বিবিধ মানবতাবাদ, বিবিধ আধুনিকতা: মানব-কল্যাণবাদ (হিউমানিটারিয়ানিজম) সম্পর্কে তালাল আসাদের অ্যান্টি-হিউমানিস্ট ক্রিটিকের পুনর্বিচার
(প্রভাবশালী নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ আধুনিকতা, মানবাতাবাদ ও সেক্যুলারিজমের জেনেওলজি অনুসন্ধান এবং এসব ধারণাকে সমালোচনার জন্য বিখ্যাত। স্লাভিকা জ্যাকেলিস এই লেখাটিতে আসাদের সমালোচনামূলক লেখাগুলোর একটি পুনর্বিচার করেছেন। আসাদের পদ্ধতির সমালোচনা করে তিনি বহুস্বরীয় আধুনিকতা ও মানবতাবাদের কথা বলেছেন। লেখাটি অনুবাদ করেছেন, মুসাব্বির আহমেদ হিমেল এবং আবদুল্লাহ হেল বুবুন]
মূল লেখা- স্লাভিকা জ্যাকেলিস
“সহিংসতা, আইন ও মানব কল্যাণবাদ বিষয়ক ভাবনা” নামক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে তালাল আসাদ ‘মানুষ’, ‘মানবতাবাদ (humanism)’১ আর ‘মানবিক’’ ধারণাত্রয়ীর ঐতিহাসিক সিলসিলা (জিনিওলজি) উপস্থাপন করেছেন। একইসাথে, তিনি এই ধারণা গুলোর পরিবর্তিত অর্থ ও আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন। যে ঐতিহাসিক সিলসিলা তিনি তুলে ধরেছেন, তা সরল নয়, তবে তার কাজের উদ্দেশ্য একটাই: মানব কল্যাণবাদের (humanitarianism)২ সমালোচনা করা; বিশেষ করে সামরিক মানব কল্যাণবাদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। চার্লস টেইলরের দর্শন (আসাদের মতে) আধুনিকতাকে সর্বজন কল্যানের ধারার দিকে একটি নৈতিক অগ্রগতি হিসেবে দেখে। এর বিপরীতে তিনি (আসাদ) যুক্তি দেন যে, ‘মানব’ এবং ‘মানবতাবাদ’ এর আধুনিক ধারনা এক প্রকার সহিংসতাকে বৈধতা প্রদান করে এবং এই সহিংসতা মানব-কল্যাণবাদের একটি মৌলিক গাঠনিক উপাদান।
আধুনিক মানব-কল্যাণবাদী হস্তক্ষেপকে (ইন্টারভেনশন) ‘মানব’ বর্গের সাথে যুক্ত করার পেছনে আসাদের একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, যেভাবে ‘মানবতা’ নামক সার্বজনিন ও বৈশ্বিক বর্গ (যার অন্তর্ভুক্ত সকলের একই ‘এসেন্স’ রয়েছে) কিছু মানুষকে মানবিকীকরণ এবং অন্যদের বিমানবীকরণ করে। কেন এটা ঘটে, তার শিকড় আসাদ খুঁজে পেয়েছেন খ্রিস্টধর্মে। আসাদের মতে, মানুষ ও জীবনের অর্থময়তা সংক্রান্ত খ্রিস্ট্রীয় বোঝাপড়ার কেন্দ্রে আছে সহিংসতার চর্চা। কারণ, অভাবগ্রস্ত ও দুর্দশাগ্রস্তদের কাছে খ্রিস্টধর্ম “দানশীলতা ও শাস্তি” (charity and chastisement)- উভয় নিয়েই “পৌছানোর” কথা বলেছে। মানব সম্পর্কিত আধুনিক ধারণার দুনিয়াবীকরণ (সেকুলারাইজেশন) হলেও, তা এখনো পুরনো খ্রিস্ট্রীয় ধারনার উপর দুইভাবে আস্থা রাখে: নিষ্ঠুরতা আর বদান্যতা—এই দুই গুণের উপর জোরারোপ বহাল রেখে এবং একইসাথে ‘কিছুর’ অন্তর্ভুক্তি আর অন্যদের বাদ দেয়া নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে।
‘মানব’, ‘মানবতাবাদ’ এবং ‘মানব-কল্যাণবাদ’ ধারণাত্রয়ীর যে ঐতিহাসিক সিলসিলা তালাল আসাদ উপস্থাপন করেছেন, তার মাঝে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ইনসাইট রয়েছে। ‘মানব’ ও ‘মানবতা’-র আধুনিক ও খ্রিস্টীয় ধারণার মাঝে তিনি যে সংযোগ স্থাপন করেছেন, তা অত্যন্ত কার্যকর রূপে উনিশ শতকে ‘’মানব-কল্যাণবাদ’ শব্দের ধর্মতাত্ত্বিক ও স্বাতন্ত্র্যবাদী (এক্সক্লুসিভিস্ট) উৎপত্তিকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম: উনিশ শতকে এই শব্দটি দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ গোঁড়া খ্রিস্টানরা ওইসব খ্রিস্টধর্মালম্বীদের বোঝাত, যারা “কেবল মানব খ্রিস্টের (জিসাসের হিউম্যান ন্যাচার) অনুসারী” ছিলেন। ‘মানব-কল্যাণবাদ’ এর ঐতিহাসিক সিলসিলাকে আসাদ অত্যন্ত সফলভাবে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কিত তার বৃহত্তর সমালোচনার সঙ্গে মিলিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল সামরিক মানব-কল্যাণবাদের মুখোশ উম্মোচন করা। তিনি এ বাস্তবতাকেও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন যে, কতিপয় রাষ্ট্রের এই সহিংসতা (সামরিক মানব কল্যাণবাদ) চর্চার ক্ষমতা রয়েছে; অন্যদের নেই। আসাদ মানব-কল্যাণবাদের বিভিন্ন গাঠনিক উপাদানের (যেমন ‘মানব’, ‘মানবতা’, ‘মানবতাবাদ’) পরিবর্তনশীল, তরল এবং জটিল চরিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। একইসাথে, তিনি আমাদেরকে পাশ্চাত্য নৈতিকতা ও নৈতিকতা সম্পর্কিত বাগড়ম্বরের মুখোশ উম্মোচনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
এই ইনসাইটগুলো থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা আধুনিকতার খ্রিস্ট্রীয় শেকড়ের উপর আসাদের অব্যাহত ও একপেশে বিশ্লেষণী গুরুত্বারোপ ঐতিহাসিক পরম্পরা নির্মাণে (তার) চেষ্টা এবং মানব কল্যাণবাদী হস্তক্ষেপের সমালোচনা উভয়কেই সীমিত করে তোলে। ঠিক এ কারণেই, আসাদ দেখতে পান না যে, আধুনিকতার আরো গল্প রয়েছে — কেবল পশ্চিম ও খ্রিস্টধর্মের মাঝেই তা সীমাবদ্ধ নয়। চীনা ও ইসলামিক ঐতিহ্যে বিদ্যমান আত্ম-উন্নয়ন এবং মানবিক মর্যাদার ধারণার সাম্প্রতিক পুনঃআবিষ্কার এই দিকে ইঙ্গিত করে যে, মানুষ হওয়া বলতে কি বোঝায় এবং সে কিভাবে বিকশিত হতে পারে— এই ধারণাগুলো কখনোই শুধু পশ্চিমা নৈতিক ও রাজনৈতিক কল্পনার একচেটিয়া বিষয়বস্তু ছিল না। আসাদের একটি কেন্দ্রীয় বক্তব্য ছিল যে, পশ্চিমা সর্বজনবাদী ‘কনসেপ্ট অফ হিউম্যান’-এর ধারণা স্বভাবগতভাবেই ‘ভিন্নতা’-র [যার সাথে ‘’অপরায়ন’ জড়িত] ধারণা বা ‘দি আইডিয়া অব ডিফারেন্স’ -কে ধারণ করে। তবে, ‘মানব’, ‘মানবতা’ ও ‘মানবতাবাদ’ — এই ধারণা গুলোর একটি বৃহত্তর তুলনামূলক আলোচনা করলে এটা পরিষ্কার হবে যে, এই ভিন্নতার ধারণা শুধু পশ্চিমেই নয়, অ-পশ্চিমা অন্যান্য মানবতাবাদী ঐতিহ্যেও বিদ্যমান ছিল। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটা যে: (মানবতাবাদের ঐতিহাসিক পরম্পরা সম্পর্কে) খ্রিস্টীয়-পশ্চিমা আধুনিকতাকে ফোকাস করা একপেশে ফ্রেমওয়ার্ক থেকে সরে আসা আসাদের কেন্দ্রীয় পূর্বানুমান গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এই সরে আসতে পারা আমাদেরকে এই প্রশ্নটি করতে বাধ্য করবে: যদি খ্রিস্টীয় ও পাশ্চাত্য মানবতাবাদী দুনিয়াবী (সেকুলার) ধারার পাশাপাশি বিভিন্ন অ-পশ্চিমা মানবতাবাদী ধারার অস্থিত্ব থেকে থাকে, তবে বর্তমানেই বা কেন মানবতাবাদ এবং মানব-কল্যাণবাদের একটি একক গল্প (পশ্চিমা-খ্রিস্টীয় মানবতাবাদ) বলা হবে?
আধুনিকতার একক কোন রূপ নেই; আধুনিকতা বহুমুখী ও বিবিধ; এই আধুনিকতাগুলো কখনো একটা অপরটার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, আবার কখনো একে অন্যকে সমৃদ্ধ করে। বর্তমান সময়ে মানবতাবাদ ও মানব কল্যাণবাদের ঐতিহাসিক পরম্পরা নির্ধারণের প্রচেষ্টা এই সত্যকে মেনে নিয়েই শুরু করতে হবে। আসাদ নিজেও স্বীকার করেছেন যে, ‘আধুনিকতা’ একেবারে গোছানো বা সীমাবদ্ধ কোনো ধারনা নয়। তিনি এটাও বলেন যে, “আধুনিকতার অনেক উপাদানের উদ্ভব আদতে অ-ইউরোপীয় মানুষের ইতিহাসের সাথে সংযোগ থেকে” (Formations of the Secular, 2003: 13–14)। কিন্তু, আসাদ খুব স্পষ্টভাবে আধুনিকতাকে এমন একটি প্রকল্প হিসেবেই ভাবেন, যার লক্ষ্য হলো কিছু মূলনীতি (যারা কখনো কখনো একে অপরের বিরোধীতা করে এবং সদা পরিবর্তনশীল) প্রতিষ্ঠা করা: সংবিধানতন্ত্র…গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নাগরিক সমতা… ভোগবাদ, মুক্ত বাজার…ধর্মনিরপেক্ষতা।” সম্ভবত বর্তমানে তিনি মানব কল্যাণবাদকেও এই তালিকায় যুক্ত করবেন। আসাদের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে, আধুনিকতার নীতিগুলোর কোন স্থির অর্থ নেই; মানব কল্যাণবাদ, ধর্ম কিংবা সেকুলারবাদের ঐতিহাসিক সিলসিলা বিশ্লেষণে তিনি এই সব ধারণার বহুমুখী অর্থ ও তারল্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। অর্থ্যাৎ, তার মতে, এই ধারণা গুলোর কোন স্থির সুনির্ধারিত সীমানা নেই, এই ধারণাগুলোর অর্থ ও গণ্ডী সদা পরিবর্তনশীল। এই ধারণা গুলোর অতীত পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন হলেও, এদের সাম্প্রতিক পরিবর্তনশীল ও জটিল রূপগুলো তার জিনিওলজিতে (ঐতিহাসিক সিলসিলা) তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। এই ধারণা গুলোর সাম্প্রতিক পরিবর্তন গুলোকে উপেক্ষা আসাদের চিন্তার কোন প্যারাডক্স নয়, আসলে এটা এড়ানোযোগ্য ছিল না। কেননা, আসাদের মূল প্রকল্পই হলো পশ্চিমা আধুনিকতা এবং আধুনিক ক্ষমতা কাঠামো গুলোকে আধিপত্যবাদী ও সর্বজনবাদী হিসেবে প্রমাণ করা। আসাদের জিনিওলজি নির্ধারণ প্রচেষ্টার বৃহত্তর উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেনো, আগের প্রশ্নটি থেকেই যায়: যদি আমরা জানিই যে, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিবিধ ও বহুমুখী মানবতাবাদ ছিল, তাহলে বর্তমানে কেন আমরা মনে করবো যে, মানবতাবাদ এবং মানব কল্যাণবাদের খ্রিস্টধর্ম-পশ্চিমা আধুনিকতা কেন্দ্রিক একটি গল্পই রয়েছে?
বেশ কিছু সময় ধরে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম, কনফুসিয়ান এবং ধর্মনিরপেক্ষ (সেকুলার) চিন্তাবিদরা আরও সংযত এবং আত্মসমালোচনামূলক মানবতাবাদী মনোভাব নির্মাণের চেষ্টা করছেন। এই নতুন প্রচেষ্টার শুধু বিমানবিকীকরণ কিংবা অপরায়ন এড়ানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, যা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এই প্রকল্প আমাদের একে অপরের প্রতি (প্রাণীকুল সহ) যে দায়িত্বগুলো রয়েছে, তা পুনঃব্যক্ত করে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা এই আলোচনাগুলো বিভিন্ন মানবতাবাদী (হিউমানিস্ট) প্রকল্পের নৈতিকতা, অনুশীলন, প্রতিশ্রুতি ও দ্ব্যর্থতাকে একটি সৃজনশীল উপায়ে পাঠ করছে৷ মানবকল্যাণবাদ (হিউমানিটারিয়ানিজম) যেভাবে কল্পিত এবং বাস্তবায়িত হয়, অথবা যেভাবে তার সমালোচনা হতে পারে — এই প্রশ্নগুলো সমাধানে এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে মানব-মানবতাবাদ-মানবকল্যাণ এর কেবল খ্রিস্টান ও পশ্চিমা আধুনিকতা কেন্দ্রিক গল্পের উপর একমুখী ফোকাসের কারণে আসাদ তা ধরতে পারেননি।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো উইলিয়াম শভেইকার ও অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের মানবতাবাদী বক্তব্য। শভেইকারের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মতাত্ত্বিক, আর সাঈদের ধর্মনিরপেক্ষ। শভেইকারের ভাবনা প্রধানত নৈতিক, আর সাঈদেরটি মূলত সমালোচনামূলক ও রাজনৈতিক। তবে উভয়ই মানবতাবাদ বিরোধী (যেমনটা আসাদ করেছেন) ক্রিটিকগুলোকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে পাঠ ও মোকাবেলা করেছেন। সম্ভবত একারণে তারা একমাত্রিক সর্বজনবাদের (ইউনিভার্সালিজম) ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন এবং মানবতাবাদী চিন্তাকল্পে বহুত্ববাদী মূল্যবোধকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। (আলাদা আলাদা কাজে) সাঈদ ও শভেইকার একদিকে যেমন মানব সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও ভঙ্গুরতাকে স্বীকার করার মাধ্যমে তাদের আলাপ এগিয়ে নিয়েছেন; অন্যদিকে, মানবকল্যাণবাদী প্রচেষ্টায় রিফ্লেক্সিভিটি ও আত্ম-সমালোচনার তাৎপর্যকে কার্যকরী রূপে চিহ্নিত করেছেন। মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে এভাবে আত্মসচেতন করার মাধ্যমে তারা প্রথাগত মানবতাবাদে অন্তর্নিহিত আশাবাদের বিপদ এবং ক্ষমতা প্রয়োগের অবাধ অধিকার দাবীর মোকাবেলা করেছেন (বিশেষ করে শভেইকারের মানবতাবাদ কেবল মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীদের প্রতিও সম্প্রসারিত হয়েছে)। এর মাধ্যমে সাঈদ ও শভেইকার সমসাময়িক রাজনীতি কিংবা নৈতিকতার জন্য মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তাৎপর্যকে কেবল প্রতিষ্ঠা করেনি; তারা আমাদেরকে এটা দেখাতেও সাহায্য করেছেন যে, সকল মানব-কল্যাণবাদী দর্শন ও ক্রিয়া একইসাথে আশাবাদী ও ট্রাজিক। দিদিয়ের ফাসিনের মতে, এই দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে লুকানো দ্ব্যর্থতা মানব-কল্যাণবাদী যুক্তিসমূহকে (humanitarian reason) এমন রূপ দেয়, যা একইসাথে সংহতি ও অসাম্য উভয়কেই প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়।
মানব ও মানবতাবাদ সম্পর্কে আসাদীয় চিন্তার সমালোচনায় আমির মুফতি বলেন যে, আসাদীয় ক্রিটিকও চরিত্রগত দিক থেকে ‘হস্তক্ষেপমূলক’ এবং এমন সব ধারণার উপর দাঁড়য়ে আছে, যাদেরকে আসাদ নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। মুফতি মনে করেন, আসাদ আলাদা আলাদা মানদণ্ডে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে মূল্যায়ন করছেন; আসাদ আধুনিকতা থেকে আত্ম-সমালোচনা প্রত্যাশ্যা করলেও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে তিনি তা করছেন না। আসাদের চিন্তা সম্পর্কে এটাই মুফতির সবথেকে বড় আপত্তির জায়গা। মুফতির এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা তা আসাদের জিনিওলজিকাল মেথোডে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তার পেছনকার মূল্যবোধ সংক্রান্ত (normative) কারণগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। তবে আমার পাঠ অনুযায়ী, আসাদ আধুনিকতার আত্মসমালোচনা দাবি করেন না — কারণ তিনি মনে-ই করেন না যে সেটা সম্ভব। তার প্রায় সকল লেখাতেই এমন একটা যুক্তি রয়েছে যে, ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমালোচনামুখী বক্তব্য কিংবা আধুনিকতার ভেতর থেকে আসা আত্ম-সমালোচনার সুর (সাম্প্রতিক মানবতাবাদী প্রকল্পকে এভাবে পাঠ করা যেতে পারে) শেষ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ও গ্রাস হয়ে যায় সেকুলার খ্রিস্টান, পাশ্চাত্য এবং আধুনিক প্রকল্পের আধিপত্যবাদী ক্ষমতার কাঠামোর ভেতরে। এই ভাবনাই তার সাম্প্রতিক সময়ে মানব-কল্যাণবাদ নিয়ে করা তার সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু এবং একইসাথে, এটাই তার সীমাবদ্ধতা। তিনি অত্যন্ত সফলভাবে আধুনিক জীবনকে গঠনকারী বহুমুখী ক্ষমতার সরূপ বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু অন্যান্য প্রতি-মানবতাবাদীদের মতো (যেমনটা শভেইকারও চিহ্নিত করেছেন) আসাদও আধুনিকতার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ বা সঠিক পথে পরিচালিত করার কোনো দিকনির্দেশনা বা উপায় বাতলে দিতে পারেন না।
ফলত, আমাদের সামনে দুটি সম্ভাবনা রয়েছে। একদিকে আছে আধুনিকতা বিষয়ক সমালোচনার ফলে সৃষ্ট অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়তাকে গ্রহণ করে নেয়া এবং মানবতাবাদ ও মানব-কল্যাণবাদ সহ সকল আধুনিক (মর্ডানিস্ট) প্রতিষ্ঠানের প্রতি চিরস্থায়ী সন্দেহ পোষণ করা। অন্যদিকে, আমরা বহুমুখী বিবিধ মানবতাবাদকে গ্রহণ করতে পারি; যে মানব-কল্যাণবাদ রিফ্লেক্সিভ, মার্জিত ও আত্মসমালোচনা মুখী এবং মানব-কল্যাণবাদী কর্মের সীমাবদ্ধতা গুলো সম্পর্কে সচেতন।
টীকা-
১. হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদ একটি দার্শনিক ও নৈতিক অবস্থান, যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সম্ভাবনা, মানবিক মর্যাদা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের উপর জোরারোপ করে। সামন্তবাদী খ্রিস্টান ধর্মীয় মূল্যবোধকে মোকাবেলা করে রেনেসাঁ ও আলোকায়ন কালীন এই দর্শন বিকশিত হয়। মানবতাবাদ যুক্তি, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে ধরে নেয়। ধর্মীয় ও অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যার পরিবর্তে মানবতাবাদ পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণকে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক পদ্ধতি হিসেবে সমর্থন করে। একইসাথে এটি সুখী ও অর্থপূর্ণ জীবন গঠনকে সকল মানবীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রচেষ্টার কেন্দ্রে স্থাপন করে।
পল কার্টজ (২০০০) সেক্যুলার হিউম্যানিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: “যুক্তিবাদ, নৈতিক প্রকৃতিবাদ (এথিকাল ন্যাচারালিজম) ও গণতান্ত্রিক মানবাধিকারকে গ্রহণ এবং কর্তৃত্ববাদ ও ধর্মীয় নৈতিকতাকে প্রত্যাখ্যান।”
২. মানব-কল্যাণবাদ (হিউম্যানিটারিয়ানিজম) বলতে একটি ভাবাদর্শ ও কতিপয় কার্যকলাপের অনুশীলনকে বোঝায়৷ এইসব কার্যকলাপের (দৃশ্যত) উদ্দেশ্য মানব জীবনের উন্নতি ও দুঃখ-কষ্টের লাঘব। মাইকেল বারনেট (২০১১) হিউম্যানিটারিয়ানিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: “একটি আদর্শ ও ক্রিয়া, যার কেন্দ্রে রয়েছে মানব জীবন রক্ষা ও তার কষ্ট লাঘব করা। মানব-কল্যাণবাদের অনুশীলন ব্যক্তির পরিচয় বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিরপেক্ষ।”
তবে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব মানবকল্যাণবাদ এর সরল বোঝাপড়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। অনেকেই মানবকল্যাণবাদী প্রকল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন পূর্বানুমানকে প্রশ্ন করেছেন। আবার, কেউ কেউ মানবকল্যাণবাদী বয়ান যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী বৈদেশিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা প্রদান করে, তার উপর আলোকপাত করেছেন।
