বই রিভিউঃ ধর্ষণের তত্ত্বতালাশ

নৃবিজ্ঞান বিষয়ে লেখা বইগুলো নিয়ে আয়োজন করতে বরাবরই আগ্রহী এনথ্রোসার্কেল। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হওয়া শাহারিয়ার জিম মাহফুজ সরকারের বই ‘ধর্ষণের তত্ত্বতালাশ‘ এর রিভিউ লিখেছেন তাসনিম রিফাত।

ধর্ষণের মত একটা জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মজবুত বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ করা অনেক সাধ্যের বিষয়। এর কারণ, ধর্ষণের ব্যাপারটিকে এতোদিক থেকে এতোভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে, সেসব ব্যাখ্যার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, ব্যাখ্যাগুলোকে পর্যালোচনা করা খুব কঠিন একটা কাজ হয়ে উঠে। মাহফুজ সরকার আর শাহারিয়ার জিম রচিত ‘ধর্ষণের তত্ত্বতালাশ’ বইটি এদিক দিয়ে ধর্ষণসম্পর্কিত আলোচনার সংকটগুলোকে অনেকাংশেই উৎরে যেতে পেরেছে। এর প্রধান কারণ, এই বইয়ে ধর্ষণ নিয়ে প্রচলিত প্রায় সব ধারার মতামতগুলিকে গুরত্বের সাথে আলোচনা করে তাদের পরখ করা হয়েছে, এর পাশাপাশি জ্ঞানকান্ডের বিভিন্ন শাস্ত্রের ধর্ষণসম্পর্কিত মতামতগুলোকে সমন্বয় করা হয়েছে। এদিক দিয়ে বলতে গেলে এটি ধর্ষণসম্পর্কিত একটি পূর্নাঙ্গ বই।

এর আগে মাহফুজ সরকার ও শাহারিয়ার জিম- এই লেখকদ্বয়ের নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয় গ্রন্থটি বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞানচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। কাজেই এইবারও অনুমিতই ছিল তাদের ‘ধর্ষণের তত্ত্বতালাশ’ বইতে নৃবিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্ব- এই দুই জ্ঞানশাস্ত্রের প্রভাব থাকবে। এই ব্যাপারটি বিশেষ গুরত্বপূর্ন , কারণ ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভিন্ন কারণকে আমলে না নিয়ে ধর্ষণ নিয়ে একরৈখিক আলোচনা আমাদের এই সংকটের খুব একটা গভীরে নিয়ে যায় না। তাদের নৃবৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি কার্যকরী সংযোজন হল, এই বইতে কেবলমাত্র তথাকথিত আধুনিক পুঁজিনির্ভর বা ইউরোপিয়ান সমাজের সাপেক্ষে ধর্ষণ প্রসঙ্গ না টেনে, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের সাপেক্ষে বুঝার চেষ্টা করা হয়েছে।

পুরো বইটি ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত- ‘ধর্ষণ কী’, ‘যৌনতার রুপরুপান্তর’, ‘নারী স্বাধীনতার পটভূমি’, ‘পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ সংক্রান্ত মিথ;, ‘ধর্ষণের ভিত্তিকাঠামো’ ও ‘ফয়সালা’।

প্রথম অধ্যায়ে ধর্ষণের বিভিন্নপ্রকার সংজ্ঞা আর ব্যাখ্যাগুলোকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের আলাপকে তিনটি আলাদা ভাগ করে দেখা যায়। একটি হচ্ছে বিভিন্ন দেশের আইনে ধর্ষণ বলতে কী বুঝানো হয়েছে। এইক্ষেত্রে কেবল সাম্প্রতিক আইনগুলো নয়, অতীতের বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় আইনগুলোকেও আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে এই অঞ্চলে ধর্ষণের আইনগুলোকেও আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে।
আরেকটা ভাগে, নারীবাদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারাগুলো ধর্ষণকে কিভাবে দেখে সেগুলোর তুলনা করা হয়েছে। এরসাথে সাথে বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানের ধারা, নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারা ধর্ষণকে কিভাবে দেখে তার আলাপও এসেছে। এই তাত্ত্বিকদের আলোচনায় ব্রাউন মিলার,মার্গারেট মিড, লেভি স্ট্রস, রোলা বার্থ, মিশেল ফুকোসহ বেশ কয়েকজনের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসা হয়েছে। এই অংশের একটি অতি গুরত্বপূর্ণ জায়গা হলো ধর্ষণ সাংস্কৃতিক না জৈবিক তা নিয়ে বিভিন্নমুখী মতামতগুলো মীমাংসার চেষ্টা করা। এই অংশটি পাঠকের জন্য বিশেষ আকর্ষণের জায়গা।
ধর্ষণের সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে তৃতীয় আরেকটি বিষয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক জায়গাটিকে জোর দেওয়া হয়েছে। উঠে এসেছে একটা বিস্তৃত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে ধর্ষণের কারণ সন্ধান।

মূলত এই অধ্যায় থেকেই ধারণা করা যায় এই বইটি যে একটি বিশাল পরিসরের সাপেক্ষে ধর্ষণের মত বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করেছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ধর্ষণকে বুঝার জন্য যৌনতা ও যৌনতাকে ঘিরে থাকা নৈতিকটা নিয়ে আলাপ করা হয়েছে। এই অধ্যায়েরও একটি ঐতিহাসিক ক্যানভাস বিদ্যমান। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে যৌনতা নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের ধারণা, নৈতিকতা ও বিভিন্ন প্রথাগুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন ব্যাবিলনের হাম্বুরাবি নীতিশাস্ত্রে অজাচার ও পশুকামিতা নিষিদ্ধ ছিল। এই অজাচার নিয়ে লেভি স্ট্রসের ধারনাগুলোও বিশ্লেষণও হাজির হয়েছে বইটিতে।

তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায় অর্থাৎ ‘নারী স্বাধীনতার পটভূমি’, ‘পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ সংক্রান্ত মিথ’-এ নারী অধিকারের আন্দোলনগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে কিভাবে দানা বাঁধছে এবং তার সাথে সাথে নারীবাদী তত্ত্বসমূহের বিকাশ ও তাদের চিন্তাভাবনার ধরনগুলো এসেছে। এরসাথে, ধর্ষণ ও নারি-পুরুষ বৈষম্যের কারণ খোঁজার ক্ষেত্রে নারীবাদী বিভিন্ন তত্ত্বসমূহের বিভিন্ন অপূর্নতা নিয়ে ক্রিটিকাল আলোচনা করা হয়েছে।

এই বইটি কেবল ধর্ষণ ও নারী-পুরুষ বৈষম্যসম্পর্কিত আলাপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, নিজেও একটি গুরত্বপূর্ন তাত্ত্বিক ভিত্তির দিকে এগিয়ে গিয়েছে। পঞ্চম অধ্যায় ‘ধর্ষণের ভিত্তিকাঠামোয় লেখকদ্বয়ের চিন্তার তাত্ত্বিক কাঠামোটি পুরোপুরি উঠে এসেছে। এই অধ্যায়ে মার্ক্সের Commodification সম্পর্কিত ধারণাগুলো ব্যবহার করে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্যের কারণগুলো তালাশ করা হয়েছে। ধর্ষণের কারণসমূহ খোঁজার ক্ষেত্রে বৃহৎ কাঠামোর সাপেক্ষে মানবীয় সম্পর্কগুলোকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আর সর্বশেষ অধ্যায়ে লেখকদ্বয় তাদের পূর্ববর্তী আলাপের সূত্র ধরে তাদের আলোচনার একটা শেষসূত্র টানার চেষ্টা করেছেন।

বইটি বাংলা ভাষার জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন প্রান্তগুলোকে দারুনভাবে স্পর্শ করেছে। এর প্রভাবও যথার্থভাবেই টিকে থাকবে। একদিকে যেমন ধর্ষণ ও নারী-পুরুষ বৈষম্য নিয়ে বিস্তারিত তত্ত্বতালাশ, আরেকদিকে নৃবৈজ্ঞানিক সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে তাকে কিভাবে বিবেচনা করা যায় আর মার্কসবাদের জায়গা থেক নারী অধিকার ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ঘটনাকে কিভাবে বিবেচনা করা হতে পারে তার দিকগুলো উন্মোচন করা হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক অনেক দিক আছে যা হয়তো এক লেখায় উল্লেখ করা সম্ভব না। পাঠক নিশ্চয়ই সেগুলো আবিষ্কার করে নিবেন।

বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিককালে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গবেষণাধর্মী বই হাতেগোনা কয়েকটি । ধর্ষণের মত একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন বিপুল পরিসর ও তাত্ত্বিকভাবে সমৃদ্ধ বই বিরল। এই বইটি সে শূন্যতা পূরণ করেছে। আশা করা যায় দিনকে দিন তার প্রভাব আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

রকমারি লিংক