পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ ধর্ষণের তত্ত্ব তালাশঃ পুরুষতন্ত্র বনাম নারীবাদ
এইবারের বইমেলায় বের হয়েছে মাহফুজ সরকার আর শাহারিয়ার জিমের লেখা ‘ধর্ষণের তত্ত্ব তালাশঃ পুরুষতন্ত্র বনাম নারীবাদ’ বইটি। এনথ্রো সার্কেল সবসময় নৃবিজ্ঞান ও কাছাকাছি বিষয়ের উপর লেখা বইগুলো নিয়ে আলোচনা মানুষের কাছে পৌছে দিতে আগ্রহী। এর আগেও এই বইয়ের একটি রিভিউ ছাপা হয়েছিল সাইটে। এইবার ছাপা হলো আরেকটি পাঠ প্রতিক্রিয়া। পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেন সাইফ ধ্রুব।
গবেষণাধর্মী বইটিতে ধর্ষণ নিয়ে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হয়েছে যা এর আগে আমাদের দেশে কখনোই হয় নি। প্রথমেই আমি বইটির সাধারণ একটি বর্ণনা দিব এবং পরবর্তীতে একজন আইনের ছাত্র হিসেবে এবং পাঠক হিসেবে আমার মূল্যায়ন তুলে ধরব।
ধর্ষণ বর্তমান বিশ্বের একটি সার্বজনীন সামাজিক ব্যাধি । উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ , সর্বত্রই এই ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত । অনুন্নত দেশের বিচারব্যবস্থার কথা যদি বাদও দেয়া হয় , উন্নত যে সকল দেশে মানবাধিকার এবং বিচার ব্যবস্থার সর্বাধুনিক প্রয়োগ রয়েছে সেখানেও ধর্ষণের উপস্থিতি বিদ্যমান । বরঞ্চ বৈশ্বিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্ষণের হার নিতান্তই কম নয় । প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ষণের ধারণাটি খুব সাধারণভাবে আইনগত দিক থেকে অপরাধ এবং ধর্মীয় দিক থেকে পাপের সাথে সম্পর্কিত করে রাখার প্রবণতা এই জটিল মানবসৃষ্ট ব্যাধিকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে । যখনই আমাদের সামনে এরূপ কোন ভয়াবহ ঘটনা উপস্থিত হয় তখনি আরেকটি জনপ্রিয় মতবাদ নারীবাদিরা প্রায়শই উপস্থিত করেন , আর তা হলো পুরুষতন্ত্রকে নির্জলা গালাগালি করার মাধ্যমে পুরুষ জাতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণের মাধ্যমে আরেকটি বর্ণবাদী ধারণার উপস্থাপন , যা সময়ের সাথে সাথে ঘটনার মতই মলিন হয়ে হারিয়ে যায় । ধর্ষণের তত্ত্ব তালাশঃ পুরুষতন্ত্র বনাম নারীবাদ ’ গ্রন্থে মাহফুজ সরকার এবং শাহারিয়ার জিম লেখকদ্বয় প্রচলিত জনপ্রিয় মতবাদ থেকে বের হয়ে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং একইসাথে প্রচলিত ধারণাগুলোর দুর্বলতা সামনে এনে ধর্ষণের অন্তর্নিহিত কারণসমূহ বের করার প্রয়াস পেয়েছেন । ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটির অধ্যায়গুলোর বিন্যাস করা হয়েছে ক্রমান্বয়ে ধর্ষণ কী ’ , ‘ যৌনতার রূপরূপান্তর ’ , ‘ নারী স্বাধীনতার পটভূমি ’ , ‘ পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ সংক্রান্ত মিথ ’ , ধর্ষণের ভিত্তিকাঠামো ’ ও ‘ ফয়সালা ’ |
প্রথম অধ্যায়ে মূলত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির এবং প্রচলিত আইনের আলোকে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন এবং ধারণা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে । বিস্তারিত আলোচনায় একটি বিষয় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে ধর্ষণের ধারণার সাথে প্রচলিত আইনের সংজ্ঞার ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান । বিশেষ করে , ব্যক্তি , সমাজ ও কালভেদে ধর্ষণের ধারণার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় । একই সাথে বিভিন্ন দেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞারও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । যেমন , আইনের ক্ষেত্রে জোরপূর্বক যৌন মিলন এবং সম্মতি – অসম্মতি দ্বৈত শর্তের উপর ভিত্তি করে ধর্ষণকে দেখা হলেও নারীবাদীরা একে বাহুল্য বলে মনে করেন এবং তাদের মতে অনেক ক্ষেত্রে যে কোন একটির উপস্থিতিই ধর্ষণের জন্য দায়ী হতে পারে । এক্ষেত্রে , দ্বৈত শর্তকে আলাদা হিসেবে বিচার করে অপরাধের আলাদা আলাদা মাত্রা নির্ধারণের প্রস্তাব সংবলিত জোয়ান ম্যাকগ্রেগরের অভিমত গ্রহণযোগ্য । নারীবাদীদের সম্মতি – অসম্মতি সংক্রান্ত ধারণাতেও অসংগতি ফুটে উঠেছে এবং জোরপূর্বক বা প্রতারণাপূর্বক সম্মতি যে আদতে কোন সম্মতিই নয় তা লেখকদ্বয় স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন । ধর্ষণ সম্পর্কিত কারণ চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে লেখকদ্বয় বেশ কিছু কারণ সামনে নিয়ে এসেছেন , যেমন- বিবর্তনকেন্দ্রিক , সংস্কৃতিকেন্দ্রিক , পুরুষের আগ্রাসী শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম , পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকৃত যৌনাচার প্রভৃতি ।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে যৌন নৈতিকতা নিয়ে প্রায়োগিক আলোচনা করা হয়েছে । প্রাচীন বিভিন্ন সমাজ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ , আধুনিক যুগ , উত্তরাধুনিক যৌন নৈতিকতার স্বরূপ এবং বিবর্তন এই অধ্যায়ের মূল বিষয়বস্তু । সমাজের বিবর্তনের ফলে যৌনতার সাথে নির্জলা আনন্দের বদলে সতীত্বের ধারণা , পাপবোধ ইত্যাদির আবরণের ফলে মানুষের যৌনতাকে কিভাবে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে , প্রেম ও কামের মধ্যে সীমানা টানার প্রক্রিয়া , অজাচার সম্পর্কিত ধারণা কীভাবে মানুষের সমাজে স্থান করে নিয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই অধ্যায়ে । প্রাচীন মাতৃ – পরিচয়ভিত্তিক সমাজ থেকে পিতৃ – পরিচয়ভিত্তিক সমাজে উত্তরণের মাধ্যমে নারীর প্রান্তিকীকরণের প্রক্রিয়া সামগ্রিকভাবে নারীকে সমাজ ও পরিবারে দুর্বল অবস্থানে স্থাপনের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হবার প্রবনতাকে বাড়িয়ে দেবার যে ঐতিহাসিক সম্ভাবনা তৈরি করেছে তা উঠে এসেছে এখানে ।
তৃতীয় অধ্যায়ে নারী স্বাধীনতার পটভূমি’তে মূলত সুসংগঠিত নারী আন্দোলনগুলোকে কেন্দ্র করে কীভাবে নারী স্বাধীনতার ধারণার বিবর্তন হয়েছে তা উঠে এসেছে । উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর নারী আন্দোলনের একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে নারীদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন । তবে , সকল ক্ষেত্রে এসব আন্দোলন যে নারীজাতির জন্য উপকারী বা সম্পূর্ণ বর্ণবৈষম্যবিহীন তার স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই । উপরন্তু লেখকদ্বয় দেখিয়েছেন যে , বর্ণবাদী প্রশ্নে নারীবাদীরা বর্ণবাদীদের পক্ষে নিতে বিলম্ব করেনি । ( ৮৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য )
চতুর্থ অধ্যায়ে ‘ পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ সংক্রান্ত মিথ ’ -এর আলোচনায় লেখকদ্বয় পুরুষতন্ত্রের পরিচয় এবং তার বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে নারীর প্রান্তিকীকরণ এবং শোষণের ধারা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। একইসাথে এই বিষয়ে নারীবাদীরা কিভাবে পর্যবেক্ষণ করেন সে বিষয়েও বিশদ বর্ণনা এসেছে । নারীবাদীদের বৈশিষ্ট্যবাদী ধারণা এবং সামাজিকতাবাদী ধারণার মধ্যে দ্বন্দ্বের পার্থক্য তুলে ধরে লেখকদ্বয় সবশেষে উত্তরাধুনিক নারীবাদ এবং মার্কসবাদের আলোচনা নিয়ে এসেছেন , যা নারী মুক্তির ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার উদ্রেক করে ।
পঞ্চম অধ্যায়ে লেখকদ্বয় দেখিয়েছেন মানবজাতির ইতিহাস মূলত বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণীর লক্ষ্য এবং স্বার্থের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ইতিহাস । পুরুষ ও নারীর চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব যে একই চলকের উপর নির্ভর করে না এবং এর ফলে নারীর প্রতি শোষণের ক্ষেত্র ঐতিহাসিকভাবেই তৈরি হয় তা উঠে এসেছে এই অধ্যায়ে । লেখকদ্বয় মূলত এই অধ্যায়ে ধর্ষণ সংগঠনের সম্ভাব্য কারণসমূহ নির্দিষ্টকরণের চেষ্টা করেছেন । আধুনিক সমাজে ধর্ষণের অন্যতম কারণসমূহের মধ্যে উঠে এসেছে অবজেকটিফিকেশনের মাধ্যমে নারীকে পণ্যায়ন , মিডিয়ার প্রভাব , বিবাহব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরণ , যৌনতার পণ্যায়ন ইত্যাদি ।
ষষ্ঠ এবং সর্বশেষ অধ্যায়ে সম্ভাব্য পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে ।লেখকদ্বয় দেখিয়েছেন যে , পুরুষতন্ত্র একটি কাঠামো , যেখানে লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে যে কোন ব্যক্তি পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারা ধারণের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে ; এবং অনেক পুরুষও পুরুষতন্ত্রের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে । অন্যদিকে কঠোর আইনের শাসন যে সকল দেশে রয়েছে সে সকল দেশেও ধর্ষণের উচ্চ হারের কারণ মূলত নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের ফল । এখানে দাবী করা হয়েছে কাঠামোভিত্তিক পরিবর্তন না আনলে এই সমস্যার উত্তরণ সম্ভব নয় ।
বাংলা ভাষায় ধর্ষণ সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক গবেষণামূলক বই নেই বললেই চলে । এ বিষয়ে ভবিষ্যতে গবেষণার ক্ষেত্রে বইটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং একইসাথে পাঠক মনে নতুন নতুন চিন্তার উদ্রেক করবে । যেমন , লেখকদ্বয় আলোচনার সুবিধার্থে উন্নত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত যে সকল দেশে , সে সকল দেশের মডেল নিয়ে ধর্ষণের আলোচনা করেছেন ( পৃষ্ঠা ১৭০ দ্রষ্টব্য ) , কিন্তু যে সকল দেশে প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ চরমভাবে অস্থিতিশীল , আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত নয় সেই সকল দেশে কাঠামো পরিবর্তন জরুরী নাকি আইনের শাসন স্থিতিশীল করা জরুরী , নাকি দুটোই যুগপৎভাবে এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন এবং একত্রে এগিয়ে নেয়ার সম্ভাব্যতা কতটুকু তা বিশদ আলোচনার দাবী রাখে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো , ধর্ষণের দুইটি প্রকারভেদ , আইনের সংজ্ঞায় ধর্ষণ ( স্ট্যাটিউটরি রেপ ) এবং ধর্ষণের উপাদান সংবলিত ধর্ষণের যুক্তিযুক্ততা নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে । যেমন , আমাদের দেশে ১৬ ( ষোল ) বছরের নিচের কোন নারীর
( স্ত্রী ব্যতিত ) সাথে তার সম্পূর্ণ সম্মতিতে যৌন সঙ্গম করাকেও ধর্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যা স্ট্যাটিউটরি রেপ নামে পরিচিত । এমন ক্ষেত্রে ধর্ষণের কোন উপাদান না থাকা সত্ত্বেও তাকে ধর্ষণ হিসেবে আইনী স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টির নৃবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি হতে পারে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন । সবশেষে , ধর্ষণ মামলার পরে ধর্ষিতা নারী স্বেচ্ছায় ধর্ষককে বিয়ে করে আপোষে আসার বিষয়টি ( যদিও ধর্ষণ আপোষযোগ্য অপরাধ নয় ) ধর্ষণ সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনাকেই একটি গোলকধাধায় ফেলে দেয় । সবশেষে বলা যায় ,‘ধর্ষণের তত্ত্ব তালাশঃ পুরুষতন্ত্র বনাম নারীবাদ ’ বইটি শুধু ধর্ষণের সামগ্রিক তত্ত্বের আলোচনাই করেনি , একইসাথে নতুন নতুন হাজারো প্রশ্নের এবং চিন্তার খোরাক এনে দেয় , যা সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যৎ গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে ।