রুটির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত
[সম্প্রদায় ভিত্তিক গবেষণা প্রকল্প দ্য রুটি কালেক্টিভে উঠে এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশের সাধারণ খাদ্য রুটি যেভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ইতিহাস। মরিয়ম দুররানি এবং নীলশ্রী বিশ্বাসের এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপিয়েন্সে। মূল লেখাটি পড়ুন এখানে। এনথ্রোসার্কেলের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন নাহিদ হাসান সাব্বির।]
দ্যা পারফেক্ট বাইট
রুটি (Roti), একটি খামিরবিহীন খাদ্য, যার উদ্ভব হয়েছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর হাত ধরে। চাপাতি, পরোটাসহ এটি বহু নামে পরিচিত। রুটি আর রুটির রন্ধনপ্রণালীর বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছে এবং স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত (Global South) অনেক দেশের খাদ্য সংস্কৃতির একটি প্রধান খাবার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আজকের দিনে যদি আমরা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের রুটির বিভিন্ন ধরনের দিকে তাকাই, তাহলেই এই জনগোষ্ঠীদের মধ্যে খাদ্য ও সংস্কৃতির যোগসূত্রটি বুঝা যায়।
একটি সাধারণ রুটি তৈরিতে মাত্র দুটি উপকরণই যথেষ্টঃ আটা এবং পানি। অনেক সময় সামান্য লবণ আর ঘি যোগ করে এর স্বাদ ও আকারে ভিন্নতা প্রদান করা যায়। রুটির পূর্ণ স্থিতিস্থাপকতা ও নমনীয়তা ( যা একে সহজে ভাঁজযোগ্য ও প্রসারযোগ্য বৈশিষ্ট্য প্রদান করে ) এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম প্রধান কারণ। রুটিতে যেমন একদিকে যেকোনো ডাল বা তরকারি সহযে এঁটে যায়, তেমনি যথেষ্ট কোমল হওয়ার কারণে সহজেই মুখে দেওয়া যায়। যার ফলে এটি একটি পরিপূর্ণ রসনানন্দের অভিজ্ঞতারও সৃষ্টি করে।
এখানে আমাদের ভূমিকাটা বলে রাখা দরকার। একদিকে যেমন গবেষনাসূত্রে রুটি নিয়েই আমাদের কাজ, আবার খাদ্যভ্যাসের কারনে রুটির সাথে আমরা শৈশব থেকেই পরিচিত, । কাজেই বলা যায়, শৈশব থেকেই আমরা রুটি নিয়ে অনুসন্ধানের যাত্রা শুরু করেছিলাম।। আমি (মরিয়ম) একটি পাকিস্তানি প্রবাসী পরিবারে বেড়ে উঠেছি যেখানে রুটি বানানোকে একটি সুসংগঠিত পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে পালিত হতে দেখেছি। তবে এই রুটি বানানোটা ছিল মূলত পরিবারের নারীদের জন্য নির্ধারিত। বিশেষত একে দেখা হয় নারীদের (মেয়ে, মা ও খালাদের) জন্য সংরক্ষিত একটি গৃহস্থালি পরিসর হিসেবে । পাকিস্তানে পারিবারিক ভ্রমণের সময় আমি লক্ষ্য করি যে আশেপাশের তন্দুর আর রেস্তোরাঁগুলোতে পুরুশরাই রুটি তৈরি করে। যদিও এখানে বাড়িতে পরিবারের নারীরাই রুটি তৈরি করে থাকে। যদিও নারী-পুরুষ উভয়কেই পারিশ্রমিকের ভিত্তিতেও রান্নার কাজে নিযুক্ত করা হয়। যেহেতু রুটি এখানকার দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচারে রুটির ব্যবহার দেখেই আমার কৌতূহলের সূচনা হয়েছি
অপরদিকে নিলশ্রী বিশ্বাসের বাড়িতে রুটি বানানোত্র চল ছিল না) কোলকাতায় তাদের বাড়িতে ভাতই ছিলো সবচেয়ে পছন্দের শর্করা জাতীয় খাদ্য। যদিও পরবর্তীতে একজন ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার (তথ্য চিত্রনির্মাতা) হিসেবে কাজের সুবাদে নীলশ্রী সমগ্র ভারতব্যাপী নানান অঞ্চলের কিশোরী, নারী, দিনমজুর, ক্ষুদ্র কৃষাণী ও গৃহিণীদের সাক্ষাৎ পান যারা প্রতিদিনই তাদের প্রধান খাদ্য হিসেবে রুটি প্রস্তুত করতেন। এই প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায় তাদের জন্য রুটি বানানোটা সবসময়ই শুধুমাত্র গৃহস্থালির কাজ বা নিজের পছন্দ ছিলো না। বরং তা ছিলো অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা কিংবা অত্যধিক লিঙ্গভিত্তিক ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থার মধ্যে অবৈতনিক গৃহস্থালী শ্রমের অংশ। বাঙালি রন্ধনপ্রণালী ও খাদ্যাভ্যাসজনিত ইতিহাস (gastronomic history) বিষয়ক নিলশ্রীর বই “Calcutta On your plate“এ সে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালি খাদ্যাভাসে রুটির অনুপস্থিতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
নিলশ্রীর ডকুমেন্টারিতে রুটি বানানোর কাজ একটি জোড়-জবরদস্তিমুলক শ্রম হিসেবে দেখা যায়। অন্যদিকে রুটির কথা ভাবলে আমার মনে হয় বাড়িতে মায়ের হাতে বানানো রুটির প্রতি স্মৃতিকাতরতা অনুভব হয়। রুটি নিয়ে এই দুই ভিন্ন বয়ান মিলে এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। তখন রুটি বানানো কেবলমাত্র একটি কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি হয়ে উঠে একটি প্রথা। যা উপনিবেশিকতা, নারী-পুরুষের ভেদাভেদ আর অভিবাসনের মত জটিল ও গভীর বিষয়গুলো দ্বারা প্রভাবিত।
“রুটি”কে ব্যক্তিগত আবেগ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে আরো ভালোভাবে বুঝতে আমি ২০২১ সালে “দ্যা রুটি কালেকটিভ” নামে একটি গবেষণাধর্মী উদ্যোগ শুরু করি। এই গবেষণার মূল লক্ষ্যই ছিলো রুটি ও রুটি তৈরির সব প্রক্রিয়াকে গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করা আর সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর নানা প্রান্তে রুটি যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তার পিছনের ইতিহাসকেও জানার চেষ্টা করা।
‘দ্য রুটি কালেক্টিভ’ হলো একটি সম্মিলিত উদ্যোগ। যেখানে শিক্ষার্থী, শিল্পী, লেখক, এবং আমার সহকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নিলোশ্রীসহ ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির আমার(মরিয়মের) ছাত্রছাত্রীরা যুক্ত আছে। এই উদ্যোগের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হল সমাজের বিভিন্ন মানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করা। নারীবাদী গবেষণা আর বিভিন্ন লেখালেখি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘দ্য রুটি কালেক্টিভ’ একটি দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে। যাতে আমরা একই সাথে রুটির বিভিন্ন ধরন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যেমন সম্মান জানাই, তেমনি সমাজের দৈনন্দিন বৈষম্যে রুটি যে জটিল ভূমিকা পালন করে, সেটাও বোঝার চেষ্টা করেছি । এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আমরা রুটির সাংস্কৃতিক তাৎপর্যকে উদযাপন এবং একই সঙ্গে এর গভীর বিশ্লেষণ করার ওপর জোর দিই।
রুটির অতীত
রুটির প্রাচীনতম সংস্করণ খুব সম্ভবত ৩,৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১,৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার মানুষের প্রাচীন শস্য চাষের সঙ্গেই উদ্ভব হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদ অনুসারে, শস্যকে পানি দিয়ে মিশিয়ে আটার খামি তৈরি করে তা চ্যাপ্টা আকারে গোল করে বেলে নিয়ে আগুনে সেঁকে নিলে শস্যের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পায়। এ প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বের পাঁচটি মৌলিক উপাদানঃ আকাশ, বায়ু, আগুন, পানি আর মাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। যা রুটিকে একটি সুষম খাদ্যে পরিণত করে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় নানা সমাজে রুটির মতো ফ্ল্যাটব্রেডের (চ্যাপ্টা গোল রুটি) সন্ধান পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর রান্নার বইগুলোতেও এমনটাই উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের মালওয়া সালতানাতের জন্যে অসাধারণভাবে অলংকৃত একটি রান্নার বই ‘নিমতনামা’তে (Ni‘matnama, or “Book of Delights”) গমের তৈরি খাবারের সবচেয়ে পুরনো ছবি পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালীন প্রশাসনিক দলিল ‘আইন ই আকবরী’তে রুটির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে বইটির লেখক আবুল ফজল ব্যাখ্যা করেন যে, ময়দা, দুধ, ঘি আর লবণ দিয়ে তৈরি এই খাবারটি গরম গরম পরিবেশন করলে খুবই সুস্বাদু লাগে। আমাদের দীর্ঘ গবেষণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে এই কথাটি এখনও সত্য।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকেই ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য পথ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন খাদ্য-সংস্কৃতিগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে ১৮৩০ এর দশক থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা প্রায় ২০ লক্ষ চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে ঔপনিবেশিক ভারত থেকে এশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ তাদের অন্যান্য উপনিবেশগুলোতে স্থানান্তর করে। যাদের অনেকেরই আর কখনো দেশে ফেরার সুযোগ হয়নি।
এই চুক্তিবদ্ধ উপমহাদেশীয় শ্রমিকদের চাষাবাদ ও শিল্পকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হতো। দাসত্বে আবদ্ধ আফ্রিকানদের যেভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নির্মমভাবে শোষণ করেছিলো, ঠিক সেভাবেই এই শ্রমিকদেরও অকল্পনীয় কষ্ট ও অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হতে হয়। তবে এতোকিছুর পরেও তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখার পথ খুঁজে নিয়েছিলো। তারা নিজেদের মধ্যে নতুন করে সমাজ গড়ে তুলেছিল, নতুন করে ঘর সাজিয়েছিল। এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের রান্না করা, খাওয়া-দাওয়া এবং একে অপরের যত্ন নেওয়ার ধরনেও নতুনত্ব এসেছিল।
রুটির বর্তমান
আজকের দিনে রুটি দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অভিযোজনের চিহ্ন বহন করছে। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপকরণ, ঋতুভিত্তিক খাবার, বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্য আর মানুষের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী রুটির অসংখ্য রূপ, স্বাদ ও বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের একটি আঞ্চলিক খাবার কালাই রুটি তৈরি হয় মাসকালাই ডাল আর অন্যান্য কিছু আটা দিয়ে। এটি সাধারণত মরিচ, টমেটো, বেগুন ভর্তা কিংবা গরুর মাংসের ভুনার সাথে খাওয়া হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলে রুটির এক ভিন্ন রূপ দেখা যায়, সেখানকার বাটার রুটিতে গলানো মাখন আর কেক ফ্লাওয়ার ব্যবহারের কারণে রুটির গঠন হয় অনেকটা নরম এবং স্পঞ্জি। দক্ষিণ এশিয়া, কেনিয়া এবং উগান্ডায় রুটি পরিচিত ‘চাপাতি ’ নামে। উর্দু-হিন্দি শব্দ ‘চাপাত’ (অর্থঃ আঘাত, চাপড়) থেকে এই নামের উৎপত্তি। যা রুটি তৈরীর সময় আটার খামি কে হাতে চাপড়িয়ে পাতলা ও গোলাকার বানানোর কৌশলকে বোঝায়। পরে এটিকে তাওয়ায় গরম করে সেঁকা হয় ।
গায়ানার ‘ক্ল্যাপ রুটি’ বানানো হয় ভিন্নভাবে। এই রুটি বানানোর সময় অনেকটা হাততালি দেওয়ার মতোই শব্দ হয়ে থাকে। ‘ক্ল্যাপ রুটি’ হালকা এবং নরম হয়, যা গরম গরম খাসির মাংসের ঝোলের সঙ্গে খাওয়ার জন্য দারুণ উপযুক্ত।
ভারতের গুজরাটে ‘রোটলি’ নামে খুবই পাতলা এক ধরনের রুটি বানানো হয়। মালয়েশিয়া রুটি শব্দটির অর্থ অনেক বিস্তৃত। এই শব্দটি দিয়ে নানা ধরনের খামিরযুক্ত ও খামিরবিহীন রুটি জাতীয় খাবারকে বোঝায়। সেখানে মচমচে, গোলাকার ও হালকা এক ধরনের বিখ্যাত রুটি পাওয়া যায় যাকে চানাই রুটি বলে। আজকের বিশ্বে খাবার হিসেবে রুটির যাত্রা বিরামহীনবিভিন্ন জায়গায় মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাস ও পছন্দের ওপর ভিত্তি করে রুটির ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ তৈরি করেছে, যার মধ্যে আছে ভেগান রুটিও।
ঔপনিবেশিক বর্ণবাদের বেদনাদায়ক ইতিহাস ও এর চলমান প্রভাবের মধ্যেও মানুষ রুটিকে তাদের স্থানীয় খাদ্যাভ্যাস ও জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ করে নিয়েছিলো। উদাহরণস্বরূপ, ত্রিনিদাদে স্বাধীনতার পর থেকেও বহু বছর সেখানকার মানুষ রুটি দিয়ে বিভিন্ন জনপ্রিয় খাবার তৈরি করেছে। উত্তর আমেরিকায় সেগুলো এখন ‘ক্যারিবীয়’ বা ‘ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান’ রুটি নামে বিখ্যাত। রিচার্ড ফ্যাঙ তার বিখ্যাত ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘ডাল পুরী ডায়াসপোরা’তে দেখিয়েছেন কিভাবে রুটি ভারত থেকে ত্রিনিদাদ হয়ে টরন্টো পর্যন্ত গিয়ে নতুন নতুন রূপ পেয়েছে। তিনি রুটির এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথকে ঘরের চুলার আগুন থেকে ফুটপাতের দোকান, সেখান থেকে রেস্তোরাঁ-হোটেল পর্যন্ত চলে আসার চিত্রও চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
ত্রিনিদাদে আরেক ধরনের রুটি রয়েছে যা সংস্কৃতিক সংমিশ্রণের এক জীবন্ত উদাহরণ। এই বিশেষ ধরনের রুটিকে মজার ছলে ‘বাস আপ শাট’ (“buss up shut”) বলে ডাকা হয়। রুটিটি দেখতে অনেকটা ছেঁড়া বা টুকরো টুকরো জামার মতো হওয়ায় এমন মজার নাম দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোরুটিপ্রেমীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সেখানে অনেকেই ‘বাস আপ শাট’ তৈরির পদ্ধতি নিয়ে নানান ভিডিও শেয়ার করে নিজেদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস তুলে ধরছেন। এই রুটি বানানোর সময় ‘ডাবলা’ নামের লম্বা, সরু কাঠের বা ধাতব খুন্তি ব্যবহার করে তাওয়াতেই রুটিকে সেঁকার সময় ভাঁজ করে ফেলা হয়। এসব ভিডিও খেয়াল করলে মনে হবে রুটি শুধু রান্না নয়, একসাথে ইতিহাস, স্মৃতি আর আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার উপায়।
ত্রিনিদাদের মতই উগান্ডায় রুটির প্রচলন ঘটে তাদের স্বাধীনতার পূর্বে, যখন দেশটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ১৮৯০ এর দশকের শেষের দিকে ব্রিটিশরা ৬০০ মাইল দৈর্ঘ্য বিশাল এক রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু করে। সাম্রাজ্যবাদী এই নির্মাণ কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল নীলনদের উপর ব্রিটিশদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা আর উগান্ডাকে কেনিয়ার সাথে যুক্ত করা। এই বিপজ্জনক ও দুরুহ নির্মাণকাজটি স্থানীয় আফ্রিকান ও ভারত থেকে আনা চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদেরকে দিয়ে করানো হয়। যাদেরকে অত্যন্ত কঠোর ও জোরপূর্বক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করানো হয়।
পূর্ব আফ্রিকায় নতুন করে গড়ে ওঠা বহুজাতিক ও বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে কিছু ভারতীয় শ্রমিক সেসময় চাপাতি বিক্রি করা শুরু করেন। মূলত তাদের হাত ধরেই চাপাতি বা রুটি পূর্ব আফ্রিকার খাদ্য-সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেয়। আজ উগান্ডার রাস্তাঘাটে স্ট্রিটফুড হিসেবে চাপাতিকে যে এতো জনপ্রিয় খাবার হিসেবে দেখা যায়, তার পেছনে রয়েছে সেই প্রথম দিককার প্রবাসী চাপাতি বিক্রেতাদের অবদান।
উগান্ডার স্ট্রিটফুডগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি উদ্ভাবন হলো ‘রোলেক্স’। মজার এই নামটা হলো ‘রোলড এগস’(rolled eggs) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। গরম গরম চাপাতির ভেতর সবজি দিয়ে ভাজা ভিমের অমলেট প্যাঁচিয়ে ‘রোলেক্স’ পরিবেশন করা হয়। ধারণা করা হয় ১৯৯০এর দশকে এক চাপাতি বিক্রেতা সর্বপ্রথম এই খাবারটি উদ্ভাবন করেছিলেন। শুরুতে কাম্পালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে রোলেক্স বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপর এটি সমগ্র উগান্ডা হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

নারীদের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘রোলেক্স ইনিশিয়েটিভ’ ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর উগান্ডায় একটি উৎসবের আয়োজন করে থাকে। সেখানে আনন্দের সাথে রোলেক্স খাওয়া হয় ও যারা এই খাবারকে জনপ্রিয় করেছে, তাদের সম্মান জানানো হয়। উগান্ডার একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ ‘দ্যা রোলেক্স গাই’ (The Rolex Guy) এর মালিক জনাথান অকেলোর ভাষ্যমতে, ‘এখানে কেউ রোলেক্স হাতে দেয় না, সবাই পেটে দেয়।’
রুটির ভবিষ্যৎ
এখন প্রতিনিয়তই ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এক্স, টিকটকে রুটি নিয়ে নানান মিম(কৌতুক) আর রুটি তৈরীর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে। এই সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে রুটি এখন আরো প্রাসঙ্গিক।
দ্যা রুটি কালেকটিভ এর একটি বড় কাজ হলো রুটি সম্পর্কিত এইসব মিম, ইলাস্ট্রেশন(ছবি), আর রুটিকে নিয়ে হওয়া নানান আলাপকে আর্কাইভ করে রাখা। এসব কনটেন্ট মূলত বানাচ্ছে জেনারেশন মিলেনিয়াল আর জেনজি প্রজন্মে। যারা রুটিকে শুধু খাবার হিসেবে না, বরং নিজেদের অভিজ্ঞতা আর চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরার একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। রুটির মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিচয়, লিঙ্গ, প্রবাসজীবন বা বড় হয়ে ওঠার গল্প বলার চেষ্টা করে।
কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েটর রুটির সাথে জড়িত লিঙ্গভিত্তিক ধারণাগুলোকে মজার ছলে সমালোচনা করেন, আবার একই সাথে তাদের কনটেন্টের মধ্য দিয়ে রুটি বানানোর জন্য যে বিশেষ দক্ষতা লাগে তারও প্রশংসা করেন। রুটি নিয়ে নারীদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক (কল ইট পুরুষতান্ত্রিক) ধারার যে মন্তব্যগুলো থাকে যেমন, ‘একেবারে গোল, নরম রুটি বানানো লাগবে’। এমন সব ধারণাকে এই কনটেন্টগুলোর মাধ্যমে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা হয়।
ইনস্টাগ্রাম রুটি নিয়ে একটি জনপ্রিয় মিমে রসিকতা করে বলা হয়, ‘রুটি গোল না তাও তো আকর্ষণীয়’। আবার, এক্সে একজন টুইট করে লিখেছেন, ‘আমি হাত দিয়ে রুটি উল্টাই, তাই আমার সাথে গলা নামিয়ে কথা বলো’।

এই ধরনের উক্তিগুলো যে আসলে নিছক মজা, এমনটা না। এর দ্বারা আসলে বোঝা যায়, রুটি বানানো কেবল একটি রান্নার কাজ নয়। এটি দক্ষতা, পরিশ্রম আর আত্মমর্যাদার কাজ, যা সম্মানের দাবিদার।
স্থান-কাল-পাত্র ভেদে রুটির উপকরণ, রেসিপি, পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে কিন্তু রুটি বানানোর জন্য যে নিখুঁত হাতের ছোঁয়া সেটা একই থাকে। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে বলা হয়, রুটি এমন একটি রেসিপি, যা ‘বারবার অনুশীলনের ফলে রপ্ত করতে হয়।’ আজ যেভাবে আমরা নানা স্বাদ আর বৈচিত্র্যময় নানা রূপে রুটি উপভোগ করি, তার পেছনে আছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের শ্রম, ভালোবাসা আর সৃজনশীলতা। যারা শুধু রুটি বানিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং সেটিকে বিশ্বের নানান রান্না আর সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন।
তাহলে রুটির ভবিষ্যৎ কী? রুটির ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা বলা কঠিন। ভবিষ্যৎ হয়তো অজানা, কিন্তু আমরা রুটি কালেক্টিভ বিশ্বাস করি রুটি নিছক একটি খাবার নয়, এটি ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক। তাই আমরা রুটির সৌন্দর্য আর সমাজে রুটিকে ঘিরে নানা জটিল ব্যাপারগুলো নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাব। আমরা আপনাকে “রুটি-কেন্দ্রিক জ্ঞান” নিয়ে আমাদের গবেষণায় সঙ্গী হতে আমন্ত্রণ জানাই। নারীবাদী গবেষণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা রুটি আর রুটি তৈরির সব গল্প বলতে ও শুনতে চাই। যেগুলো একদিকে ঔপনিবেশিকতা, মজুরীবিহীন চুক্তিভিত্তিক শ্রম , অভিবাসন আর বাস্তুচ্যুতির মতো কষ্টের ইতিহাসের গভীর দিকগুলো তুলে ধরবে। আবার বেঁচে থাকার দক্ষতা আর সৃজনশীলতার বয়ানও সামনে নিয়ে আসবে রুটির মাধ্যমে।
