অনুলিপি বিশ্লেষণ করা হয়েছে যার ফলস্বরূপ এই আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে। আলাপের শেষ ভাগে প্রসবকালীন সময়ে নারীর প্রতি অসদাচরণের বিরূদ্ধে নারীর প্রতিরোধ ও মধ্যস্থতা কৌশলের কিছু উদাহরণ সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।

(চলবে)