জাতীয়তাবাদের প্রাইমর্ডিয়াল ধারণাঃ জন্ম থেকে জাতিপ্রেম
[জাতীয়তাবাদের প্রাইমর্ডিয়াল ধারণা নিয়ে লিখেছেন সিদরাতুল মুনতাহা]
জাতীয়তাবাদ বর্তমান পৃথিবীর মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতীয়তাবাদকে ঘিরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চলছে যুদ্ধ-বিগ্রহ। আবার এই জাতীয়তাবাদকে ঘিরেই মানুষে মানুষে গড়ে উঠছে একাত্বতাবোধ। তাত্ত্বিক জায়গা থেকে মানুষের মাঝে জাতীয়তাবাদের বিকাশ নিয়ে রয়েছে মতভেদ। তার মধ্যে বহুল আলোচিত একটি তাত্ত্বিক ঘরানা হলো প্রাইমর্ডিয়ালিজম।
প্রাইমর্ডিয়ালিজম (Primordialism) একটি আমব্রেলা টার্ম। যখন একটি টার্ম কোন নির্দিষ্ট এবং একক বিষয়কে নির্দেশ না করে একই ঘরানার বিষয়ভিত্তিক ধারণা একত্রিত করে বৃহৎ আকারে প্রকাশ করে তখন সেই টার্মকে আমরা বলি আমব্রেলা টার্ম। প্রাইমর্ডিয়ালিজম কথাটি দ্বারা এমন একটি বিশ্বাসকে বোঝানো হয় যাতে জাতীয়তাবাদের ধারণাকেও মানুষের ভাষা, দৃষ্টিশক্তি ও অন্যান্য জৈবিক সহজাত বৈশিষ্ট্যের মতো করে মানুষের জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি বা প্রাকৃতিক অংশ হিসেবে ধরা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি মতে বিশ্বাস করা হয়, জাতীয়তাবাদের ধারণা আদিম যুগ থেকেই মানুষের চিন্তায় বিরাজমান।
‘Primordialism’ শব্দটি এসেছে এর বিশেষণ রূপ ‘Primordial’ থেকে । অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী ‘Primordial’ এর অর্থ হচ্ছে সময়ের শুরুর সাথে সম্পর্কিত বিষয়, আদ্য অথবা আদি, বর্তমান সময় হতে অনেক দূরে, যা মূলত কোন কিছুর শুরুকে গঠন করে বা যা থেকে কোন কিছুর উদ্ভব ঘটে, যার উপর কোন কিছু নির্ভর করে, যেটি মৌলিক এবং বস্তুগত।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে এডওয়ার্ড শিলস সর্বপ্রথম প্রাইমর্ডিয়ালিজম টার্মটি ব্যবহার করেন। তিনি দাবী করেন, পরিবারের সদস্যরা একে অপরের সাথে কেবল সংস্কৃতি নির্মিত পারিবারিক বন্ধনেই আবদ্ধ নয়, বরং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে রক্তের বন্ধন, যা জন্ম থেকেই তাদের মধ্যে প্রদত্ত (Given)। জাতীয়বাদের প্রাইমর্ডিয়াল ধারণাটিও ঠিক তাই। এতে বিশ্বাস করা হয়, জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে তৈরী করা হয় না, বরং জন্ম থেকেই এই ধারণা মানুষের মধ্যে নিহিত থাকে; কেউ জন্মানোর পর বাংলাদেশী বা ভারতীয় হয়ে উঠে না, জন্ম থেকেই সে বাংলাদেশ, ভারত, কিংবা তার জন্মভূমির জাতীয়তাবাদ ধারণ করে। অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদকে মনে করা হয় মানবজীবনের একটি জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তাত্ত্বিক ধারণা মতে, প্রাইমর্ডিয়ালিজমকে কোন একক ক্যাটাগরিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটাকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন ধারণার মাধ্যমে বোঝা যায় –
- The Nationalist Thesis Approach
- Sociobiological Approach
- Culturalist Approach
- Perennialist Approach
প্রাইমর্ডিয়ালিজমের ধারণা দিয়ে জাতীয়তাবাদ বুঝতে এখন আমরা এই চার ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করবো।
The Nationalist Thesis Approach
এই ধারণা মতে, জাতীয়তা হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর্নেস্ট গেলনার বলেন, “একজন মানুষের যেমন একটি নাক ও দুটি কান আছে, একইভাবে অবশ্যই তার একটি জাতীয়তা আছে।” জাতীয়তাবাদীদের মতে, মানবজাতি তখনি পরিপূর্ণতা পায় যখন তারা কোন জাতীয় গোষ্ঠীর ভিতরে থাকে।
জাতীয়তাবাদীরা একটি জাতির প্রাচীনত্বের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তার ধারণা ব্যাখা করে। কিছু উদাহরণ দিয়ে এই বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি –
- তুর্কি ইতিহাসবিদ টেকিন আল্প, তুর্কি জাতির ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখান, তুর্কি ইতিহাস ওসমানীয়দের সময়কাল থেকে শুরু হয়নি, বরং যিশুখ্রিস্টের ১২ হাজার বছর পূর্বে তা শুরু হয়েছে।
- সেনেগালের ইতিহাসবিদ চেখ আন্তা দিওপ বলেন, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ বিশেষ করে ইউরেশিয়ার মানুষ যখন যাযাবর জীবন কাটাচ্ছিল, তখন সর্বপ্রথম ইথিওপিয়ানরা এবং পরবর্তীতে মিশরীয়রা সভ্যতার সমস্ত উপাদানগুলোকে সৃষ্টি করে এবং সেগুলোর উন্নতি সাধন করে। মিশরীয় যুগের সাহায্য ছাড়া সমগ্র পৃথিবী কে বিশেষ করে হেলেনিক যুগ’কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল।
- পাকিস্তানি জাতীয় আন্দোলনের প্রবক্তা চৌধুরী রহমত আলী দাবি করেন, পাকিস্তান প্রাচ্যের সবচেয়ে প্রাচীন দেশগুলোর একটি। এটিকে প্রাচীনত্বের দিক থেকে ইরাক এবং মিসরের সাথে তুলনা করা হয়, যেখান থেকে মূলত সভ্যতার শুরু।
এসকল আলোচনা হতে দেখা যায় যে, জাতীয়তাবাদীরা তাদের চিন্তাগুলোকে তুলে ধরার জন্য একই রকম ভাষা এবং রেফারেন্স ব্যবহার করেন। ফলে তাদের চিন্তাগুলো স্থির থাকে এবং যৌথ বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে। এভাবে একটি জাতির চিন্তাধারা সেই পুরো জাতিকে একক সত্তা হিসেবে তুলে ধরে। ফলে সেই জাতির কোন একক সদস্যের জীবনের থেকে পুরো জাতিটিক সামগ্রিক টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আর এর ফলেই, কোন জাতির সদস্যরা জাতীয়তাবাদ ও জাতি রক্ষার দোহাই দিয়ে নিজ নিজ জীবন বাজি রাখতে প্রবৃত্ত হয়।
The Sociobiological Approach
জাতীয়তাবাদ অধ্যায়নে এই দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে স্পষ্টভাষী প্রবক্তা হচ্ছেন পিয়েরে ভ্যান ডেন বার্ঘ। তিনি Sociobiological Theory of Ethnicity, Race and Nationalism গ্রন্থে দেখান যে, বিভিন্ন সমাজে প্রত্যেক গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার্থে যে উদ্দেশ্যগুলো থাকে সেগুলো সামাজিকভাবে নির্মিত এবং পরিবর্তনীয়। এমনকি সেই গোষ্ঠীগুলোও পরিবর্তনীয় এবং সামাজিকভাবে নির্মিত। Sociobiology-এর দৃষ্টি মতে গোষ্ঠীগুলোকে আবার একই গোত্র দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় এবং এগুলোর ভিতরে অন্তর্বিবাহ পদ্ধতিও বিদ্যমান থাকে। Sociobiology-এর একটি মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে পশুরা কেন সামাজিক এবং কেন তারা একে অপরকে সহায়তা (Co-operate) করে? পিয়েরে বার্ঘ বলেন, পশুরা একে অপরকে সহায়তা করে কারণ তা পশুদের পরস্পরের জন্য লাভজনক। তিনি আরও বলেন, পশুরা আত্মীয়তা নির্বাচন (kin selection) এর মাধ্যমে নিজেদের জিনগত বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখে। এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই আত্মীয়তা নির্বাচন প্রক্রিয়াটি কি?!
পশুরা পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে সরাসরি তাদের জিনের ডুপ্লিকেট করতে পারে। আবার প্রত্যক্ষভাবে তার আত্মীয়দের সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ জিন শেয়ার করেও পুনরুৎপাদন করতে পারে। এভাবে পশুরা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতামূলক আচরণ করে এবং ফিটনেসকে ধরে রাখে এটা বোঝানোর জন্য যে জিনগতভাবে তারা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। এটাই মূলত আত্মীয়তা নির্বাচন বা kin selection প্রক্রিয়া। বার্ঘ দাবি করেন যে kin selection অথবা আত্মীয়দের সাথে জৈবিক সম্পর্ক মানবজাতির সামাজিকতার একটি শক্তিশালী দিক। কারণ এরই মধ্য দিয়ে জ্ঞাতিসম্পর্ক অর্থাৎ kinship গঠিত হয়। Ethnicity এবং Race মূলত Kinship-এরই উপভাষা। আর এই দুটি বিষয় মানুষের আবেগের সাথে জড়িত। এর মধ্য দিয়েই গোত্রের vertical বন্ধন (যেমন ভাই-বোন) এবং বিবাহের মত horizontal বন্ধনতৈরী হয় । জ্ঞাতিসম্পর্কের কিছু ছোট ছোট ইউনিট থাকে যাতে জ্ঞাতিত্ত্বের মতো আবেগ-গুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং যা থেকে পরবর্তীতে Nationalism, Tribalism, Racism, Ethnocentrism এর মতো ধারণাগুলো বিকাশ লাভ করে।
বার্ঘ এর মতে, এই বৃহৎ পর্যায়ে জ্ঞাতি (Kin) শনাক্তকরণে জৈবিক নির্ণয়কের চেয়ে সাংস্কৃতিক নির্ণয়কগুলোই বেশি লক্ষনীয়। যেমন –ভাষা, সাজসজ্জা, পছন্দ-অপছন্দ (Mutual interest) ইত্যাদি। তবে এক্ষেত্রে ভাষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আবার জৈবিক দিক দিয়েও মানুষ তার kin শনাক্ত করতে পারে। যেমন – গায়ের রং, চুল ও চোখের রং, দৈহিক গঠন ইত্যাদি। তবে জ্ঞাতি শনাকতকরণে আরো দুটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। Reciprocity এবং Coercion। Reciprocity হচ্ছে পারস্পরিক লাভ যেখানে উপকারের বিনিময়ে উপকার প্রত্যাশা করা হয়; আর Coercion হচ্ছে এককেন্দ্রিক লাভ। আর এই তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রত্যেক সমাজে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে Kin selection করা হয়ে থাকে, যেখান থেকে পরবরতীতে জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদের মতো ধারণা।
Culturalist Approach
এডওইয়ার্ড শীলস এবং ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের কাজগুলো culturalist approach এর সাথে সম্পৃক্ত। তাদের লেখা The Poverty of Primordialism পর্যালোচনা করে ইলার এবং কঘলান দেখেন যে, প্রাইমর্ডিয়ালিজম ধারণাটির ভেতর তিন ধারার চিন্তা পরিলক্ষিত হয় –
- প্রথম ধারাটি প্রাইমর্ডিয়াল পরিচয় বা সংযুক্তি প্রদত্ত বিষয়ক। এই চিন্তাধারা মতে প্রাইমর্ডিয়াল সংযুক্তি মানুষের মাঝে প্রকৃতিগতভাবে আগে থেকেই বিদ্যমান, নতুন করে এর উদ্ভব ঘটে না। সকল ধরনের অভিজ্ঞতা এবং মিথস্ক্রিয়ার উর্ধ্বে এটি অবস্থান করে। এটি মূলত সামাজিকতার চেয়ে প্রাকৃতিক, এমনকি আধ্যাত্মিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়। আদিম সংযুক্তির কোন সামাজিক নির্মাণ হয়না। প্রাইমর্ডিয়ালিজমের এই চিন্তাধারার নাম দেওয়া হয় apriority.
- দ্বিতীয় ধারা মতে প্রাইমর্ডিয়াল অনুভূতিগুলো অবর্ণনীয়, সহজে খারিজ করা যায় না, এবং মানুষ সর্বদাই এটি অনুসরণের মধ্যে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি একটি দলের সদস্য হয়, তখন সে ওই দলের সব ধরনের সংযুক্তি অনুভব করে এবং কার্যক্রমগুলো চর্চা করে। প্রাইমর্ডিয়ালজমের অন্তর্ভুক্ত এই চিন্তাধারার নাম দেওয়া হয় ineffability.
- প্রাইমর্ডিয়ালিজম হচ্ছে আবেগ এবং অনুভূতির সাথে সংশ্লইষ্ট। এই অনুভূতি প্রাইমর্ডিয়ালিজমকে শুধুমাত্র একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে রূপ দেয়। প্রাইমর্ডিয়াল পরিচয় মানুষের অন্যান্য পরিচয় (যেমনঃ শ্রেণী, জাতি ইত্যাদি) থেকে ভিন্ন। প্রাইমর্ডিয়ালিজমের অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় এই চিন্তাধারার নাম দেওয়া হয় affectivity.
এই তিনটি ধারণা হতে বোঝা যায় যে, গিয়ার্টজ রক্ত, ভাষা, ধর্ম এবং নির্দিষ্ট সামাজিক আচার বা প্রথার সামঞ্জস্য কে আদি সংযুক্তির অবজেক্ট হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি এটা বলেননি যে এই অবজেক্ট কোন ব্যক্তি কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার চেয়ে আগে থেকেই প্রদত্ত, আদিম বা প্রাচীন। তার মতে, এই হিসাবহীন বা অসংখ্য আরোপিত বন্ধন সংযুক্তিগুলো মূলত সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত। তবে যারা এগুলো বিশ্বাস করে তাদের কাছে সেসব প্রাকৃতিক, বর্ণনাতীত, সহজাত এবং অদম্য। অর্থাৎ, তাদের এই বিশ্বাসকে সহজে ভাঙা যায় না। অন্যদিকে এডওয়ার্ড শীলস বলেন, প্রত্যেক আদিম সংযুক্তির মধ্যে পবিত্রতা বিদ্যমান। তিনি দাবী করেন, এই আরোপিত পবিত্রতা আসে রক্তের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে।
Perennialism
প্যারেনিয়ালিজম কথাটি দিয়ে বোঝানো হয় কোন জাতির ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব ও জাতিগতভাবে বিশ্বাস করা বহুবর্ষ ধরে চলে আসা বৈশিষ্ট্য। Perennialist-রা জাতিকে প্রাকৃতিক বিষয় হিসেবে দেখে না, বরং ঐতিহাসিক রেকর্ডের মধ্য দিয়ে টিকে থাকা স্থায়ী, স্থির এবং মৌলিক উপাদান হিসেবে দেখে।
আর্ডিয়ান হেস্টিং প্যারেনিয়ালিজমকে দুই ভাগে ভাগ করেন। প্রথমটি হচ্ছে Continuous perennialism। এটি মূলত শতশত বছর এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহস্র বছর পেছনে গিয়ে একটি আধুনিক জাতির মূল ভিত্তিকে দেখে। এটি ধারাবাহিকভাবে চলে আসা কিছু সংস্কৃতি ও পরিচয়কে তুলে ধরে যার মাধ্যমে মধ্য যুগ বা আদিম যুগের জাতির সাথে উক্ত জাতির আধুনিক অংশের মিল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ধারণাটি হচ্ছে Recurrent perennialism। এটি দ্বারা জাতিকে মানব সংঘের এমন একটি ক্যাটাগরি হিসেবে দেখা হয় যা ঐতিহাসিকভাবে সর্বত্র বিরাজ করে। কোন জাতির উত্থান-পতন ঘটলেও সেটার একটি সংঘ ও সামষ্টিক পরিচয় হিসেবে পুনরাবৃত্তি ঘটে।
হেস্টিং মূলত একজন Recurrent perennialist। তার মতে মধ্যযুগ হতে জাতির যে ধারণা বিদ্যমান তার পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে। তিনি তার বিশ্লেষণমূলক কাজে Ethnicity-কে সংজ্ঞায়িত করেছেন একই দলের মানুষ হিসেবে যাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং মুখের ভাষা অভিন্ন এবং এই দুইয়ের ভিতর আদান-প্রদান ঘটে। হেস্টিং এর মূল কথা হচ্ছে একটি আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের চাপের প্রভাবে নির্দিষ্ট Ethnicity-এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। যেমন – সকল ইংরেজরা তাদেরকে একক জাতি হিসেবে মনে করে।
প্রাইমর্ডিয়ালিজম ঘরানার এই চার ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে জাতীয়বাদকে বোঝার একটি স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের নির্মাণ হয়। তবে প্রাইমর্ডিয়ালিজমের পর্যাপ্ত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকলেওীটি সমালচনার ঊর্ধ্বে নয়।
- প্রথমত – প্রাইমর্ডিয়ালিজমের সাধারণ ভাষ্য হচ্ছে, এথনিক এবং জাতীয় পরিচয় একটি প্রদত্ত অথবা প্রাকৃতিক বিষয়। এটি এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে যায় এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো অপরিবর্তনীয়, স্থায়ী বা স্থির থাকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এই ধারণাকে অবমাননা করা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, জাতীয়তা এবং পরিচয় ব্যক্তির পছন্দ, সিদ্ধান্তের কৌশল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা এবং বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে এবং এটি পরিবর্তনশীল।
- দ্বিতীয়ত – নতুন পরিচয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষ নতুন ভাষা অর্জন করে, যা জাতির স্থায়ী হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য কে খারিজ করে। আবার, ধর্ম কোন জাতির একত্রিত থাকার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বর্তমানে মানুষের ভিতর ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
- তৃতীয়ত – “উন্নত” জীবনযাত্রার উদ্দেশ্যে মানুষ অভিবাসন করে অন্য দেশে গিয়ে ওই দেশের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে। ফলে জাতির একাগ্রতা ভেঙে যাচ্ছে, যা প্রাইমর্ডিয়াল ধারণার বিপরীত।
জাতীয়তাবাদ বোঝার ক্ষেত্রে প্রাইমর্ডিয়ালিজম এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। তবে এছাড়াও আরো কিছু আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি (Modern theories of Nationalism) রয়েছে যা মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করে। জাতীয়তাবাদের আধুনিক তত্ত্বগুলোর মধ্যে বেনেডিক্ট এন্ডারসনের Imagined Communities গ্রন্থটি বহুল আলোচিত, যার রিভিউ পাবেন এখানে – ইমাজিন্ড কম্যুনিটিজ।
References
- Eller, J. D., & Coughlan, R. M. (1993). The poverty of primordialism: The demystification of ethnic attachments. Ethnic and racial studies, 16(2), 183-202.
- Ozkirimli, U. (2017). Theories of nationalism: A critical introduction. Bloomsbury Publishing.