বই রিভিউঃ নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়

বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী মার্শাল শাহলিন্স শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘নৃবিজ্ঞান বিষয়টি বেশ আলাদা। একজন পদার্থবিজ্ঞানী যদি একটি টেবিল নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন, তাহলে তিনি ঐ টেবিলটির গঠনপ্রণালী নিয়ে যত জানবেন ততোই এটি তার কাছে আরো অপরিচিত ঠেকবে। এতোক্ষণ যেটা ছিল স্রেফ একটা টেবিল, পদার্থবিজ্ঞানের অনুসন্ধানের পর এটি এখন অনেকগুলো অনুর সমষ্টি। সেই অনুগুলোর মধ্যে আবার শূন্যস্থান বিদ্যমান। আবার কেউ যদি কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স জানেন, তাহলে তার কাছে এই টেবিলের অস্তিত্ব পুরো নতুন একটা মাত্রা পাবে, আরো বেশি নতুন ঠেকবে। অন্যদিকে নৃবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয় উলটো। একজন নৃবিজ্ঞানী একটি নতুন সমাজ বা সংস্কৃতি নিয়ে যত জানতে শুরু করেন, এটি ততোই তার কাছে অধিক পরিচিত ঠেকে।’ অর্থাৎ নৃবিজ্ঞানের একটি কাজ হলো যা আপাতদৃষ্টিতে অপরিচিত বা নতুন, তাকে আরো পরিচিত ও নিকটবর্তী করে তোলা। মার্সাল শাহলিন্সের এই বক্তৃতায় আরো জানা যায়, শাহলিন্স যখন শিক্ষার্থী হিসেবে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের ১০১ ক্লাস করতে যান, তখন সেখানে মোট শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৩৫ জন। এর নয় বছর পরে তিনি যখন মিশিগানে শিক্ষক হিসেবে ১০১-এর কোর্স নেন, সেখানে শিক্ষার্থী ছিল ৪০০ জন!

মিশিগানের মতো বাংলাদেশেও নৃবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী মানুষদের সংখ্যা বাড়ছে। এর সাথে সাথে বাড়ছে নৃবিজ্ঞান বিষয়ক লেখাপত্রের সংখ্যাও। এরমধ্যে মাহফুজ সরকার ও শাহারিয়ার জিমের ‘নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়’ বইটির কথা উল্লেখ করতেই হয়। বইটি বাংলাদেশের আগ্রহী পাঠকদের মধ্যে নৃবিজ্ঞানের প্রায় অপরিচিত বিষয়গুলোকে পরিচিত করে তুলছে।

কিছু কিছু বই আছে যেগুলো পড়লে পাঠকের চোখের সামনে একগুচ্ছ দরজা-জানালা খুলে যায়। আমি যখন ছোটবেলায় আরব্য-রজনী পড়েছিলাম তখন আমার চোখের সামনে সমগ্র আরব ভূখন্ড তার দরজা খুলে দিয়েছিল । তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ যে একবার পড়বে, সে একবার হলেও তার শরীরে রাশিয়ার বিখ্যাত শীতের পরশ পাবে । প্রত্যেকটা শাস্ত্রেও এমনকিছু বই থাকে, যেগুলো ঐ শাস্ত্রের জানালাগুলো খুলে দেয় পাঠকের সামনে। ২০১৯ সালে আমি যখন নৃবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি, তখন আমার সামনে সে রকম একটি বই ছিল ইংরেজিতে লেখা কোটাকের ‘Introduction to Anthropology’ ।  নৃবিজ্ঞান নিয়ে ইংরেজিতে বহু লেখালেখি থাকলেও বাংলা ভাষায় এখনো অপ্রতুল। এরমধ্যে শিক্ষার্থীবান্ধব, সহজ ও সাবলীল ভাষায় লেখা বইয়ের সংখ্যা আরো কম। সবসময় কোটাকের মতো বাংলায়ও একটি বইয়ের অভাব অনুভূত হয়েছে। তবে, ‘নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়’ বইটি এই অভাব পূরণ করতে পেরেছে। শুধুমাত্র আগ্রহী পাঠক না, নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কাজেও বইটি খুবই প্রয়োজনীয়।

বইটিতে প্রত্যেক অধ্যায়ের শুরুতে অলঙ্করণ করা হয়েছে

বইটি মোট ১৩ টি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলো হলঃ ‘নৃবিজ্ঞান’,’ সংস্কৃতি’, ‘নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব’, ‘গবেষণা প্রণালী’, ‘ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান’, ‘অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান’, ‘জ্ঞাতিসম্পর্ক’, ‘বিবাহ এবং পরিবার’, ‘সেক্স এন্ড জেন্ডার’, ‘রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস’, ‘শিল্পের নৃবিজ্ঞান’ আর ‘বিশ্বায়ন’। অধ্যায়গুলো দেখেই বুঝা যায় যে এই বইটি ক্লাসিক্যাল ‘ইন্ট্রোডাকশন টু’ ধারারই একটি অংশ। নৃবিজ্ঞানের একদম মৌলিক যেসব আলোচনা বিষয়, যেমন সংস্কৃতি, জ্ঞাতিসম্পর্ক, ধর্ম, রাজনীতি কিংবা অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোর প্রাথমিক ধারণা অর্জন করার জন্য বইটি খুবই কাজের। একইসাথে এই বইটি শুধুমাত্র প্রাথমিক ধারণাগুলো অর্জনের জন্যই নয়, আরো গভীরভাবে কোন একটি ইস্যুকে বুঝার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশ্নও ছুড়ে দিয়েছে। বইটির শেষে এর সমৃদ্ধ গ্রন্থপঞ্জিও শাস্ত্রটিকে আরো গভীরভাবে জানার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা যোগাবে। 

আমার ব্যক্তিগতভাবে এই বইয়ের যে কয়টি বিষয় ভালো লেগেছে সেগুলো একটু বলে নেই। প্রথমত এই বইয়ের একটা চমকপ্রদ বিষয় হলো এর প্রথম অধ্যায়টি, যেটি নৃবিজ্ঞানের বিকাশের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। এর মধ্য দিয়ে যে কেউ প্রথমেই নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের প্রসঙ্গগুলো জানতে পারবে। বেশিরভাগ শাস্ত্রের মতো নৃবিজ্ঞানও ইউরোপীয় আলোকায়নের ফসল, এবং তার সাথে উপনিবেশবাদের সম্পর্কও বেশ জটিল। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে নৃবিজ্ঞান পাঠ করাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই, নৃবিজ্ঞানের সাথে আধুনিকতাবাদ, উপনিবেশবাদ আর আলোকায়নের সম্পর্ক বুঝার জন্য এই অধ্যায়টি খুবই কার্যকরী। আরেকটি অধ্যায়, যেটি বিশেষ করে চোখে পড়েছে সেটি হলো ‘শিল্পের নৃবিজ্ঞান।’ মানুষের শিল্পচর্চা ও শিল্পবোধের নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ইদানীং বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়েছে। নৃবিজ্ঞানীরা অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন সমাজগুলোর মানুষের শিল্পচর্চার কুলুজি সন্ধানে জোর দিচ্ছেন। এই সুখপাঠ্য অধ্যায়টি সে বিষয়গুলোই তুলে এনেছে। একইসাথে শিল্প কিভাবে একটি জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ও সামাজিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, সেটিও এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। নৃবিজ্ঞানের যেকোনো পরিচয়ভিত্তিক বইয়ের ক্ষেত্রে এই অধ্যায়টি আমার কাছে সবসময় পছন্দের হিসেবে বিবেচিত হবে। 

বাংলা ভাষায় নৃবিজ্ঞান চর্চাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করা যে অল্প কয়টি বই আছে, মাহফুজ সরকার ও শাহারিয়ার জিমের ‘নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়’ তার মধ্যেই অবশ্যই বিশেষ হিসেবে বিবেচিত। এটি প্রকাশের পরপরই তার জায়গা সুনিশ্চিত করে নিয়েছে। আমি আশা করি, এই ধরণের শিক্ষার্থীবান্ধব ও পাঠকবান্ধব বইগুলো আরো বেশি বেশি প্রকাশিত হবে। কেননা, একটি শাস্ত্রকে সাধারণের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিতে, এর ধারণাগুলোর বিস্তার ঘটাতে এইধরনের  বইগুলোই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। 

বইঃ নৃবিজ্ঞান পাঠপরিচয়

লেখকঃ মাহফুজ সরকার, শাহারিয়ার জিম

প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ হাসান আত্তার

প্রকাশকঃ সংবেদ

রকমারি লিংক